Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

4.5  

Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

জালিয়াত

জালিয়াত

13 mins
2.9K


মানিক।

মানিকের চিরকালই অদ্ভুত গুণ ছিল। সেই একই নতুন বোতলে পুরোনো মদ ঢাললেও, খেতে কখনোই না খারাপ লাগতো না।

না, না, আমি পার্ক স্ট্রিটের বিস্ট্রোর বারটেন্ডার মানিক দত্তের কথা বলছি না। সেই মানিক তো কবেই মরে ভূত গেছে।

আমি বলছি জালি মানিকের কথা। ওই যে হাওড়া-মেচেদা লোকালে সন্ধ্যা বেলায় খেলা দেখাতো। এবার মনে পড়েছে?

আচ্ছা, আচ্ছা -- জালি বললে ওনার আবার গায়ে খুব লাগতো।

তাই বরঞ্চ জালি মানিক না বলে, মানিক সাধুখাঁ বলেই ডাকি। হাজার হোক পিতৃদত্ত নাম তো।

মরবার পরেও নামটার মায়া আর ছাড়তে পারেনি।

আশ্চর্য ! ভিমরতি যত্ত !


১.

এমনিতে মানিকের খেলা এমন কিছু আহামরি ছিল না। সেই এর ব্যাগ থেকে ডিম হাওয়া করে অন্যের ব্যাগে চালান দেওয়া, এর পকেট থেকে পেন বের করে অন্যের পকেটে চালান করা, ম্যাদামারা তাসের খেলা, কয়েন হাফিস করার বেরঙা ম্যাজিক, এর টুপিতে ক্যাম্বিস বল রেখে অন্যের কোল থেকে বের করে আনার সেই পুরোনো স্ট্রাটেজি। বা কখনো হাই-স্পিড ট্রেনে জাগলিংয়ের খেলা দেখানো। বা মাঝে মাঝে ওর সেই কথা-বলা পুতুলটা নিয়ে যাত্রীদের সাথে মস্করা করা। কি নাম যেন দিয়েছিলো পুতুলটার? কি যেন বেশ? হ্যাঁ, হ্যাঁ -- রিকু। সেই 'মেরা নাম জোকার' মার্কা লম্বা লম্বা দাগ কাটা পায়জামা, লাল রঙের জামা, আর ঝাঁকড়া, ঝাঁকড়া চুল।

না, না -- ভুল বললাম। শেষোক্ত খেলাটি আবার সবসময় দেখা যেত না। AC কামড়ায় উঠলেই ও দেখাতো। মজা করে বলতো -- রিকু'র খুব গরম লাগে তো - তাই AC ছাড়া ও কোথাও চড়ে না। আসলে তা নয় -- জেনারেল কম্পার্টমেন্টে এতো আওয়াজ হয় যে বেশিরভাগ সময়ই পুতুলের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। তাই AC কম্পার্টমেন্টই এসব ক্ষেত্রে আদর্শ। এছাড়া জেনারেল কম্পার্টমেন্টের কামড়াগুলো এতো বেশি দোলে, যে ব্যালান্স রাখাটাই দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়, পুতুল কোলে খেলা দেখানো তো দূরের কথা। এসব ক্ষেত্রে তাই AC কামড়াই জিন্দাবাদ।

ও হ্যাঁ -- ওর আরেকটা পছন্দের খেলা ছিল। সেলফি। এর ফোনে ফটো তুলে, অন্যের মোবাইলের গ্যালারি থেকে বের করে জনসমক্ষে দেখানো। এর ফোন থেকে ভিডিও করে অন্যের মোবাইলে সেটা খুঁজে বের করা। বেশ কাব্য করে নাম ও রেখেছিলো খেলাটার: ইসকি টোপি - উসকা সর। চোখের পলকে, হাত সাফাইয়ের এক চরম কৌশল। ব্যতিব্যস্ত আরোহীর অজান্তে মোবাইলের থেকে তোলা ছবিটি যে চোখের পলকে কখন bluetooth-এ চেপে আরেকজনের মোবাইলে পৌঁছে যাচ্ছে, সেটা কেউ টেরই পাচ্ছে না। "ফটোটা তো তুললেন একেন-বাবু", টিপ্পনি দিয়ে কথাটা বলে চোখ মারতো মানিক -- "চলে গেলো দুপুর-ঠাকুরপো'র ফোনে কি করে?" 

এই খেলাগুলোর কোনোটাই এমনকিছু আহামরি নয়। কিন্তু হলে কি হবে? মানিকের এমন এক অদ্ভুত, অভিনব কথা বলার ক্ষমতা ছিল যে লোকে হা করে শুনতো। জানা কথা, জানা জিনিস -- তাও মানুষে দেখতো -- পয়সাও ফেলতো। মানিকের presentation-টা এ এমন ইউনিক থাকতো সবসময়, ট্রেনে ওই সময় বসে থাকা সব প্যাসেঞ্জার-ই কম বেশি কৌতুহল নিয়ে মুখ তুলে তাকাবেই। কেউ কেউ তো আবার --"আরো একবার, আরো একবার" বলে ফরমাস ও দিতো। বাকিরা হাসতো, হাততালি দিতো, সাবাসি দিতো।

কে জানে কবে যে ওর নাম হয়ে গেছিলো জালি-মানিক।

ওই যে কথায় বলে সব দিন সমান যায় না।

বেশ কিছু মাস বেশ ঝড় গেছিলো মানিকের জীবনে। খেলা দেখানোর সেই রঙ ফিকে হতে শুরু করে। চটক যেন মুছতে শুরু করে ওর কথার ধারে। কথার সেই মার-প্যাঁচ ও যেন ফুরিয়ে আসছে। চোখের তলায় এক পোঁচ কালী -- গলায় দম কমে গেছে। 

তারপর বেশ কিছুদিন ওকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি।

আসতে আসতে ভুলেই যেতে শুরু করেছিল লোকে ওকে।

তারপর একদিন।

রেল লাইনের ধারে।

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মানিক, এক হাত দিয়ে ওই পুতুলটাকে জড়িয়ে। গলার কাছে প্রায় আড়াই ইঞ্চি লম্বা ক্ষুর চালানোর দাগ - ফালাফালা করে কে যেন কেটেছে।

চোখে ভয়, হা করা মুখটা যেন কিছু একটা বলতে গিয়ে মাঝ পথেই থেমে গেছে।

হাতে একটা চিরকুট। তাতে লেখা: the show must go on….


২.

ট্রেনে একই পথে আরেক নক্ষত্র কিছুদিন ধরেই ঘোরাঘুরি করছিলো।

হুডিনি জগাই।

হুডিনি নামটা স্পস্টতই নিজেরই নেওয়া -- আসলে ওর নাম জগন্নাৎ দত্ত। নন্দকুমারে বাড়ি। টিপ্ করে সেই ট্রেনগুলোতেই উঠতো যেগুলোতে মানিক খেলা দেখাতো। মানিক নেমে যাবার পরই, দু-তিনটে স্টেশন পরই ও উঠতো, এভারেজে সেই লোকগুলো তখনও থাকতো যারা একটু আগেই মানিকের খেলা দেখেছে। আর তাদের শুনিয়ে শুনিয়েই কাব্য করে বলতো:

কি ভেবেছিলি একাই খাবি

সভা করে পন্ড…

জগন্নাথ সব নেবে কেড়ে

পাইবি অশ্ব-অন্ড…..

মানিক যা, যা করতো, এও ঠিক তাই তাই করতো। তাই এরও একটা পুতুল আছে। এরও পুতুলও AC কামড়া ছাড়া ওঠেনা। সেই একই খেলার ছক, একই কথা আবার করে বলা, একই গল্প আবার করে শোনানো। স্পস্টতই শ্রোতারা বিরক্ত। জগাইয়ের শোয়ে সেই প্রাণ কখনোই নেই যেটা মানিকের আছে। এ যেন যাত্রা করছে, চটুল কবিতা বলে। যেন প্যারোডি করেছে।

ফলে, কেউই দেখতো না ওর খেলা -- যে যার মনে যা করছিলো তাই করতে থাকলো। মুখ উঠিয়ে কেউ দেখলো ও না। জগাই কিছুদিন এরকম চলার পর বুঝলো ওকে রুট পাল্টাতে হবে। ও দু-তিনটে আলাদা আলাদা লাইনে চেষ্টা করতে থাকলো। নাহঃ -- তাতেও কিছু লাভ হলো না। আজকের ওয়েব-সিরিজের জমানায় কে-ই বা আর এইসবে ইন্টারেস্ট দেখায় ! লোকে গল্পের বই-ই পড়তে চায়না -- এসব তো আরও অনেক দূরের কথা। নাহ -- কিছু একটা করতেই হচ্ছে।

সেদিন প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা। মেদিনীপুরের শেষ লোকাল ট্রেনটা ঘরে ঢোকার পর, মানিক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ব্রিজটা পার হচ্ছিলো। শহরের এই কোণায় কেন যে গভমেন্টে এতো বিজলি নিয়ে কিপ্টেমি করেছে কে জানে? ঘুটঘুটে অন্ধকারে - এহ, শালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না যে। পকেটের থেকে মোবাইল বের করলো ও -- আলোটা ফেলে হাঁটলো কিছু পা। কোথায় যেন গান বাজছে -- আর দেড় মাস পরেই পুজো। এখন থেকেই বেশ জায়গায় জায়গায় ম্যারাপ লেগে গেছে। এই সময়টা বেশ লাগে কিন্তু -- ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, মা বাবার কথা মনে পড়ে, গ্রামের ফেলে আসা বাড়িটার কথা মনে পড়ে --

টর্চের আলোটা একটা কুকুরের চোখের ওপর পড়লো। কুকুরটা চমকে উঠে চেঁচাতে শুরু করলো।

ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা ধাক্কা। মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে মানিক।

কিছুক্ষণ অন্ধকারে হিমশিম খেতে খেতে, ব্যাগটা খুঁজে পেতেই মানিক টের পেলো পেল্লায় ভারী একটা বুট ওর হাতটার ওপর -- পিষছে। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো ও।

"কি কাকা -- চিনতে পারছো ব্রাদারকে?"

হ্যাঁ। মানিক চেনে এই গলাটা। কি নাম যেন? হুডিনি। হুডিনি ই তো?

"কি জানো ভাই -- প্রকৃতি খুব নির্মম", হুডিনি একা নয়, ওর সাথে আরও দুজন লোক আছে। এগিয়ে এলো ওরা -- হাতে লোহার রড আর চেন -- "একই সাথে কংশ কানাই বেঁচে থাকতে পারে না। ওই যে কি যেন বলে -- Jungle theory....তুমি থাকলে আমি খেতে পাবো না, আর আমি থাকলে তুমি বেঁচে থাকতে পারব না। তাই দুজনের ভিতর একজনকে তো যেতে হবে ভাই...."

হাতড়ে হাতড়ে পকেটে হাত দিলো মানিক। এখানে আরেকটা ফোন আছে -- এই ফোনটা সবসময় ও ব্যবহার না করলেও, হাতের কাছেই রাখে। ফোনটা বের করে এনেই, ভিডিও মোড অন করলো ও।

"তোর জন্য আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। তোর জন্য আমার পেটে ভাত পড়ছে না। তোর জন্য আমার কথা কেউই শোনে না -- আমি কিছু বললে লোকে হেসে উড়িয়ে দেয়", লোকটা বলেই চলেছে -- "তোর জন্য আমায় লোকে একটা ক্লাউন মনে করে। আমায় লোকে একটা unwanted পোকা বলে লোকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ঘেন্নায়।"

ও উবু হয়ে বসলো মানিকের কাছে। খুব সস্তার কোনো মদের গন্ধ ছাড়ছে গা থেকে।

"এসব তোর জন্য। তোর জন্যই হচ্ছে।"

মানিক উঠে বসতে চেষ্টা করলো -- "আমি তো তোমায় কোনো ক্ষতি করি নি। তুমি ই তো ইচ্ছে করে তোমার খেলাগুলো এমনভাবে সাজিয়েছ যেন দেখে মনে হয় নকল করছো --"

"চুপ কর জালি মানিক", ঠাটিয়ে একটা চড় কষালো হুডিনি জগাই -- "তোকে এখনই এখানে গলার নলি কেটে ফেলে রেখে গেলে দুদিন বাদে যখন লোকে টের পাবে, তোর দেহ তখন পচে-গলে গেছে, শুয়োরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।"

"আমার নাম মানিক লাল সাধুখাঁ", ঠোঁট ফাটা রক্ত মুছতে মুছতে বলল মানিক -- "জালি মানিক নয়।"

"উফফ....ছ্যাছড়ার আবার আত্ম-সন্মান....জাঙ্গিয়ার আবার বুক-পকেট রে..." উঠে দাঁড়ালো হুডিনি -- একটা ইশারা করলো ওর স্যাঙাতদের। দূরে গিয়ে একটা বিড়ি ধরালো। একটা গান গাইছে ও।

পরের দশ মিনিট প্রচুর মার মারলো ওরা মানিককে। কখনো পিঠের হাড়ে , কখনো বা ঘাড়ে, কখনো বা পায়ে, পায়ের চেটোয়, সিন বোন্স-এ।

হাতের চেটোয় মোবাইলটা চেপে ধরে মানিক প্রচন্ড হাসলো। পাগলের হাসি -- মার খেতে খেতে হাসি। হেরে যাওয়ার হাসি, কষ্টের হাসি -- অবজ্ঞার হাসি। ব্যাথা -- খুব ব্যাথা। ব্যাথার এক অদ্ভুত মায়া -- ব্যাথা অসাড় করে দেয়। ব্যাথা ব্যাথাকে ভুলিয়ে দেয়। যেন বিষে বিষক্ষয়।

হাসতে হাসতে এক সময় জ্ঞান হারালো মানিক - রক্তে আর ঘামে সারা গা ভেসে যাচ্ছে।

ওর মোবাইল সারাক্ষণ নৃশংস jungle theory'র নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো।

***

তিনদিন অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকবার পরে থানায় গিয়ে ওই ভিডিওটা দেখানোয় খুব কাজ দিয়েছিলো। হুডিনি এমনিতেও খুব একটা প্রিয় পাত্র ছিল না পুলিশের চোখে -- দুবার হিউমান অর্গান ট্রাফিকিং নিয়ে জেলে গিয়ে মোটামুটি বেশ ভালোই নাম ছিল ওর, নতুন করে চেনাতে হয়নি আর।

আরো কিছুদিন বাড়িতে শুয়ে থাকবার পর, আবার ট্রেনে দেখা গেলো মানিককে। সেই পুরোনো বোতলে নতুন মদ ঢেলে।


এরপর কিন্তু অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো ওর সাথে।

খেলা দেখতে গিয়ে বারবার ভুল করতে লাগলো ও। খোরাকগুলো শুনে আর আগের মতন হাসি পায় না। খেলাগুলো আগের মতন অতটা চটকদার হয় না। লোকেরা তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ -- তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যেন ওরা ওদের পুরোনো খেলোয়াড়কে চিনতে পারছে না।

কিছুদিন এরকম চলার পর ও ভাবলো আচ্ছা যদি নতুন কিছু চেষ্টা করা যায়? এই যেমন...এই যেমন ধরো নতুন কিছু খেলা যদি নিয়ে আসি? নতুন আইটেম -- মানুষে নতুন জিনিস খুবই পছন্দ করে। আচ্ছা, যদি এমনই কিছু করা যায় -- আরো ভয়ের কিছু? যেমন নাইফ থ্রোয়িং? বা যেমন ধরো সাপ-খোপ নিয়ে খেলা দেখানো? বা আরও ভয়ের কিছু -- চলন্ত ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে লাফ মারা? ও আগেও এরকম অনেকবার করেছে -- অনেক আগে। সেই বিদ্যা আউড়ে নিতে আর কতক্ষণ লাগবে?

না -- এসব কিছুই করতে হয়নি।

একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো সেদিন ট্রেনে।

ট্রেনে একদিন উঠে জাগলিং দেখাচ্ছিল মানিক। এই খেলাটাও AC কাম্ড়াতেই ও দেখায় -- ঝাঁকুনি এড়াতে। হঠাৎ একজন প্যাসেঞ্জার বলে উঠলো -- আরে ভাই একটু আগেই তো খেলা দেখিয়ে গেলে -- আবার এসেছো?

অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকালো মানিক, খেলা থামিয়ে।

"একটু আগেই তো এলে-- জাগলিং করলে বেশ কিছুক্ষণ। একই জিনিস কি আর বারবার ভালো লাগে দেখতে?"

"মানিক-দা খেলা পাল্টাও, এখন কিন্তু আগের মতন সেইরকম আর হচ্ছে না", আরেকজন বলল দর্শকের দরবার থেকে।

"আরে এগুলো বাচ্ছারাও আজকাল দেখতে চায়না -- নতুন কিছু দেখাও ভাই", আরেকজন উপদেশ দিলো।

অবাক হয়ে মানিক আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।

একটু আগে খেলা দেখিয়ে গেলাম মানে? এখানে -- একটু আগে কেউ এসেছিলো খেলা দেখাতে - যাকে আমার মতন দেখতে?

ট্রেন থেকে নেমে টের পেলো ওর মাথাটা ঘুরছে।

আরও কেউ আছে -- যে খুবই নোংরাভাবে আমার সাথে খেলা করছে।

সে আমার ভালো চায় না।

***

না, না, ব্যাপারটা এখানেই থেমে যায়নি। আরও কয়েকবার এরকম শোনা গেছিলো। বারবার লোকের মুখে শোনা সেই এক নালিশ।

একটু আগেই তো এলে। একটু আগেই তো এই খেলাটাই দেখিয়ে গেলে।

অনেক ভেবেছে বসে বসে মানিক। কোনো সদুত্তর পায়নি। অনেকদিন চুপচাপ চাদর মুড়ি দিয়ে ট্রেনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বসেছিল - যদি হাতেনাতে ধরা যায়। যদি কাউকে দেখা যায়। যদি কিছু জানা যায়। না, কিছুই জানা যায়নি কোনোদিন।

যেন এক ছায়ামূর্তি ওকে ধাওয়া করে চলেছে। ও যা করবে -- সেটা আগের থেকে ঘটাচ্ছে।

অদ্ভুত এক premonition, তাই না?

***

না, না -- ভুল হচ্ছে কোথাও।

আমি? আমার মতন খেলা দেখায়? কে? হেঃ....লোকে পাগল হয়ে গেছে।

শহরে যদি আমার মতন কেউ খেলা দেখাতে পারে -- সেটা আমি নিজেই। আমি একক -- একমেবাদ্বিতীম। আমায় নকল করছে ? কার এতো সাধ্য ?

সেদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড ঘৃণা আর পরিহাস নিয়ে ও ট্রেনটাকে দেখলো হুড়মুড়িয়ে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে।

কোথাও ভুল হচ্ছে কোনো -- এবং এটার খুব শীঘ্রই নিরসন ঘটাবো আমি। এক অদম্য জেদ যেন চেপে বসলো ওর মজ্জায় মজ্জায়।

***

তবে হ্যাঁ -- উত্তর একদিন ও পেয়েছিলো। প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিদান।

ওই যে কি যেন বলে: Karma, প্রারব্ধ না কি যেন....

সেদিন স্টেশনে নামলো যখন তখন বেশ দেরি হয়ে গেছিলো। খুব ক্লান্ত। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিচ্ছে বেসিনে।

ঠিক সেই সময় কে যেন পাশের বেসিনটায় এসে দাঁড়ালো। তাড়াতাড়িতে আর দেখা হয়নি কে।

মুখ ধুয়ে আয়নায় রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে -- চোখ পড়লো পাশের আয়নায়। 

একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেও মুখ ধুচ্ছে।

তবে...সেটা আর কেউই নয় -- মানিক নিজে। ওরই জামা, ওরই প্যান্ট, ওরই মতন ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর -- মাথা ঘুরে মাথা ঘুরে পড়লো মানিক।

আর ঠিক তখনই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো ও।


৪"

"কি রে?", বুড়ো আবার প্রশ্নটা করলো -- "মনে রাখবি তো আমায়?"

মানিক সারা রাত কেঁদেছে। তাও যেন ওর চোখে জলের অভাব নেই।

"আমার যে আর বেশি সময় নেই রে", বুড়ো আবার কাশলো। এখন কাশলেই রক্ত উঠে আসে মুখে -- "আমার কথা রাখবি তো বাবা?"

মানিক মাথা নাড়লো। বুড়ো কাঁপা কাঁপা হাতে মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সস্নেহে -- "সব সময় মনে রাখবি তুই আসলে কি। যত বড়োই হোস না কেন জীবনে, সব সময় মনে রাখবি কোনোদিন না কোনোদিন, কোথাও না কোথাও থেকে তুই ও শুরু করেছিলি। কোনোদিন ও....কোনোদিন ও...অহংকার আনবি না", বুড়ো আবার কাশলো, হাঁপাতে হাঁপাতে -- "অহংকার আনলেই জানবি সব শেষ। মানুষকে ভালোবাসবি -- তোর এই বিদ্যা কিন্তু মানুষকে হাসানোর জন্য। অহংকার দেখানোর জন্য নয়", ঠান্ডা হাতটা রাখলো বুড়ো মানিকের হাতে -- "সব সময় শিখবি। সব সময় নতুন কিছু শেখার তাগিদে থাকবি। দেখবি অনেক উঁচুতে উঠতে পারবি। রাখবি...রাখবি তো আমার কথা?"

মানিক বুড়োর হাত টা নিয়ে চুমু খেলো।

"জানবি...এটাই তোর গুরু দক্ষিণা..."

ওর গলায় প্রচন্ড দলা পাকাচ্ছে -- বুক ফেটে যাচ্ছে -- মাথার ওপর একটা ছাত ছিল --ওর শেষ আশ্রয়।

সেটা ও আজ উড়ে যাচ্ছে। 

বুড়োর দেহ নিয়ে ওরা সবাই বেরোলো। কাঁধ দিয়েছিলো অনেকেই। মানিক দেয়নি। ও চুপচাপ ওদের সাথে হাঁটছিলো।

সবাই মাটি দিলো বুড়োকে। আসসালাম-আলায়কুম-ওয়ারামাতুল্লাহ।

মানিক এক মুঠো মাটি কুড়িয়ে নিয়েছিল। আজও সেটা তাবিজ বানিয়ে হাতে বেঁধে রেখেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস কোনোদিনই ছিল না ওর -- যা মানত, তো ওর সেই গুরুকেই।

ওস্তাদ রামজান আলী চৌধুরী। 

***

"তোর পুরোটাই ভুলে বোঝাই, সেটা জানিস?" ওস্তাদ একটা গদি-ওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন। পরনে সেই শেষ দিনের আলখাল্লা। খুব সুন্দর লাগছিলো দেখতে ওনাকে -- "যখন দেখলি জগাই কম ভাবে তোর পিছনে পড়েছে, তোরই উচিত ছিল রাস্তার থেকে নিজের থেকে সরে যাওয়া। তুই ইচ্ছা করলেই আরও বড় জাদুকর হতে পারতিস। বড় শো, বড় স্টেজ, বড় অডিয়েন্স, বড় জাদুর খেলা -- এগুলো তুই সহজেই নিজে আয়োজন করে বেরিয়ে যেতে পারতিস। জগাই হলো ছোট জাতের আত্মা -- ও কোনদিনই বড় হতে পারবে না। তোরই দরকার ছিল ওর রাস্তা থেকে সরে যাওয়া।"

"ওস্তাদ -- ও আমায় -- "

"মেরেছে? তুই তো ওরকম করার জন্য ওরকম ভাবেই ওকে ভড়কেছিস। তোকে বলিনি আমি -- দুর্জন লোকের থেকে দূরে থাকতে?"

