Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Abstract Tragedy Classics

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Abstract Tragedy Classics

এরই নাম সংসার

এরই নাম সংসার

12 mins
650


এরই নাম সংসার

শ্যামশ্রী কর্ম্মকার

"পিকু ও পিকু কই রে বাবা" রুমা দেবী চিৎকার করতে করতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।

বছর দশেকের পিকু ওরফে পিনাকী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে রুমা দেবীকে " বম্মা এতোদিন পড়ে এলে কেন? তোমাকে ছাড়া কি আমি থাকতে পারি?"।

চোখে জল ভরে আসে রুমা দেবীর, তিনি নিজেও তিন সন্তানের জননী, তবু কেন জানিনা পিকু যেন তার হৃদয়ের টুকরো।

এই কথোপকথনের মাঝে পিকুর মা সুলেখা দেবী বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে, বলে " দিদি তুমি!! কখন এলে দিদি, চিনে আসতে কষ্ট হয় নি তো?"।

সামান্য হেসে রুমা দেবী বলেন" না রে লেখা, আমি তো এই শহরের মেয়ে, বিয়ের পর ঘরে আঁটকে পড়েছি তাই বলে তো সব ভুলে যায়নি, আমিও তো পড়াশোনা করেছি নাকি"।

পিকু বুঝতে পারে এরা গল্প করতে শুরু করলে পিকুর বম্মাকে পাওয়া কম হবে,আর কোনদিনও কারো সাথে তার প্রিয় মানুষটিকে ভাগ করে নিতে তার ভাল্লাগে না।তাই পিকু আর কথা বাড়াতে না দিয়ে নিজের সাজানো গোছানো ঘরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে যায় তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে।তার যে অনেক অনেক কথা জমে আছে, বম্মাকে জানাতে হবে তার বাবা বড্ড পচা হয়ে গিয়েছে।

পিকু বলে "তুমি আজ থাকবে তো, আমি তোমার সাথে বাড়ি যাবো, এখানে না আমার একটুও ভালো লাগে না"।আরও কত কি বলে যায় পিকু,যার কোনটাই রুমা দেবীর কানে ঢোকে না,তিনি চলে যায় অতীতে। তিনি ধর বাড়ির সর্বময় কর্তী, শ্বাশুড়ি যখন সব মায়া কাটিয়ে চলে যান তখন তার দুই দেবর রিজু, বিজু কলেজে আর দুই ননদের একজন আইন বিভাগে স্নাতক হয়েছে আর অপরজন কেবলমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল অপেক্ষায়। যেহেতু বিয়ের একবছরের মাথায় তার শ্বাশুড়ির অকস্মাৎ যাওয়া , সমগ্র পরিবারের সাথে বিশেষত তাকে অথৈজলে ফেলে দেয়, তিনি তার বাড়ির কনিষ্ঠা হওয়ায় দায়িত্ব, সংসার সামলানো কিছুই করতে হয়নি কোনদিন তাকে।পড়াশোনা আর গানবাজনা এসব নিয়েই বেশ কাটিয়ে দিয়েছে জীবনখানা৷ তার বাবা ও শ্বশুরমশাই দুই বন্ধু হওয়ার সুবাদে বিয়ে ঠিকের মাত্র দুই মাসের মাথায় বিয়ে হয়ে যায় তার। তার স্বামী নীল বছর খানেক আগে পারিবারিক ব্যবসায় প্রবেশ করেছে বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর। রুমা দেবীর চেয়ে বছর তিন-চারেকের বড়। রুমা দেবী এখানে এসেই তার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষাটি দেন,আরও পড়ার বিষয়ে সকলেরই সম্মতি ছিল কিন্তু তার শ্বাশুড়ির উনার সাথে তার স্বপ্ন গুলোকেও সাথে নিয়ে চলে গেলেন। এসব ভাবলে মনে হয় কয় যুগ আগের কথা। তারপর তিনি তার স্বপ্ন গুলোকে দূরে সরিয়ে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন। উনার শ্বশুরমশাই অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন,রুমা দেবী তার মায়ের মতো উনার হাত শক্ত করে ধরলেন,উনাকে প্রতিদিন জোর করে খাইয়ে দাইয়ে পাঠিয়ে দিতেন অফিসে,এই দেখে নীলাদ্রি বাবু স্ত্রীর উপর যারপরনাই খুশী হলেন।

