এই যুগের দুর্গা
এই যুগের দুর্গা
এই যুগের দুর্গা-----
ডাঃ সত্যব্রত মজুমদার
তারিখ :-০১/০৮/২০২২
-------------------------
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া রাতের শেষ ক্যানিং লোকাল ট্রেন। মাঝামাঝি কামরায় আমরা তিন বন্ধু উঠেছি, গন্তব্যস্হল ক্যানিং , সেখানে রাত্রিতে বন্ধুর বাড়ি থেকে পরের দিন আমরা সুন্দরবন বেড়াতে যাব, ফিরবো তিনদিন পরে, এইভাবেই আমরা মোটামুটি শীত বিদায়ের শেষ বেলায় সুন্দরবন ঘুরতে চলেছি।
আমরা তিন বন্ধু ট্রেনের কামরার পিছনের দিকে জানালার পাশে বসেছি আর সামনের সারিতে তিনজন অল্পবয়সি মহিলা বসেছেন। রাতের এই কামরায় মোটামুটি পনেরো কুড়িজন যাত্রী রয়েছে। ট্রেন চলতে চলতে আমাদের সামনে বসে থাকা তিনজন মেয়ের সাথে পরিচয় পর্ব তারপর গল্পগুজব বেশ ভালোই জমে উঠেছে, তিনজনের মাঝে একজন বর্ণালী , শিক্ষিত , কলকাতায় এক বেসরকারি হাসপাতালে নার্সিং এর কাজ করেন, আমাদের বললেন দাদা," আপনারা ক্যানিং যাবেন, আমি তালদি স্টেশনে নামবো, পাশে বসে থাকা আরো দুইজন মেয়ে নামবেন তালদির পরের স্টেশনে । হালকা ঠান্ডা হাওয়া চলমান ট্রেনের জানালা দিয়ে ঢুকে আমাদের আসর বেশ মাতিয়ে তুলেছে। দাদা ঝালমুড়ি খান, আমি নিচ্ছি, এই বলে বর্ণালী ঝালমুড়ির অর্ডার দিলেন, আমি বললাম , খেতে পারি, পয়সা কিন্তু আমি দেব,
না, না হাসতে হাসতে বর্ণালী আমাদের বললো,
তা কি করে হয়; আমি আপনাদের খাওয়াবো , বোনের এই আব্দার রাখতে হবে ।
আচ্ছা ঠিক আছে বর্ণালী এই যাত্রায় তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, আমার এই কথা শুনে সবাই হাসতে থাকলো। রাতের ক্যানিং লোকাল এগিয়ে চলেছে, একের পর এক স্টেশন আসছে আবার গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, কিছু লোক উঠছে আবার নামছে, ঘুটিয়ারিসরিফ স্টেশন ছাড়ার পরই আমরা দেখলাম চার পাঁচ জন যুবক নেশাগ্রস্হ অবস্থায় আমাদের কামরায় উঠলো, মুখে অশ্লীল ভাষা, উঠেই সারা কামরায় দাপাদাপি করতে শুরু করলো, ক্রমাগত হুমকি দিতে লাগলো, মোবাইল , টাকা পয়সা, গয়না কি আছে, দাও, কখনো বাংলা , কখনো হিন্দীতে গালিগালাজ, ধমক এক নাগাড়ে চলতে লাগলো, সব মদ খেযে রয়েছে। দুইজনের হাতে ভোজালি, আবার মাঝে মাঝে মেশিনের অর্থাৎ পিস্তলের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, আমি আর আমার দুই বন্ধু পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়ে পড়লাম, আমরা বর্ণালীদের আড়াল করে ওদের আটকানোর অবিরাম চেষ্টা করতেই একজন আমার মুখে ঘুষি চালিয়ে দিল, আমি কোনোরকমে সহ্য করে একজনের হাত চেপে ধরলাম, পাশে আমার বন্ধুর বুক পকেট থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিল একজন, ওদের প্রধান নিশানা মেয়েদের প্রতি, বর্ণালী আমাকে আস্তে আস্তে বললো," দাদা আপনারা বেদ- বেরিয়া স্টেশন পর্যন্ত একটু কষ্ট করে ওদের আটকে রাখার চেষ্টা করুন, এরপর ছিনতাইয়ের দল আরো উন্মত্ত মনোভাব নিতে শুরু করলো, ওদের লক্ষ্য বর্ণালীদের প্রতি, এই পরিস্থিতিতে অন্য মেয়েরা কান্নাকাটি করতে লাগল, সবাই আতঙ্কে দিশেহারা অবস্হা, আমার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগে ঠিক এই রকমই এক ঘটনায় দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে একটি স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের পড়া শিশুর প্রাণ গিয়েছিলো গুলিতে , সেই ছবি ভেসে উঠতে থাকলো মনে।
বর্ণালী, সাথে আরো দুটি মেয়ে সমানে আমাদের সাথে লড়াই চালাতে লাগল, আমরা তিনজন ওদের আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, বর্ণালীদে বাঁচানোর জন্য, এরই মধ্যে একজন দূষ্কৃতি ছুরি চালিয়ে দিল বন্ধুর হাতে, গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করলো, রুমাল দিয়ে চেপে ধরে কোনোরকমে ওদের ঠেকাতে লাগলাম।
বর্ণালী চিত্কার করে বলতে লাগল দাদা বেদ- বেরিয়া স্টেশনের গাড়ি ঢুকছে, আর একটু দাদা, গাড়ি স্টেশনে ঢুকে দাঁড়ানো মাত্র প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ ছেলে হৈ - হৈ করে আমাদের কামরা ঘিরে ফেললো, দশ- বারোটা ছেলে লাফিয়ে কামরার ভিতর ঢুকে সাথে সাথে ঐ চার পাঁচজন দূষ্কৃতিকে চেপে ধরে টানতে টানতে প্ল্যাটফর্মে ফেলে পেটাতে শুরু করলো ।
সেই সময় কিছুক্ষণ আমরা বর্ণালীদের নিয়ে স্হবির হয়ে বসে থাকলাম , চারিদিকে প্রচুর ভীড় জমে গেছে, আমাদের দেখার জন্যে।
চার পাঁচ জন যুবক আমাদের ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনলেন, হঠাত্ শুনলাম বর্ণালীর কন্ঠস্বর দাদা , পল্টুদা, বাপি দা , মানুদা তোমরা বাঁচালে; আমাদের বাঁচালে , বর্ণালী কাঁদতে লাগল, আরে তুমি ফোন করার সাথে সাথে আমরা ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে গাড়ি, বাইকসহ তালদি থেকে বেদ- বেরিয়া স্টেশনে চলে এসেছি
তোমাদের বাঁচানোর জন্য।
দাদা আপনারা এই দাদাদের দেখুন, এনারা কিভাবে প্রাণ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে আমাদের বাঁচালেন, তার তুলনা নেই। আমি জীবনে কখনো এনাদের ভুলতে পারবো না, এনারা আজ থেকে আমাদের প্রাণের দাদা হয়ে রইলেন।
শোনো বর্ণালী, তুমি যে বুদ্ধিমত্তার সাথে ফোন করে দাদাদের আনিয়ে আমাদের সবাইকে রক্ষা করলে, সত্যি তারিফ্ না করে পারা যায় না, তুমি হলে এই আধুনিক যুগের বিপদনাশিনী দুগ্গা, , বর্ণালী ভাবো তো, এই যুগের এই সব দুর্ধর্ষ অসূরদের বধ করতে একজন মা দুর্গার দশ হাতের সেই মান্ধাতা আমলের অস্ত্র দিয়ে হবেনা, এখন দরকার আধুনিক স্মার্ট ফোন আর জনবল, আর বুদ্ধি , বিচক্ষণতা, অসীম সাহস, আর তাই তুমি করে দেখালে আজ বর্ণালী, এই মুহূর্তের আমাদের ভূমিকা ছাড়ো, তুমিই হলে সকলের কাছেই এই যুগের চলমান মা দুর্গা।
ডাঃ সত্যব্রত মজুমদার-