"হ্যাঁ, বলেছেন।"

 "তোর ভয়ানক অহংকার এসেছিলো। সবকিছুতেই আমিই শ্রেষ্ট -- এটা যেন তোর এক মজ্জাগত বৈশিষ্ঠ। নতুন কিছু শেখারও তোর তাগিদ নেই। নতুন কিছু করার ও কোনো স্পৃহা হয়নি।" 

মাথা নিচু করে দাঁড়ালো মানিক।

"তাই আমার মনে হয়েছিল -- তোকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। আমার মনে হয়েছিল তোর ভিতর গড়ে ওঠা ওই অহংকারী রাক্ষসটাকে মারা উচিত। তোর মনে বেড়ে ওঠা ভয়ানক অভিমানের ঢেউ -- কেউ তোর থেকে বড় হতে পারে না -- মনে হলো, সেই অভিমানটা ভাঙা উচিত। এই কয়েকদিন আমি তুই সেজে খেলা দেখিয়ে সেটাই তোকে মনে করিয়ে দিলাম -- যে তোর ধারণা ভুল।"

"কিন্তু ওস্তাদ -- আপনি তো --"

"আমি তো -- কি?", রমজান আলী উঠে দাঁড়ালেন -- "মারা গেছি তো?", স্মিত হাসলেন বৃদ্ধ -- "সবচেয়ে বড় ম্যাজিক কি জানিস পৃথিবীতে? মানুষ বেঁচে থাকতে বোঝে না, যে সে মরণশীল, আর মারা গেলে মনেই হয় না -- সে কোনোদিন বেঁচে ছিল বলে", রমজান আলী ঝুঁকে মানিকের কপালে সস্নেহে হাত বোলালেন -- "মৃত্যু সেই প্রহেলিকা আমার ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। এখন যখন খুশি, যেখানে খুশি, ঘুরে, উড়ে বেড়াতে পারি। রূহ আমার আলাদিন, আর ইচ্ছা আমার উড়ন্ত কার্পেট। আদিগন্ত, নিখিল ব্রম্ভান্ড -- আমার বিচরণ ভূমি.... উড়তে উড়তে মনে হলো তোকে একটু দাওয়াই দেওয়া দরকার। কি করবো বল -- ছাত্র ভুল করলে, গুরুর কাজ হলো তাকে সংশোধন করা...."

***

ঘুমটা ভাঙলো কি যেন একটা আওয়াজে।

বেশ কিছু মুখ। ঝুঁকে পড়ে ওকে দেখছে -- "দাদা -- ও দাদা -- "

ও আসতে আসতে উঠে বসলো। স্টেশনের বাথরুম। ইশ -- কাল রাতে এসে সেই যে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলাম -- সেই থেকে পড়েই আছি?

আসতে আসতে প্যান্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বাথরুমের বাইরে এসে টের পেলো ও - হাতে বাঁধা তাবিজটা আর নেই।


**********************

দাঁতে দাঁত চিপে জেলের ঘানি টানতে টানতে জগাই ঠিকই করে রেখেছিলো প্ল্যানটা।

জেল থেকে বের হবার পরের দিনই চড়াও হলো ও মানিকের ঘরে। ও আর ওর পোষা নেকড়ের দল। মাঝরাত। বেধড়ক মার মারতে মারতে স্টেশনের কাছে নিয়ে এসে, গলায় ক্ষুর চালালো জগাই।

রক্ত। প্রচুর রক্ত। চাপতে গিয়ে রেল লাইনেই শুয়ে পড়লো মানিক -- "তুই....তুই...এটা কি...করলি..."

রক্তে লাগা ক্ষুরটা প্যান্টে মুছে, এক নোংরা হাসি হেসে, হাত নাড়তে চলে গেল জগাই।

মানিক কিছুক্ষণ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে শেষে হাল ছেড়ে দিল।

রাত হচ্ছে। ঝিঁঝি আর ট্রেনের আওয়াজের ভিড়ে দেখলো আলখাল্লা পরা এক দিব্ব্য-পুরুষকে – "Show must go on, my boy…."

***

হুডিনি জগাই আজ খুব খুশি।

আপদ বিদায় হয়েছে বেশ কিছু মাস। এখন খেলা দেখানোর ও হলো বেতাজ বাদশা। আসতে আসতে লোকে ওর খেলা দেখতে শুরু করেছে। হাসতে শুরু করেছে ওর কবিতায়, ফরমাস শুরু করেছে খেলা দেখানোর জন্য।

এ যেন নিজেকে নতুন করে পাওয়া।

আজ ও খুব খুশি - প্রায় হাজার তিনেক আদায় হয়েছে সারা দিনে। বেশ গরম হয়ে আছে প্যান্টের পকেট -- এরকম যদি রোজ হয়, তাহলে মার-দিয়া -কেল্লা !

হাঁটতে হাঁটতে বুরুজ পেরিয়ে মাঠের রাস্তা ধরলো ও। বেশ রাত হয়েছে। সামনেই পুজো - একটা কাছের কোন ক্লাব থেকে আবার বায়নাক্কাও এসেছে খেলা দেখানোর। এর পরে গরু-মরার খালের ব্রিজ। কোনো এক সময় নাকি গরু মরলে এখানে ফেলে আসতো লোকে। ওটা পেরিয়ে আর দশ মিনিট হাঁটলেই বাড়ি। দারু নিয়ে বসে একটা প্ল্যান বানাতে হবে -- কি, কি খেলা দেখানো যায় সেই বিষয়ে। না, না -- শুধু খেলা দেখানোই না -- বিশেষ নজর দিতে হবে উপস্থাপনার ওপর। পুরোটাই চলে দুনিয়ায় উপস্থাপনার ওপর।

ওই ক্যাবলা মানিকটা পর্যন্ত ভুলভাল খেলা দেখিয়ে মাত করতো সের্ফ ওর presentation-এর জন্য।

পকেটে হাত ঢোকালো। এহঃ -- বড্ড অন্ধকার।

কে...কে যেন দাঁড়িয়ে আছে না ওখানে?

টর্চটা মারতেই দেখতে পেলো ও।

খুব ভালো করে।

মানিক।

শেষদিনের সেই ফিকে রঙের জামা আর সাদা পাজামা।

"কি রে চিনতে পারছিস?"

থমকে দাঁড়িয়ে গেলো জগাই।

"এই দেখ...এই দেখ দাগটা এখনো আছে -- তোর চালানো ক্ষুরের দাগটা", গলাটা দেখালো মানিক -- "দেখ রক্ত আজ ও বেরোয় আমার। শুকোয়নি..."

"তুই.....তুই....তো....", হাত, পা কাঁপছে জগাইয়ের।

"আমি তো কি? মারা গেছিলাম?"

"জালি মানিক -- ", কথাটা কেন জানিনা মুখ ফসকেই বেরিয়ে এলো জগাইয়ের -- "তোকে...তোকে আমি নিজের...হাতে মেরেছিলাম..."

"আহঃ বলেছি না -- আমার নাম মানিক সাধুখাঁ..." এগিয়ে এলো মানিক। মরার পরও পিতৃদত্ত নামটার প্রতি মায়া যায়নি -- "ম্যাজিক দেখবি? সত্যিকারের ম্যাজিক?"

কুলকুলিয়ে ঘামছে জগাই। মোবাইলের ব্যাটারি ফিকে হয়ে আসছে।

"সব থেকে বড় ম্যাজিক", মানিক এগিয়ে এসে জগাইয়ের বুকে হাত রাখলো। মানিকের হিম শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো ও -- "মরার পর ও একভাবে বেঁচে থাকা যায়, জানিস? আমি আজ ও খুব ভালো আছি -- এখানে সবাইকে পেয়েছি, যাদেরকে কোনো একসময় হারিয়েছিলাম। সত্যিই এক অদ্ভুত ম্যাজিক রে। আমরা লোকে মারা গেলে কেঁদে কেঁদে মরি -- আর এখানে এসে দেখি: কৈ, না তো ! সবকিছুই সেই আগেরই মতন আছে, যেমন ছিল। দেখবি, দেখবি?"

"না...না...", কথা আর গলা দিয়ে বেরোচ্ছিল না জগাইয়ের।

এক ঠেলা -- জগাইয়ের দেহটা অনেক নিচে খালের জলে পড়লো। কিলবিল করে নড়ে উঠলো এক ঝাঁক মশা, কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেলো ঝিঁঝিদের কোরাস।

হাঁ করে চেয়ে রইলো আশ্বিন মাসের তারারা -- সভা হলো নিস্তব্ধ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror