হালং বে
হালং বে
কোন জায়গায় বেড়াতে যাবার আগে সে জায়গা সম্বন্ধে পড়াশোনা করা আমার ধাতে নেই। মনে হয় surprise element টা চলে যাবে। তাই যখন হ্যানয় বিমানবন্দর থেকে ভিয়েতনামের উত্তরপূর্বে স্থিত হালং বের দিকে আমাদের বাসটা রওনা হল তখন শুধু এইটুকুই জানতাম যে এটা একটা ইউনেস্কো ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট আর আমরা দুদিন ক্রুজে কাটাবো।
সকাল সাড়ে নটা বাজে। ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস ছুটে চলেছে। দুধারে সবুজ খেত। এখানকার গাছপালাদের আমি চিনি , নিম, নারকোল, কলা ইত্যাদি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় নিজের দেশেই আছি।
ঘণ্টা তিনেক চলার পর আমরা পৌঁছলাম হ্যালং বের জাহাজ ঘাটায়। এখান থেকে একটা ফেরী নৌকো আমাদের নিয়ে গেলো জাহাজে। জাহাজে উঠতেই ড্রাম বাজিয়ে, সরবত দিয়ে আমাদের ওয়েলকাম করা হল। তারপর আমরা চললাম নিজের নিজের ঘরের দিকে।
ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে সামনে তাকাতেই, সামনের দৃশ্য দেখে খানিকক্ষণ চোখ সরাতে পারলাম না। ঘরের একটা দেয়াল পুরোটাই কাঁচের আর তা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ জলরাশি। সেই জলের থেকে মাঝে মাঝে মাথা তুলেছে ছোট ছোট টিলার মত দ্বীপ। দ্বীপগুলোর নিচের দিকটা জলথেকে সোজা দেয়ালের মত উঠে গেছে, সেখানকার সাদা পাথরে কোন গাছপালা নেই। আর মাথার দিকগুলো গোলাকৃতির যেগুলো ঘন রেন ফরেস্টে ঢাকা। দূরের দ্বীপগুলো আবছায়া নীল দেখাচ্ছে। হালং বে প্রায় দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত আর প্রায় ১৬০০ চুনাপাথরের দ্বীপ দিয়ে তৈরি। বেশীর ভাগ দ্বীপেই মানুষ বাস করে না।
ঘরের সঙ্গে লাগানো একটা ছোট্ট খোলা বারান্দা। জাহাজটা চলতে শুরু করার পর সামনের দৃশ্য ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো, এক চলমান চিত্রপটের মত। এখান বলে রাখা দরকার যে এখানকার জল খুবই শান্ত, তাই সি-সিকনেস হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আমাদের নৌকো করে নিয়ে যাওয়া হল লুয়ন গুহা দেখতে। এই চুনা পাথরের দ্বীপগুলোর ভিতর দিকটা ফাঁপা বলে এখানে প্রচুর গুহা দেখা যায়। প্রায় শ খানেক অসমান সিঁড়ি চড়ে এই গুহাতে পৌঁছনো কষ্টকর, কিন্তু পৌঁছনোর পর যে দৃশ্য দেখা যায় তা ওই কষ্টকে সার্থক করে। গুহার ভিতর স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের যে অপূর্ব ভাস্কর্য প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে, তার সৌন্দর্য আরও শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এখানকার ভব্য আলোকসজ্জা।
গুহায় চড়তে না পারলে দুঃখ করার কিছুই নেই, আনন্দ নিতে পারেন ওখানকার ছোট্ট ছোট্ট বিচের। যদিও জলে সাঁতার কাটা বারণ। কিন্তু তাতে নরম বালিতে পা ছড়িয়ে বসে বা জলে পা ভিজিয়ে সামনের দৃশ্য উপভোগ করায় কোন বাধা নেই। যারা একটু বেশী অ্যাডভেঞ্চার ভালোসেন তারা কায়াকিং বা স্নরকেলিংএ অংশগ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া আছে ভিয়েতনামী রান্নার ক্লাস, ছিপ ফেলে মাছ বা স্কুইড ধরা, ‘তাই চি’ ক্লাস।
অবশ্য এর কিছুই না করে আপনি জাহাজের মাথার খোলা ছাদে, ডেক চেয়ারে শুয়ে হাওয়া খেতে খেতে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগও করতে পারেন ।
লাঞ্চ আর ডিনারে আছে আন্তর্জাতিক খাবারের সঙ্গে ভিয়েতনামী সি ফুডও। অক্টোপাসের স্যালাড, স্কুইডের পাকোড়া, খেতে মন্দ না। জাহাজের কর্মীরা খুবই ভালো। কিন্তু ভাষা নিয়ে সামান্য সমস্যা আছে। একজন কর্মীকে পাত্রে কি খাবার রাখা আছে জিজ্ঞাসা করাতে, প্রথমে সে বলল “ গা (ওদের ভাষায় চিকেন)”। আমি বুঝতে পারছিনা দেখে হাত দুটো পাখার মত নেড়ে, ‘কোক কোক’ ডেকে বুঝিয়ে দিলো ওটা চিকেন।
পরের দিন আমরা নৌকো করে গেলাম এখানকার জলে ভাসমান ‘ফিশিং ভিলেজ’ দেখতে। আট দশটি ছোট ছোট নৌকো মিলে এক একটি জেলে গ্রাম। দেখলাম ওইটুকু নৌকো-বাড়ীর মধ্যে কি সুন্দর গোছানো ওদের সংসার। সংসারে বৃদ্ধ বাবা-মা, কচি-কাঁচাদের সঙ্গে স্থান পেয়েছে পোষা কুকুর বেড়ালও। সত্যি! যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নজন। গ্রাম থেকে ফেরার পথে দেখলাম গ্রামের ভাসমান ডাস্টবিন। যেখানে প্লাস্টিকের ব্যাগে বন্দী হয়ে ভেসে আছে আবর্জনা, কিন্তু জলে এক টুকরোও নেই।
মনে মনে কুর্নিশ করলাম এদের প্রকৃতি প্রেমকে। যদি সুযোগ পাই আবার আসবো তোমার কোলে হালং বে।