কচিদা
কচিদা


কলেজে পড়ার সময় বাজার পাড়ার হাঁড়ি পুকুরের চাতালে আমাদের জমিয়ে আড্ডা বসত। খুব ইমারজেন্সি ছাড়া পর পর দুদিন কামাই করলে মেম্বারশিপ কাটা যাবে, এমনটাই ছিল কচিদার ফতোয়া। কামাই অবশ্য সচরাচর কেউ করত না। কচি হলেও ও আমাদের থেকে বছর দশেকের বড় ছিল। বয়সে অনেকটা বড় হওয়ার ফলে ও এমন অনেক কিছু জানত যা আমরা তখনও জেনে উঠতে পারিনি। আড্ডায় তাই অধিকাংশ সময় মূল বক্তা হত কচিদা আর আমরা সব ছিলাম মুগ্ধ শ্রোতা। মানুষটার অসাধারণ মজাদার উদ্ভাবনী শক্তি ছিল। কেবল বয়সে বড় হওয়ার জন্য নয়, বিচিত্র সব চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য কচিদাকে আমরা মনের থেকেই নেতার স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। লেখাপড়া কতদূর করেছে একথা কেউ জিজ্ঞেস করলেই চট্ জলদি উত্তর আসত- TTMP। মানে টেনে টুনে ম্যাট্রিক পাশ। ম্যাট্রিকে ইংরাজি পরীক্ষার দিন হয়েছিল এক মজার ঘটনা। ইংরাজিটা কচিদার চিরকালই নড়বড়ে ছিল। সাহেবদের ভাষা তো, সেরকম রপ্ত করতে পারেনি। দু একটা যা কমন পেয়েছে সেগুলো লেখার পর translation এ হাত দিল। নিজের মত করে লিখছিল, কিন্তু বিধবাতে গিয়ে আটকে গেল। ইংরাজিটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। সামনের বেঞ্চে তপনও তখন translation করছে। তপনের ইংরাজিতে দখল আছে, ভরসা করা যায়। কিন্তু সমস্যা হল গার্ড খুব কড়া। জিজ্ঞেস করা যাবে না, ফিস ফিস করে কথা বললেও ধরে ফেলবে। কায়দা করে দেখতে হবে। দূর থেকে তপনের widow লেখাটা কচিদা পড়ল window। ইংরাজিতে কাঁচা হলেও window মানে যে জানলা সেটা কচিদা জানত। ভুল জিনিস টোকার কোন মানে হয় না। নিজেকেই ভাবতে হবে। অনেক মাথা খাটিয়ে ইংরাজি প্রতিশব্দ পাওয়া গেল। বিধবা মানে হল স্বামীহারা। সুতরাং সঠিক অনুবাদ হবে ‘HUSBAND LOOSER’. ঐ ভয়ানক অনুবাদের পরেও ইংরাজিতে কোন রকমে উৎরে গিয়েছিল। অবশ্য লেখাপড়ায় ওখানেই ইতি।
ঐ সময় আমাদের একটা ভাল গ্রুপ ছিল। পাড়ার নানান কাজে আমাদের ডাক পড়ত। তার মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল শ্মশানে যাওয়া। শ্মশানে যাওয়া লেগেই থাকত। এতে লোকের উপকার হত ঠিকই কিন্তু আমাদের নজর থাকত শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণের দিকে। একমাত্র শ্রাদ্ধেই তখন কিছু না দিয়ে খাওয়া যেত।
খবর এল এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। সময়মত আমাদের টিম হাজির। কচিদার নিদের্শে খাট, ফুল, বাঁশ, দড়ি সব আনা হয়ে গেছে। দু-একজন নিকট আত্মীয় তখনও এসে পৌঁছয়নি তাই বেরোতে একটু দেরী আছে। দেহ চাদরে ঢাকা। বাতের প্রকোপে বৃদ্ধের বাঁ পাটা বেঁকে অনেকটা পিছনদিকে ঘুরে গিয়েছে। শেষ জীবনটা তাই বিছানাতেই কেটেছে। যারাই আসছে তারা অভ্যাসবসে একবার ডান পায়ে আর একবার পাছার কাছে (বাঁ পায়ের উদ্দেশ্যে ) হাত দিয়ে প্রণাম করছে। ব্যাপারটা খানিকক্ষণ লক্ষ করার পর কচিদা খুব বিনয়ের সঙ্গে সকলকে বলল- আপনারা দয়া করে একটু বাইরে যান। আমরা বডিটা খাটে রেখে একটু ফুল টুল দিয়ে নিই তারপর আসবেন। বেশিক্ষণ লাগবে না। সকলে বেরিয়ে গেলে কচিদা দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল। বডিটা খাটে শোয়ানোর পর আমাকে আর স্বরাজকে বলল—একজন বুকের কাছটা চেপে ধর আর একজন দড়ি নিয়ে রেডি থাক, যেখানে বাঁধতে বলব সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে দিবি। কি হতে চলেছে কিছু না বুঝেই আমি বৃদ্ধের কাঁধের কাছটা চেপে ধরলাম আর স্বরাজ দড়ি নিয়ে রেডি। এরপর কচিদা মোচড় খাওয়া পাটা ধরে টান দিয়ে চড়চড় করে খানিকটা সোজা করল। কিন্তু পুরো সোজা হওয়ার আগেই কচিদার হাত ফসকে পাটা সজোরে স্বস্থানে ফিরে এল। সারা শরীর এমনভাবে দুলে উঠল মনে হল যেন দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে। আমরা আঁতকে উঠে সরে এলাম।
কচিদা খেঁকিয়ে উঠল—এত অল্পেতে ঘাবড়ে যাস কেন ? আবার ভাল করে চেপে ধর। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় পা পুরো সোজা হল আর স্বরাজ সাথে সাথে হাঁটুর ওপরে আর খানিকটা নিচে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।
--দ্যাখ, পা এক্কেবারে নর্মাল। লোকে অস্থানে হাত দিয়ে নমস্কার করছে দেখতেও তো খারাপ লাগে। গায়ে চাদরটা টেনে দে আর হাঁটুর কাছে একটা ফুলের রিং রেখে দে, তাহলে কিছু বোঝা যাবে না। পুরো অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর দরজা খুলে দেওয়া হল। দু একজন সবে আসা আত্মীয় ঘরে ঢুকে প্রণামের জন্য অভ্যাস বশে বৃদ্ধের কোমরের দিকে হাত বাড়াতেই কচিদা জিজ্ঞেস করল—কি খুঁজছেন?
---না মানে আর একটা পা ।
--পা পায়ের জায়গাতেই তো আছে। লোকগুলো অবাক হয়ে তাকাতে কচিদা গম্ভীরভাবে জানাল যে শেষদিকে যোগব্যায়াম করেই নাকি এই অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছিল। তাই শুনে এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল—আহা, কাকা পা নিয়ে কি কষ্টটাই না পেয়েছে। আর একটু আগে থেকে যদি ব্যায়ামটা করত!
ঐ কম্মের পর আর ওখানে বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ নয়। যাদের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল তারা সকলেই এসে গেছে। তাই আর দেরী না করে হরি ধ্বনি দিতে দিতে আমরা রওনা হয়ে গেলাম।
ছোটবেলায় বাড়ির লোকের সাথে কোলকাতায় মাঝে সাঝে গিয়েছি বটে, তবে শহরটা চিনেছি কচিদার দৌলতে। উঠতি বয়স, ওইরকম একটা গাইড, সঙ্গে শাসন করার কেউ নেই, ফলে সে ঘোরার মজাই ছিল আলাদা। একদিন মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার সময় এসপ্ল্যানেডে এত গাড়ি যে কিছুতেই রাস্তা পার হওয়া যাচ্ছে না। ষাট পয়সায় লাইন দেব। বেশি দেরী হয়ে গেলে টিকিট পাওয়া যাবে না।
কচিদা বলল---দুজন দুদিক থেকে আমাকে একটু ধরে থাক।
তারপর নিজের হাত আর পা দুটো অদ্ভূত ভাবে বেঁকিয়ে এমন ভাবে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোতে শুরু করল যে দেখলেই দুঃখ হবে। ট্রাফিক পুলিশ দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে এসে প্রতিবন্ধি কচিদাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিল। সাথে আমরাও পার হয়ে গেলাম।
তখন কলেজে পড়ি। এক রবিবার সকালে কচিদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল—আজ তোর কোন কাজ আছে?
