Piyali Mukherjee

Abstract Tragedy Inspirational

3.8  

Piyali Mukherjee

Abstract Tragedy Inspirational

একা বৈদেহী 🌿

একা বৈদেহী 🌿

12 mins
516


অমিতাভের আর মিথিলার পাশাপাশি বাড়ি কলকাতার নিউ আলিপুরে, বড়লোকের সন্তান । এলাকায় বাস অনেক দিনের । মিথিলার বাবা শ্রী শোভন সরকার কলকাতার একজন বিখ্যাত চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, নিজস্ব কনসালটেন্সি ফার্ম আছে। বড় বড় দুখানা অফিসের মালিক তিনি । দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং বিদেশে কাজের জন্য অনবরত আনাগোনা করতে হয়। একমাত্র মেয়ে মিথিলা এবং একমাত্র ছেলে সুজনকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন বিশাল। সুজন তাঁরই পথ অনুসরণ করেছে। মিথিলা মাস্টার্স ইন ফিলোজফি। ডক্টরেট করছে আপাতত কলকাতা থেকে।

অমিতাভরা বংশানুক্রমে ব‍্যবসায়ী। বাবা শ্রী মৃণাল ব্যানার্জী কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নিজের তৈরি রঙ-এর ব্যবসা করেন । এখন ছেলে অমিতাভ ব্যবসার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠেছে। যেহেতু তাদের রং বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে ব‍্যবহার করা যায়, আর অনেকদিন তার ঝকঝকে ভাব বজায় থাকে , তাই দেখতে দেখতে এর চাহিদা বেড়ে উঠেছিল তার বাবার আমল থেকেই । ফলে ওর বাবা এখন একজন বেশ নামী সাপ্লায়ার দেশে- বিদেশে।

কলকাতায় দুই পরিবার পাশাপাশি বাড়িতে থাকার জন্যই পারস্পরিক বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। অমিতাভ এবং মিথিলার ক্ষেত্রে সেটা হয়ে ওঠে আরও আলাদা। বলা যায়, তাদের ঠাকুরদার সময় থেকেই,

প্রায় তিন জেনারেশন ধরে তাদের সম্পর্কটা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। প্রতি অনুষ্ঠানেই দুই পরিবারের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য।

অমিতাভ বাবার মতই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বাবার ব‍্যবসাতেই যোগ দিল। আরও নতুন অনেক কিছু যুক্ত করলো, তাতে ব‍্যবসা দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠতেও লাগলো। দুই পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ হলেও, এরা কিন্তু নিজেদের বন্ধুত্বকে চিরস্থায়ী করার জন্য অমিতাভ আর মিথিলার মধ্যে বিবাহ স্থির করলো। তবে এতে ছেলে বা মেয়ের মতামত জানারও প্রয়োজনও মনে করল না কেউই। দুই পরিবারের সবাই ভুলটা বোধহয় এখানেই করলো। 

ফলে এক্কেবারে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে উভয়কেই জানানো হলো। দুজনেই আকাশ থেকে পড়লো। যদিও অমিতাভ আর মিথিলা একে অপরের খুব চেনা ,কথাও হয় কিন্তু বিয়ে ? এটার জন‍্য দু'জনের কেউই প্রস্তুত ছিল না। অমিতাভ ভালবাসে তারই ক্লাসমেট দেবযানীকে , সে এখন চাকরি করে আইটি কোম্পানিতে, থাকে বর্তমানে পুণে , মুম্বাইতে শিফট করবে খুব শিগগিরই।

অমিতাভ ভেবেছিল কয়েকটা বছর যাক, তারপর না হয় দেবযানীর কথা বাড়িতে বলবে, কিন্তু তার আগেই তো অনেক কিছু হয়ে গেল। ও জানতেও পারলো না, যখন জানতে পারলো তখন বাবার মুখের ওপর 'না' বলার মতন ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই তার হলো না। সে তো স্বাধীন ভাবে চাকরি করে না, পাশ করে বাবার তৈরী ব‍্যবসায়ে যোগ দিয়েছে। এখন ভাবছে চাকরি করলেই বুঝি ভালো হতো।

এই পরিস্থিতি সে সামলাবে কি করে? দেবযানীকেই বা কি বলবে? ও তো তার ভরসাতেই রয়েছে!

