STORYMIRROR

Rima Goswami

Tragedy Crime Thriller

3  

Rima Goswami

Tragedy Crime Thriller

এক নারীর প্রতিশোধ

এক নারীর প্রতিশোধ

8 mins
307

সৌরজা আর গৌরিকা দুই পিতৃহীন যমজ মেয়েকে নিয়ে তার মা অম্বার বাস ছিলো নিজের শশুড় বাড়িতে একরকম কাজের লোকেদের মতোই । বাড়ির বড়বউ হলেও স্বামীহীন নারী অম্বা দাসীবাদী ছাড়া নিজেকে কিছুই যেন ভাবতে পারত না । একে দুই মেয়ে নিয়ে দেবরদের গলগ্রহ হয়ে থাকা উপরন্ত পুত্রহীন নারী সে । দুবেলা দুমুঠো ভাত আর মাথার উপরে আশ্রয় এটুকুর জন্য অম্বা ঝিগিরি করত নিজের বাড়িতেই । অথচ এই অম্বার কত রূপ আভিজাত্য ছিলো তার স্বামী বেঁচে থাকা কালীন । অবনী মোহন গাঙ্গুলির মৃত্যু হয় সেবার বাড়িতে ডাকাত পড়ায় । ডাকাতের দলকে বাধা দিতে গেলে অবনীকে ওরা মাথায় আঘাত করে । ওখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অবনী , দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অম্বা দেখে তার সর্বনাশ । কোলে তখন সদ্যজাত দুই যমজ সন্তানেরা । সেই থেকে দাদার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দুই ভাই দখল করে আর বিধবা বৌদিকে সর্বহারা করে । হঠাৎই রাজা থেকে ভিখারি হওয়া অম্বা দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েদের জন্য লড়ে যায় বোবা হয়ে । শত অত্যাচার সহ্য করেও মুখে রা পর্যন্ত কাটেনি কোনদিন অম্বা । দেবরদের ছেলেরা বড় বড় ইস্কুলে যায় আর অম্বা তার দুই মেয়ে সৌরজা আর গৌরিকাকে সরকারি ইস্কুলে পাঠায় । এভাবেই দিন পেরোতে পেরোতে মেয়ে দুটো বড় হয় । গৌরিকাটা বড্ড ভালোমানুষ গোছের মুখে কোন রা শব্দ পর্যন্ত নেই । সৌরজা আবার বিপরীত মেরুর মানুষ । সূর্যের মতোই তেজ মেয়ের , কথায় কথায় তেড়ে আসতে তার জুড়ি মেলা ভার । অম্বাকে অনেক কথা শুনতে হয় মেয়েটার জন্য । সত্যি তো বাপু বাপমরা মেয়ের অত কথা কিসের ? এখনই যদি বাপ কাকাদের সাথে মানিয়ে নিতে না পারিস তবে স্বামীর ঘর করবি কি করে ছুরি ? মেয়ে সৌরজা কাকিমা , ঠাকুমা , কাকা বা দাদাদের রেয়াত করেনা । সে ছিনিয়ে খেতে জানে , নিজের অধিকারটা বুঝে নিতে জানে । সেদিন গৌরিকাকে দেখতে এলেন পাশের গ্রামের পাঁচু অধিকারী । বিপত্নীক পাঁচুর একটা বিবাহযোগ্য ছেলে আছে । সেই ছেলে সাতকরি আর পাঁচু যখন এলো গৌরিকাকে দেখতে তখন অম্বা জানতে পারলো ছেলের জন্য না পাঁচু নিজের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে । ব্যাস সৌরজাকে কে আটকায় ? পাঁচু গোপালকে আচ্ছা সে দিলো মুখের ঝাঁটা বাড়ি । সৌরজা জানালো পাঁচু যদি এখানে বিয়ের সমন্ধ নিয়েই এসেছে তো সেটা সৌরজার মা অম্বার জন্য হওয়া বাঞ্চনীয় ।


পাঁচু বা অম্বা সকলে তো হতবাক মেয়ের কথা শুনে । সৌরজার স্পষ্ট বক্তব্য পাঁচু এক ছেলের বাবা হয়ে যদি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে তো তার মা অম্বাও বসতে পারে বিয়েতে । অম্বা তো কেঁদে ফেললেন আর হাত জোড় করে পাঁচুকে মেয়ের কথায় কান দিতে মানা করে । পাঁচু অধিকারী ও পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে কথা দিয়ে ফেলে যে গৌরিকাকে স্ত্রী না বৌমা করেই নিয়ে যাবেন । বিয়েটা সোজা কথায় স্থির না হয়ে সৌরজার বাঁকা কথায় শেষে স্থির হলো । কাকা ,কাকিরা সবই দেখলো বুঝলো এ মেয়ের সাথে লড়াই করে জেতা যায় না । নিজের ভাগের শেষ একটুকরো ধান জমি যেটা দয়া করে দেবররা তাকে দিয়েছিল সেটাই বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো অম্বা । এরপর কি হবে ? আর একটা মেয়ে আছে সে আবার কথার ফুলঝুরি । গৌরিকা শশুড় বাড়ি গিয়ে থেকে স্বামী সাতকরি আর শশুড় পাঁচুর অত্যাচার সহ্য করে মুখ বুজে । সে যে বড্ড বেশি শান্ত মানুষ । শান্ত মেয়ে গৌরিকা দুবেলা উনুনের আঁচে পাটকাঠি দিয়ে রান্না করে । পুড়ে যাওয়া বাসন ধুতে নিয়ে যায় সে বাড়ির সংলগ্ন পুকুরে । ছাই মাটি সোডা দিয়ে ওই পিতল কাসার বাসন মাজতে মাজতে গৌরিকার হাতের ছাল উঠে যায় ।


গোয়ালের গরুদের জাবনা দেওয়া , গোবর পিটানো , গোয়াল পরিস্কার করা তারপর ওই শশুড় পাঁচু গোপালের বড় পেল্লাই দালান বাড়ির ঝাড় পোছ সব করতে গিয়ে পরিশ্রমের চোটে গৌরিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে । ডাক্তার দেখানোর সময় বা ইচ্ছা কারোর নেই , তাই একটু ওষুধ ও জোটেনা মেয়েটার । সময়ে খাবার খাওয়া নেই , ঘুম নেই , বিশ্রাম নেই ... কে কতদিন এভাবে অমানুষের মত পরিশ্রম করতে পারে ? গৌরিকাও পারেনি , একদিন পুকুরে বাসন ধুতে গিয়ে ওখানেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায় সে । জলে তার মাথাটা ঢুবে যায় অচেতন অবস্থায় আর তার ওখানেই মৃত্যু হয় । বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় যখন পাঁচু বা তার ছেলে সাতকরি বউকে খুঁজে পায় না তখন এদিক ওদিক দেখতে দেখতে গৌরিকা কে পুকুর ঘাটে ডুবন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে । খবর যায় মেয়ের বাড়িতে , মা অম্বা মেয়ের খবর শুনেই শোকে বোবা হয়ে যায় । সৌরজা কিন্তু কষ্ট গিলতে জানে । সে শোকে ভেঙে পড়েনি , নিজের সহোদরার বদলা তো তাকেই নিতে হবে । খুন , এটা একটা সোজা কথায় খুন । সোজাপথে না করে তিল তিল করে কষ্ট দিয়ে মেরেছে ওরা গৌরিকাকে । সৌরজা বোনের শশুর বাড়ী পৌঁছে সাতকরিকে সরিয়ে নিজে মুখাগ্নি করে গৌরিকার । তারপর সে স্পষ্ট জানায় গৌরিকা নেই তো কি হয়েছে এবার সৌরজা পাঁচু গোপাল অধিকারী আর সাতকরি জামাইবাবুর দায়িত্ব নেবে ।