আমি বললাম—না তেমন কিছু নেই ।
---তাহলে দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে রেডি হয়ে থাকিস, সাহেব পাড়ার দিকটা একটু ঘুরতে যাব।
---সেটা কোথায় ?
---গেলেই দেখতে পাবি।
বাড়িতে গুল তাপ্পি দিয়ে ম্যানেজ করলাম। তাড়াতাড়িতে পরিষ্কার জামা কাপড় দেখতে না পেয়ে এন সি সি র ড্রেসটাই পরে নিলাম। নিউ মাকের্ট চত্বরটা ঘুরতে ঘুরতে কচিদা বলল—এই এলাকাটাই হল সাহেব পাড়া, বুঝলি।আমি গ্লোব, লাইট হাউস, নিউ এম্পায়ার, ঝাঁ চকচকে দোকানপাট, সব হাঁ করে দেখছি।
---সিনেমা দেখবি ?
বললাম---পকেটে মাত্র তিন টাকা আছে।
---অনেক আছে, টিকিট তো পঁয়ষট্টি পয়সার। চল নিউ এম্পায়ারের বইটা মনে হচ্ছে ভাল। তবে অ্যাডাল্ট বই, তোকে আটকাতে পারে। ঘাবড়াবি না, যা বলার আমি বলব তুই শুধু গম্ভীর হয়ে থাকবি।
লাইন দিয়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে পৌঁছোতেই দারোয়ান আমায় আটকে বলল---বাহর যাও, ইয়ে বচ্চালোগকা দেখনেকা সিনেমা নেহি হ্যায়।
আমি বেশ ভয় পেলেও তা বুঝতে দিইনি।
কচিদা ফুঁসে উঠল--- কৌন বচ্চা হ্যায়। ইউনিফর্ম দেখতা নেহি, হোমগাডর্কা ডিউটি দেকে অভি ফিরা হ্যায়।
দারোয়ানটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আর আমরা ঐ তালে হলে ঢুকে গেলাম। অন্যান্য হলে সস্তার টিকিট কাটলে একেবারে সামনে বসতে হত। নিউ এম্পায়ারের বসার ব্যবস্থা অন্যরকম ছিল। ওখানে পঁয়ষট্টি পয়সার টিকিটের জন্য বরাদ্দ ছিল একেবারে ওপর তলাটা। জীবনের প্রথম ইংরাজি সিনেমা দেখব, তাও আবার অ্যাডাল্ট বই, বেশ থ্রিলিং লাগছিল। সিনেমা শুরু হল। মাঝে মাঝে দু একটা শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝছিলাম না। তবে আমি একা নয়, আমার আশে পাশে সকলেরই একই অবস্থা। সেটা বুঝলাম একটু পরেই। সারা হলের লোক যখন হাসছে আমাদের পঁয়ষট্টি পয়সায় কোন হাসি নেই, আবার পঁয়ষট্টি পয়সার লোকেরা যখন হাসছে হলের বাকি অংশে তেমন হাসি নেই। আসলে ব্যাপারটা হল, হাসির কথোপকথন যখন থাকছে তখন সকলে হাসলেও মানে বুঝতে না পারায় পঁয়ষট্টি হাসছে না। অঙ্গভঙ্গি করে হাসালে তবেই পঁয়ষট্টির লোকেরা হাসছে। তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। মনে একটা উড়ু উড়ু ভাব। বয়সে নাবালক হলেও মন তা মানতে চায় না। নিজের অজান্তেই সেদিন কচিদার হাত ধরে দারোয়ানকে ভড়কি দিয়ে কৈশোরের সীমানা পেরিয়ে সাবালকত্বের দিকে প্রথম পা ফেলেছিলাম।
কচিদার পরিবারে ওর মা ছাড়া আর কাউকে কখনও দেখিনি। চৌধুরী পাড়ায় একটা বাড়িতে মায়ে ব্যাটায় থাকত। চাকরি বাকরি না পেলেও কচিদা কখনো বসে থাকেনি। সকালে কাগজ বিলি থেকে শুরু করে সারাদিন কিছু না কিছু করে রোজগারের চেষ্টা করত। মাসিমা পেনশন পেতেন। দুয়ে মিলে সংসার চলে যেত। অবস্থা সেরকম ভাল ছিল না, তা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে মাঝে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত। মাসিমা মানুষ যেমন ভাল ছিলেন তেমনই ভাল ছিল তাঁর হাতের রান্না। খাবারগুলোর স্বাদ ভোলার নয়।
কলেজে পড়ার শেষ দিক থেকে আমাদের আড্ডাটা একটু হাল্কা হতে থাকে। কেউ পড়ার জন্য, কেউবা চাকরি পেয়ে এদিক ওদিক চলে যায়। এর মধ্যে কচিদাও বজবজের দিকে কোন একটা কারখানায় চাকরি পায়। কারখানার কোয়ার্টারেই থাকতে হবে। ফলে বাধ্য হয়েই এতদিনের বাস আর সম্পর্কগুলো ছেড়ে চলে যেতে হয়। যাওয়ার আগে বলেছিল—ঘাবড়াস না, রোজ দেখা হবে না ঠিকই তবে ছুটি ছাটা পেলেই চলে আসব। প্রথম কয়েক মাস এক আধবার এসেছিল পরে আর আসেনি। আর আমাদের সাথে এত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কেন জানি না ওর নতুন ঠিকানাটাও আমাদের জানায়নি। এইসব ঘটনা প্রবাহের ফলে রমরমা কমে গেলেও আমাদের আড্ডাটা কিন্তু একেবারে উঠে যায়নি। অন্য দিনগুলোয় সময় না পেলেও ছুটির দিনে সকলে আসার চেষ্টা করতাম। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও প্রথম দিকে ঘুরে ফিরেই কচিদার কথা আলোচনা হত। সময়ের সাথে সাথে আমাদের মনেও কচিদা ক্রমশঃ আবছা হয়ে গেল। বছর কয়েক পর শোভন একদিন আড্ডায় এসে বলল---জানিস, কচিদাকে দেখলাম।
সমস্বরে প্রশ্ন এল—কোথায় ?
---বজবজ লোকালে। কি যেন একটা ফিরি করছিল।
আমি বললাম—তুই ডাকলি না ?
---ডেকেছিলাম। চোখাচুখি হতেই ছিটকে দূরে চলে গিয়ে পরের স্টেশনে নেমে গেল।
---সে কিরে ! এতদিন বাদে দেখা, অ্যাভয়েড করে চলে গেল।
---আমিও তো অবাক হয়ে গেলাম। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন বাদে কোন একটা কাজে তারাতলার দিকে গিয়েছিলাম। দুপুর বারোটার মধ্যে কাজ মিটে গেল। ট্রেনে করে বাড়ি ফিরব বলে মাঝেরহাট স্টেশনের দিকে আসার সময় রাস্তার ধারে একটা বড় জটলার দিকে চোখ পড়ল। হাতে সময় ছিল।
জটলার একটু কাছে যেতে কানে এল---কবিরাজ হরিমাধবের অব্যর্থ দাওয়াই। লাগালেই শেষ। একটু থেমে---খুশকি থেকে
এক্সিমা, দাদ হাজা থেকে পা ফাটা সব ভ্যানিস। চামড়া থেকে জ্যোতি বেরোবে। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি—আবার একটু থেমে...কোন গুপ্ত রোগে আমার এই ওষুধ কাজ করে না। আপনাদের মধ্যে যদি কারো গুপ্ত রোগ থাকে তাহলে দয়া করে চলে যান। দাঁড়িয়ে কোন লাভ হবে না।
এইবার ভিড়ের আসল কারণটা বুঝতে পারলাম। যে একবার ওখানে আসছে সে চট করে যেতে পারছে না। কারণ চলে গেলেই লোকে ভাববে ব্যাটার নিশ্চই গুপ্ত রোগ আছে। গলাটা চেনা চেনা লাগছিল। উঁকি মেরে দেখতেই বুঝতে পারলাম আমার আন্দাজ সঠিক। বক্তাটি কচিদা। এমন বক্তব্য ওর পক্ষেই রাখা সম্ভব। চেহারাটা ভেঙে গেছে। মুখে বেশ কয়েকদিনের না কামান দাড়ি। একধারে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিক্রি বাট্টা শেষ করে ওঠার পর আমার সাথে চোখাচুখি হল। নিজেই আমার কাছে এগিয়ে এল।
---অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস ?
---এই কিছুক্ষণ। তোমার কাণ্ড কারখানা দেখছিলাম। কেমন আছ বল?
---কি আর বলব, দেখতেই তো পাচ্ছিস।
---আমাদের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ রাখ না, কি ব্যাপার। আমাদের কি একেবারেই ভুলে গেলে?
---তোদের কি কখনও ভুলতে পারি রে !
সেদিন আর কোন কাজ ছিল না। বাড়ি ফেরারও তাড়া নেই। বললাম---তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে ? মাসিমাকে কতদিন দেখিনি।
কচিদার মুখটা খুশিতে ভরে গেল।
সত্যিই যাবি ? মা তোদের কথা প্রায়ই বলে। দেখলে খুব খুশি হবে। বজবজগামী একটা ট্রেনে উঠলাম। আক্রা স্টেশনে নেমে কচিদা বলল—স্টেশন থেকে আমার বাড়িটা একটু দূরে। আমি হেটেই যাই, মিনিট কুড়ি লাগে। তবে তোর কষ্ট হবে, চল একটা রিক্সা নিই।
আমি বাধা দিয়ে বললাম---কোন কষ্ট হবে না। চল গল্প করতে করতে হাটি।
---হ্যাঁরে, আমাদের আড্ডাটা এখনও আছে ?
---হ্যাঁ আছে। তবে আগের সে জৌলুস আর নেই। এক এক জন এক এক দিকে ছিটকে গেছে। যারা আছে তাদের মধ্যেও কিছু ঘোর সংসারী। বউ ছাড়ে না। একেবারে ভাঙা হাট। তোমার মত ক্যাপ্টেন যে টিম ছেড়ে চলে গেছে সে টিম কি আর ভাল থাকে?
কচিদার মুখে ম্লান হাসি।
---কচিদা, তুমি তো একটা চাকরি করতে। তা সে চাকরি ছেড়ে রাস্তায় ফিরি করে বেড়াচ্ছ কেন?
---বছর খানেক হল কোম্পানি লাটে উঠে গেছে। বসে থাকলে তো আর কেউ খেতে দেবে না। তাই এসব করা ছাড়া আর উপায় কি বল?
---বিয়ে থা করেছ না এখনও মাসিমাকে খাটাচ্ছ ?
---কারখানায় চাকরিটা পাওয়ার পর মাসে যেই একটা বাঁধা রোজগারের ব্যবস্থা হল অমনি ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য মা ক্ষেপে উঠল। মাকে বললাম যে নিজের বাড়িঘর নেই, রোজগার ভাল নয়, বিয়ে করব না। কিন্তু এমন কান্নাকাটি শুরু করল যে বাধ্য হয়ে মত দিতে হল।
---বাঃ দারুন খবর। তা মেয়ে কোথাকার ?
---কাছাকাছি, সন্তোষপুরের। একেবারে রাজযোটক বুঝলি। আমারও কিছু নেই, ওদেরও কিছু নেই।
---ভাগ্যিস তোমার সাথে দেখা হল। কতদিন বাদে মাসিমার সাথে দেখা হবে, বৌদির সাথে পরিচয় হবে আর তার হাতে কড়া করে এক কাপ চা খাব।
---ঐটি হবে না ভাই। আমার বৌ খুব অলস। সারাদিন কেবল শুয়ে থাকে। গল্প কর, কিন্তু ওর কাছে চা খেতে চাস না। ওটা মা করে দেবে।
---ঠাট্টা করছ !
---গেলেই দেখতে পাবি। নে এসে গেছে। ঐ সামনে আমার বাংলো।
একটা পুরনো নোনাধরা জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেওয়ালের চারিদিকে ফাটা। মাঝে বড় বড় গাছ গজিয়ে গেছে। যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে।
---আমার সিংহ দুয়ারটা একটু ছোট, মাথা নিচু করে আয়। মাথা নিচু কি, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম । বাড়ির ভেতরে সোঁদা গন্ধ, অন্ধকার। পোড়ো বাড়িও এর থেকে ভাল হয়। কচিদা একটা টুল এগিয়ে দিল আমার বসার জন্য।
---মা দেখ কে এসেছে।
ঘরের ভেতর থেকে মাসিমার গলা পেলাম---একটু দাঁড়া আসছি।
প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে চোখটা একটু সেট হতে বুঝলাম ঘরের সামনে একটা সরু দালানে আমি বসে আছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কচিদা টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে ঢুকলাম। একফালি জানলা দিয়ে অল্প আলো আসছে। ঘরের একপাশে একটা চৌকি পাতা। তাতে এক মহিলা শুয়ে আছে আর মাসিমা একটা থালায় ভাত মেখে তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন।
---ভাল আছ বাবা ? থাক থাক আর পায়ে হাত দিতে হবে না, বস বস। অতি পরিচিত সেই স্নেহ মাখা কণ্ঠ।
---হ্যাঁ মাসিমা। কতদিন বাদে দেখা হল।
---শুধু মাসিমার সাথে কথা বললেই হবে, আমার বউ এর সাথে আলাপ করবি না।
ঘরে আর কোন লোক নেই। তাই বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাটির দিকে হাতজোড় করে বললাম---নমস্কার বৌদি। এমন সময় এলাম আপনার শরীর খারাপ। কি হয়েছে?
কচিদা মাঝখানে ঢুকে পড়ল---এতদিন বাদে এলি। শরীর খারাপের ফিরিস্তি শুনে সময় নষ্ট করলে চলবে না। তোকে বললাম না আমার বউ শুয়ে থাকতে ভালবাসে। কতদিন ভাল করে আড্ডা মারা হয়নি। আজ প্রাণ খুলে আড্ডা হবে।
বউমাকে খাওয়ান হয়ে গেলে মাসিমা থালা নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
---মা তাড়াতাড়ি চলে এস। আর তোরও কিন্তু চট করে যাওয়া হবে না। এখনি যেন যাই যাই করিস না।
কাঁপা কাঁপা গলায় মেয়েটি বলল--- আপনাদের কথা আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আলোচনা হয়। এত গল্প শুনেছি যে একবার দেখলেই বলে দিতে পারব যে কে কোন জন।
---বৌদি আমার একটা অভিযোগ আছে। দাদা কিন্তু বিয়েতে আমাদের ফাঁকি দিয়েছে।
---সে তো দাদা ভাইয়ের ব্যাপার। আমি আর কি বলব ভাই।
---আপনার শরীর ভাল হলে সকলে মিলে আমার বাড়িতে আসুন। গল্পে শোনা জিনিসগুলো চোখে একবার পরখ করবেন।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মেয়েটির চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। আমার কোন কথায় কি আঘাত পেল। চুপ করে গেলাম।
আবার কচিদা---কিরে চুপ করে গেলি কেন। তোকে দেখে, তোর সাথে কথা বলে আনন্দে তোর বৌদির চোখে জল এসে গেছে।
পরম স্নেহে বৌ এর চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল---চম্পা, ভাইটা অমন ভাবে বলছে একদিন সময় করে সকলে না হয় ঘুরে আসা যাবে।
ততক্ষণে মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়েছে। ঈশারায় আমাকে কাছে ডেকে বলল---ভাই যেতে তো খুবই মন চায়। আগে বেশ ঘোরাঘুরি করতাম, এখন তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না। যাই কি করে বল ত।
ব্যাপারটা আমার একেবারেই স্বাভাবিক মনে হল না। কচিদার কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি শুনলাম। এর মধ্যে মাসিমা চা আর তেলেভাজা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে কচিদা আর মাসিমার সাথে পুরোনো দিনের গল্পে মেতে গেলাম। স্মৃতির উজান বেয়ে কখন যেন অতীতের সোনালি দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার জন্য যখন উঠলাম তখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
আসার সময় ছলছল চোখে মাসিমা বললেন---আমার বেলা ফুরিয়ে এসেছে বাবা। পারলে মাঝে মাঝে একটু এস, মনটা ভাল লাগে। নমস্কার করে বাড়ির বাইরে এলাম।
---চল তোকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
---আরে না না, তোমাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না।
---পাকামো করিস না, চল।
রাস্তায় আলো অনেকটা দূরে দূরে। ফলে চারপাশটা বেশ অন্ধকার। কচিদা সাথে না এলে একটু অসুবিধেই হত। হাটতে হাটতে অনেকক্ষণ ভেতরে গুলোতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেললাম---কচিদা সত্যি করে বল তো বৌদির কি হয়েছে।
---কি আবার হবে, বললাম না...
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম--- একদম বাজে বকবে না, কি হয়েছে আমায় বল।
আর থাকতে না পেরে প্রকৃত ঘটনাটা বলতে শুরু করল--- বিয়ের পর বছর খানেক ভালই ছিল রে। রান্নাবান্না ঘরের কাজ সবই করত। মাও একটু বিশ্রাম পেয়েছিল। হঠাৎ একদিন জ্বর হল। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ালাম। উপকার যে হল না তা নয়। জ্বরটা কমল। তবে শরীরে কোন জোর নেই। ভাবলাম কড়া অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যাকশন। কিন্তু সময় যত গড়াল শরীরের ক্ষমতা আরো কমে গেল। প্রথম দিকে ধরে ধরে চলাফেরা করত, পরে তাও পারত না। আর এখন তো বিছানাতেই সব। আমার ক্ষমতায় যতটা কুলোয় ডাক্তার দেখিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বুড়িটার দেখভালের জন্য বিয়ে করলাম কিন্তু এমনই কপাল যে বুড়িটাকেই এই বয়সে চম্পার সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। আমি আর কতক্ষণ বাড়িতে থাকি। যাক্ বাদ দে, ওসব এখন সয়ে গেছে। রোগ হয়েছে বলে মন খারাপ করলে হবে। কারো শরীর খারাপ না হলে ডাক্তারদের চলবে কি করে বলত। ওদের দিকটাও তো ভাবতে হবে। এত ঝড় ঝাপ্টা , অনটন, কষ্টের মধ্যেও কি অদম্য প্রাণশক্তি। আমার কাছে হাজার খানেক টাকা ছিল। ওটা কচিদার পকেটে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম--- এটা রাখ। আমি আরো টাকা দিয়ে যাব। বৌদির ভাল করে চিকিৎসা করাও। সারিয়ে তুলতেই হবে। আমার হাতটা চেপে ধরে বলল---ঠিক বলছিস ভাই! চম্পা ভাল হয়ে যাবে?
---সবাই মিলে দেখিনা একটু চেষ্টা করে।
কচিদার চোখে জল। হয়ত ঘোর অন্ধকারে ক্ষীণ আলোক শিখা দেখতে পাওয়ার আনন্দে।
ট্রেনে ওঠার সময় জড়িয়ে ধরে বলল---আবার আসিস ভাই। আসতে তো আমাকে হবেই। জীবনের চরম দুঃখ-দুর্দশা অবিশ্বাস্য ক্ষমতায় হাসি ঠাট্টা মস্করা করে উড়িয়ে দিয়ে যে মানুষ সকলকে আনন্দে রাখে তার আনন্দ এভাবে নিঃশেষ হতে দেওয়া যায় না।