অমিতাভ দেবযানীকে ফোন করে জানালো বর্তমান পরিস্থিতির বিপর্যয়ের কথা। দেবী তো শুনে হেসেই অস্থির, বললো --" তাহলে আর কি! ভালো ছেলে সেজে ছাদনাতলায় বসে পড়ো। আমি কোন অভিযোগ করবো না। সেই নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না।"

দিব‍্য রেগে গিয়ে বলল-- "ইয়ার্কি মনে হচ্ছে তোমার! আমি মরছি নিজের জ্বালায় আর তুমি রসিকতা করছ? একটা উপায় বলো না। আমি কাল আসছি তোমার কাছে, দুজনে পরামর্শ করে একটা উপায় বার করতেই হবে। রাখলাম ,কাল দেখা হচ্ছে।" কাল ভোরের ফ্লাইটেই মুম্বাই যাওয়াই স্থির করলো অমিতাভ । অনলাইনে টিকিটও বুক করে ফেলল।

বাড়িতে বলল, "বন্ধুর বিয়ে । দু চারদিন পর ফিরবে।"

নিজের ব‍্যাগ গুছিয়ে ফেললো। ভোর হতেই রওনা হল। সেদিন রবিবার তাই দেবীর অফিস নেই ,তাছাড়া ও তো বাড়িতে একা থাকে, কাজেই সেখানে থাকতে তার কোনো অসুবিধে নেই। দুদিন থাকলো সেখানে ঠিকই কিন্তু অনেক ভেবে কোনো সুরাহা হল না। শেষে ঠিক হল অমিতাভ নিজের মাকে বলবে দেবযানীর কথা।

ক'দিন ওর সঙ্গে মুম্বাইতে কাটিয়ে অমিতাভ বাড়ি ফিরে এল।

কথাটা যেদিন বলবে ভাবছে সেই দিন অফিস থেকে ফিরেই মৃণালবাবু হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

বুকে ভীষণ ব‍্যথা, খুব ঘাম হচ্ছে, পুরো হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। অমিতাভ সেদিন বাড়িতেই ছিল , সময় নষ্ট না করে AMRI-তে ভর্তি করে দেওয়া হল। ঐ হাসপাতালে ডঃ অরিন্দম সরকার হার্ট স্পেশালিস্ট, মৃণালবাবুর বন্ধু, আর তাই সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। বেঁচে গেলেন ঠিকই , তবে বাম দিকটা একটু অসুবিধার কারণ তৈরি হলো , কথাও জড়িয়ে যায়।

ডাক্তার বললেন--" খুব যত্নে রাখতে হবে, কোনো রকম উত্তেজনা যাতে না হয় তাহলে বাঁচানো যাবে না।" একসপ্তাহ পর অমিতাভ বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। কয়েক দিন একটু সুস্থ হয়ে উনি কিন্তু মিথিলার বাবাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন---"যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই , কোনো দিন যদি কিছু ঘটে, ওদের বিয়েটা দেখে যেতে চাই।"

সেই দিনই সন্ধ্যায় দুই পরিবার একসাথে বসে পুরোহিত মশাইকে ডেকে দিন ঠিক করল। ঠিক একমাস পর একটি শুভলগ্নে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ স্থির হলো। বেশী আড়ম্বর আর লোক সমাগমের থেকে বিয়েটা হয়ে উঠলো দুই পরিবারের একান্ত ইচ্ছের স্বার্থপূরণ। মৃণাল বাবু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তখন জাঁকজমকপূর্ণ একটা প্রীতিভোজের আয়োজন করা যাবে, স্থির হলো। একমাত্র ছেলে অমিতাভ, তাই অনেক আশা তাঁর মনে।