ছোট ননদ মালার উপর শ্বাশুড়ি মারা যাওয়ার পরে নজর বাড়িয়ে দিলেন, কারণ আঠারো বছর বয়সটাকে বিশ্বাস নেই, বাড়িতে সবসময় এর কাজের লোক যাদুকে ঠিক করলেন সেই কাজে, মালা ডাক্তারী পড়বে ঠিকই ছিল, এটা মালার মায়ের স্বপ্ন কারণ মালার দাদু ডাক্তার ছিলেন, তাই তিনি চাইতেন তার একজন সন্তান অন্তত ডাক্তার হোক।তাই কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পাশাপাশি চলল ডাক্তার হওয়ার প্রস্তুতি, বাইরে থেকে কেউ আসলে সদা নজর রাখত রুমা নিজে, নইলে যদু তো আছেই। আসলে দিনকাল তো ভালো নয়, কি না কি হয়ে যায়। এখন বিচক্ষণ বুদ্ধিতে মনে হয় একটু বেশী বাড়াবাড়ি হয়েছিল তখন কিন্তু তখন রুমা নিজেও যে সংসারে কাঁচা ছিল, কি করে বুঝবে ঠিক ভুল? তবে এখন মনে হয় এতকিছু করে কি লাভ হল? বছর দুয়েক পড়ে মালা ডাক্তারী পড়তে গেল, তারপর আর ফিরে আসল কই? সামান্য কৃতজ্ঞতাও আজ আর কেউ দেখায় না কেউ কাউকে,পালিয়ে বিয়ে করল তারই কলেজের সহপাঠীকে,ডাক্তারী পড়াটাও শেষ করল না গর্ভবতী হয়ে পড়ার কারণে,এই কাজে সবচেয়ে ভেঙ্গে পড়লেন রুমার শ্বশুরমশাই, আজও ঠিক হলেন না। অবশ্য ততদিনে রুমা দেবী অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বিয়ে দিতে পেরেছিল তার বড় ননদকে, অবশ্য কাজটি সোজা ছিল না, ভাবলে মনে হয় আস্ত একটা নাটক, যার পুরোটাই লেখা তার নিজের হাতে, তবে এখন বড় ভালো লাগে নীলা সুখী আছে দেখে।তবে সে কাজটি নীরবে তাকে সংসারের কর্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিল, ভাবলে মনে হয় যেন এই তো সেদিন...

নীলা রুমার বড় ননদ হলেও সামান্য রুমার চেয়ে বড়, তবে রুমা ছিল সম্মানে বড় এবং তার বড় বৌদি।আইন শেষ বর্ষে পড়া কালীন প্রেমে পড়েন আনিসুর নামে একজনের সাথে, শ্বাশুড়ি যখন চলে যান তখন সবে পাশ করেছে আইন নীলা,রুমা সর্বময় কর্ত্রী, একদিন বাড়িতে নীলাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় চোখে পড়ে গেল রুমা দেবী, জিজ্ঞেস করলেন না নীলাকে কিছু, জানেন উত্তর মিলবে না, ছোট দেবর বিজুকে লাগালেন এই কাজে, তিনি জানতেন এরা কাছাকাছি কলেজের সুবাদে অনেকে Common friend ছিল, দুই দিনের মধ্যে সব খবর এসে গেল, ছেলেটি আনিসুর রহমান,কলেজে নীলার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিল কিন্তু নীলার সাথে এ বছর পাশ করে। রাজনৈতিক দলের পোশা গুন্ডা।আগেও অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। রুমা দেবরকে প্রশ্ন করে বাড়ি কোথায় , বাবা কি করে এসব কি খোঁজ নিয়েছ? মাথা চুলকায় বিজু, না সে সেসব জানেনা। তবে এতোটুকুই খোঁজ পেয়েছে মালদা কালিয়াচকে বাড়ি। এই নাম শুনে চমকে উঠে রুমা দেবী,তিনি তার কলেজের বন্ধু রূপের কাছে শুনেছিল এই জায়গায় নাম,বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী স্থান,যত ধরনের খারাপ কাজ সেখানে হয়।সে দ্রুত রূপের সাথে যোগাযোগ করল,রূপ জানালো আনিসুররা ১০ ভাই ৫ বোন, অবস্থা মোটামুটি, ৪ ভাই দিল্লিতে কাজ করে, সেই টাকায় পঞ্চম ভাই মানে আনিসুরকে পড়াচ্ছে বাইরে রেখে। তবে মুখে না বললেও আকার ইঙ্গিতে অনেক কিছুই বলে দিল,যাওয়ার আগে বলে গেল ওই স্থান মেয়ে পাচারের জন্য বিখ্যাত। মাথায় বাজ পড়ল রুমা দেবীর, তার শ্বাশুড়ি সবার দায়িত্ব তাকে দিয়ে গিয়েছে, কি করে নীলার মতো সুন্দরী ও শিক্ষিত মেয়েকে জলে ফেলে দেবে ও? শ্বশুর ও তার স্বামীকে জানালেন সবটা, চলল স্বল্প পরিকল্পনা,নীলের পিসি দিল্লিতে থাকেন তিনি স্কুল শিক্ষিকা ও পিসেমশাই অধ্যাপক,ওখানে পাঠিয়ে দিলেন উচ্চশিক্ষার নাম করে।বিয়ে ঠিক হল প্রবাসী বাঙ্গালীর সাথে, তিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।এদিকে নীলা জানেনা তার বাড়ির কেউ তার প্রেমের ব্যপারে কিছু জানে,তাই চুপ করে মেনে নিতে হল তাকে সবটা, অপরদিকে পাত্র প্রাণেশ তার পিসিমার মাসতুতো ননদের ছেলে, আগে থেকেই চেনা, আর প্রাণেশ পিসিমনির বাড়ি থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে সে,ওদিকে আনিসুরের নিজের কোনো ঠিক নেই,আর সবথেকে বড় প্রাচীনপন্থী চিন্তাধারার,এ যুগের হয়েও কারো সাথে কথা বলতে দিতে চায় না,যার সাথে কথা বলে তাকে গিয়ে শাসায়, একবার তো চড় পর্যন্ত মেরেছিল নীলাকে।এবার বান্ধবীরা মিলে প্রজেক্টের নাম করে সে আনিসুরের বাড়ি গিয়েছিল,ওদের পারলে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়,ওদের কথা শুনে মনে হয়েছিল আনিসুর ভালো দাও মেরেছে, ধনী ঘরের তনয়া সে, অর্থের অভাব কোনদিনও হবে না আনিসুরের, অবশ্য প্রেমের পড়ার পড়ে অনেক অর্থ নষ্ট করেছে নীলা আনিসুরের পেছনে।যে বন্ধুদের সাথে গিয়েছিল তাদের সাথে রাতে গোপনে পালিয়ে আসে এক স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায়। বাড়ির কেউ জানত না, এদিকে এতোদিনে আনিসুরের ঘরনি।ভাবলে জ্বর আসে তার।এরপর কলেজে ফিরে আনিসুর তাকে শাসায়,বলে তোকে আমি বিয়ে করব। নীলা উত্তর দিয়েছিল জোর জুলুম নাকি, আনিসুর বলেছিল" তোর লেখা সব চিঠি, আমাদের গোপন ছবি সারা শহর দেখবে "।চমকে উঠেছিল নীলা এই মানুষটিকে ভালোবেসেছিল সে!!! । তারপর থেকে আনিসুর তাকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে দিয়ে যেত ও নিয়ে যেত।

পিসির বাড়ি আসাটা তাকে মুক্তি দিয়েছিল আর এরমাঝে ছবিগুলো সে হস্তগত করেছে তার ছোট বেলার বন্ধু ও আনিসুরের ছায়াসঙ্গী আকাশের মাধ্যমে। তবে লজ্জিত হওয়ার মতো কিছুই ছিল না সেসব ছবিতে, সামান্য ছবি, তাই ভয় কেটে গিয়েছে তার, তবে চিঠি গুলো সে উদ্ধার করতে পারেনি।দিল্লিতেই বিয়ে হয়েছিল নীলা ও প্রাণেশের। মাস খানেকের মধ্যে, তারপর লণ্ডন। তার আগে এসেছিল তার ছোট শহরটিকে ও প্রাণ প্রিয় বাড়িটিকে বিদায় জানাবার জন্য আর ভিসা বানানোরও ছিল।সেসময় সব কথা বলেছিল রুমাদেবীকে, অবশ্য রুমাদেবীই জিজ্ঞেস করেছিল আনিসুরকে ভুলতে পেরেছিস?চমকে উঠে বলেছিল "তুমি জানো?" তারপর মন খুলে সব কথা বলেছিল, শেষে অনেক ধন্যবাদ পর্যন্ত দিয়েছিল সে, সে সময় নীলাকে ঠকানোর যে ভার মনে চেপে বসেছিল, তাও কেটে গিয়েছিল নীলার কথা শুনে।

পড়ে অবশ্য চিঠি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল নীলা ও প্রাণেশের মধ্যে, যা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াতে পারত যদিনা আন্তরিক ভাবে ও বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টি রুমা দেবী বিফল করে দেন এবং আনিসুরের অপপ্রচেষ্টা বিফল হয়।

"বম্মা ও বম্মা শুনছ?" ছোট্ট পিকুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে রুমা দেবীর,তিনি চিন্তার রাজ্যের ডুব দিয়েছিলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে "বল বাবা বল শুনছি তো,তোর কথা না শুনে থাকতে পারি?"

কিছুক্ষণ পরে বাড়িতে ফিরে রিজু, হয়তো রুমা বাড়ি আসাতে ফোন করে ডেকেছে লেখা, রিজু এসেই রুমা দেবীকে এসে বলে " কি গো কখন এলে, কিছু দরকার বুঝি? তা আজকেই ফিরবে তো? "

রুমা তার দেবরের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল, এর মাঝেই পিকু বলে উঠলো " না না আজকে বম্মাকে যেতেই দেবোনা ", রিজু ধমকে বকে উঠে " আঃ পিকু বড়দের মাঝে কথা বলছ কেন?, লেখা ও লেখা ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও "। লেখা বলল " যাচ্ছি তবে শান্তি করে বসে কথা বলো না আর দিদিকে আজ যেতেই দেবো না কিন্তু আজকে"। রিজু আরও গলার স্বর উচ্চ করে বলে উঠে " তুমি সব বিষয় কথা বলো না, যা বলছি তাই করো"। সুলেখা একবার স্বামীর মুখের পানে তাকিয়ে ছেলেকে নিয়ে ওই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।তবে সুলেখা বড় সম্মান করে এই মানুষটিকে,আর ওর জন্যেই তো তার জীবনের সব পাওয়া।

ওরা বেড়িয়ে যেতেই বলে উঠলো রিজু "বলছি চুপ যে কিছু তো বলো? ", কি বলবে রুমা দেবী, এ কাকে দেখছে?এই রিজু যখন MBA পড়তে যাবার জন্য নাছোড়, তখন রুমা দেবী তার গহনা বন্ধক রেখে পাঠিয়েছিলেন এই রিজুকে,তখন সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে নীলার আর ছোট ননদ ডাক্তারীতে ভর্তি হয়েছে আর দুই দেবরের কলেজ পড়ার খরচ,এছাড়াও আছে বাড়ির বাকি খরচ আর আয় বলতে পারিবারিক ব্যবসা, তাও রুমার স্বামী নীল উদয়াস্ত পরিশ্রম আর বুদ্ধির জোরে চলে যায়, রুমার শ্বশুর সংসারে থেকেও নেই, রুমার শ্বাশুড়ি চলে যাওয়ার পর থেকে। এর মাঝে MBA এর মতো খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, রুমা নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নিজের গয়না গুলো তুলে দিয়েছিল পড়ার জন্য,কি না করেছে রুমা এই পরিবারের জন্য।

আস্তে আস্তে বলে "তেমন কিছু না, সামনে দীপাবলি ,বাড়ির পুজো আর দূর্গাপুজোতেও একবারও গেলে না,এমনকি বিজয়া করতে গেলে না, তাই আর কি, পিকুটাকে না দেখে কি থাকা যায়? সামনে বাড়ির কালী পুজো আর তারপর ভাইফোঁটা, তা টিনা মিনা (রুমার দুই কন্যা) বরাবর ওকে ফোঁটা দিয়ে এসেছে তো তাই আর কি, আর পুজোর খরচ....", কথা শেষের আগেই বলে উঠে রিজু "তাই বলো, ওসব ভাইফোঁটা আর দেখা টেখা কিছু না, পুজোর খরচ চাইতে এসেছ তাই না?", লজ্জায় অপমানে বোবা হয়ে গেল রুমা দেবী। আরও বলতে থাকে রিজু " দেখো আমি ওসব পুজো টুজোর খরচ দিতে পারব না, আমার কাছে আশা করো না আর ভাইফোঁটা-টোটার মতো এসব bogus ritual আমি মাথায় ঢোকাতে চাই না আর আমিও চাইনা আমার ছেলেও এগুলো মাথায় ঢুকুক, ও আরেকটা কথা পুজোয় যাওয়া সম্ভব না, আমরা foreign trip এ যাচ্ছি"।

রুমা দেবী আর একটা কথা না বলে বেড়িয়ে আসেন, তিনি জানেন না কি করে বাড়ি ফিরবেন, ফেরার বাস আদেও পাবে কি না, তাছাড়া আশার সময় পিকু পেছনে ছুটে এসেছিল, জোর করে নিয়ে যায় ওকে রিজু, পেছনে থেকে শুনতে পায় সুলেখা বলছে "দিদিকে যেতে দিলে, আঁটকালে না?", উত্তরে রিজু জানায় " ছাড়ো তো, পয়সা সব পয়সার লোভে আসে "। তারপরের কথা আর রুমার কানে ঢোকে না, অনেকটা এগিয়ে এসেছেন উনি আর পিকুর গগন ভেদি চিৎকারে ঢাকা পড়ে যায়।

বুকটা মোচড়ে উঠে রুমার, জন্ম সুলেখা দিলেও তিনিই মানুষ করেছেন পিকুকে, তখন লেখা ওরফে সুলেখা চাকরি আর নিজের Carrier নিয়ে ব্যস্ত ছিল আর রিজু তখন বিদেশে চাকরি নিয়ে। কলেজ থেকে প্রেম ছিল ওদের,রিজু MBA পড়তে বাইরে যায়, এদিকে সুলেখাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য, বিয়েও হয় ওদের কিন্তু দুইজন দুদিকে।রিজু - লেখা জন্ম দিলেও পিকুর প্রকৃত মা-বাবা রুমা আর নীল আর খেলার সাথী তার ৯ বছরের বড় দাদা নীরু আর ৮ বছরের বড় দুই দিদি টিনা মিনা, অবশ্য দাদুকে বেশীদিন পায়নি পিকু। আরও মনটা হু হু করে উঠে রুমার আজ পর্যন্ত কোনও পুজো তারা পিকুকে বাদ দিয়ে কাটায় নি, সবার আগে ওর জামাটাই কেনা হতো আর বাড়ির কালীপূজা ও ভাইফোঁটা পিকুকে বাদ দিয়ে ভাবতেই পারে না কেউ, পুজোতে যায়নি দেখে সব মান অভিমান ভুলে পিকুকে দেখতে ও জামাটা দিতে এসেছিল রুমা,ইচ্ছে ছিল সাথে করে নিয়ে যাবে পিকুকে।

অপমানের এমন আঘাতে কেমন যেন হয়ে পড়ল রুমা, কিছুদূর এগিয়ে একটা শিশু উদ্যান ছিল, সেখানে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল, যেন পাথর মূর্তি। রুমার দুই ননদ নীলা আর মালার বিয়ের পর কতবার নিজে হাতে দুই দেবরকে ফোঁটা দিয়েছে সে,যাতে ফোঁটা বন্ধ না হয় এদের, আর তার ভালোবাসার এই প্রতিদান?এর নামই কি সংসার?

এদিকে টিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেটাও জানাতে এসেছিল আর রুমা তার সব গহনাই তো দিয়ে দিয়েছিল, তার কিছুটা যদি পেতো, তার তো অনেক ছিল, কিছুটা পেলেই ভালো হতো,যে বাড়ির পুজোর খরচই দেবে না বলেছে, সে কি আর বৌদির গহনা ফিরিয়ে দেয় বা তাকে ওসব কথা বলা যায়? যাদের স্বপ্ন বাঁচাতে নিজের স্বপ্নকে বলি দিয়েছে, তারাই কি প্রতিদান দিচ্ছে আজ!! রুমা কিছুই ফিরিয়ে নিতে চায় না, নেহাত ব্যবসা ভাগ করে নিয়েছে ছোট দেবর বিজু,তবে ব্যবসার ঋণ মেটাবার ভাগটা বাদ দিয়ে।

এই বিজুর জন্যেও কম করেছে রুমা, পড়াশোনায় মনোযোগী কোনদিনও ছিল না, তাই তিনি ব্যবসায় জোর করে ঢুকিয়ে দেয় আর একবার তো অসুখে মরতে বসেছিল, সারা দিন-রাত থেকে সেবা করে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছিল রুমা আর শুধু কি তাই একজন গায়িকা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, বাড়িতে কোনমতেই মানবে না তিনি দেবরের পাশে দাঁড়ায় ও ওদের বিয়ে দেয়।বছর দুই আগে বিয়ের প্রায় আট বছর পড়ে পিতা-মাতার স্বাদ পেলো বিজু আর নন্দিতা, সেটাও রুমার দৌলতে,নন্দিতাকে পুরোপুরি বিশ্রামে রাখতে হত আর রুমার নিরলস পরিশ্রম ও পরিচর্যার কারণে। বাচ্চার একবছর জন্মদিনে ব্যবসা ভাগ করে নেয় আর সাথে ভাগ বুঝে নেয় বাড়ির উপরটা বাচ্চার সুরক্ষার দোহাই দিয়ে, আসলে কিছুদিন ধরে ব্যবসায় মন্দ চলছিল ,দাদার পাশে না দাঁড়িয়ে, ঠিক নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজে নেয়। অবশ্য রিজুই পথটা দেখায়,সেই নিজের বাড়ি বানানোর জন্য সম্পত্তির ভাগ নিয়েছে, সেসময় কিছু শেয়ার পর্যন্ত বিক্রি করতে হয় টাকা মেটাতে, সেই ধাক্কাটাই ব্যবসা মন্দার আরেকটি কারণ। সম্পত্তির ভাগ নিলেও দায় দায়িত্ব আত্মীয় কুটুম্বের ভাগ গুলো পড়েছে কেবলমাত্র নীলের ভাগেই,এই যেমন পারিবারিক পুজোর দায়িত্বটাও কেবলমাত্র তাদের।

এরপরে কেটে গিয়েছে আরও ৮ টা বছর,সেদিন কি করে বাড়ি ফিরেছে, রুমার তেমন কিছুই মনে নেই, তবে পড়ে শুনেছিল সে সেই উদ্যানেই জ্ঞান হারায়, আশেপাশের লোকজন উনাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায়, সেখানকার ডাক্তার ছিল টিনার ছোট ননদের স্বামী, ব্যগ খুলে পায় ঠিকানা, জানতে পারে পরিচয়, সাথে সাথে ডাঃ মল্লিক ডেকে নেয় স্ত্রী মালাকে, এতো বছর ধরে তারা লজ্জায় বাড়িতে যেতে পর্যন্ত পারেনি তারা,মালা বৌদিকে এমন অবস্থায় দেখে কেঁদে ফেলে।ওরাই পরের দিন বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায় রুমাকে, মালার যত্নে সুস্থ হয়ে উঠে রুমা। মালা দাদা-বৌদির সামনে ক্ষমা চেয়ে নেয়, রুমা এতোটুকুই বলেছিল - " বোন তোর উপর রাগ করিনি, হয়েছিল অভিমান, বিয়ে করতিস রুপাইকেই খালি পড়াশোনা শেষ করে,তোর মায়ের স্বপ্ন ছিল যে আর এমন করে কেউ পালিয়ে বিয়ে করে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন তোদের বাবা, শেষ দিন পর্যন্ত তোকে ক্ষমা করতে পারেনি, আর এতোবছরে একবারও এলি না, এতো পাষাণ তুই? " বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় রুমা নিজের চোখের জল লুকোতে। মালা বলে " না গো বৌদি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনি, ছাড়ো এসব আর ক্ষমা করো আমাকে, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো, পুজো তো করতে হবে যে "। পুজো ভাইফোঁটা কেটে যায় সেবছর বেশ আনন্দে, তবু কোথায় যেন কষ্ট ভাইবোনের মাঝে, নতুন দুই ভাইবোনকে পেলেও পিকুকে কাছে না পাওয়ার কষ্টটা রয়েই যায় ওদের মনে।

সেখানে টিনার বিয়েটা হয়নি,অবশ্য টিনার তখন সবে আঠারো কারো ইচ্ছেও ছিল না, খালি টিনা নাছোড় ছিল দেখে রাজি হয়, পণের টাকার ভার এরা না নিতে পারায় টিনার বিয়েটা ওখানে হয় না। আর নতুন পিসো টিনাকে নিজেদের উদাহরণ দিয়ে বোঝায় নিজেদের ভুলটা।

আজ আট বছর পরের ছবি ধর বাড়ির, টিনা সরকারি চাকরিজীবি, মিনা M.com করে বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে রাজ্যের শাখা গুলো দেখে আর নীরু MBA শেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলেছে, আর তার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ও নিয়েছে । অবশ্য নীরু আর মিনা বিদেশে না দেশেই পড়াশোনা করেছে, সাহায্য করেছে তাদের নতুন পিসো, অর্থের সাহায্য নেয়নি ওরা, কষ্ট করে নিজের চেষ্টায় পড়েছে। কিন্তু পিকু আজ ছন্নছাড়া নেশাগ্রস্ত একজন কৈশোর আর ওদিকে বিজু চলন্ত ব্যবসাটাই চালাতে পারেনি বেশীদিন কারণ একা ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা ছিল না কোনদিন,দাদার সাথে থাকত দেখে নিজের অক্ষমতা তার চোখে পড়েনি, তারফলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় নন্দিতার সাথে, সন্তান নিয়ে চলে যায় নন্দিতা।

তবে তার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে যেতে পারেনি রুমা দেবী, এই আঘাতের কয়েকবছর পড়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান উনি, তবে মেয়েদের আর ছেলের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আর নীলের কাছ থেকে সন্তানদের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়ে অভিমানী রুমা বিদায় নেয় সংসারের রঙ্গমঞ্চ থেকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract