হাতবদল
হাতবদল


আজ রথ। গতকাল মেয়ের জন্য একটা কাঠের রথ কিনে এনেছি। সে মেয়ের আমার কি ফুর্তি। একটা জগন্নাথ মূর্তি তার মধ্যে বসিয়ে ফুলের মালা দিয়ে আজ সাজিয়ে দিলাম। উঠোনময় সারাদিন রথ চালিয়ে বিকেলবেলায় মেয়ের বায়না হল বাইরে রাস্তায় চালাবে। মনে পড়ল আমার ছোটবেলার কথা। পাড়ায় একটা ভুরকুন্ড গাছ ছিল,তার তলা থেকে গোল গোল ভুরকুন্ড ফল কুড়িয়ে আনতাম আগের দিন। সেই ফলে খ্যাংড়াকাঠি গেঁথে তৈরি হত আমাদের রথ। তারপর তাকে রঙিন কাগজ দিয়ে ঘেরা হত। ঠাকুমার কাছ থেকে পেতলের জগন্নাথ মূর্তি নিয়ে রথে বসিয়ে,ফুল-মালা দিয়ে সাজাতাম। ঠাকুমা একটা থালায় বাতাসা দিতেন,ঠাকুরের সামনে রেখে রথের দড়িতে টান দিতাম। ছোট ভাইবোনেরা কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে চলত। পাড়া পরিক্রমা হত। খরখরে রাস্তায় সে ভুরকুন্ড ফল কখনও আবার বিদ্রোহ করত। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বড়রা আবার রথ দেখে প্রণাম করে পয়সা দিতেন আর আমরা একটা করে বাতাসা তাদের হাতে দিতাম। সে কি আনন্দ আমাদের ।
রথ টানা হয়ে গেলে বাবার কাছে বায়না করতাম রথের মেলায় নিয়ে যেতে। বাবা বিকেলবেলা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তো একবার তখন দিদি ৮,আমি ৬,বোন ৪,বাবা আমাদের নিয়ে রথের মেলায় গেলেন। কত জিনিস! প্লাস্টিকের খেলনা,পুতুল,ওদিকে জিলিপি, গুড়কাঠি,নাগরদোলা,কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি। আমি আর দিদি হাত ধরাধরি করে রয়েছি বাবার নির্দেশে,আর ছোটজন বাবার হাত ধরে। খেলনাপত্র কিনে টাকা দেবার সময় বাবা বোনের হাতটা ছাড়েন। আমরা তো খেলনা পেয়ে মশগুল। খানিক গিয়ে বাবা দেখেন বাবার হাত ধরে অন্য একটি বাচ্চা মেয়ে আর বোন কোথাও নেই। ভিড়ের মধ্যে কোথায় খুঁজবেন,বাবার মুখ তখন কালো আর আমাদেরও সব আনন্দ মাটি। এদিকে ছোট বাচ্চাটিকেও বাবা ছেড়ে দিতে পারছেন না একা। খুব আপসেট হয়ে বাবা পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার মনস্থ করলেন।
দূর থেকে পুলিশের লাল টুপি দেখতে পেয়ে বাবা,সঙ্গে আমরা এগোতে লাগলাম। সেখানেও দারুন ভিড়। তা অতিক্রম করে বাবা তাকে সব জানালেন। বাচ্চা মেয়েটাকে তার হাতে সঁপে দিলেন। পুলিশ ভদ্রলোক তখন পিছন থেকে বোনকে বার করে বাবাকে বললেন,"দেখুন তো এই বাচ্চাটা আপনার কিনা?" আমরা চমকে গেলাম। পাশেই এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ওকে পুলিশের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। জানা গেল তিনিও মেলায় ওইখানেই কেনাকাটা করছিলেন। কিভাবে যেন দুটো বাচ্চা হাতবদল হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে থাকা বাচ্চাটা ওনারই। সবশেষে হাসিমুখে বাড়ী ফিরেছিলাম সেদিন আমরা। এইসব ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলি আমি। মেয়ে ধাক্কা দেয় আমায়,"ও মা শুধু শুধু হাসছো কেন? আমাকে বাইরে নিয়ে চল না রথ চালাতে"।