Priyanka Bhuiya

Romance Tragedy Inspirational

4.2  

Priyanka Bhuiya

Romance Tragedy Inspirational

ভালো থাকুক, ভালোবাসা

ভালো থাকুক, ভালোবাসা

9 mins
1.7K


সেই উচ্চমাধ্যমিকের পর পরিচয়, তারপর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একই কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ – সময়ের গতিতে বেড়েছে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা। দেখতে দেখতে ঋষভ ও সুনেত্রার সম্পর্কের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। ওরা দু’জনেই এখন একই মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন। সুনেত্রা কার্ডিওলজি আর ঋষভ নিউরোলজি বিভাগে রয়েছে। বিভাগের ভিন্নতা ওদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং প্রতিদিন একই সাথে যাওয়া-আসা, কর্মজীবনের সুবিধা-অসুবিধার কথা পরস্পরের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই ক্রমশ বেড়েছে ওদের পারস্পরিক টানের গভীরতা। দু’জনেই ভীষণ মেধাবী এবং প্রতিষ্ঠিত। তাই দুই বাড়ি থেকেই ওদের আগামীর পরিণতি অর্থাৎ বিবাহে সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ওদের সম্পর্কের মূল ভিত্তিটাই হল পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, সম্মান ও ভালোবাসা।

কিন্তু গত কয়েক মাস ধরেই ঋষভের আচরণে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সুনেত্রা। হসপিটাল থেকে প্রতিদিন দেরিতে বাড়ি ফেরা, কম কথা বলা, সারাক্ষণ ওর চোখেমুখে যেন একটা চিন্তার ছাপ! এতদিন ধরে দেখে আসা ঋষভের এই হঠাৎ পরিবর্তনটা সুনেত্রার চোখ এড়ায়নি। ও এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে ঋষভের একটাই জবাব, "কিছুই হয়নি। ওটা তোমার ভুল ধারণা।" ক্রমশ ঋষভের প্রতি সন্দেহের বেড়াজালে শঙ্কিত হল সুনেত্রার হৃদয়। ও কয়েক মাস ধরেই ধারণা করেছিল যে ঋষভ ওর থেকে কিছু একটা গোপন করছে। আজ ঐন্দ্রিলার লেখা এই প্রেমপত্রে সেই অনুমানই প্রকট হল।


"প্রিয়, তুমি তো জানোই, আমার একই জীবনে দু’বার সবকিছুতে হাতে খড়ি, চিঠি লিখতে শেখাটাও তার ব্যাতিক্রম নয়। ক’জনের এই সৌভাগ্য হয় বলো?

ডাক্তারবাবু, তুমি নাকি কাল ও.টি তে ব্যস্ত ছিলে! ওদের বকাবকিতে আমি খেতেও পারিনি। ওরা আমায় খুব বকে, চোখ দেখায়। আমার খুব ভয় লাগে গো। তোমার মতো ক’রে আমায় কেউ ভাত মেখে খাইয়ে দেয় না। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ায় না। সারাদিনে অন্তত একবার তুমি না এলে খুব কষ্ট হয়। তোমায় যে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি! তুমি সারাজীবন আমাকে এভাবেই আগলে রাখবে তো?" দীর্ঘ প্রেমপত্রের শেষ স্তবকটায় সুনেত্রার মনের গভীরে আশঙ্কার বেড়াজাল। ওর চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা জল। নিঃশব্দে চিঠিটা আবার ভাঁজ করে খামে ভরে বইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল ও।

সেদিন আর ঋষভের জন্য অপেক্ষা না ক’রে সুনেত্রা একাই হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে এল। বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে চিঠিটা। প্রেমপত্রটা দীর্ঘ হলেও পুরোটাই কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা, ঠিক যেন সদ্য কলম ধরতে শেখা কারোর হস্তলিপি। "একই জীবনে দু’বার সবকিছুতে হাতে খড়ি" – কথাটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না সুনেত্রার। রাতে ঋষভ বেশ কয়েকবার ফোন করেছে, ফোনটা ধরার প্রবৃত্তি হয়নি ওর। মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে ঋষভ ওর সাথে ছলনা করেছে! কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সুনেত্রা।

পরদিন একাই হসপিটালে পৌঁছল ও। ঋষভের সাথে দেখা করার ইচ্ছে একেবারেই না থাকলেও উপায় নেই। কারণ, কর্মস্থলটা একই। ঋষভের সাথে চোখাচোখি হওয়ার সাথে সাথে সুনেত্রা দ্রুত চলে যেতে চাইল।

- সুনেত্রা! দাঁড়াও!

- বলো...

- কাল আমার ফোনটা তুললে না কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে?

- আমার খোঁজ না নিলেও চলবে।

- এভাবে বলছ কেন? কী করেছি আমি?

- না, কিছুই করোনি। জীবনটা তোমার, তাই তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কোনও অধিকার আমার নেই।

সুনেত্রা চলে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঋষভ। সুনেত্রা কী কিছু জানতে পেরেছে? ওকে কী তবে ও ভুল বুঝছে? কিন্তু ওর যে কিছুই করার নেই। ও জানে, ও কোনও ভুল করছে না। ধীরে ধীরে নিউরোলজি জেনারেল ওয়ার্ডে রোগীদের রুটিন চেক আপের জন্য এল ও। উপলক্ষ্য এখানকার তিরিশ জন পেশেন্ট হলেও আজকাল ওর অভ্যেস হয়ে উঠেছে শুধু একজনই। ওয়ার্ডে ঢুকতেই প্রতিদিনের মতো আজও চোখ চলে গেল ৬ নম্বর বেডের মেয়েটির দিকে। ঐন্দ্রিলা একমনে ড্রয়িং খাতায় কিছু একটা আঁকছে, ঋষভকে দেখতেই পায়নি ও। ঋষভ বাকি পেশেন্টদের রুটিন চেক আপ ক’রে অবশেষে এল ঐন্দ্রিলার কাছে। ও এখনও আঁকাতেই মগ্ন। একটা হসপিটাল, সামনে দাঁড়িয়ে একজন ডাক্তার, গলায় স্টেথো, হাতে ব্রিফকেস – কাঁপা কাঁপা হাতে এটাই এঁকেছে ঐন্দ্রিলা।


"এটা কে?" জিজ্ঞেস করল ঋষভ।

- ও ডাক্তার! তুমি কখন এলে?

- এখুনি। তুমি তো দেখছি আঁকাতেই মগ্ন, দেখার সময়ও নেই।

- তোমাকেই তো আঁকছিলাম। এই দেখো!

- হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। শুনলাম, তুমি নাকি ব্রেকফাস্ট করোনি!

- না। খেতে ইচ্ছে করছিল না।

- এখন আগে লাঞ্চ করে নাও। তারপরে কথা।

- না, খাব না। আগে গল্প করো।

- খেয়ে নাও, নাহলে কিন্তু তোমার গিফ্ট পাবে না।

- আচ্ছা! আচ্ছা! তবে খাইয়ে দাও।


ঋষভ যত্ন করে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে শুরু করল ঐন্দ্রিলাকে। খাওয়ার মাঝেই ঐন্দ্রিলার কত কথা! সারাদিন কী কী হয়েছে, কে কী করেছে – তার হুবহু বর্ণনা। আর মাঝে মাঝেই বলে চলেছে, "কি গিফ্ট এনেছো? দাও না..."

ঋষভের জবাব, "আগে খাবারটা শেষ করো, তারপর..." সম্পূর্ণ খাবারটা খাইয়ে ঐন্দ্রিলার মুখ মুছিয়ে দিল ঋষভ।

"এবার দাও গিফ্ট।" বাচ্চাদের মতো করুণ আর্তি ঐন্দ্রিলার।

"ধরো, তোমার উপহার..." এই বলে ঐন্দ্রিলার দিকে একটা পুতুল এগিয়ে দিল ঋষভ। ঐন্দ্রিলা কী খুশি! বুকে জড়িয়ে ধরে পুতুলটাকে কত চুমুই না খেল! অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঋষভ।


ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবা এবং স্কুল শিক্ষিকা মায়ের একমাত্র মেয়ে ঐন্দ্রিলা। ছোট থেকে খুব আদরে মানুষ হয়েও উচ্ছৃঙ্খলতা গ্রাস করতে পারেনি ওকে। ভীষণ মেধাবী ঐন্দ্রিলার জীবনের লক্ষ্য ছিল রসায়নবিদ হওয়া। তাইই একাগ্রতার সাথে লেখাপড়া ক'রে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বি.এস.সি, এম.এস.সি - সবেতেই দুর্দান্ত ফলাফল করেছে ও। নেট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঐন্দ্রিলা।

স্কুলশিক্ষক মনোতোষ সেন ছোট থেকেই ভীষণ স্নেহ করতেন ওকে। ওদের বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতেন অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী দূরদর্শী এই মানুষটি। ওনার একমাত্র ছেলে সংলাপ সেন এখন নিউইয়র্কে রসায়ন শাস্ত্রেই গবেষণারত। তাই উভয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই মানুষটি নিজের ইচ্ছের কথা ঐন্দ্রিলার মা-বাবাকে জানালেন। তাঁরাও সংলাপের মতো ভালো ছেলের সঙ্গে নিজেদের মেয়ের বিবাহ প্রস্তাবে ভীষণ খুশি। ঐন্দ্রিলারও এতে কোনও আপত্তি ছিল না। কারণ, এতদিন নিজের লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে বিয়ে নিয়ে ভাববার কোনও অবসরই পায়নি সে।


পুজোর ছুটিতে সংলাপ দেশে ফিরলে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়, ক্রমে বন্ধুত্ব, একসাথে সময় কাটানো, ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পরের বছরই ওদের বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে যায়। দুই বাড়িতেই ভীষণ আনন্দ। এর মধ্যেই একদিন সংলাপ ঐন্দ্রিলাকে জানায় যে বন্ধুদের গেট টুগেদারের পার্টিতে তাকেও সংলাপের বাগদত্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে। প্রথম প্রথম ইতস্তত করলেও মা-বাবার কথায় ঐন্দ্রিলা রাজি হয়ে যায়। ও ভাবতেও পারেনি যে ওর এই সিদ্ধান্তেই ওর জীবনে আসতে চলেছে আমূল পরিবর্তন।

পার্টিতে যাওয়ার জন্য একটা সালোয়ার পরেছিল ঐন্দ্রিলা।

"আর ইউ ম্যাড? আমার একটা স্ট্যাটাস আছে। তুমি এইসব পাতি সালোয়ার পরে গেট টুগেদারে যাবে! যাও, চেঞ্জ করে এসো।" এই বলে সংলাপ ঐন্দ্রিলাকে একটা আলট্রা মডার্ন ড্রেস পরতে বাধ্য করে।


ঐন্দ্রিলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সংলাপের এই চাপিয়ে দেওয়া প্রভুত্বপূর্ণ মানসিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ঐন্দ্রিলা। ও কোনওদিনই চায়নি যে কেউ ওর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে ওকে নিয়ন্ত্রণ করুক, আর ওর সাথে সংলাপ ঠিক সেটাই করে।

এরপর পার্টিতে গিয়ে সংলাপের বন্ধুদের তির্যক দৃষ্টি, ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় হতচকিত হয়ে পড়ে ঐন্দ্রিলা। এই উচ্ছৃঙ্খল বিকৃত রুচিসম্পন্ন পরিবেশে ওর নিজেকে বড় বেমানান লাগে। মদ্যপানে অস্বীকার করলে সংলাপ ও ওর বন্ধুরা জোরাজুরি করতে শুরু করে ঐন্দ্রিলাকে। অবশেষে এক বন্ধু ওর গায়ে হাত রেখে কথা বললে সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয় ওর। ছেলেটিকে ও সপাটে এক থাপ্পড় মারে, সংলাপ ভীষণ রেগে সজোরে ধাক্কা দেয় ঐন্দ্রিলাকে। মেঝেতে ছিটকে পড়ে ও, সঙ্গে সঙ্গে অচেতন, মাথা ফেটে বয়ে চলে রক্তের ধারা। ঐন্দ্রিলাকে হসপিটালে ভর্তি করে সংলাপ।


মাথার পেছনে গুরুতর আঘাত নিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নিউরোলজি বিভাগে ভর্তি করা হয় ঐন্দ্রিলাকে। সংলাপের এক বন্ধু সবটা জানিয়ে দেয়। জেল হয় সংলাপের। এদিকে লাগাতার দু’সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই ক'রে সিনিয়র ডাক্তারদের নিরলস তৎপরতায় আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসে ঐন্দ্রিলা। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও অধিকাংশ স্মৃতি লোপ পায় ওর, সেই সাথে নিজের পরিবারের মানুষগুলোকেও মনে করা কষ্টকর হয়ে ওঠে ওর কাছে। শিশুসুলভ আচরণ প্রকট হয়ে ওঠে ওর মধ্যে। ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার রেশটা রয়ে যায় ওর মনে, তাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই।

প্রথম থেকে শুরু করে ঋষভও একজন ইন্টার্ন হিসেবে ঐন্দ্রিলার চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ের সাক্ষী ছিল। বিপদ কেটে যাওয়ার পর ওর রুটিন চেক আপের দায়িত্ব আসে ঋষভের ওপর। এদিকে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সংলাপ ঐন্দ্রিলার পরিবারকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, "দেখুন, একটা পাগলের সাথে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।" বিয়েটা ভেঙে যায়।

ঐন্দ্রিলার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ওর মা-বাবাকে আরও কয়েক মাস ওকে হসপিটালে ভর্তি রাখতে বলে ঋষভ। ওর সারল্য, বই পড়ার প্রবল নেশা, জীবনযুদ্ধে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা দেখে মুগ্ধ হয় ঋষভ। ঋষভ ওকে আবার সব কিছু নতুন করে শেখানো শুরু করে, স্পষ্ট কথা বলা থেকে শুরু করে চিঠি লেখা - সবেতেই ঋষভের হাত ধরে ঐন্দ্রিলার আবার হাতে খড়ি। ধীরে ধীরে ঐন্দ্রিলারও ঋষভের প্রতি এক গভীর টান তৈরী হয়। আশেপাশের জগৎটার প্রতি বিশ্বাস ওর হারিয়ে গিয়েছিল। ঋষভকে ঘিরে আবার ভরসা জেগে ওঠে ওর মনে। ঋষভ কোনওদিন জোর করে ওকে কিছু চাপিয়ে দেয় না বা বকাবকি করে না, পরম যত্নে ওকে খাইয়ে দেয়, ভালো-মন্দ বুঝিয়ে দেয়। ঋষভের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে ঐন্দ্রিলা। ঋষভ এর আগে কত মানসিক রোগী দেখেছে! কিন্তু ঐন্দ্রিলা যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম। উগ্র সামাজিকতায় হতবাক একটা মেয়ে ঋষভকে ঘিরেই আবার বাঁচতে শিখেছে। এই ভালোবাসায় কোনওরকম উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই। চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে এই টানের গভীরতা মাপা যায় না। ঋষভের এই ভালোবাসা ঐন্দ্রিলার দ্রুত আরোগ্যের অন্যতম কারণ। মেয়েটা আঁকড়ে জড়িয়ে রাখে ওকে, ভয় পেলে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। ও যে কিছুতেই ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে যেতে পারবে না! ফুলের মতো নিষ্পাপ এই মেয়েটার বিশ্বাস ও ভাঙতে পারবে না কিছুতেই। ঋষভ মাঝে মাঝেই উদাসীন হয়ে পড়ে। ভাবে, দীর্ঘ পাঁচ বছর সম্পর্কে থেকে ও এখন সুনেত্রার সাথে প্রতারণা করছে না তো! সুনেত্রাকে অনেকবার ঐন্দ্রিলার কথা বলতে গিয়েও বলে উঠতে পারেনি ও। কীভাবেই বা বলবে! সুনেত্রা কিছুতেই বিশ্বাসঘাতক ঋষভকে মেনে নিতে পারবে না।

দু'হাতে পুতুলটা শক্ত করে আঁকড়ে ঋষভের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ঐন্দ্রিলা। ওর মাথাটা খুব যত্নে বালিশে রেখে নিঃশব্দে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেল ঋষভ। এতক্ষণ জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল সুনেত্রা। চোখের জলটা মুছে নিয়ে ও এগিয়ে গেল নিউরোলজি বিভাগের এক নার্সের দিকে। তার কাছ থেকেই ঐন্দ্রিলার জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাটা জানতে পারল সুনেত্রা। ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ফিরে গেল ও, বিকেলের দিকে আবার এল ৬ নং বেডের কাছে।

- কেমন আছ ঐন্দ্রিলা?

- ভালো না গো।

- কেন?

- দেখো না, আমার ডলিকে কখন থেকে বসতে বলছি! কিছুতেই বসছে না।

ঐন্দ্রিলার হাত থেকে পুতুলটাকে নিয়ে বিছানার ওপরে বসিয়ে দিল সুনেত্রা।

- তুমি কে গো?

- আমি তোমার নতুন বন্ধু।

- তাই! আমার তাহলে দু'টো বন্ধু হল। ডাক্তারবাবু আর তুমি। কী মজা!

- খুশি তো তুমি?

- খুব খুশি। তুমি ডাক্তারবাবুকে চেনো?

- হ্যাঁ, চিনি তো! ঐন্দ্রিলা, ডাক্তারবাবুর মতো মানুষ হয় না গো। ওই মানুষটার ভালোবাসায় এতটুকুও খাদ নেই। কোনওদিন তার হাত ছেড়ো না...কেমন?

- না গো বন্ধু, ছাড়ব না। শক্ত করে ধরে রাখব। খুব শক্ত করে.... তোমায় কথা দিলাম।

ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সুনেত্রা। রুমালে মুছে নিল চোখের জলটা। সেদিন বাড়ি ফিরে চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইল সুনেত্রা। একটা মেয়ে, যার সামনে একটা দুর্দান্ত ভবিষ্যৎ ছিল, সে আজ উন্মত্ত সমাজের স্ট্যাটাস রক্ষার নির্মম শিকার। শিশুসুলভ আচরণ গুলোর জন্য এই জগতের কাছে যে মানুষটার পরিচয় আজ শুধুই 'পাগল', ঋষভকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েই তার সমগ্র জগৎ। ঋষভ মেয়েটাকে বাঁচতে শিখিয়েছে, আজ মনে মনে ওর জন্য ভীষণ গর্ববোধ করল সুনেত্রা। ওর তো জীবনে মা, বাবা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, এত বন্ধু-বান্ধব - সবাই আছে। কিন্তু ঐন্দ্রিলার জীবনে যে সবাই থেকেও কেউ নেই। কারণ, ও মানসিক ভারসাম্যহীন। ঋষভকে সুনেত্রা কিছুতেই ঐন্দ্রিলার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা অঝোর ধারায় ঝরে পড়ল কান্না হয়ে। নিজের মনকে অনেক বুঝিয়ে নিজেকে সামলে ও ঋষভকে ফোন করল।

- হ্যাঁ সুনেত্রা, বলো...

- ঋষভ, তুমি সত্যিই সফল গো।

- কেন?

- তোমার অনাবিল ভালোবাসাই ঐন্দ্রিলাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্রমশ সুস্থ করে তুলছে। তুমি একজন ডাক্তার হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে, একজন প্রেমিক হিসেবে সার্বিক সফল।

চমকে উঠল ঋষভ। সুনেত্রা এসব জানল কী করে!

- সুনেত্রা! আমি তোমাকে বলার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। আমায় ভুল বুঝো না, পারলে ক্ষমা করে দিও।

- তোমায় আজও ভালোবাসি, ঋষভ। তাই আমি চাই, তুমি খুব ভালো থাকো। আর ঐন্দ্রিলা তোমার হাত ধরেই সুন্দর একটা জীবনের পথে এগিয়ে চলুক।

- তুমি আমায় ভুলে যাবে, সুনেত্রা?

- কখনওই না। আমরা ভালো বন্ধু হয়েই থাকব আজীবন।

- আর আমাদের ভালোবাসা? সেটা যে অপূর্ণই রয়ে গেল!

- ঋষভ, অপূর্ণতাই কিছু সম্পর্কের সৌন্দর্য, সেখানে পরিপূর্ণতা খোঁজা বৃথা।

মোবাইলের দু'পাশে গভীর নৈঃশব্দ্য। নিজেদের অজান্তেই ভিজে গেছে দু'জনের চোখ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance