হাটের কথা
হাটের কথা


হাট বসেছে রবিবারে। জগৎপুরে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। এখনতো আর আগের যুগ নেই। আগে মাসে কি সপ্তাহে একবার হাট বসত। সাত গাঁয়ের লোক উজিয়ে এসে জড়ো হতো সেথায়। সে এক ভারি হইহই রইরই ব্যপার। ভিড়ের মাঝে হামেশাই কারুর গরু কি ছেলে হারিয়ে যেতো। আবার অনেক বাপই সেই হাটে খুঁজে পেতেন বচ্ছরকার আগের হারিয়ে যাওয়া ছেলে কিংবা ছেলের মত কাউকে। বিয়ের ঘটকালি থেকে চুরিবিদ্যার হাতেখড়ি -সবেতেই হাট ছিল এককথায় তীর্থক্ষেত্র।
সেই দিন গত হয়েছে বহুকাল। নিধিরামের মাটির কলসি, সনাতনের সাড়ে তিন প্যাঁচের জিলিপি, জামাইয়ের দোকানের গরম গরম বোমার সাইজের আলুর চপ আর লাল মুড়ি থেকে শুরু করে মায় করিমের ছিপ -বড়শি- চাহিদা কমেছে এই সবেরই। এখনতো হাট বসে রোজই। তাই নিত্যিদিনের কেজো জিনিসের রোজকার চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে। তাছাড়া এখনকার দিনে আর তেমন দরিয়া মনের মানুষই বা মেলে কজন। বেশির ভাগের নজরই তো খোঁটা। খাঁটি জিনিসের কদর করার লোক এখন বলতে গেলে মাত্তর হাতে গোনা দু-চারজনই বেঁচে বর্তে আছে । এই যেমন অলিনগরের তাজ মিঞা বা গোকুলপুরের রত্নাকর বাবু, হরিশ বাবু বা চাঁদপুরের ঘোষাল ভাইয়েরা। এদের মত শাঁসালো খদ্দেরের জন্যই হাটে এখনো খাঁটি তালপাটালী, পেল্লাই ইলিশ , আড়ে বহরে প্রমাণ মাপের শীতলপাটি বা শালকাঠের ছড়ি বিক্রির সাহস করেন কিছু কিছু পুরনো দোকানদারেরা। পড়তি দিনে হাটের মIন-সম্মান যেটুকু আছে তা এই এনাদের মতো কয়েকঘর সরেস খরিদ্দারের কৃপাতেই বেঁচে-বর্তে আছে। তা না হলে বেশিরভাগ লোকই এখন সস্তায় চমক খোঁজে। লাভ-লোকসানের হিসেবে কষতে কষতে চটকদার ঝুটা জিনিসে ঝুলি ভরিয়ে বাড়ি ফেরে।
এই মওকায় সুযোগ বুঝে হাটে পসার করেছে নন্দর পোঁ র মত কিছু ফেরেব্বাজ দোকানদার। তার দোকানে দু-চার পয়সায় বাহারি চিনে লণ্ঠন থেকে শুরু করে বাতের মলম, গন্ধ সাবান, ফল কাঁটার হাত মেশিন এমনকি বৌয়ের চাহিদামতো হাল ফ্যাশনের যাকে বলে ডিজাইনার গিল্টি করা গয়না -পাওয়া যায় সবই। জিনিসগুলো তেমন টেকসই না হলেও গৃহশান্তি বজায় রাখতে আর বাড়ির মেয়েদের মন ভোলাতে এমন জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। সেকথা এখন সাত গাঁয়ের লোক একবাক্যে স্বীকার করে। জগৎপুরের হাটে এমন বাহারি জিনিসের দোকান আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
তবে সময়তো সবসময় একরকম যায় না। দিন কয়েক হলো চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নন্দর পোঁর এমন চওড়া তেল চকচকে সুখী কপালেও। এমনিতে তো শত্তুরের অভাব নেই। তার মধ্যে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে হাটের শেষপ্রান্তের নতুন দোকানটা। শেষ মাথায় হলে কি হবে সেই দোকানই এখন কিনা যাকে বলে হাটের মধ্যমনি। চুম্বকের মত লোক টানছে দোকানখানা । সকাল-দুপুর উপচে পরছে ভিড়। ভিড়ের ঠেলায় ইদানিং মাছি অব্দি গলতে পারে না। আর হাটের বাকি দোকান বলতে গেলে শুধুই বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছে ।নতুন দোকানের নামখানাও বেশ কায়দার -'জবর খবর'। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। খাবার নয় খবরেরই দোকান বটে কিন্তু খাবারের দোকানের চেয়েও ইদানিং তার চাহিদা অনেক বেশি।
নন্দর পোঁ প্রথম প্রথম ব্যাপারখানা দুর থেকে দেখেই মাপার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো বিপদের শুঁটকো গন্ধটা নাকের ওপর কেমন যেন তত বেশি করে চেঁপে বসতে লাগলো । কপালে দুশ্চিন্তার রেখাটা ক্রমেই বাঁক নিতে নিতে প্রায় ধনুকের মত লম্বা হতে লাগলো। একসময় চিন্তার চোটে আহার-নিদ্রা প্রায় মাথায় ওঠার জোগাড় হল তার। শেষমেশ আর হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারলো না । একদিন সবটা তলিয়ে দেখার জন্য পাঠালো তার স্যাঙাৎ হারুকে।
হারু বেশ চটপটে, কাজের ছেলে। দিনের বেশির ভাগ সময় নন্দর পোঁর দোকানটা বলতে গেলে প্রায় একার হাতেই সামলায়। হারু আগে মালিকের কথা মতো ভালো করে সময় নিয়ে জরিপ করলো সব কিছু। তারপর ফিরে এসে যা খবর দিলো তাতে পিলে চমকে উঠলো নন্দর পোঁর। যেটুকু জানা গেলো তা থেকে ঝেড়েপুছে ব্যাপারটা খানিক এরকম দাঁড়ালো - শহর থেকে সাহেবদের মতো সং সেজে চারজন 'ছ্যামরা-ছ্যামরি' এসেছে এই জগৎপুরের হাটে। রূপ দেখে মনে হয় বুঝি 'সগ্যের দ্যাবতা'। পালা করে তারাই চালায় দোকানখানা। সেখানে তারা সারাদিন বকমবকম করে। মাঝে মধ্যেই হেডমাস্টার মশাইয়ের মতো ইংরেজি বুলি আওড়ায়। বেশিরভাগ কথাই হারুর মাথার দুই-ক্রোশ দূর দিয়ে চিল বেগে পালিয়ে যায় কিন্তু শুনলে বেশ 'গেরামভির বিষয়' বলে মনে হয় তার। পন্ডিত মশাইয়ের কথা শুনলেও অনেক কাল আগে হারুর এইরকমই কিছু একটা মনে হতো, মাথার ভেতর 'পেজ্জাপতি' ফুরফুর করতো। তা যাই হোক। হারু তাতে দমে যায়নি বরং ভিড়ের চাপ গায়ে মেখে পৌঁছে গেছিলো একদম দোকানের সামনে।
দোকানটা কিন্তু হেব্বি সাজানো, অদ্ভুত সব যন্ত্র রাখা ভেতরে। মেঝেতে যেন মুখ দেখা যায়। এতো আলো চারপাশে যে একটা আলপিনও হারানোর যো নেই। একটা ছোট ঘর আছে দোকানের ভেতর। তার নাম ' এস্টুডি (studio) না কি যেন। সেখানে টিকিট কেটে ঢুকে পছন্দমাফিক খবরের অর্ডার দিতে হয়। ঠিক যেমন মতিচাচার হোটেলে লোকে মেনু দেখে খাবার অর্ডার করে, তেমনই। লোকের মানে খরিদ্দারের মন বুঝে ফরমায়েশ সমঝে লিস্টে থাকা একই খবর একেকজনকে একেক ভাবে শোনায় ওই চারজন দোকানি- কোনোটা বেশ মসলা দিয়ে, কোনোটা একেবারে টাটকা ( তার নাম নাকি 'লাইফডাটা' {live update} ,দামও বেশি একটু ), কোনোটা নাটুকে ভঙ্গিতে আবার কোনোটা বেশ ব্যঙ্গ করে। তবে হারুর ট্যাঁকে কড়ি না থাকায় একবারের বেশি 'এস্টুডি'তে ঢুকতে পারে নি। ফলে সব খাবার থুড়ি খবর নিজের চোখে চেখে দেখতে পারেনি। বাকিটা শুনেছে দোকান-ফেরত খরিদ্দারদের মুখে।
হারু খোঁজ নিয়ে জেনেছে সবথেকে দামি খবরের নাম নাকি - 'বেরেকিং নিউজ (Breaking News)'। ধারে -ভারে যাকে বলে দিনের সেরা খবর। কয়েকজন হুজুগে আর পয়সাওয়ালা খদ্দের ছাড়া ওই দেবভোগ্য জিনিস পাতে তোলার মতো রেস্ত বা সাহস বেশিরভাগ লোকেরই নেই। তেমনি একজন প্রতক্ষ্যদর্শী বাবুইপাড়ার কমলাক্ষ বাবু। ভারি সৌখিন মানুষ তিনি আর সাধ্যেরও কোনো অভাব নেই। তাঁর মুখেই শুনেছে ওই খবরের সাথে আবার সিনেমার মতো ছবিও নাকি দেখায় বারবার করে। মতিচাচার দোকানের কষা পাঁঠার মাংসের মতো ওই খবরের স্বাদটাও নাকি সারাদিন মনে লেগে থাকে। বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে সময় ধরে উপভোগ করা যায় সবটা। প্রতি দিন একটা করে অমন খবর দেখায় আর শোনায়।
তবে এখানেই শেষ নয়। রঙ্গ দেখা বাকি আছে আরো। আসল খেলা জমে দিনের শেষে।ওই সময় ওই দোকানে প্রতিদিন নিয়ম করে একটা করে টকশো (talk-show) হয়। হারু প্রথমে নাম শুনে আর লোকের ব্যাপক ভিড় দেখে ভেবেছিলো হয়তো ঐসময় কিছু টক আচার, টক হজমি বা নিদেনপক্ষে হয়তো ল্যাবেঞ্চুস খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে কিন্তু পরে নিজের চোখে দেখে বুঝে যাকে বলে ব্যোমকে গেছে এক্কেবারে। ঐসময় নাকি আশ-পাশের সাত-দশ গাঁয়ের মোড়ল-মুরুব্বিদের নিয়ে নানান বিষয়ে গল্প-ঝগড়া-তর্কাতর্কি-চুলোচুলি হয়, ঠিক যেন কুস্তির আখড়া। প্রতিদিনই তাদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধানো হয় ।গাঁয়ের মাতব্বরেরা লোকলজ্জা ভুলে ইস্কুলের খোকাদের মতো লড়াই-ঝগড়া করে,লোকে তালি দেয় আর ওই সং সাজা একজন দোকানি (লোকে বলছিলো ওদের সবার নাকি নাম ' রিপুদা' [reporter]) রিং-ম্যাস্টরের মতো সামলে রাখে তাদের। আর তখন সেই বিনা পয়সার সার্কাস দেখতে দোকানের বাইরে লোকের চরম ভিড় লেগে যায়। এইতো গেলো হপ্তাতেই ভিড় সামলাতে আবার পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। গতকালই এই ভিড়ের ঠেলায় বহুদিন পর আবার হাটে দক্ষিণদাঁড়ি গ্রামের সিতেশ সামন্তর সেজো মেয়ে আর উত্তরপাড়ার নীতিশ গড়াইয়ের ছোট ছেলে হাত ফস্কে হারিয়ে গেছে।এখনো অব্দি পাওয়া যায় নি কাউকে। পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।
সব শুনে নন্দর পোঁ আঁচ করলো গতিক সুবিধের নয়। সামনে দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। তার কারবার তো লাটে উঠেইছে , হাটখানাও আর বেশিদিন টিকলে হয়। বেলা গড়িয়ে এসেছে। দূর থেকে চেয়ে দেখলো নতুন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে ভিড় ভাঙছে। নতুন কোনো সার্কাস দেখে লোকজন আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরেছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে নন্দর পোঁ হাঁক দিলো-'বলি ও মোড়লমশাই ...শুনছেন? আপনার নাতির জন্য একটা ভালো খেলনা এনেছি...ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন " . মোড়লমশাই যেন শুনেও শুনতে পেলেন না । বেশ উত্তেজিত ভাবে পাড়ার উঠতি নেতা বিনয় বাবুর সাথে কিসব বলতে বলতে দোকানের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নন্দর পোঁ অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলো খানিক্ষন। তারপর দোকানের দিকে ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎই চোখাচোখি হয়ে গেলো শ্যামলবাবুর সাথে। তার দোকানের বহুদিনের পুরোনো খদ্দের শ্যামলবাবু। তাকে ধরে নন্দর পোঁ সাত তাড়াতাড়ি জিজ্ঞ্যেস করলো - 'ব্যপার কি বলুন তো মশায়। নতুন দোকান পেয়ে আমাদের যে ভুলেই গেলেন একেবারে '। স্টুডিও ফেরতা শ্যামল বাবুর মন তখন বেশ ফুরফুরে। অনেকদিন পর আজকের টকশোটা বেশ জমেছিলো। সবার সামনে আচ্ছা জব্দ হয়েছে জগৎপুরের মোড়লমশাই। সব ফুটানিতে আজ জল ঢেলে দিয়েছে শহরের ওই রিপোর্টার ছোকরা। বেশ মেজাজের সঙ্গে শ্যামল বাবু বললেন - 'ওই দোকানে যে মধু আছে গো মধু । এ সব তোমাদের কম্মো নয়। তোমাদের বুঝতে হবে লোকে কি চায়, ঠিক যেমন করে ওরা বুঝেছে । ওদের ওই দোকানের সামনে গেলে বৌয়ের খোঁটা , ছেলে-মেয়ের আবদার, চাকরির যন্ত্রনা - এই সব নিমেষের মধ্যে এক্কেবারে মাথা থেকে ফুরুৎ হয়ে যায়। চোখের পলকে অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে দেয় ওরা, বুঝলে নন্দর পোঁ। তাছাড়া দেশের ভালো-দশের ভালো ওদের মতো করে আগে কেই বা চেয়েছে বলো। সবুর করো কিছুদিন-দেখবে ছোকরারা কেমন ভোল পাল্টে দিয়েছে সব কিছুর।' শুকনো হাসি হেসে বললো নন্দর পোঁ -'তাই যেন হয় গো কত্তা।'
মুখ ফুটে আর কিছু সেদিন না বললেও নন্দর পোঁর খালি মনে হতে লাগলো হাটসুদ্ধু লোক সবাই কেমন যেন আফিম খেয়ে আছে। সক্কলে যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মত নাচছে কোনো অদৃশ্য শক্তির আঙ্গুলের ইশারায়। কেউ যেনো কিচ্ছুটি শুনতে পাচ্ছে না, দেখতেও পাচ্ছে না কেমন করে মায়ার জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে একদল মিথ্যের বেসাতি করা মানুষ। সক্কলে যেনো সমস্ত কান্ডি জ্ঞান বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে, এমনকি কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে । হঠাতই এই সময় মনে পড়ে গেলো তার রুগ্ন মাকে চিকিৎসা করার সময় বলা যদুডাক্তারের কথাগুলো - 'মধুতে শর্করা থাকে রে বিশে। অধিক শর্করায় স্বাস্থ্য নাশ। বেশি করে তিতা খাওয়াতে হবে রে তোর মাকে, বুঝলি!' আজ এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে তারও মনে হলো এই হাটে আসা মানুষগুলোর নেশা কাটাতে নতুন কোনো প্রতিষেধক প্রয়োজন । নাহলে এই মধুমেহ রোগের কবল থেকে বাঁচানো যাবে না কাউকে।