পাঁচু সৌরজাকে মোটেও পছন্দ করে না তবুও সে রাজি হয়ে যায় কারণ গৌরিকার মৃত্যুর পর ওদের হেঁসেল ঠেলার তো আর কেউ নেই ? সৌরজাকে পাঁচু নিজের বিপত্নীক ছেলেকে বিয়ে করতে বললে চালাক সৌরজা জানালো গৌরিকার সবে মৃত্যু হয়েছে তাই আপাতত ও বিয়ে করতে পারবে না । কাল অশৌচ পার হলেই সৌরজা সাতকরিকে বিয়ে করবে । আস্তে আস্তে জাঁকিয়ে বসে সৌরজা পাঁচুর বাড়িতে । চালাকি করে সৌরজা এমন রান্না করতে শুরু করলো যে তা মানুষ কেন কুকুরের ও মুখে দেওয়া দায় । পাঁচু ভাবলো না এ মেয়ের হাতের রান্না খাওয়া সম্ভব নয় । তাই সে সৌরজাকে রান্নার কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ছেলে সাতকরিকে সে দায়িত্ব দিলো । পাচক রাখতে গেলে অনেক খরচ , অত খরচ পাঁচুর পোষাবে না । সাতকরি এতদিন বেজায় খুশি ছিলো , বিয়ের পর থেকে বউ গৌরিকা সব কাজ করত তাই সাতকরি সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে তাস পেটাতো বা জুয়া খেলার আসরে বসত । এবার দুবেলা হেঁসেল ঠেলতে গিয়ে তার নাভিশ্বাস উঠলো । শালী সৌরজাকে সে ভয় ও করে আবার তাকে চটালে সে যদি বিয়েতে না করে দেয় ? তখন সাতকরি সারাজীবন বিপত্নীকই থেকে যাবে হয়ত । এরপর সৌরজা গোয়ালে রোজ বাছুর খুলে দিতে লাগলো , এতে বাছুর সব দুধ খেয়ে সাবার করে দিত তার মায়ের । আর পাঁচুর কপালে দুধ , দই , ক্ষির , ছানা সব বন্ধ হয়ে যায় একে একে । ঘরে তিনখানা গাই গরু থাকতেও এক ছটাক দুধ মেলা ভার । পাঁচু দেখলো মেয়েটা গরু গোয়াল সামলাতে পারছে না তাই গোয়ালের কাজটা সে ছেলের ঘাড়ে তুলে দিলো । সাতকরি এবার পাচক এর সঙ্গে গোয়ালের রক্ষণাবেক্ষণ এর দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলো । সারাদিন খেটে ওর মনে পড়ে যেতে লাগলো মরে যাওয়া বউ গৌরিকার কথা । যেভাবে আজ এক একটা দায়িত্ব সাতকরির ঘাড়ে এসে চাপছে এরকম একদিন গৌরিকার সাথেও তো ঘটেছিল ! মেয়েটা কি পরিশ্রমই না করত রোজ ! কিপটে পাঁচু একদিন শুনলো সৌরজা পুকুরে বাসন ধুতে গিয়ে সব কাসার বগি থালা গুলো জলে খুইয়ে এসেছে । রাগে জ্বলে উঠতে পাঁচু কিন্তু এ মেয়ে তো গৌরিকা নয় , এ সৌরজা । একে কিছু বলতে গেলে পাঁচুর ধুতির কাছা খুলে দেবে মুহূর্তে । চুপচাপ লোকসান হজম করে বাসন মাজার কাজটা ও ছেলেকে দিতে গেল পাঁচু । এবার সাতকরি ফুঁসে উঠলো , সেই বা একা কেন কাজ করবে ? পাঁচু বেগতিক দেখে বাসন ধোবার দায়িত্ব নিজে নিলো । ধীরে ধীরে বাপ ছেলে সাপে নেউলের মত হয়ে গেল । এখানেও কীর্তি সৌরজার ..