কিন্তু অমিতাভর সায় নেই এই বিয়েতে, অথচ কারোকে বারণ করবে তারও কোনও উপায় নেই। ও পড়লো মহা ঝামেলায় ! দেবযানীকেই বা কি বলবে, বাড়িতেই বা কি বলবে, বাবার যা শরীরের অবস্থা তাতে তাঁকে কিছুই বলা যাবেনা। অতএব পরিস্থিতি তাকে চুপ করে থাকতে বাধ্য করল।

কোথাও কিছু জানানো গেল না। নির্ধারিত দিনে বিয়ে হয়ে গেল অমিতাভ আর মিথিলার। বৌভাতের সামান্য অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে মিথিলা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল অমিতাভর জন্য। প্রত‍্যেক মেয়েদের কাছেই এই রাতটার নানারকম স্বপ্ন থাকে। আর মিথিলা তো অমিতাভকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে, কথাও বলেছে। তবে তার সঙ্গে বিয়ের কথা কোনদিন মনে আসেনি। আজ হঠাৎ তার জীবনে এমন ভাবে অমিতাভর প্রবেশ তার জীবনটাকে যেন সত্যিই ওলটপালট করে দিল।

ভালো লাগা একটা ছিল অমিতাভর জন্য, আর এমন স্বীকৃতি পেয়ে মনটাও বেশ হালকা হয়ে গিয়েছিল।

এই সব ভাবনার মাঝখানে অমিতাভ এল এবং ঘরের দরজা বন্ধ করতেই ওর শরীরে শিহরণ খেলে গেল।

কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অমিতাভ খুব গম্ভীর গলায় বলল-----"বাবার ইচ্ছেতে আমি তোমায় বিয়ে করেছি। আমি আমার ক্লাসমেট দেবযানীকে ভালোবাসি, সে মুম্বাইয়ে চাকরি করে। আমি বাড়িতে বলবো ভাবছিলাম, সেই সময় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল, কিছুই বলতে পারলাম না। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো।"। মিথিলা অবাক হয়ে অমিতাভর কথাগুলো শুনল, কিছু সময় চুপ করে রইলো। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়লো। এক মুহুর্তেই যেন তার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

শুধু এটুকুই বলল-- "আমি এবার কি করবো?"

অমিতাভ বলল--"এখন কাউকে কিছু জানানো যাবে না। পরে ভেবে দেখব।"

সারাদিনের ক্লান্তি আর এত বড় আঘাতের পর মিথিলা এতো ক্লান্ত হয়ে পড়লো যে ভাববার মতন শক্তিটুকু হারিয়ে ফেললো। কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে নিজেই জানে না।

এখন থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের মতন পথ চলা তার। এখন আর কিছু করার নেই। স্বামী-স্ত্রীর মত অভিনয় করে যেতে হবে যতদিন শ্বশুর মশাই বেঁচে আছেন বা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে না উঠছেন। নিজের বাপের বাড়িতেও কিছু বলতে পারবে না। এ যে কি মর্মান্তিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! শুধু তা মিথিলাই বুঝতে পারলো। কারোকে বলার কোনো উপায় নেই। মনে হলো, এখন শুধু পড়াশোনা আর কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে হবে।

বাঁচার রাস্তা এই একটাই।

অতিথিরা একে একে বিদায় নিতেই, ঘর ফাঁকা হতেই অমিতাভ অফিসের কাজ আছে বলে মুম্বাই চলে গেল । মিথিলা বুঝল , অমিতাভ কোথায় গেল। মিথিলা ভেবেছিল হনিমুনে যাবে তাই পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে ছিল। কিন্তু সেটা যখন হলো না ,তখন ছুটি ক্যানসেল করে আবার ইউনিভার্সিটি জয়েন করলো। মিথিলা একজন রিসার্চ ফেলো।

বন্ধুদের বলল--"শ্বশুর মশাই অসুস্থ তাই কোথাও যাওয়া আর হলোনা।"


অমিতাভ দিন দশেক পরে ফিরল। মৃণালবাবুর চিন্তা , ছেলে নিজের ব‍্যবসার দায়িত্ব না নিলে তো তাঁর পার্টনার-বন্ধু চন্দন রায় সর্বস্ব নিজের মুঠোয় করে নেবেন ‌। ওর ছেলে দিব্য অতি ধূর্ত। সেক্ষেত্রে অমিতাভ যদি এমন ভাবে ঘুরে বেড়ায় তাহলে সব লাটে উঠবে। মৃণালবাবুর এতদিনের প্রচেষ্টা সব ব‍্যর্থ হবে। যদিও উনি সুস্থ আছেন তবে হাঁটাচলার ক্ষমতা একটু হারিয়েছেন। একা চলতে এখন তিনি বেশ ভয় পান।

অফিসে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ব‍্যবসার যে বারোটা বাজতে চলেছে তা তিনি বুঝতে পারছিলেন,তাই একদিন ছেলেকে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন---"তোমার কি ব‍্যবসায় মন নেই ? বার বার মুম্বাই যাও কেন? আর বৌমার ওপর সংসারের দায়িত্ব চাপিয়েই বা ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?!"

এতদিন পর বাবার এমন প্রশ্নের উত্তরে শুধু বললো ---" ব্যবসা তার ভালো লাগছে না। মুম্বাইয়ে সে চাকরির চেষ্টা করছে আর মিথিলা যেহেতু এখানেই চাকরি করে সেহেতু ও এখানেই থাকবে। " ওর কথায় বাড়ীতে সবাই অবাক হলো। বলা যায়, একরকম নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।

আর মিথিলা সব শুনে ভাবল, "কি সুন্দর ডিসিশন, কোন সম্পর্ক নেই যার সঙ্গে , তার বাড়িতে তার বাবা- মায়ের দায়িত্ব নিয়ে আমাকে থাকতে হবে!"

মৃণালবাবু চুপ করেই রইলেন। বুঝলেন ব‍্যবসাটা আর ধরে রাখা যাবে না। শরীরটা ভালো লাগছে না। বারান্দায় গিয়ে বসলেন চুপচাপ। কারো সঙ্গে কথাও বললেন না। খুব খারাপ লাগলো মিথিলার। এই কয়দিনে কর্তব্যপরায়ণা বলে সুনাম হয়েছে শ্বশুরবাড়িতে। চা খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসে দেখলো কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে শ্বশুরমশাই। ওর হাত দুটো চেপে ধরলো। মিথিলা বুঝলো উনি কি বলতে চাইছেন! অনেক পরিশ্রমের ফল আজ এই ব্যবসা।

মিথিলাও শ্বশুরমশাইকে সরাসরি না করতে পারল না। বলল--"বাবা , আমি কি পারব ব‍্যবসা সামলাতে?"

মৃণাল বাবু বললেন--" নিশ্চয়ই পারবে, আমি তোমায় সব শিখিয়ে দেব। অফিসের দরকারি কাগজ পত্র,ফাইল বাড়ি নিয়ে আসবে । আমি মোহনকে বুঝিয়ে বলব। দেখবে তোমার কোনো অসুবিধে হবেনা। কলেজ থেকে ফেরার সময় আমাদের অফিসে গিয়ে একটু সময় দিও আর সব বোঝার চেষ্টা কোরো। দরকার হলে আমাদের প্রোডাকশনের জায়গাটাও দেখে এস। আমার বিশ্বাস তুমিই পারবে। অমিতাভর ওপর আর ভরসা নেই আমার।"

মিথিলা রাজী হলো। ঘরে এসে দেখলো , অমিতাভ বেরিয়ে গেছে। এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিথিলা নীচে গেল। রাতের রান্না বলে দিতে হবে। শ্বশুর-মশাইয়ের চা করতে হবে। একবার শাশুড়ি -মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। উনি এই কথায় এতটাই হতভম্ব যে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।

অমিতাভ এখন প্রায়ই মুম্বাই যায়, টানা বেশ কয়েকদিন থাকে, শনিবারে এসে রবিবার বিকেলে ফিরে যায়। দুদিক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে সে চাকরি জয়েন করেছে। আর মিথিলাকে বলল-----"আমি চাকরি জয়েন করেছি , দেবযানীর সাথেই থাকি। আমাদের ডিভোর্স না হলে তো ওকে বিয়ে করতে পারব না।"

মিথিলা নির্বিকার ভাবে বলল----"আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। তুমি যেখানে বলবে সাইন করে দেব। কেউ জানবে না। তুমি যার সঙ্গে থাকতে চাও তাকে বিয়ে করে ভদ্রভাবে থাকো। আমার জীবন আমি বুঝে নেব। বাবার বিশ্বাস আমি ভাঙতে পারব না। দেখি কতদিন এভাবে চলতে পারি।"

এতো কঠিন কথা শুনে অমিতাভ অবাক হলো, ও সত্যিই ভাবেনি মিথিলা এত তাড়াতাড়ি তাকে মুক্তি দিতে রাজি হবে!

দেখতে দেখতে তিন বছর পেরিয়ে গেল। মিথিলা এখন নিজের সব আশা- আকাঙ্খার বিসর্জন দিয়ে একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। যতটা সম্ভব নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। শ্বশুরমশাইকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু বিধি বাম, কিছুই হচ্ছে না। ইচ্ছে ছিল উনি ভালো হলে আবার নিজের ব‍্যবসার দায়িত্ব নিয়ে মিথিলাকে মুক্তি দেবেন। এখনো বাড়ীতে কেউ জানে না ওদের ডির্ভোসের কথা । এমনকি ওর বাপের বাড়িতেও নয়। কী অদ্ভুত না! বরং সবাই গর্ববোধ করে মিথিলার এমন ভূমিকায়।


অমিতাভ এখন দুমাসে দুদিনের জন্য আসে । বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিয়ে যায়। মিথিলার সঙ্গে একই ঘরে থাকে অপরিচিতের মত। কখনো কখনো দু-একটা কথা হয়। তিন বছর হয়ে গেলো অমিতাভর মা নাতি নাতনির মুখ দেখতে চান।

যার জন্য মিথিলাকে অনেক কথাই মাঝে মাঝে শুনতে হয়। "ছেলে বারমুখো হবে না তো কি ! একটা ছেলেপিলে না হলে এমনি তো হবে বাপু.... "..ইত্যাদি গোছের কথা আর কি! এখন আর কিছু বলে না মিথিলা, নীরবে চোখের জল ফেলে। কিন্তু যার জন্য তার এই অবস্থা তার কিন্তু ওর প্রতি কোনো সহানুভূতি আছে বলে মনে হয় না। ডিভোর্স পেয়ে গেছে, সবার অজান্তে দেবযানীকে বিয়ে করে সুখে ঘর সংসার করছে। ওর কাছ থেকে হয়তো মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু মিথিলা তো ওর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও বাঁধা পড়ে রইলো এই সংসারে। শুধু মানবিকতার খাতিরে। কারোকে বলার কোনো উপায় রইলো না। অমিতাভর মায়ের কথাও সহ্য করে নিল। যার সঙ্গে স্বামী- স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই, তার বাচ্চা নেওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কোথায়!

মিথিলার দায়িত্ব অনেক। কোনো সম্পর্ক নেই তবু দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কলেজ , অফিস, বাড়ি সব তাকে একা হাতেই সামলাতে হচ্ছে। নিয়মিত শ্বশুরমশাই এর চেকআপ করা থেকে সব। ও যে ধীরে ধীরে মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, তাও যেন বোঝার মতো ক্ষমতা নেই কারোও। পাশেই বাপের বাড়ি তবু কখনো-সখনো যায় ঘন্টা খানেকের জন্য। বাপের বাড়ি গেলে মার কাছেও সেই একই কথা শুনতে হয়, "এখন ছেলেপুলে হলো না কেন, ডাক্তার দেখানো উচিত ইত‍্যাদি।" তাই আর ভালো লাগে না ওর।

মিথিলা এখন ব‍্যবসার অনেক কিছু বুঝে নিয়েছে।

মৃণালবাবু অনেকটা নিশ্চিন্ত। ম্যানেজার মোহনকাকুও তাকে মেয়ের মতন স্নেহ করেন। তাই আর কোনো অসুবিধাও হয় না।

ইতিমধ্যেই অমিতাভ জানিয়েছে যে , তাদের ছেলে হয়েছে। মিথিলা তাদের নিয়ে একবার আসতে বললো। অমিতাভ একটু চিন্তায় পড়েছিল যদিও, কিন্তু মিথিলা বললো-- " চিন্তা কোরোনা আমি সব সামলে নেব। তোমার বাবা, মা আমার কাছে বংশধরের আশা করেন। কিন্তু তুমি তো জানো এটা সম্ভব নয়। তুমি তাঁদের বংশধরকে নিয়ে একবার এস। ওনাদের বয়স হয়েছে। দেখে খুশি হবেন।"

অমিতাভ জানালো কয়েক মাস পরে আসবে, বাচ্চাটা একটু বড়ো হোক।

--" তাহলে আমি যখন বলবো তখন এসো, এখানে ওর অন্নপ্রাশন দেব।

দিন ঠিক করে তোমায় জানাব।"

‌ দেখতে দেখতে কটা মাস পেরিয়ে গেল। মিথিলা অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক করে ফেলেছে। তার পরিচিত পুরোহিত ঠাকুরের কাছে গিয়ে অন্নপ্রাশনে যা যা লাগবে তার লিস্ট নিয়ে এসেছে এবং রোজ কিছু কিছু জিনিসপত্র কিনেও ফেলছে।

এই কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারলেই তার ছুটি। পাঁচ বছর হয়ে গেল এবাড়িতে তার, মায়াও পড়ে গেছে এই দুজন বয়স্ক মানুষের ওপর। "বাবা , মা" বলে ডেকে আসছে এই কবছর। তাঁরাও মিথিলার ওপর সম্পূর্ণ

নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তবুও সব কিছুর মায়া ত‍্যাগ করে মিথিলাকে তো একদিন চলে যেতেই হবে। কারণ এই সংসার তো ওর নয়! শুধু অভিনয় করছে মাত্র।

রোজ রাতে শুয়ে ভাবে কিভাবে বলবে বাড়িতে অমিতাভর কথা ,তাদের কি প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে!

তবু বলতেই হবে, কতদিন আর এই ঘটনাকে আড়াল করে রাখবে।

অমিতাভ-র সপরিবারে আসার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই মিথিলা নার্ভাস হয়ে পড়ছে। অবশেষে এলো সেই দিন। ঘরবাড়ি রং করতে শুরু করেছিল একমাস আগে, সবাই ভাবলো, "বাঃ, এই না হলে দায়িত্বশীল ছেলের বউ!" এরপর সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে বাড়ি মিথিলা । যেদিন আসার কথা ওদের, সেদিন কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছে । অমিতাভ সস্ত্রীক দুপুরের ফ্লাইটে পৌঁছে যাবে তাই তাদের খাওয়ার আয়োজনও করেছে। বিশাল আয়োজন।

শাশুড়ি মা ভাবছেন " আজ বৌমাকে অন‍্য রকম লাগছে, কেউ কি আসবে?" কৌতুহলের বশে জিজ্ঞেস করে ফেললেন --"আজ কি কেউ আসবে বৌমা?"

মিথিলাও যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, বললো--" হ্যাঁ, মা, আপনার ছেলে আর তার সঙ্গে দুজন অতিথিও আসবে ।"

অমিতাভর মা ছেলে আসছে শুনে খুশি হলেন। এবার প্রায় সাত- আট মাস পরে ছেলে আসছে, খুশী তো হবারই কথা।

বাড়ির বাইরে গাড়ির হর্ন শুনে মিথিলা এগিয়ে গেল। গাড়ি থেকে অমিতাভ নামল , পিছনে তার স্ত্রীর কোলে তাদের সন্তান। অমিতাভর মা বসে ছিলেন ড্রয়িং রুমে সোফায়, আর বাবা ইজিচেয়ারে। অমিতাভ এবার বেশ কয়েক মাস পরে এলো, তাই তাদের অনেক রাগ অভিমান মনে জমে আছে।

অমিতাভ বাড়িতে ঢুকে বাবা মাকে প্রণাম করল। মিথিলা দেবযানীর কোল থেকে সযত্নে ছেলেকে তুলে শাশুড়ি মার কোলে দিয়ে বলল--- "নিন ধরুন আপনার বংশধর, আমি তো দিতে পারিনি বলে অনেক অভিযোগ ছিল আপনার।"

অমিতাভর মা বললেন--"মানে?!" শ্বশুর -শাশুড়ি দুজনেই অবাক হলেন।

মিথিলা একটু চুপ করে থেকে নিজের ফুলশয্যার রাত থেকে আজ পর্যন্ত সব ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করল সবার সামনে।

বললো-- "এবার নিজের বৌমা নাতিকে গ্রহণ করুন আর আমাকে দায়িত্ব মুক্ত করুন। আমি আপনার নাতির অন্নপ্রাশনের সব ব‍্যবস্থা করে রেখেছি। কাল পুরোহিত মশাই আসবেন আপনি কথা বলে নেবেন। দুদিন পর শুভ দিন আছে সেই দিনই সব অনুষ্ঠান হবে। সেদিন যা যা লাগবে সব কিনে রেখেছি আমি।"

অমিতাভর বাবা মা এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। শুধু বললেন-"এতো কষ্ট বুকে চেপে রেখে সব দায়িত্ব পালন করলে এতগুলো বছর , কি করে পারলে তুমি? তোমার বাবা-মাকেই বা মুখ দেখাবো কি করে বলো তো ?"

মিথিলা বলল--"সে নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আমি তাদের বুঝিয়ে বলব।"

অমিতাভর মা বললেন---" তোমার এই কটা বছরের হিসেব যে মেলাতে পারছি না মা, কতকিছু পেলাম তোমার কাছে, পরিবর্তে কি দিলাম?"

মিথিলা হেসে বললো --" সব হিসেব মেলানো সম্ভব হয় না মা সবসময়। অনেক কিছু না মিললেও মিলিয়ে নিতে হয়। নাহলে হিসেবের খাতায় শুধুই গরমিল  মেলে ।"

এর পরে পাঁচ বছর পরের কথা ।

অমিতাভ চাকরি ছেড়ে আবার কলকাতায় ফিরে এসে নিজের ব‍্যবসা সামলাচ্ছে। দেবযানীও এখন অমিতাভর সঙ্গেই শ্বশুরবাড়ির ব্যবসা দেখছে। অমিতাভর বাবা -মা এখন নাতি-নাতনিকে নিয়ে গুছিয়ে সংসার করছেন।

মিথিলা কলকাতা ছেড়েছে, বাড়ির সকলের সম্মতিতে। ও এখন অস্ট্রেলিয়ায়, ওখানের ইউনিভার্সিটি জয়েন করেছে। সেখানে বিয়ে করেছে ওর এক অস্ট্রেলিয়ান কলিগকে । ভালোই আছে । ওখানের নাগরিকত্ব পেয়েছে বিবাহসূত্রে। ওদের একটি মিষ্টি কন্যা সন্তানও হয়েছে। ওর নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার দেখাও করে গেছে।

অমিতাভর সঙ্গে ওর কোনো শারীরিক বা মানসিক কোনো সম্পর্কই তৈরি হয়নি কোনোদিন, তাই এই নামমাত্র বিয়েটাকে সে সহজেই ভুলে যেতে পেরেছে। কোনো মধুর স্মৃতি ছিল না তখন, শুধু একটা মানসিক চাপ ছিল। বরং এখন নিজেকে মুক্ত করতে পেরে মিথিলা নিষ্কৃতি পেয়েছে ।

মিথিলা এখন সুখী, ভালো আছে।।


(কলমে -পিয়ালী মুখোপাধ্যায়)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract