গান্ধীবুড়ি
গান্ধীবুড়ি




একদল লোক আসছে। দূর থেকে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। গান্ধীবুড়ি তখন সবে পুকুরে ডুব দিয়ে এসে শাড়ির আঁচলটা নিংড়ে জল ঝাড়ছিলো। উনোনে শাকের তরকারিটা ভাপা হচ্ছে। সেটা একটু নেড়ে চেড়ে গান্ধীবুড়ি বারান্দায় এসে বসলো। কারা যায় ?
একচালা ছোট একটা কুঁড়েঘর। সামনে এক চিলতে একটা বারান্দা। গান্ধীবুড়ি নামটা গ্রামের লোকে দিয়েছে। বুড়ি একাই থাকে। ছেলেপুলেও নেই। বয়স ষাট পার হয়ে গেছে অনেক আগে। কিন্তু এখনো যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ্য। গ্রামের কারুর হাত কেটে গেলে বা পা ভেঙে গেলে গান্ধীবুড়ি তার সেবাযত্ন করে, ব্যান্ডেজ করে দেয়, ঝোপঝাড় খুঁজে কীসব পাতা-টাতা এনে বেটে লাগিয়ে দেয়। সেরেও যায় ঘা-প্যাঁচড়া। গান্ধীবুড়িকে গ্রামের লোক খুব ভালোবাসে। শোনা যায় অনেক ছোটবেলায় নাকি তার বিয়ে হয়েছিলো, দোজবরে। লোকটা ছিলো নিতান্তই কোনো এক ঘাটের মরা। আঠেরো পেরোনোর আগেই বিধবা হতে হয় গান্ধীবুড়িকে, আর সেই থেকে সে একা থাকে এই গ্রামে।
একদল লোক মার্চ করতে করতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলে যায়। রাজনৈতিক স্লোগান তাদের মুখে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে আমাদের সমাজ ও দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশের কাজে যুক্ত হতে হবে সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে। প্রতিবাদ চাই, সংগ্রাম চাই। তবেই আসবে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা চাই।
স্বাধীনতা। কথাটা পুরোপুরি না বুঝলেও গান্ধীবুড়ির মনে দাগ কেটে গেলো।
সেই কোন এক ছোটবেলায় জীবনটা যে তার ছিনিয়ে নেওয়া হলো, পরাধীন করে দেওয়া হলো, সেই থেকে তো চলছে এই ধারাবাহিক রোজনামা। কী আছে এই জীবনে ? কেন এরকম পরাধীন থাকা ? মুক্তি কীসে ? মুক্তি কোথায় ?
এই প্রশ্নগুলো কুরে কুরে খেতো গান্ধীবুড়িকে। আজ হঠাৎ এই স্বাধীনতা শব্দটা বুকে দোলা দিয়ে গেলো তার। শাকের তরকারিটা সে নামিয়ে রাখলো উনোনের পাশে। এক ছিঁটে জল দিয়ে উনোনটা নিভিয়ে কাঠের দরজায় শেকল তুলে দিলো। তারপর আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে নেমে এসে ওই লোকগুলোর পিছন পিছন চললো গান্ধীবুড়ি।
**************************************************
সে আজ থেকে অনেকদিন আগের কথা। তখনের দিনে বাড়িতে নুন বানানো ছিলো বে-আইনি। এমনকি প্রচুর পরিমানে নুন মজুত করে রাখাও ছিলো আইনের চোখে অপরাধ। কারণ তখন ব্রিটিশ সরকার ছিলো আমাদের শাসক। তারা ইংল্যান্ড থেকে নুন আমদানি করে চড়া দামে এই দেশের মানুষকে কিনতে বাধ্য করতো। আমাদের দেশে খুব সহজেই অল্প দামে নুন তৈরী হলে ইংল্যান্ডের নুন বেশি দাম দিয়ে কেউ কেন কিনবে ? তাই তৈরী হয়েছিলো এমন আইন যে এই দেশে বসে যে কেউ নিজের মতো নুন তৈরী করতে পারবে না। অথচ নুন ছাড়া কোনো খাওয়াই হয় না। কিছু জায়গায় সরকারিভাবে নুন তৈরী করা হতো ব্রিটিশদের অনুমতিসাপেক্ষে, কিন্তু সেই নুনের উপর বিপুল পরিমান ট্যাক্স নিতো ইংরেজ সরকার। ক্রমে নুনের দাম এমন হলো যে গরিব মানুষদের তখন সত্যিই নুন আন্তে পান্তা ফুরোয় অবস্থা।
ওদিকে সারা দেশে তখন চলছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। গান্ধীবুড়ি কিছু কিছু খবর শুনতে পায়। সেদিনের সেই মিছিলের সাথে অনেকটা পথ হেঁটে কেমন যেন একটা বুকভরা সাহস পেয়েছে সে। হবে, আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। স্বাধীন হবে সবাই, নিজের স্বাধীন জীবন বেছে নেবে। অন্যের কথামতো চলতে হবে না। কিন্তু তার জন্য আন্দোলন চাই, প্রতিবাদ চাই, চাই লড়াই। নুনের খবরও একদিন তার কানে এলো। অদ্ভুত এই আইন। নিজে কম খরচে তৈরী করতে পারলেও তৈরী করতে দেওয়া হবে না, বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। মগের মুলুক নাকি!