সে ছেলেকে বলে বেশি বেশি বাসন করতে রান্নার সময় । মাজুক না পাঁচু গোপাল কত মাজতে পারে ? আবার কিপটে পাঁচুকে বলে সাতকরির রাস টেনে ধরতে । তার জুয়ার আসরে যাওয়া পন্ড করতে হাতখরচ বন্ধ করা বা রান্নার অনাজপাতি কম কিনে আনা । অনাজ মসলা কম থাকলে সাতকরি রাঁধবে কি ? এদিকে খাবার সময় সৌরজা মুখ ভার করে , পাঁচু ব্যাটাকে গাল পারে । সাতকরি শুকিয়ে দিনে দিনে এককরিতে পরিণত হয় । সৌরজা একদিন সাতকরিকে বলে , " তোমার বাবা তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবেন না মনে হচ্ছে " ।সাতকরি জিজ্ঞাসা করে কেন দেবেন না ? নিশ্চই দেবেন ।সৌরজা বলে পাঁচু গোপাল নিজে সৌরজাকে বিয়ে করতে চাইছে আর সেই কারণেই এখন সাতকরিকে তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন । যে ছেলেকে বাপে এত ভালোবাসত আজ সেই ছেলেকে চাকরের মত করে খাটাচ্ছে । সৌরজার কথায় সাতকরি বিশ্বাস করলো কারণ আগেও বাবা গৌরিকার সাথে বিয়ে করতে চেয়েছিল । সেদিন দুপুরে পাঁচু পুকুর ঘাটে বাসন নিয়ে যাবার সময় সৌরজা ইচ্ছা করে বেশি দোক্তা দেওয়া পান পাঁচুকে দেয় । সেটা খেয়ে বাসন মাজতে গিয়ে পাঁচু মাথা ঘুরে ওখানেই পড়ে যায় । বাপের উপরে নজর রেখে ছিলো সাতকরি । দুম করে বাপকে পুকুর ঘাটে পড়ে যেতে দেখে ওর মাথায় বুদ্ধি আসে , অচেতন বাপের মাথাটা সে পুকুরে ডুবিয়ে চেপে ধরে । কিছুক্ষণ খাবি খেয়ে শেষ হয়ে যায় পাঁচু । তারপর ভালোমানুষ সেজে সাতকরি ওখান থেকে চলে আসে । যে কাজটা সৌরজা করতে চেয়েছিল , সেটা সাতকরিকে দিয়ে করিয়ে নেয় সে । তারপর পাঁচুর মৃত্যুর পর সাতকরিকে আফিং দিয়ে দিয়ে নেশাগ্রস্ত করে ফেলে সৌরজা । রাতের বেলা সাতকরিকে গৌরিকা সেজে ভয় দেখাতে লাগে সৌরজা । ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায় সাতকরি । আর সর্বস্বর মালিক হয়ে যায় সৌরজা । নিজের বোনের বদলা নিয়ে তো সে নেয় কিন্তু তার মনে শেষে দয়ার উদ্রেক হয় সাতকরির প্রতি । ওকে ছেড়ে যদি সৌরজা চলে যায় তার তো ঘর সংসার সব হবে কিন্তু সাতকরিকে কে দেখবে ? এ সাতকরি তো তার দিদির মৃত্যুর জন্য দায়ী মানুষটা নয় । এ সাতকরি শিশুর মত ... তাই সৌরজা মা অম্বাকে নিয়ে আসে গৌরিকার শশুড়বাড়ি । মাকে সে জানায় বিয়ে সংসার তার আর করতে ইচ্ছা নেই । সে তার অসুস্থ জামাইবাবু আর মায়ের সেবা করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে । অম্বা অবাক হয়ে যায় সৌরজাকে দেখে ! নারী প্রতিশোধের জন্য যে আগুন লাগায় প্রতিশোধ সম্পন্ন হলে সেই আগুনে নিজেও পুড়ে ছারখার হয়ে যায় হয়ত । কারণ নারী যে মাতৃত্বের এক রূপক । তাই তো অপরাধী সাতকরির মধ্যেও মমত্ব খুঁজে পায় সৌরজা । ওদের সম্পর্কে না আছে প্রেম , না আছে অধিকার , না আছে চাওয়া পাওয়া ..


সাতকরি আর সৌরজা একে অপরের সাথে বেঁধে যায় এক নামহীন সম্পর্কে । যেখানে রয়ে যায় শুধুমাত্র মমত্বর দায় । নারী মন বোঝা বড্ড ভার .. এখানে নিজের মেয়ে সৌরজাকে তার মা অম্বা ও বুঝে উঠতে পারে না ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy