আবার দীর্ঘ নয় বছর পর গ্রামের মাটিতে পা রাখলাম। কলকাতায় নিজের স্কুল, কোচিং ক্লাস ইত্যাদির ঝক্কি সামলাতেই প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত....সেখানে এতদিন গ্রামের ভিটেবাড়ির কথা যেন একরকম ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু এইবছর দাদুর আকস্মিক প্রয়াণের কারণে কোনওমতে ছুটি জোগাড় করে আসতেই হল।
দাদুর শেষকৃত্য সুষ্ঠুভাবে সমাধা হয়ে গেছে। আমরা শ্রাদ্ধ পর্যন্ত গ্রামেই থাকব, সুতরাং এখন হাতে দিন দশেক মতো সময় একদম খালি। একদিন রাতে নৈশভোজ সেরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসে গল্প করছিলাম। কারেন্ট ছিল না; বাইরে ঝড়ের সম্ভাবনাও খুব প্রবল। বেশ একটা ভৌতিক গল্পের আসর জমে গেছিল। যে যার নিজের-নিজের জীবনের ভৌতিক অভিজ্ঞতাগুলো রং চড়িয়ে বলতে ব্যস্ত। তার মধ্যে ফোড়ন কেটে বসল অনি দা। আমার মাসতুতো দাদা অনির্বাণ।
- "আচ্ছা এইখানে....মানে এই গ্রামে....কোনও ভুতুড়ে জায়গা-টায়গা আছে ঘুরে দেখার মতো?"
- "আছে তো দাদাবাবু," আমাদের বাড়ির বহুদিনের পুরনো কাজের লোক রতন দা চোখ গোল-গোল করে বলল, "ওই যে দত্তদের রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে যে বড় ইঁদারাটা আছে, ওর সঙ্গে নাকি অনেক কালো ইতিহাস জড়িয়ে আছে গো। এত বছরে কত অলৌকিক কাণ্ডই না ঘটেছে ওই কুয়োটা কে ঘিরে!"
রতন দা হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেশো হঠাৎ চোখ রাঙিয়ে একটা কড়া ধমক দিতেই সে মুখ কাঁচুমাচু করে চুপ মেরে গেল।
- "আহ্ বাবা! রতন দা কে থামালে কেন?" অনি দা অস্থির হয়ে উঠল, "কী বলছিলে রতন দা? কোথায় আছে এই কুয়ো?"
- "অনি দা ঠিকই বলেছে মেশো," আমিও আগুনে খানিকটা ঘি ঢাললাম, "আজ রতন দা ওই কুয়োর গল্পটাই বলুক।"
কিন্তু রতন দা দেখলাম মেশোর ভয়ে গুটিসুটি মেরে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। বেগতিক দেখে অগত্যা মেশো নিজেই মুখ খুললেন।
- "সত্যিই এই কুয়োর সঙ্গে একটা কালো ইতিহাস জড়িয়ে আছে রে দীপু। তোরা তো জানিস, দত্ত'রা ছিল এই অঞ্চলের ডাকসাইটে জমিদার। ওই পরিবারের নিবারণ দত্ত একজন অতীব প্রজা-নিপীড়ক শাসক ছিলেন। যে সব গরীব প্রজারা অর্থের অভাবে জমিদারের কাছে মাসে-মাসে খাজনার টাকা জমা দিতে পারত না, তাদের উপর চলত লেঠেলদের অকথ্য অত্যাচার। একবার এই অঞ্চলে চরম দুর্ভিক্ষ নামে। অসংখ্য দরিদ্র মানুষ সে বছর অনাহারে প্রাণ হারিয়েছিল। নির্ধন প্রজাদের কাছে আনাজ কেনারই পয়সা নেই....সে আবার সরকারি তহবিলে খাজনার টাকা জমা দেবে কোত্থেকে? কিন্তু এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যেও ওই অর্থলোলুপ অত্যাচারী জমিদার নিবারণ দত্ত'র মন গলেনি। দিবারাত্রি চলেছে কল্পনাতীত অত্যাচার। দীর্ঘদিনের অনাহারী কঙ্কালসার দেহে ওই আসুরিক চাবুকপেটা আর নারকীয় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বহু মানুষ বেঘোরে মারা পড়েছিল। শোনা যায়, সে বছর নাকি এই গ্রামে মড়ক লেগেছিল। জমিদারের আদেশে পেয়াদারা সব মৃতদেহগুলি স্তূপীকৃত করে এনে বাগানের পাশের বড় কুয়োতে ফেলে মুখটা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর বহুদিন ধরে এর মুখ বন্ধই রয়েছে। গ্রামের লোকে সেই অভিশপ্ত কুয়োর নাম দিয়েছে:- মৃত্যুকূপ।"
****************
রাতে তখন সবেমাত্র শুয়েছি। হঠাৎ মনে হল কেউ একখানা বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত দিয়ে আমার পা'দুটো ধরে টানছে। গোড়ালিতে একটা হ্যাঁচকা টান পড়তেই বিছানায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। দেখি অনি দা; আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
- "কী যে করো দাদা!" খানিকটা রাগত গলায় বললাম, "এত রাতে আমার পা ধরে টানাহ্যাঁচড়া করছ কেন?"
- "তুই এখানে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছিস দীপু? এদিকে আমার যে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না।"
- "কেন? কী হল আবার?"
- "আরে যখন থেকে ওই মৃত্যুকূপের গল্পটা শুনেছি, তখন থেকে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিনা। মনটা ভীষণ উশখুশ করছে। চল না দীপু, একবার চট করে গিয়ে কুয়োটা স্বচক্ষে দেখে আসি। তুই আর আমি....ব্যাস।"
- "পাগল নাকি?" আমি লাফিয়ে উঠলাম, "বাবা কিংবা মেশো জানতে পারলে আমাদের ওই কুয়োর ভিতরেই জ্যান্ত পুঁতে দেবে। অনেক রাত হয়েছে। এখন এইসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে দূর করে ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।"
- "এইতো যাব আর আসব, কেউ টেরও পাবে না। চট করে দেখেই চলে আসব। একটি বার আয় না ভাই।"
- "উফ্....আজব আব্দার তো! মনে হয় একটু পরেই বাইরে ঝড় উঠবে। তাছাড়া আমি তো এটাও জানিনা যে ওই কুয়োটা কোথায়। কীভাবে যাব?"
- "চিন্তা নেই। শুনলি না রতন দা কী বলল? জায়গাটা দত্তদের বাসভবনের পশ্চিম দিকে। আমি ওই রাজবাড়িটা চিনি, মাত্র দশ মিনিটের পায়ে হাঁটা রাস্তা। ওঠ না....তাড়াতাড়ি ওঠ।"
শেষমেশ অনি দা'র পীড়াপীড়িতে নিমরাজি হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। খুব সন্তর্পণে পা টিপে-টিপে বাড়ি থেকে বেরোতে হল। বাইরেটা একেবারে নিশ্ছিদ্র ঘুটঘুটে অন্ধকার। কারেন্ট এখনও আসেনি। আকাশে দিগন্তজোড়া কালো মেঘ আর ঘন-ঘন বিদ্যুতের ঝলকানি ঝড়ের অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে। অনি দা টর্চ নিয়ে আগে-আগে হাঁটছিল। ভূতের ভয় ততটা না থাকলেও, এই নিশুতি রাতে গ্রামের মেঠো পথে সাপখোপের ভয় বিলক্ষণ আছে। খুব সন্তর্পণে ঘাসের উপর পা রেখে হাঁটছি। থেকে-থেকে অবাধ্য বাতাসের দমকা আছড়ে পড়ছিল গায়ে; বারবার ভুলিয়ে দিচ্ছিল আমাদের চলার পথ। মনে-মনে নিজেকেই গাল পাড়তে ইচ্ছে করছিল। কেন যে দাদার অহেতুক হুজুগে তাল মেলাতে গেলাম! অনি দা বরাবরই আমার চেয়ে অনেক বেশি ডাকাবুকো এবং সাহসী। তার হিড়িকে পাল্লা দিয়ে মিছে বাহাদুরি না দেখালেই ভাল হতো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রাজবাড়ির বিশাল ফটকের সামনে এসে পড়লাম। লোহার আকাশছোঁয়া সিংহদুয়ারে একটা আদ্যিকালের মরচে ধরা তালা ঝুলছে। গরাদের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, বিশাল অট্টালিকা সমান রাজবাড়িটা অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে দৈত্যের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সেখান থেকে পশ্চিম দিকে কয়েক পা এগোতেই দেখা পেলাম সেই কুখ্যাত মৃত্যুকূপের। অবশ্য এখন তার যা হাল; ভাল করে না দেখলে রাতের আঁধারে আলাদা করে চিনতে পারাই মুশকিল। ঘন ঝোপজঙ্গল আগাছায় ঘেরা পাথরের একটা বৃহদাকার ইঁদারা দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে পরিত্যক্ত পড়ে রয়েছে। কুয়োর হাত দুয়েক উঁচু পাঁচিলটার উপর শ্যাঁওলার পুরু আস্তরণ। একটা ভারী চৌকো পাথর চাপিয়ে কুয়োর মুখটা বন্ধ করা আছে। কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদের আলোয় পুরো জায়গাটা কেমন এক অদ্ভুতুড়ে আলো-আঁধারিতে ভরে উঠেছে।
- "দেখো, এই তবে তোমাদের সেই কুখ্যাত মৃত্যুকূপ!" খানিকটা ব্যঙ্গের সুরে বললাম, "ভেবেছিলাম কী না কী ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা দেখব....শেষে কি না এই? চলো এবার ফিরে যাই। বাড়ির কেউ ঘুণাক্ষরেও যদি এইসব জানতে পারে, তাহলে আমাদের কপালে কিন্তু অশেষ দুর্ভোগ আছে।"
- "ফিরে যাই মানে? আরে পাথরটা সরিয়ে ভিতরে দেখবি না? আসল ভূত তো মৃত্যুকূপের ভিতরেই আছে রে!"
- "বাজে কথা বোলো না!" ঝাঁঝিয়ে উঠলাম আমি, "এই কুয়োর মুখ এত বছর ধরে বন্ধ....ভগবান জানে ভিতরে কত রকমের সাপখোপ বা বিষাক্ত পোকামাকড় নিজেদের বাসা বেঁধেছে। তাছাড়া মৃত্যুকূপের এই গল্পটা কম করে দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো। তোমার কী মনে হয়, কুয়োর জলে লাশগুলো এখনও মাছের মতো ঘাই মেরে বেড়াচ্ছে? কবেই যে এই কুয়ো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে কে জানে! আর বাড়াবাড়ি কোরো না, চলে এসো।"
- "এত কাছে এসেও এই সুযোগটা হাতছাড়া করবি দীপু?" অনি দা নাছোড়বান্দা, "ষোলো বছরের তরতাজা জোয়ান ছেলে তুই, এত ভয়ডর তোর সাজে না। আয় না, আমার সঙ্গে আয়। আমি আছি তো....ভয় কীসের?"
দাদা একরকম হিড়হিড় করে টানতে-টানতেই আমাকে কুয়োর কাছে নিয়ে এল। দুজনে মিলে অনেক কসরৎ করে কুয়োর উপরের ভারী পাথরটা সরিয়ে ফেললাম। ভিতর থেকে বহু পুরনো একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারছে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে টর্চটা দাদার দিকে এগিয়ে দিলাম।
- "তোমারই তো বেশি কৌতুহল। এই নাও, আগে তুমিই কুয়োর মধ্যে আলো ফেলে দেখো....ভিতরে কিছু মণিমাণিক্য খুঁজে পাও কি না।"
অনি দা ঝুঁকে পড়ে ভিতরে টর্চ ফেলেই চিৎকার করে উঠল।
- "এই দীপু! তুই বলেছিলি না কুয়োটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে? না রে! ভিতরে এখনও কাকচক্ষু জল টলমল করছে। আয় আয়! নিজের চোখেই দেখে যা।"
বলে কী অনি দা! আমি অবাক হয়ে কুয়োর কাছে ছুটে গেলাম। টর্চটা নিয়ে পাঁচিল ধরে নিচে ঝুঁকে দেখি, ও মা তাই তো! কুয়োটা জলে পুরো টইটম্বুর, একদম পরিষ্কার স্বচ্ছ জল। অথৈ গভীর জলরাশির ভিতর থেকে এক অদ্ভুত গাঢ় নীলচে আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। স্তিমিত চাঁদের জোছনা কুয়োর জলে যেন এক বিচিত্র মায়াবী আলপনা এঁকে চলেছে। রূপালী জলের বুকে ছোট-ছোট তরঙ্গগুলো সেই আলপনা কে থেকে-থেকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
কতক্ষণ ওইভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কুয়োর ভিতর তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। অনি দা'র ডাকে আমার চমক ভাঙল।
- "কী রে দীপু, কেমন দেখলি?"
- "খুবই অদ্ভুত। ভাবতেই পারিনি এতদিন পরেও এই মৃত্যুকূপ নিজের বুকে জলের এত বিশাল ভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছে। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার।"
- "এর রহস্য জানতে গেলে তোকে ভিতরে নেমে তলিয়ে দেখতে হবে," দাদার ঠোঁটের কোণে ঝলসে উঠল একটুকরো শয়তানি হাসি, "এতই যখন পছন্দ হয়েছে, তখন বাকি জীবনটা এই জলের ভিতরেই কাটা।"
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাদা আমার পিঠে সজোরে এক ধাক্কা মারল। টাল সামলাতে পারলাম না....কুয়োর পাঁচিল ডিঙিয়ে সোজা গিয়ে পড়লাম তিরিশ ফুট নিচে গভীর জলের মধ্যে। 'ঝপাং' করে বিরাট একটা শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। সাঁতার জানিনা, কিছুতেই নিজের শরীরটা ভাসিয়ে রাখতে পারছি না। জলে হাবুডুবু খাচ্ছি আর প্রাণপণে হাত-পা চালাচ্ছি। কিন্তু যতই ছটফট করি, ততই যেন শরীরটা জলের গভীরে তলিয়ে যায়।
এতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করিনি, তবে এইবার মনে হল যেন কুয়োর ভিতরে জলের সাথে আমার বিফল সংগ্রামের 'ছপ ছপ' শব্দটা ছাড়া আরও একটা শব্দের সমান্তরাল কিন্তু পৃথক অস্তিত্ব আছে। ঠিক যেন বেশকিছু মানুষের করুণ আর্ত চিৎকারের সমবেত প্রতিধ্বনি কানে আসছে, ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট! আর সেই কোলাহলের মধ্যে কেউ একজন অত্যন্ত নির্দয় ভাবে ওদের গায়ে সপাটে চাবুকের আঘাত করে যাচ্ছে। একটু-একটু করে আওয়াজগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। কেউ চেঁচাচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ আবার ব্যথার চোটে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। তবু সেই নির্মম চাবুকপেটা এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না। তার মাঝে কানে আসছে এক দৃঢ় পুরুষ কণ্ঠের জলদগম্ভীর অনুরণন:-
"মার....আরও মার! মেরে পিঠের ছালচামড়া তুলে দে! জমিদার নিবারণ দত্তের সঙ্গে চালাকি করার মজাটা এরা এবার হাড়ে-হাড়ে টের পাবে।"
ধীরে-ধীরে সেই শব্দগুলো একসময় হালকা হয়ে মিলিয়ে গেল। রাতের ভুতুড়ে নিঃস্তব্ধতা পুনরায় গ্রাস করল নিদ্রামগ্ন পৃথিবী কে। আর লড়াই করতে পারছি না। দম আটকে আসছে। বেশ কয়েকবার তারস্বরে অনি দা'র নাম ধরে ডাকলাম; কেউ সাড়া দিল না। বেশ বুঝতে পারছি, আমার নাক-মুখ দিয়ে ফুসফুসে হড়হড় করে জল ঢুকছে। একটু-একটু করে চেতনা লোপ পাচ্ছে। জলে খাবি খেতে খেতে একসময় হাত-পা ক্রমেই অসাড় হয়ে এল। নিঃশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
বাঁচার শেষ আশাটুকুও ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল....কুয়োর ঠিক উপরের উন্মুক্ত আকাশে যেন চাঁদের আলো হঠাৎ এক জায়গায় জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। তার থেকে এক জ্যোতির্ময় মূর্তি একটু-একটু করে আকার নিচ্ছে। একসময় ওই সাদা ধোঁয়া ধারণ করল এক দীর্ঘাঙ্গী মানবাকৃতি। সেই আলোকময় পুরুষ তার বায়বীয় একখানা হাত আমার দিকে প্রসারিত করে দিল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম সেই ধূম্রগঠিত হাতটি। কী চিরন্তন শান্তি মিশে ছিল ওই স্পর্শে....সারা শরীর যেন এক লহমায় জুড়িয়ে গেল! ঘোরের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও বেশ টের পাচ্ছি, কুয়োর অতল গর্ভে একদল ছায়াশরীর প্রচণ্ড কোলাহল জুড়ে দিয়েছে। হাত থেকে শিকার ফসকে যাচ্ছে, তাই বারম্বার তারা আমার পা'দুটো ধরে নিচে টানার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সেই সব অপদেবতাদের শক্তি কে উপেক্ষা করে কোনও এক দৈবী সত্তা যেন একটু-একটু করে আমাকে উপরে টেনে তুলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করলাম, আমি এখন আর কুয়োর ভিতরে নেই। বাইরে উঠে এসেছি। নরম ঘাসে আমাকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিল সেই দেবদূত। একবারের জন্য চোখটা কোনওমতে খুলে নিজের ত্রাণকর্তার মুখপানে তাকালাম। কিন্তু....কিন্তু এই মুখটা যে আমার বড়ই চেনা! দাদু....তুমি?
****************
কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল জানিনা। আস্তে-আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। একি! আমি তো এখন নিজের ঘরেই শুয়ে আছি। জানালা দিয়ে ভোরের আলোর সঙ্গে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসছে। আমাকে ঘিরে সকলে চিন্তিত মুখে বসে রয়েছে। ডাক্তার বাবু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-
- "যাক, ছেলেটার জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। একটু চোখে-চোখে রাখবেন। ওষুধপত্র সব লিখে দিয়েছি, কোনও দরকার পড়লে খবর পাঠাবেন। আমি তাহলে এবার আসি।"
বাবা ডাক্তার বাবুকে এগিয়ে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। থেকে গেল শুধু মেশো, অনি দা আর রতন দা।
- "এবার বল তো দীপু," মেশো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "কী হয়েছিল কাল? অত গভীর রাতে কেন গেছিলি ওই অভিশপ্ত মৃত্যুকূপের কাছে? তোকে ঘরে দেখতে না পেয়ে তোর বাবা আর আমি মিলে সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছি। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে তোকে ওই রাজবাড়ির কাছে ঝোপের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল। কী হয়েছিল রে? আমাকে সব খুলে বল তো দেখি।"
অতি কষ্টে মেশো কে কাল রাতের সব ঘটনাগুলির যথাসম্ভব বিশদে বিবরণ দিলাম। সব শুনে অনি দা রীতিমতো চমকে উঠল।
- "বলিস কী দীপু? আমি তোকে কুয়োর মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম? আরে আমি তো কাল সারারাত ঘর থেকে বাইরেই বেরোইনি। কাল রাতটা আমি বাবা-মায়ের ঘরেই ঘুমিয়েছিলাম।"
- "একদম ঠিক," মেশো বললেন, "অনি কাল সারাটা রাত আমাদের সঙ্গেই শুয়েছিল। তোর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে রে দীপু।"
- "আমি অত কিছু জানিনা মেশো," ক্লান্ত মাথাটা বালিশে এলিয়ে বললাম, "কিন্তু ভগবান সাক্ষী আছেন....যা কিছু আমি তোমাদের বলেছি, তার প্রতিটা বর্ণ অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি।"
রতন দা এতক্ষণ চুপ করে ঘরের এককোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কথায় সে হঠাৎ বলে উঠল-
- "না না দাদাবাবু, আমি জানি....তুমি এক বর্ণও মিছে কথা বলছ নাকো। এমন অঘটন এর আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে এই গ্রামে। প্রধানের কাছে আমরা গ্রামবাসীরা অনেকবার চিঠিপত্তর পাঠিয়ে আর্জি জানিয়েছি, ওই অলক্ষুনে কুয়োর মুখটা সিমেন্ট দিয়ে পাকাপাকি ভাবে বুজিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা?"
- "কাল তাহলে কী হয়েছিল আমার সাথে রতন দা? অনি দা'র ছদ্মবেশে ওইটা কে এসেছিল?"
- "ছায়া ছিল দাদাবাবু, অতৃপ্ত কোনও আত্মার ছায়া। যে প্রচণ্ড ব্যথা আর অপমান সহ্য করে ওরা মরেছিল, সেই না-বলা যন্ত্রণাগুলোই কিছু বিশেষ-বিশেষ অপয়া তিথিতে মানুষের আকৃতি ধারণ করে। ধোঁয়া-ধোঁয়া ছায়াশরীরগুলো রূপ নেয় নিজের শিকারের খুব কাছের কোনও মানুষের। হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় মৃত্যুর জগতে। ঠিক যেমন কাল রাতে ওরা রূপ নিয়েছিল অনি দাদাবাবুর। সেই ছায়ার দেশে একবার পাড়ি দিলে সেখান থেকে আবার ইহলোকে ফিরে আসা অসম্ভব দাদাবাবু....অসম্ভব!"
শেষের কথাগুলো উত্তেজনার বশে খানিকটা চিৎকার করেই বলল রতন দা। আড়চোখে লক্ষ্য করলাম, মেশো আর অনি দা'র চোখে-মুখে আতঙ্কের কালো ছাপ নেমে এসেছে। একটু ধাতস্থ হয়ে রতন দা আরও বলল-
- "তোমার ভাগ্যের খুব জোর দীপু দাদাবাবু। কাল বড়কর্তা না থাকলে কী যে বিরাট অনর্থ হয়ে যেত; ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।"
দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে রতন দা দাদুর উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম করল। নিজের অজান্তেই আমারও চোখটা চলে গেল দাদুর বাঁধানো ছবির দিকে। রজনীগন্ধার মোটা হার পরানো ছবির মধ্যে থেকে দাদু আমার দিকেই চেয়ে আছেন। তাঁর ঠোঁটে লেগে রয়েছে একটুকরো হাসি....অনাবিল আনন্দের হাসি।
**** সমাপ্ত ****