জীবন যন্ত্রণা (পর্ব তিন)
জীবন যন্ত্রণা (পর্ব তিন)
নবীন বলল ,"আর আমার গৃহে ফিরার ইচ্ছা নেই, যদি আমাকে আশ্রয় দেন ভালো, না হলে আমি আবার নিরুদ্দেশ হব,পথে মরতে হয় মরব,তবু সম্মান ইজ্জত নিয়েই মরব।"
সাধু স্মিত হাসলেন। তারপর বললেন, " এসো আমার আশ্রম তোমার কেমন লাগে আগে দেখো।"
দামোদর থেকে চারশো মিটার বা একটু বেশী দুরে সাধুর আশ্রম। জনবসতিহীন নির্জন প্রান্তর,গ্রাম থেকে দুরে মাঠের মাঝে অন্তত বিশ পঁচিশ বিঘা জমির উপর তার আশ্রম।আশ্রমের উত্তর আর পশ্চিম দিকে বরাবর বড় বড় বৃক্ষতে বনের মত ছায়ঘন পরিবেশ। মাঠাল গ্রাম্য রাস্তার পাশে পুর্ব দিকে বড় লোহার গেট,ইটের প্রাচীর দেওয়াল ঘেরা আশ্রম ,রাস্তার দিকে প্রাচীর থাকলেও বাকী তিন দিক কংক্রিটের ছয় বাই ছয় ইঞ্চি পিলার আট ফুট উচ্চতার,কাটা তারে ঘেরা। ঘেরা তারের বরাবর বাবলা গাছের ঘন জঙ্গলে যেন আশ্রমের পূর্ব, উত্তর আর দক্ষিণ বরাবর প্রাচীরে কাজ করছ।
আশ্রমের জমির দক্ষিণ আর পূর্ব দিক বরাবর বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত আর পুকুর। সাধুর বসবাস গৃহে একবারে আশ্রমের উত্তর পশ্চিম চেপে ছায়া ঘন পরিবেশ।বাস গৃহের সম্মুখে প্রশস্ত প্রাঙ্গন নানান ফুল গাছ।আর তার পর মন্দির ,ছোট পরিপাটি মন্দির, সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গন বা খোলা বারান্দা।
সাধুবাবার দুটি ঘর,একটি তার শয়ন কক্ষ অন্যটি রান্নার ঘর আবার এক পারিচালক কাম ভক্ত রাতে ঐ ঘরেই শয়ন করে।
এত সকালেই, ঐ পরিচালিক মধ্য বয়সী, ফুল তুলে পূজার আয়োজন করেছিল, মন্দিরের ঘর বারেন্দা ধুয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেছিল।
সাধু আশ্রমে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে ঐ পরিচালককে ডেকে বলল,
"দেখো রতন নতুন এক অতিথিকে নিয়ে এলাম, ওর যতদিন খূশী এখানে এখন তোমার সঙ্গী হয়ে থাকবে।"
রতন নবীনকে চেয়ে দেখল, তারপর এক মুখ হেসে বলল,
"বাবাজী ইনাকে কোথায় পেলেন?"
"সে এখন পরে বলব, ও ক্লান্ত কিছু খেতে দাও পোষাক পরিচ্ছদ ও কিছুই আনেনি।"
রতন ,নবীনের উদ্দেশ্যে বলল,
" আপনার কী নাম ভাই!"
নবীন একটু সংকোচে বলল,
"আমাকে তুমি করে বলুন ,আপনি বয়সে অনেক বড় ,আমার নাম নবীন ।"
"ঠিক আছে ভাই ,আশ্রমে থাকবে ,গেরুয়া পরবে! না সংসারী পোষাক! কী তোমার পছন্দ!"
"আমার সংসারে অনীহা তাই গৃহ ছেড়েছি, আমি গেরুয়া বসনই পরতে চাই।"
সাধু বাবা স্মিত হেসে রতন কে বললেন ,
"ও বেচারা ক্লান্ত ক্ষুধার্ত আগে ওকে তৃপ্ত করো,তার পর ওর একটু বিশ্রাম দরকার। আমি মন্দিরে ঢুকছি।"
"হ্যাঁ বাবাজী আমি ওর পরিচর্যায় সব ব্যাবস্থা করছি।"
বাবাজী দুঘন্টা ধরে মন্দিরে যোগ সাধনা করেন। রতন সমীহ চোখে মন্দিরে সাধুর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বলল,
"এসো ভাই ,তুমি একটু মুখ হাত ধুয়ে নাও। আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করি।"
"বাসগৃহের সামনেই নলকূপে নবীন হাত মুখ ধুয়ে তারপর সাধুর বসবাস গৃহের বারান্দায় বসল।"
রতন যত্ন করে কাঁসার কানা উচু পাত্রে চিড়ে দই কলা আর গুড় দিয়ে ফলার আকারে নবীনকে খেতে বলল।
নবীন যখন খাচ্ছিল, রতনের এতক্ষণ এই সাধু বাবার ও আশ্রমের ইতিহাস বলার জন্য যেন পেট ফুলছিল।এক রকম মুখস্থ বলার মত রতন বলতে শুরু করল, তার সারমর্ম,
রতন এ গ্রামেরই মানুষ,তবে এককালে সংসারী থাকলেও এখন সংসার বিরাগী, বয়স পঞ্চান্ন ,বছর পাঁচেক হল বিপত্নিক হয়েছে ,দুই মেয়ের বিয়ে, স্ত্রীর মৃত্যুর আগেই হয়েছিল,জাতে কামার কিন্তু খুব নিষ্ঠাবান ধার্মিক ।
বাবাজীর নাম, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ।তিনি এককালে রেলের উচ্চ পদস্থ আধিকারিক ছিলেন। অবসরের পর সংসারের স্বার্থপরতা,সংকীর্ণ মানসিকতায় তিনি মনে করেন, তার সব জীবনটাই অজ্ঞান আর উদ্দেশ্য হীন ভাবে ব্যায় হয়েছে। উনি ইউ পির মানুষ, কর্মস্থল ছিল কলকাতা ,রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের বড় ভক্ত, তাদের জানতে পড়তে বাংলা ভাষাটাই শিখে নিয়েছিলাম, এখন পুরোপুরি বাঙালি।
উনার এক অধস্থন সহকর্মীর এ গ্রামের মানুষ।তার যোগাযোগে বিরাটএকলপ্তে জমি ক্রয় করে আশ্রম তৈরী করেন। আজ না হলেও তিন চার বছর ধরে বসবাস করছেন। পেনশন পান, যার একটা অংশ ইউ পিতে বসবাসরত স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন। এক সময়ের সন্তান পাগল, এখন সন্তানদের সংসারে অসহ্য অবাঞ্ছিত মনে করেন।মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। চাকরীর কারনে বাবাজী তার জীবনের বেশী সময় একা একা কাটিয়েছেন। খুব সরল সহজ সাধারণ জীবন, ভোগ লালসার চেয়েও যেন তার জ্ঞান আহরনে নেশা বেশী।
স্ত্রী বিপরীত চরিত্রের,তিনি ভোগ,অহংকার আর লালসায় অভ্যস্থ,সমঝোতায় রাজী নয়।কলকাতায় আসতেই চাইতেন না।নিজের বাপ মা ভাই আত্মীয় স্বজন ছেড়ে কোয়ার্টার জীবন তার পছন্দ ছিল না। শ্বশুরালয় আর বাপের বাড়ির সব ছিল কাছাকাছি বাবাজী যেত ছুটি ছাটায় । প্রথম জীবনে যা হয়, চারটে সন্তান জন্ম হয়েছিল,দুই পুত্র দুই কন্যা।
সে সময়ে বাড়ির গেলে সন্তানদের যেন চোখে হারাতেন ,সেটা ওদের কিশোর কিশোরী কাল অবধি।এখন তারা অনেক বড়,সবাই বিবাহিত সংসারী,কেমন সব যেন স্বার্থপর,অন্যের ব্যাপারে উদাসীন ,অনুভুতি হীন।
মায়ের অতি আদর, আর বাবার প্রায় অনুপস্থিতির কারনে বাল্যে শাসন নুন্যতম পায়নি। স্বল্প কালীন সময় বাবা এসে থাকতেন, শাসন সম্ভব নয় ,আদর স্নেহটাই করতেন বেশী। অবসরের আগেই বাবাজী মনস্থির করেন, দেশে তার সখের তৈরী বিলাস বহুল বাড়িতে ফিরে এলে মানসিক যন্ত্রণার ছাড়া কিছুই মিলবে না।
এখন এখানে এই আশ্রমে স্ত্রী আসতে চাইলেও তিনি রাজী নন। কারণ স্ত্রী এই সহজ সরল জীবনে রপ্ত নয়। এ সি ছাড়া ঘুম হয় না।গহনার বড় মোহ, মুখোরচোক খাবার পছন্দ, শৌখিন পোষাক চাই, গেরুয়া পছন্দ নয়।আর সিরিয়াল সিনেমা টিভিতে দেখার বড় নেশা।বাবাজী তাই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন এই নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশে থাকা তার এত সহজ কর্ম নয়।
নবীন বলল,
"একটু আশ্রমটা ঘুরে দেখব দাদা !"
রতন বলে ,"পরে ঘুরবে,এখন বিশ্রাম নাও,তোমার তো গতরাতে ঘুম হয়নি। অনেক পথ হেঁটেছ।এখন একটু বিশ্রাম দরকার।"
একটা গেরুয়া কাপড় আর গেরুয়া হালকা কটনের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবী দিয়ে রতন বলল,এসব নতুন আনকরা,বাবাজী একসাথে এক ডজন করে এমন পোষাক কিনে রাখেন। ভীষণ উচু মনের মানুষ। উনার পোষাক আর আমার কোন ভেদাভেদ নেই।খাবার দাবার খুব সাধারণ ,একই আহার খাই তবে আমি আগে উনাকে পরিবেশন করে নিজের খাবার নিয়ে খেতে বসি।
উনি কখনও খাবার দুবার চেয়ে খান না।পরিমিত খাবার তাও উনি মোটেও নষ্ট করেন না। মোটা পোষাক মোটা খাবার অথচ কত বড় পদে কাজ করতেন। বাড়ির সবাই ওর উপার্জনে তৈরী বাড়ি ঘরে কত বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন।এতে উনার কোন আফসোস অভিযোগ নেই বরং এ সরল সাদাসিদে জীবনযাপনে তৃপ্ত।
রতন যে ঘরে শয়ন করে,বড় কাঠের তক্তা কোন গদি বা তোষক অবধি নেই।শতরঞ্জির উপর চাদর পাতা আর তার উপর শুধু মাদুর। গ্রীষ্মের সময় আরামদায়ক ,শীতের সময় কম্বলে শয়ন করে। বিছানায় কোন বৈষম্য নেই তবে, বাবাজীর ঘর যেন লাইব্রেরির মত কতশত বই ধর্ম গ্রন্থ বিভিন্ন দর্শন সংক্রান্ত বই আর আধুনিক বিজ্ঞানের উপর সহস্র ম্যাগাজিন বই।
সনাতন ধর্ম ছাড়াও খৃষ্ট ইসলাম বৌদ্ধ ধর্মের অনেক বই তিনি পড়ে সব ধর্মের একটা ধারনা অর্জন করেছিলেন। সনাতন ধর্মের নানা গ্রন্থ বই বেদ উপনিষদ পুরান গীতা রামায়ণ মহাভারত মনু সংহিতা থেকে সব বই সংস্কৃত আদি গ্রন্থ। এজন্য তিনি সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার জন্য দীর্ঘদিন অনুশীলন করেছিলেন ।
নবীন ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিল।তখন সকাল সাতটা। বেলা একটার সময় রতন তাকে ঘুম থেকে তুলল,
আচমকা ঘুম ভেঙ্গে নবীন ভাবছিল এ কোন অন্য জগতের এলাম !
রতন বলল,"এবার তুমি স্নান করে দুপুরের খাবার খাবে এসো।বাবাজী একসাথেই এই দুপুরের খাবার খেতে পছন্দ করেন ,রাতেও তাই।"
রতন সামনের নলকূপে স্নান সেড়ে নিজ পোষাক পরিচ্ছদ কেচে পরিষ্কার করে তারে মেলে দিল।আবার এক সেট পোষাক, নবীনের ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু তার কোন উপায় ছিল না।ঈশ্বরের অশেষ কৃপা ভাবছিল একটা সম্মান নিয়ে বাঁচার আস্তানা পেয়েছি। যা দরকার ,যত শ্রমই দিতে হয় দেবো।এই আশ্রমকেই আপন করে নেবো।
দুপুরের খাবার আতব চালের ভাত, কাঁচ কল সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, মুগডাল সেদ্ধ, লবন আর ঘী। নিজে মেখে নিয়ে খেতে হবে।বাবার মৃত্যুর পর হবিশ্যির কথা নবীনের মনে পড়ছিল।বাবাজী আর নবীনকে কাঁসার থালায় পরিবেশন করে, রতন নিজের খাবার নিল। তারপর একসাথেই তারা খাবার খেতে শুরু করল।বহুদিন পর এমন খাবার নবীনের বেশ ভালো লাগল।তবে এমন খাবার নাকি প্রতিদিনই তারা খায়, রতন জানাল।
নবীন ভাবছিল খাবার মন্দ নয়,স্বাস্থ্যকর কিন্তু মুখের স্বাদ বদল করতে এদের ইচ্ছা হয় না!
বাবাজী যেন তার মনের কথা বুঝেছিলেন,নীরবে আহার গ্রহনের পর বললেন।
"খাদ্য গ্রহণ ছাড়া তো আমরা জীবন ধারণ করতে পারি না। তাই খাবার দরকার, কিন্তু কী খেলাম মুখ্য নয়,জীবনে সূস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই মূখ্য, তোমার কী মনে হয় নবীন!"
"ঠিক বলেছেন বাবাজী, আমিও একমত।"
এছাড়া নবীনের আর কি বলার আছে! বাবাজীর দয়াতে আশ্রয় আহার বস্ত্র সব।
রতন বলল,
"জানো ভাই সব আমাদের এই আশ্রমের ফসল।
সব ধরনের শস্য ফসল এই আশ্রমের মাঠেই হয়।"
রতন এককালে চাষে অভিজ্ঞ, আর গ্রামের ট্রাক্টর থেকে মজুর,রতন সব যোগাযোগ করে । রতন ই দ্বায়িত্ব নিয়ে সব মরসুমের চাষ করে।
পুকুরের জলে সেচ হয়।কোন মাছের চাষ করে না।নিরামিষ ভোজী আর জীব হত্যা বা জীব জন্তু বেচে ব্যবসা করে না।দেশী চারটে গরু আছে আর বাছুর এতেই বায়োগ্যাস প্যান্ট করে ঐ গ্যাসেই রান্না হয় ।ঐ গোবর সারেই জমির চাষ।আর দুধ দৈ ঘী সব আশ্রমের তৈরী।রতন গ্রামের একজন বিশ্বাসী মজুরের সাহায্য নিয়ে সব কাজ করে। নানান ফল গাছ, আম জাম কাঁঠাল পেয়ারা আতা,পেঁপে নানা প্রজাতির কলা আরও কত কী!
নবীনের শরীরটা একটা বড় ঘুম দেওয়াতে একটু ক্লান্তি দুর হয়েছিল। দুপুরের খাবার পর বাবাজীর ঘরে নবীন গেল। এক ধরনের বিছানা তবে ঘরটা যেন ছোটখাটো লাইব্রেরি। আলমারী ভর্তি কত বই।
বাবাজী নবীনকে নিজের তক্তাপোসে ডেকে বসতে বললেন। নবীন কৃতজ্ঞ চিত্তে প্রনাম করলে বললেন
"এসব ব্যাহিক লোকাচার দরকার কী! অন্তরে শ্রদ্ধাটাই আসল।এমন অনেক সন্তান দেখেছি মা বাবাকে খুব প্রনাম তো করে।যত্ন করে না,দেখভাল করে না,এমন কী দুরে থাকে, ভিন্ন থাকে, বাবা মা খেতে পায় কীনা খোঁজ নেয় না। নিজের কাছে রাখার কথা দুরে থাক। নিজের সংসার মানে স্বামী স্ত্রী আর সন্তান।বাবা মায়ের আবার যদি সম্পদ না থাকে, পেনশন না থাকে ,তা হলে তাদের যে কী হাল! এমন সব ছেলে মেয়েরাও কত গদগদ প্রনাম করে।আবার মা বাবা মরার পর কী কান্না! লোক দেখিয়ে নাটক করে অজ্ঞান! তারপর নিষ্ঠাভরে হবিশ্যি আর শ্রাদ্ধের নাম কত ধুম মানুষদের ভোজ খাওয়ানোর আয়োজন যা খরচ করলে বাবা মা জীবন দশায় না খেয়ে মরত না।কতই এ জীবনে দেখলাম।
আমি কারোর প্রনাম নি না।তুমি নতুন জানো না ঠিক আছে। আমাকে প্রনাম করার কোন দরকার নেই।"
নবীন লজ্জা সংকোচে তক্তাপোসের একপাশে বসল।
ভাবছিল এ যে নতুন ধরনের মানুষ! সাধু কিন্তু প্রনাম নেন না। হবিশ্যির খাবার, আর এক ধরনের পোষাক পরিচ্ছদ,রতন দার সাথে কোন তফাত নেই। শ্রদ্ধায় মনে মনে ভাবল, আমি যদিও গুরু নেওয়া বিশ্বাস করি না, তবে এমন মহান মানুষ তার গুরুর যোগ্য।
একটু বিনয়ের সাথে বলল, "আপনি গুরুর তুল্য।"
"তোমার গুরু আছে নাকি!"
"না আমি বা আমার পরিবার এসবে আস্থা রাখে না। আমার পৈতার পর বাবাই আমায় দীক্ষিত করেন।বাবা এখন জীবিত নেই।"
"গুরু কে জানো!"
"শুনেছি গুরু ঈশ্বরের সাথে শিয্যের যোগসূত্র।"
"না সেটা ঠিক নয়,তুমি যদি বলো, সনাতন ধর্ম মতে আমরা ঈশ্বরের সন্তান ,অমৃতের সন্তান, তবে বাবার সাথে সন্তানের যোগাযোগ মাধ্যম থাকবে কেন! আসলে যিনি সঠিক দিশা দেখান, জ্ঞান শিক্ষা নৈতিকবোধ সুরুচী সততা যা কিছু উত্তম আমাদের অন্তরে প্রেরণ তিনি গুরু।আর মা বাবার চেয়ে বড় গুরু কেউ নয় ! যদি তারা মূর্খ হয়, বধির অন্ধ হয়, বা অনৈতিক মনের হয়, গুরুর দরকার অবশ্যই। শিক্ষা গুরু আগে দরকার, তোমার যদি শিক্ষা না থাকে, সৎ অসৎ শুভ অশুভ বোধ না থাকে ,তুমি নিজেকে মানুষ ভাববে কী করে!"
"নবীন বলে যার নৈতিক শিক্ষা নেই , যে যত শিক্ষিত হোক মানুষ নয় ,নিরপেক্ষ বিচার বোধ থাকে না।"
বাবাজী বলে,
"এই কথাটাই তোমাকে বলছিলাম গুরু বলতে যা তোমরা বলো কানে ফুঁ ইষ্ট মন্ত্র এসবে কোন লাভ নেই।আমাদের শাস্ত্রেও মা বাবাকে গুরুর অনেক উপর স্থান দিয়েছে।অবশ্যই সু পিতা সু মাতা যারা জন্মতো কুকুর বিড়াল দেয়, মানুষ পশুর তা হলে তফাত কেন!"
নবীন বলে,
" হ্যাঁ বাবাজী সনাতন শাস্ত্রে গ্রন্থে পিতৃবন্দনা বলা হয়েছে, পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ/ পিতোরি প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা, অর্থাৎ "পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে ভজন করলে সব দেবতা সন্তুষ্ট হন। আর মাতৃ বন্দনায় বলা হয়েছে জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। কিন্তু কজন আজ এসব স্মরণ করে!
আর গুরুর উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদনে গুরু প্রনাম বলা হয়েছে গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর,গুরু সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।"
বাবাজী হেসে বললেন,
"এ মন্ত্রটিতে অর্থ বুঝায় যে জগতেরতিনজন গুরু আছেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নামে এই তিন শক্তির একশক্তির প্রকাশরূপ তিনিই পরমব্রহ্ম ।
এই গুরু তোমার মানুষ গুরু নয় । তোমার শ্লোকেই পরমব্রহ্ম উল্লেখ আছে। ব্রহ্ম ব্যপ্তি বিস্তার অসীম, এসব জানতে হলে তোমার উচ্চ মার্গের বিজ্ঞান সাধনার দরকার।আধুনিক রিসার্চ তথ্য ভিত্তিক লেখা পড়া চর্চা করবে , কত ধরনের জার্নাল আর ম্যাগাজিন আমার কাছে রাখা আছে ঐ দেখো।"
নবীন দেখল একটা আলমারী ঠাসা কত সব বিজ্ঞান দর্শন সংক্রান্ত জার্নাল ম্যাগাজিন ।
বাবাজী বললেন,
" আমার সাধনা কালী মায়ের সামনে বসে মন্ত্র উচ্চারণ নয়! কাপালিকের মত কোন মানুষ কে ধরে এনে বলি দিয়ে বা ছাগল বলি দিয়ে মদ মাস গ্যাজা সেবন করে চোখ লাল করে ফুর্তি নয়।রূপক জানো কাকে বলে!"
"রূপক তো বাবাজী একটার আড়ালে অন্য কোন অব্যক্ত ইংগিত, যারা বোঝার বুঝবে।"
"খানিকটা বলেছ, আসলে আমার মন্দির,আর তার ভিতর কিছু দেব দেবীর বিগ্রহ হল আমার সাধক স্বীকৃতি, আমার আইডেন্টিটি! আমার নিরাপত্তার রক্ষাকবজ, একটা সম্মান সামাজিক ইজ্জত। আমিও ঈশ্বরের সাধনা করছি,কিন্তু এটাকে পেশা নয়,মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজ আমিত্ব বড়াই করে মানুষের দুর্বলতা নির্বুদ্ধিতার সুযোগ নিয়ে, নানা লোভ লালসায় মোহগ্রস্থ করে আর পরকালের ভয় ভীতি প্রলোভন দেখিয়ে, উপার্জন করব ,পায়ে প্রনাম মাথা ঠোকাব এসব নয়। সত্যের অনুসন্ধান।
গোঁড়ামী ,ভন্ডামী ,কুসংস্কার ,অন্ধ বিশ্বাস ,অন্ধ অনুকরণ ,অশিক্ষা ,ধর্মের নামে মানুষকে হিংস্র করা, লোভী করা,অসহিষ্ণু করা ,সৎ ধার্মিক মানুষের কর্ম নয়। এই সব শিক্ষা যারা দেয় ধার্মিক গুরু নয়, ভন্ড অধার্মিক, তারা ঈশ্বর বিশ্বাস করে না। এটা ওদের পেশা, নেশা ,ক্ষমতা শক্তি আর প্রচারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা। হোক না নেগেটিভ প্রচার! আর বর্বর মূর্খ গুলো মগোজ ধোলাই হয়ে তাদের অনুসরণ করে,কিছুই পায় না।নেশার মত নেশার মাদকই একদিন নেশাখোরদের যেমন গ্রাস করে।এদের সেই দশা, সুস্থ জীবনকে বিষময় করে, নিজের কাছে , সবার কাছে।
প্রকৃত সনাতন ধর্ম শিক্ষা তাই মহান।জ্ঞান আর সত্যের অনুসন্ধান যা হিংসা বিদ্বেষ অসহিষ্ণুতা শেখায় না।তবে কাপুরুষতা শেখায় না, অন্যায় অধর্ম হিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শেখায়।আর যুদ্ধের রণনীতিতে নৈতিকতা সততা নয়, ছল কৌশল মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া দরকার, বৃহত্তর নীতি আর সত্যের জয় নিশ্চিত করনে এই বিচ্যুতি জানবে ধর্মেরই অংশ । স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাভারতের তাঁর যে ভূমিকা আর গীতার বানী এর উদাহরণ।
শঠে শাঠাং সমাচরেৎ। যে অসৎ খল অসহিষ্ণু হিংস্র, তাকে হিংসা দিয়ে দমন করতে হয়।পুরানে বার বার তার উল্লেখ আছে। সত্য মিথ্যা,ন্যায় অন্যায় বিচারের দরকার নেই। জীবন যাপনের জন্য বাস্তব শিক্ষা।সংসারে শত্রু দমনে অহিংসার কোন স্থান নেই, তোমাকে কেউ আক্রমন করলে তার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আক্রমন করো।আক্রমন করবে অনুমান হলেই আগেই আক্রমন করো,যেন সে তোমার বা তোমার আপনজনের কোন অনিষ্ট করতে না পারে। আমাদের সনাতন ধর্ম যে গুরু এ শিক্ষা দেয় না ! এদের গুরু ভাবা তাই পাপ অধর্ম। যারা এই জীবনের বাঁচার দিশা দেখাতে পারে না, তারা পরকালে তোমার কোন কাজে আসবে না।