একদিন বিকেলে চুপচাপ বসে ভাবছিলো গান্ধীবুড়ি কী করা যায়। কীভাবে এর প্রতিবাদ করা যায়। হঠাৎ একটা ভাবনা এলো তার মাথায়। স্বপন মুর্মুর বাড়িটা গ্রামের সেই শেষ মাথায়। সন্ধ্যে নামার আগে দেখা করে আসতে হবে।
**************************************************
গত বছর সাপের কামড়ে মর-মর অবস্থা হয়েছিলো স্বপন মুর্মুর। এই গান্ধীবুড়ির সাহায্যে কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচে তখন। পায়ে ন্যাড়া বেঁধে কাছাকাছি ডাক্তারকে খবর পাঠিয়েছিলো গান্ধীবুড়ি। নাহলে আর দেখতে হতো না। তাকে এই অবেলায় বাড়ি আসতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে নিজেই বেরিয়ে এলো স্বপন।
'আরে আপুনি যে এই সময়ে, কী মনে কইড়্যা ? আইয়েন আইয়েন।'
'স্বপন, তুকে লাগিব রে ইকটা কাজে। কালি আসতে পারবি ?'
'হ, পারবো। কুথায় আসতে হইবেক কুয়েন।'
'তাইলে শোন, তুই... আর তুর সাথে যে কাজ করে গোপাল আছে না, উকেও লিয়ে একসঙ্গে আসিস। আমার ঘরে।'
'কাজটা কী আছে বটেক, সিটাও যদি কুয়েন।'
'তুরা তো মালঙ্গী, নুন তৈরী করতে হইবেক, আর কী।
গোপাল হাঁসদা, স্বপন মুর্মু এরা ছিলো মালঙ্গী। মালঙ্গী বলা হতো তাদের যারা ক্ষেতে জল জমিয়ে জমিয়ে নুন তৈরী করতে জানতো। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে লবন কারখানায় কাজ করতো এরা। এদেরকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন গান্ধীবুড়ি।
**************************************************
কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামের সব মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের একত্রিত করে গান্ধীবুড়ি তৈরী করে ফেললেন নুন তৈরির ভিটে। স্থানীয় মালঙ্গীদের সাহায্যে তৈরী হলো নুন, দেশীয় নুন। আর সেই খবরে ব্রিটিশ শাসকদের রোষে পড়লেন গান্ধীবুড়ি। পুলিশ এলো মেদিনীপুরের এই গ্রামে। আর গ্রেফতার করে নিয়ে চললো গান্ধীবুড়িকে। পিছনে পাঁচশো লোকের স্লোগান তখন - বন্দে মাতরম!
শুরু হলো বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। তেষট্টি বছর বয়সে গান্ধীবুড়ি প্রথম যুক্ত হলেন দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনে। অমর অক্ষয় হয়ে রইলো তার সাহসের কাহিনী। জানো এই গান্ধীবুড়ি কে ছিলেন ? তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি পরিচিত অশীতিপর অক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা।
~ সমাপ্ত