কালপনিক কথোপকথন
কালপনিক কথোপকথন
১৫ অগাস্ট ভোর। ক্রমে আলো আসছে ময়দানে। আর কিছুক্ষণ বাদেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন শুরু হবে। শোনা যাবে দেশাত্মবোধক গান, ড্রাম এবং মার্চ পাস্ট। ছোট পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে যাবে ছেলে মেয়েরা। কিন্তু এতো সবকিছু শুরু হওয়ার আগেই কেমন যেন বিষণ্ণ মুখ করে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বসে ছিলেন এক ব্যক্তি। দেখলেই চেনা চেনা লাগছে। বছর ৫০ হবে। মাথায় ওনার নেতাজীর টুপি। এক ঝলকে নেতাজী ই মনে হচ্ছে। তিনি উঠে চলে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ই পিঠে টোকা লাগে। পেছন ফিরে তাকিয়ে উনি অবাক হয়ে যান। এ কাকে দেখছেন উনি? এ যে দেশের হৃদয়। মহাত্মা গান্ধী।

" কেমন আছ সুভাষ? সেই যে পালিয়ে গেলে আর তো ফিরেও এলে না। "
" আপনি ভুল করছেন। আমি পালিয়ে যেতে চাইনি।"
" যাই হোক,,, তুমি যে কারণে দেশ ছাড়া হয়েছিলে,,, একটু অপেক্ষা করতেই পারতে। দেশ তো স্বাধীন হলো তবে তার জন্য বহু রক্ত ঝরল।"
"আচ্ছা বাপু একটা প্রশ্ন করব তোমাকে? "
" নিশ্চয়ই করতে পারো।"
" বাপু দেশ কি সত্যিই স্বাধীন হয়েছে? "
" স্বাধীন যদি না হতো তাহলে আজ কি মানুষ তাঁর ইচ্ছে মতন কাজ করতে পারতো? "
" আমার যেন মনে হচ্ছে দেশটা আজও স্বাধীন নয়।"
" কিসব বলছ তুমি সুভাষ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই মানুষকে অত্যাচার সহ্য করতে হয় না আর। নিজেরা নিজেদের মতন কাজ করতে পারে। কেউ তাদের ওপর অকারণে হুকুম চালাতে পারে না। এই কাজ করতেই তো জীবনে এগিয়ে গেলাম। দেশ স্বাধীন মানে সব মানুষকে শান্তি দেওয়া। দেশের সকল মানুষ আনন্দে থাকলেই তো শান্তি পাওয়া যায়। জীবনটা তো দেশের মানুষের শান্তির জন্যই আমি তুমি ত্যাজ্ঞ করলাম। তুমি কি সবকিছু ভুলে গেছ? "
" না, ভুলতে পারি নাকি? আন্দোলনের সময় আমরা না খেয়ে থাকতাম। আপনার সেই ডান্ডিমার্চ। সে কথা ভোলা অসম্ভব।
দেশের মানুষের জন্য প্রাণ দিয়ে দিলাম, তবুও দেখুন, আপনি শুধু একজন মূর্তি হয়ে আছেন আর আমার ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতে যাওয়ার মূর্তি করে রেখেছে। আমাদেরকে অতো কেউ মনেও রাখে না। দেশের মানুষের জন্য ই যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে দিলাম,, সেই মানুষ ই আর আমাদেরকে মনে রাখে না। "
" ভুল করছ সুভাষ। আমরা এসেছিলাম আমাদের কর্তব্য করতে। কে আমাদের মনে রাখবে তার জন্য নয়।
ভারতবর্ষ ছিল এবং আজও হচ্ছে আমাদের জীবন। তাই জীবনের জয় হলেই তো সবচেয়ে ভালো লাগে। প্রাণ হারিয়েছি এ কথা ঠিকই,,,, তবে দেশের মাটির জন্য। দেশ আমাদের মাতৃভূমি। মায়ের জন্য জীবন ত্যাজ্ঞ করা কোন কষ্টের নয়।"
" তবুও কি আমরা পেরেছি কিছু পালটাতে? এখনো চলে খুনোখুনি। পলিটিক্স মানেই অশান্তি আর ঝগড়া। মানুষ কি খুশি আদৌ আছে?
মনে তো হয় না। গরিব মানুষরা আজও পড়াশোনা করে না। চেষ্টা করলে সবই করা যায়। ওই যে শুধু একটা জিনিস দরকার,,,,, মনের ইচ্ছে।
একবারও দেখেছ বাপু? নারীদের ওপর আজও অত্যাচার করে। একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলে কিছু ছেলে,,,,,, কিন্তু সব দোষ চলে যায় মেয়েটার ঘাড়ে। সবার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় সেই নারী। কিন্তু কেন? ওর তো কোন দোষ নেই। তবে কেন সহ্য করতে হয় তাদের এই যন্ত্রণা? "
" এর কোন উত্তর নেই সুভাষ। নারীদের ওপর অত্যাচার আজীবন হয়ে চলেছে।
৭ বছরে বিবাহ, সতীদাহ করে দিত সেই বাচ্ছা মেয়েটাকে, একজন বুড়ো বর মরে যেতে। নিজের মেয়ের গায়ে আগুন জ্বালাচ্ছে দেখেও মেয়ের মা চুপ করে থাকত।
বছর চলে গেছে,,,, এতো অত্যাচার চলে গেছে। মেয়েরা এখন পড়াশোনা করে চাকরি করে। বাহবা দাও সেই নারীদের আজ।
তবে এখনো হয় বিয়ের সময় "কন্যাদান।" যেন কন্যাকে দান করছে। পন দিতে হবে, অর্থ দিতে হবে, সোনার গয়না দিতে হবে, খাট, বিছানা সব দিতে হবে কন্যার পরিবারকে। তবেই নাকি বিয়ে হয় সার্থক।
নারীকে যখন "কন্যাদান" বলছে,,, সকলের মনের মধ্যে ভাসে কন্যা শুধু দান করার জিনিস। কোন জিনিস ছিড়ে গেলে যেমন ভালো লাগে না। তাই সেটা আমরা ফেলেদি। মানুষের কাছে কন্যার গায়ে অন্য কোন মানুষের আচ ও লাগলে,,,, তাঁরা ঠেলে সরিয়ে দেয়।
সবকিছু পালটে গিয়ে আজ মেয়েরা চাকরি করছে। একদিন নিশ্চয়ই দেখবে,,,,,, নারীদের সবাই সম্মান করবে।
একটা কথা সকলেরই মনে থাকবে,,,, নারীদের যদি আর জন্ম না হয়,,, এ পৃথিবী ধংশ হয়ে যাবে, কারণ একজন নারীই দিতে পারে বাচ্ছার জন্ম,,,,, কোন পুরুষ নয়।
আর যদি বলো খুনোখুনি,,,,, সে তো রাজনীতি কথাতেই আসছে "রাজা" শব্দ। আর রাজারাই করে ন্যায় অন্যায়ের বিচার। ইতিহাসে তো তাই পড়েছি। রাজা যখন নিজেই করে অন্যায়,,, তখন শুরু হয়, যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যেমন শেষ হয়ে গেছিল বহু মানুষ,,,, ঠিক সেরমই।"
" বাপু তুমি মহাত্মা। তোমার মতন মানুষ আর হয়না। যেন মনে হচ্ছে বৃথাই করছি এই স্বাধীনতা দিবস। নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ বিদেশে থাকতে। নিজের দেশকেই ভালোবাসে না। এরম মানসিকতা এখন মানুষের মনে ভাসছে। নিজ দেশকেই ভালোবাসে না মানুষ এখন? তাহলে সবই কি ব্যর্থ হয়ে গেল?"
" কিছুই বৃথা নয় সুভাষ। যে মানুষ ভারতবর্ষকে নিজ মাতা ভাবে,, সে ই বলে "আমার এই দেশেতেই জন্ম,, যেন এই দেশে তেই মরি। " আর যে ভারতবর্ষকে নিজ হৃদয়ে নিতে পারে না,,,, সে মাতৃভূমি কথার অর্থই যানে না। সবকিছু পাল্টানো যায়,,,, তবে মানুষের মন নয়। আমাদের কর্তব্য ছিল সব মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে আনন্দ করা। আমাদের কর্তব্য শেষ। মানুষ এখন কি করবে সে কথা মানুষ ই ভাবুক।"
" ঠিকই বলেছ বাপু। তবুও একটু খারাপ লাগে ভেবে,, যে আমাদের দুজনের অস্তিত্বের মুল জায়গা হচ্ছে ভাবনা। আশা করি এই স্বাধীনতা দিবসে, কেউ না কেউ আমাদের কথা ভাবছে।
সময় হয়েছে বাপু। চলুন, পতাকা উত্তোলন দেখে আসি । দেশকে স্যালুট জানিয়ে আসি।"
"ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।"
