Debdutta Banerjee

Abstract

3  

Debdutta Banerjee

Abstract

কবরস্থানে কোন আলো

কবরস্থানে কোন আলো

7 mins
1.1K


রুবাইয়ের এবার নতুন ঘর হয়েছে দোতলায়। ও এখন একটু বড় হয়েছে বলে একা একা দোতলার ঘরে থাকার অনুমতি পেয়েছে। আর তাই বন্ধুদের মধ‍্যে ওর একটু খাতির বেড়েছে। ওদের বাড়িটা লোকালয়ের শেষ প্রান্তে।  ওর  নতুন ঘরের জানালা দিয়ে আবার চার্চের পেছনের পুরানো কবর খানার একটা অংশ দেখা যায়। যদিও ঐ জানালাটা সব সময় মা বন্ধ রাখতে বলেছে, কারন ওদিক দিয়ে খুব বৃষ্টির ছাট আসে। তবে কাচের জানালা দিয়ে চার্চের লম্বা টাওয়ারের মাথায় ঘন্টা আর পেছনের কবরখানা পরিস্কার দেখা যায়।

রুবাই অবশ‍্য বেশ সাহসী, ভূতের ভয় ওর কোনোদিন ছিল না। আর পর পর বেশ কয়েকটা রহস‍্য উদঘাটন করে ও তো এখন বন্ধুদের হিরো। পাড়ার বড়রাও ওকে বেশ সমিহ করে। 

তাই সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে ও যখন কবর খানায় একটা আলোকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল ও একটুও ভয় পায়নি। ভাবছিল কথাটা কাকে বলবে। প্রায় দশ মিনিট সেদিন আলোটাকে ঘুরতে দেখেছে ও। অনেকটা মোবাইলের আলোর মত। অন্বয়দা ওদের গেমটিচার, পাড়ার ক্লাবে অন্বয়দার কাছেই ওরা ক‍্যারাটে শেখে। অন্বয়দাকেই একমাত্র বলা যায় ঐ আলোর কথা। কিন্তু অন্বয়দা কয়েকদিনের জন‍্য কলকাতা গেছিল। 

শনিবার বিকেলে আকাশের সাথে রুবাই চার্চের মাঠে বল খেলতে গেছিল। বলটা হঠাৎ কবরখানার দিকে গড়িয়ে যেতেই রুবাইয়ের আলোর কথাটা মাথায় এসেছিল। অবাক হয়ে ও ওদিকে তাকিয়েছিল। রোহণ ওকে বলটা আনতে বলতেই সম্বিত ফিরে পেল ও, বলটা নিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু মন পড়েছিল ঐ কবরখানায়। খেলা শেষ করে ও রোহণকে নিয়ে এগিয়ে গেছিল ওদিক পানে। রোহণকে এজন‍্য একটা মিথ‍্যা বলেছিল ও যে একটা বড় রঙিন পাখি ওখানে দেখেছে ও। রোহণের পাখির উপর দুর্বলতা রয়েছে। কয়েকদিন আগে রুবাইয়ের মা ওকে বুঝিয়ে বলেছিল কোনো ভালো কাজের প্রয়োজনে মিথ‍্যা বললে কিছু হয় না। 

দুরুদুরু বুকে কবরখানার মাঝে যখন ওরা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পশ্চিম আকাশ লালে লাল। কবরস্থানের ওধারে রয়েছে সবুজ চা বাগান। বর্ষাকালে কচি পাতায় সেজে উঠেছে চা বাগান গুলো। কিন্তু এবার পাতা তোলা এখনো শুরু হয় নি। একটা গন্ডগোল চলছে বাগানে তাই কাজ বন্ধ। একটু ঘোরাঘুরি করেই জায়গাটা আন্দাজ করে রুবাই একটা বড় কবরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বহু পুরানো কবর এটা। তবে বড় শ্বেত পাথরের কবর। কালো পাথরের ফলকে  নামের নিচে সাল লেখা ১৯৭৪, কবরের উপরের বড় ক্রশটা ওর ঘর থেকে দেখা যায়। কবরটার চারপাশ বাধানো, সেখানে বেশ কিছু জুতোর দাগ শুকিয়ে আছে। কবরের উপরের স্ল‍্যাবটা কি একটু বেরিয়ে আছে ? একটা পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠতেই রোহণ ওকে বলে বাড়ি ফেরার কথা। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলেই আবার চিতা বাঘ আর হাতির আনাগোনা শুরু হয় চা বাগানে। বাধ‍্য হয়ে বাড়ির পথ ধরে ওরা দু জন।

 

রুবাইদের ছোট্ট টাউন মালবাজারে ছোট কোনো ঘটনা ঘটলেই তা লোকের মুখে মুখে প্রচার হয়ে যায়। চা ব‍্যবসায়ী অর্চিস্মান রায়ের নিখোঁজ হওয়ার গল্প পেপার টিভি সবেতেই দেখাচ্ছিল। অর্চিস্মান রায় উত্তরবঙ্গের এক সফল চা ব‍্যবসায়ী। মোট সাতটা বাগান নিয়ে ওনার চা কোম্পানী ডুয়ার্স ভ‍্যালি। মালবাজারে ঢোকার সময় যেখানে রাস্তাটা কাস্তের মত বেঁকে রেল ব্রিজের নিচ দিয়ে এসেছে সেখানে ওনাদের একটা ছোট্ট টি কাউন্টার হয়েছে। ঐ জায়গাটায় টিলার উপর থেকে পুরো ডুয়ার্সের একটা সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। টুরিষ্ট গাড়ি গুলো ওখানে দাঁড়িয়ে যায়, চা জলখাবার ছাড়াও বাগানের ফ্রেশ টি এরপ‍্যাকেট বিক্রি হয় ওখানে। নানারকম ফ্লেবাবের চায়ের ভেতর ওদের গ্ৰীনটিয়ের ভালো ডিমান্ড রয়েছে। রুবাইও মাঝে মাঝে বাবা মায়ের সাথে যায় ওখানে চা আর স্ন‍্যাক্স খেতে। রুবাই অবশ‍্য হট চকলেট খায়, ভালো হোম মেড কুকিজ পাওয়া যায় ঐ স্টলে। বেশ কিছু লোকাল মহিলাকে কাজ দিয়েছেন ভদ্রলোক। ওনার বাংলোটাও ঐ শুখা ঝোড়ার পাশে বড় টিলাটার ওপর। বেশ পুরানো কাঠের দোতলা বাংলো।

হঠাৎ করে দু দিন ধরে অর্চিস্মান রায়কে পাওয়া যাচ্ছে না, এটাই এখন ডুয়ার্সের সব চেয়ে বড় খবর। ভদ্রলোক বিপত্নীক, ওনার ছেলে মেয়েও নেই। নিকট আত্মীয় বলতে এক ভাইঝি, সে হোস্টেলে থেকে পড়ে কার্শিয়াং এ। ভদ্রলোকের গাড়িটা শুখাঝোড়ার কাছে পরিত‍্যক্ত পড়েছিল। উনি নিজেই চালিয়ে ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। 

রুবাই দুদিন ধরে সব কাগজ খুটিয়ে পড়েছে। টিভির খবর দেখেছে। চা মাফিয়াদের কাজ মনে হচ্ছে সবার। ওরা কিছুদিন থেকেই বড় একটা টাকা দাবী করছিল ওনার কাছে। প্রাণে মেরে দেবে বলে ভয় ও দেখাচ্ছিল ওনাকে। যদিও ওনাদের বাগানে তেমন ইউনিয়ানবাজি ছিল না। মিঃ রায় স্টাফদের প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিতেন। সবার সুখ দুঃখে পাশে থাকতেন। আশেপাশের বাগান গুলো যখন মুখ থুবরে পড়ছে ওনার বাগানে বছরে দুবার বোনাস হত। এলাকার স্কুল কলেজকেও সাহায‍্য করতেন ভদ্রলোক। পুলিশ প্রচুর খুঁজছিল, কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। চা মাফিয়াদের হাত প্রচুর লম্বা।

 

সেদিন রাতে বেশ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। শুতে এসে রুবাইয়ের চোখ চলে গেছিল ঐ কবরস্থানের দিকে, বিদ‍্যুতের ঝলকানিতে কবরখানাটা হঠাৎ দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে উঠেছিল।  ওর যেন মনে হল একটা গাড়িকে ঐ চা বাগানের দিকে যেতে দেখল ও। রুবাই অনেক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আলোর খেলা আজকেও চলেছিল বেশ কিছুক্ষণ। তবে পরিস্কার কিছুই দেখা যায়নি। কাল অন্বয়দা ফিরলেই আলোর খবরটা দিয়ে রাখতে হবে। নিশ্চই কোনো অসামাজিক কাজ হচ্ছে ঐ অঞ্চলে। কবরের হাড়গোড় তুলে বেঁচে দিচ্ছে না তো কেউ? এসব তো হয় শুনেছে অনেক জায়গায়।

রুবাই শুয়ে শুয়ে সাত পাঁচ ভাবতে থাকে। এভাবেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। ঝকঝকে রোদ উঠেছে, বৃষ্টিতে সব নোংরা ধুলো ধুয়ে গিয়ে চারপাশ পরিস্কার। অন্বয়দা আজ জয়েন করবে স্কুলে।

স্কুল থেকে ফেরার পথে অন্বয়দাকে ও আলোর ব‍্যপারটা খুলে বলেছিল। অন্বয়দা চিন্তিত হয়ে ওকে বলল-'' অতবড় কবরস্থানে আলোটা ঠিক কোথায় দেখেছিলি মনে আছে? দেখানে পারবি?''

-''মোটামুটি বলতে পারবো। আমি গেছিলাম ওখানে। তবে একদম শিওর না হয়তো.....''

-''আলোটা এক জায়গায় জ্বলে ছিল, নাকি ঘুরছিল?'

-''ঘুরছিল, অন অফ হচ্ছিল। দশ মিনিট মত ছিলো।''

অন্বয়দা বিকেলে ওকে বাইকে করে নিয়ে গেছিল কবরখানায়। আজ আর গাটা ছমছম করছিল না ওর। ওদের ক্লাসের আন্ড্রু আর এরিক আসে রোববার করে ফুল নিয়ে এখানে। প্রিয়জনের আত্মার শান্তি কামনা করে সবাই। ওরা বলে এটা পবিত্র জায়গা। ওরা যখন ভয় পায় না তখন রুবাই পাবে কেনো? ও পায়ে পায়ে বড় শ্বেত পাথরের কবরটার কাছে এগিয়ে যায়। এটা এই চার্চের পুরানো ফাদারের কবর ও জেনেছে এরিকের থেকে। পাশেরটা কোনো বাচ্চার। ওধারে একটা বড় সাদা কবর, এই জায়গাটা ওর জানালা দিয়ে চোখে পড়ে। এখানেই শেষ দুদিন আলোটাকে ঘুরতে দেখেছিল ও। গাড়িটাকে ওধারে চা বাগানে দেখেছিল কাল। অন্বয়দা আশেপাশে ভালো করে দেখছিল। বৃষ্টিতে পায়ের ছাপ ধুয়ে গেছে। তবে বড় কবরটার স্ল‍্যাবটা আজ খাপে খাপে বসানো। দূর থেকে পিটার ওদের দিকে এগিয়ে আসে। পিটার এই কবরখানা দেখাশোনা করে। যদিও সবাই জানে রাতে ও নেশা করে চার্চের পিছনে পড়ে থাকে। তখন হাজার ডাকলেও ওকে পাওয়া যাবে না।

অন্বয়দা পিটার কে দেখে বলে -''কি খবর পিটার ? পাহারা কেমন চলছে?''

-''বড়িয়া দাদা, কিছু খুঁজছেন এখানে?'' 

-''হ‍্যাঁ, ঐ এর মধ‍্যে একদিন এসেছিলাম এদিকে, একটা চাবী হারিয়ে গেছিল। সেটাই দেখছি। '' পিটারের দিকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে অন্বয়দা বলে -''আজকাল রাতের দিকে অনেকেই আসে শুনলাম এখানে। ''

এক হাত জ্বিব কেটে পিটার বলে -''না না, ঐ কয়েকজন একটু ধুনকী নেয় এখানে। '' টাকাটা নিয়ে ও চলে যায়। কবরখানাটা পার করে ও ধারে একটা ছোট নালা রয়েছে। ওটা পার করে চা বাগান, একটা কাঁঁচা রাস্তা রয়েছে বাগানের বুক চিরে। লেবারদের ট্রাক আসে ঐ পথে, পাতার গাড়িও আসে। সেদিকে গিয়ে অন্বয় দা ভাল করে দেখে এল। নালায় কিছু একটা দেখে মোবাইলে ফটো তুলে নিল। রুবাই উঁকি দিয়ে দেখলো একটা জুতো কাদায় মেখে পড়ে রয়েছে।কবর খানার একদিকের বাউন্ডারী দেওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে আগেই। 

 

ওকে বাড়িতে নামিয়ে অন্বয়দা সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে গেছিল। একা ওদিকে যেতে বারণ করেছিল।

সন্ধ‍্যায় চার্চের দিক থেকে একটা চেঁঁচামেচির আওয়াজ কানে এসেছিল।  বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়িকে ওদিকে ছুটে যেতেও দেখেছিল রুবাই। মায়ের দেওয়া অঙ্ক কটা করতে করতে বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছিল ওদিক পানে। হঠাৎ বাবার ডাকে ও ছুটে নিচে নেমে এল। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে অর্চিস্মান রায় কে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল মালবাজারের কবরস্থানে। ভদ্রলোককে আজ সন্ধ‍্যায় পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। ওনাকে কড়া ড্রাগ দিয়ে আচ্ছন্ন করে এক পুরানো কবরের ভেতর হাত পা বেঁধে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে বিশেষ সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ আজ রেড করে ওখানে। তবে ওনাকে ওখানে অচৈতন‍্য অবস্থায় পাওয়া যাবে পুলিশ জানত না। ঘটনার পেছনে বড় কোনো দল রয়েছে বোঝা যাচ্ছে।  আপাতত উনি সুস্থ, তবে শক কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।

বাবাকে মা খবর দেখতে দেখতে বলছিল -''বাড়ির এত কাছে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা, আমরা টের পেলাম না!!"

রুবাই খবর দেখছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। অন্বয়দার জন‍্যই কাজটা ঠিকঠাক মিটেছিল। রুবাইয়ের কথা আর কেউ সে ভাবে না শুনলেও অন্বয় দা ওর সব কথা শোনে।

পরদিন সকালেই অন্বয়দা এসেছিল ওদের বাড়ি।

রুবাই বলল -''কি করে বুঝলে ওরা কবরের ভেতর ওনাকে আটকে রেখেছে? আমায় তো বললে না একবারো?''

-''প্রথমে আমিও বুঝিনি। বিকেলে তোকে নিয়ে গিয়ে যখন দেখছিলাম মনে হয়েছিল একটা কবরের ওপরটা আলগা, অথচ ডেট বলছে ওটা বেশ পুরানো কবর। সোজা থানায় গিয়ে মন্দারকে সবটা বললাম। ও সাথে সাথে ফোর্স নিয়ে আমায় নিয়ে ওখানে যেতেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। ''

রুবাইয়ের মা জলখাবার দিয়ে গেছিল।একটা মিষ্টি মুখে পুরে অন্বয়দা বলল -''ইচ্ছা করেই তোর নামটা গোপন রেখেছি। চা মাফিয়াদের কাজ এসব। ওনাকে চাপ দিয়ে বাগান গুলো কব্জা করে নিতো ওরা, পরে প্রাণেও মেরে দিত। ওদের হাত বেশ লম্বা, ওরা ধরাও পরেনি সবাই। তাই তোর নাম কোথাও প্রকাশ করিনি। তবে মন্দারকে বলেছি এবারেও পুরো কৃতিত্ব তোর। অর্চিস্মান বাবু সুস্থ হলে ওনাকেও জানান হবে তোর কথা। ''

রুবাই মিটি মিটি হাসছিল। ভাগ‍্যিস আলোটা ওর চোখে পড়েছিল। তাই তো ভদ্রলোক প্রাণে বেঁচে গেলো। না হলে জীবন্ত কবরে থাকতে থাকতে....... আর ভাবতে পারে না ঘন্টা রুবাই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract