গঙ্গাসাগর স্নান - ৪
গঙ্গাসাগর স্নান - ৪


সে বছর মকর সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে বাবাকে নিয়ে গঙ্গাসাগরে রওনা হয় অনিকেত। সাগর ও নদীর সঙ্গমে সাগরদ্বীপের গঙ্গাসাগর মেলার সৌন্দর্য ওর দুরভিসন্ধিতে থাবা বসাতে পারে না। পুণ্যস্নান করে কপিল মুনির আশ্রমেই বৃদ্ধ বাবাকে একা ফেলে রেখে ভিড়ে মিশে যায় অনিকেত। একবারের জন্যও ফিরে দেখেনি ও সেদিন। এর মধ্যে অনিন্দ্যবাবুর স্মৃতিভ্রংশটা প্রকট হওয়ায় ও নিশ্চিত ছিল যে উনি ফিরতে পারবেন না বা কাউকে বাড়ির ঠিকানাও বলতে পারবেন না। এখন নিরুদ্দেশ বাবার সব সম্পত্তি অনিকেতের। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।
অনিকেতের অনুমান সঠিক ছিল। অনিন্দ্যবাবু আর ফিরে আসতে পারেননি। ওনার সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে। ক্রমে অনটন গ্রাস করে পরিবারটাকে। অনিকেতকে উপার্জনে নামতে হয়, অনেক খুঁজে অবশেষে ও স্বল্প মাইনের সিকিউরিটি গার্ডের একটা চাকরি পায়। টাকার জন্য বাড়তে থাকে নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তি। বাবার গুরুত্বটা ক্রমে উপলব্ধি করতে পারে ও। যে মানুষটার ছত্রছায়ায় সুখী জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল অনিকেত, তাকেই ছত্রহীন করে দিতে একবারও ভেবে দেখেনি ও। অনেক খোঁজ চালিয়েও বাবাকে আর ফিরে পায়নি ও। সুনন্দার সাথে প্রতিদিনের ঝামেলায় সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে যায়। 'বাবা' হতে যে কতটা আত্মসমর্পণ লাগে, সেটা বাবার অনুপস্থিতিই বুঝিয়ে দেয় অনিকেতকে।
এভাবেই চলছিল। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে কোনওরকমে ট
িকে থাকা। তাই এই বছর অনিকেত আর সুনন্দা মকর সংক্রান্তির দিন গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নান করার সংকল্প নেয়। পুণ্যতোয়া ধারার স্পর্শে যদি একটু শান্তি ফেরে সংসারে! সেই মতো যাত্রা করা। সঙ্গে যায় ওদের ছেলে অঙ্কুশ, এখন ওর বয়স তেরো।
অনিকেত সম্বিত ফিরে পায় ছেলের 'বাবা' ডাকে। ওর দৃষ্টি এতক্ষণ সেই সাধুর চোখে আটকে ছিল। হঠাৎ অঙ্কুশ অনিকেতের হাত ধরে টেনে বলে ওঠে, "বাবা, বাবা, এই সাধুটা তো দাদাই। তাই না বাবা?" ততক্ষণে সুনন্দা একপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। অনিকেতের দু'চোখে জলের ধারা। সাধুর হাতটা ধরে ও বলে ওঠে, "বাবা, আমাকে মারো, খুব মারো। কিন্তু এভাবে চুপ করে থেকো না। বাড়ি ফিরে চলো, বাবা।"
নির্বিকার সাধু ততক্ষণে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেছেন, আরও সামনের দিকে। অনিকেতের হাতটা ততক্ষণে সাধুর হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, "ফিরে এসো, বাবা..."
সাধু চলতেই থাকেন, আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। ক্রমে মিশে যান মেলার থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে। এটা স্মৃতিভ্রংশ না মায়া কাটিয়ে ফেলার প্রকট ফল - বুঝে উঠতে পারে না অনিকেত।
মেলা প্রাঙ্গণ থেকে গানটা ভেসে আসে,
"ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়...
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়...
আমরা আর পাব না, আর পাব না...
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না..."