SATYABRATA MAJUMDAR

Tragedy Inspirational

3.4  

SATYABRATA MAJUMDAR

Tragedy Inspirational

জন্মদায়িনী

জন্মদায়িনী

5 mins
191



জেলার দায়রা ফার্স্ট্ ট্র্যাক্ আদালত। আজ এখানে একটি নির্মম পারিবারিক অপরাধের প্রায় ছয় মাসের বিচার পর্বের পরে রায়দান হবে। আদালত চত্বরে উৎসুক মানুষের ভীড় রয়েছে,রায়দান শোনার জন্য। এই মামলাটির বিশেষত্ব যে সরকার পক্ষ অসহায় বৃদ্ধ, অসুস্হ, স্বামীহারা একজন মার পক্ষ নিয়ে লড়াই করছে, অত্যাচারি ছেলের আর তাঁর বউয়ের শাস্তির বিধান করবার জন্য।

ঠিক বেলা বারোটা নাগাদ জেলা দায়রা আদালতের প্রধান বিচারপতি আদালত কক্ষে নিজের আসন গ্রহন করলেন, বৃদ্ধা,অসুস্হ মা মেয়ের সাথে সামনের চেয়ারে বসে আছেন, চোখে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে মাঝে মাঝে, কাঠগোড়ায় মাথা নীচু করে দন্ডায়মান একমাত্র ছেলে আর বউ।

বিচারপতি সরকার পক্ষের আইনজীবি বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করলেন, আইনজীবি দৃঢ় কন্ঠে বললেন," মহামান্য প্রধান বিচারপতি মহাশয়, আমার মক্কেল শ্রীমতি পাঁচুবালা চক্রবর্তী, বিরাশি বৎসরের বৃদ্ধ, দশ বৎসর পূর্বে স্বামী হারিয়ে ছিলেন, ওনার দুই মেয়ে,এক ছেলে, স্বামী একদা টিটাগড় পেপার মিলে চাকরি করতেন, আশি দশকের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায়, তাঁর পর টাকা পয়সা যা পান তাতে সংসার বাঁচিয়ে, ছেলে মেয়েদের বড়ো করা, তাদের বিয়ে-থা, রোগের চিকিৎসায় আর বিশেষ কিছুই ছিল না, শুধু টালির বাড়ি আর তিন কাঠা জমি এই বৃদ্ধ মায়ের শেষ সম্বল। 

স্যার, ছেলে বিবাহিত, বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে, একটি সন্তান আছে। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তিও ভালো পেয়েছে, এই সম্পত্তি পুরো তাঁর নামে লিখে দিতে হবে, মার ইচ্ছা দুই মেয়েকেও সম্পত্তির ভাগ দেবেন, এই নিয়ে ছেলে আর বউ আর মা আর দুই মেয়ের বিরোধ। ছেলে বউয়ের কথায় কাজ করতো আর মার ওপর দিনের পর দিন মানসিক পীড়ন চালাত, অসহায় বৃদ্ধ মাকে ঠিকমত খেতে দিত না, প্রতিবেশীরা আর মেয়েরা এসে মাকে খাবার দিত, ঔষুধপত্র কিনে দিয়ে যেত। একদিন রাত্রে ছেলে আর বউ তর্কাতর্কির মাঝে মাকে হুমকি দিয়ে বলতে থাকে," তোমার মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছ টাকা পয়সা দিয়ে, তাদের ছেলে মেয়ে হয়েছে, এখন এখানে ভাগ বসাতে আসবে কেন? তুমি মরে গেলে এই সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা বাঁধবে, তোমার শরীর ভাল নয়,আমি তোমাকে খাওয়া দিই দুই বেলা, তাই আজকেই তোমাকে আমার নামে দলিলে স্ই করে দিতে হবে, না হলে ফল খারাপ হবে ভবিষ্যতের পক্ষে, মনে রাখবে মেয়েরা তোমাকে রক্ষা।করতে পারবে না।

স্যার, সেই মুহূর্তে স্তম্ভিত, কম্পিত, ভয়ার্ত অসহায় মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন," দেখ অবুঝ হোস্ না, আমি তো মা, বাবা নেই, মেয়েদের বিয়ে হলে কি হবে, তুই যেমন আমার সন্তান, তাঁরাও তেমন আমার সন্তান একই রকম, তাঁরা আমার এখনো সব সময় আপদ বিপদ দেখে, তুই যখন দিনের পর দিন ঠিক মত খেতে দিস না বৌমার উস্কানিতে, প্রয়োচনায়, গাল মন্দ করিস, ঘর থেকে মাঝে মাঝে ঠেলে রাত বিরেতে, ঠান্ডার মধ্যে বের করে দিস্ তখন মেয়েরা পাড়ার লোকেদের কাছে খবর পেয়ে নিজেদের সংসার ফেলে আমাকে রক্ষা করে, নিজেদের কাছে নিয়ে যায়, সূস্হ করে তোলে।

মেয়েরা না থাকলে হয়তো আমি কবেই মরে যেতাম। তাই তাদের আমি কখনোই বঞ্চিত করতে পারবো না, তাহলে আমার আরো যত দিন বাঁচার আয়ু থাকবে, দুঃখের শেষ থাকবে না, অভিশাপ কুড়াতে হবে। আমি এই সম্পত্তি সবাইকেই সমান ভাগ করে দিতে চাই, এই কথা শোনার সাথে সাথে বৌমা গালাগাল দিতে দিতে ওনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর ছেলে রাগের বশে মাকে ঘুসি মারতেই, বৃদ্ধ মা চিৎকার করে খাট থেকে পড়ে যান, এবং সাময়িক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তাতে এই বয়সে বাঁ হাতের " হিউমারাস" আর " আলনা" অংশ আঘাত প্রাপ্ত হয়, আলনা অংশে হাড়ে ফাটল ধরে। থানায় এফ্, আই, আর করা হয়। তারপর মেয়েরা এখনো সেই চিকিৎসা করে যাচ্ছে, স্যার।


প্রধান বিচারক মহাশয় এর পরেই ছেলের পক্ষের আইনজীবির নিয়ম মাফিক আর্জি শুনলেন।

তারপর এই কেসের আনুষঙ্গিক সমস্ত দিক, সাথে সাক্ষি সাবুদদের বয়ানের রেকর্ড, নথি দেখার পরে নিজের বক্তব্যে আবেগঘন গলায় বললেন," আজকের এই বিচারসভায় আমার এতো বছরের বিচারকার্য্যের অভিজ্ঞতার মাঝে এই ধরনের অমানবিক ঘটনার অভিজ্ঞতা কমই হয়েছে, এখানে একজন " জন্মদায়িনী " মা নির্যাতিত ও অপমানিত আর শারিরীকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে নিজের পুত্র সন্তান আর একজন নারী বৌমার দ্বারা। এই জগতে যে মা তাঁর শরীরের শেষ রক্তবিন্দু নিংরে নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে বড়ো করে, আগলে রেখে লালন পালন করে, শরীরে কোনো আঘাত লাগতে দেয় না, সন্তানের জন্য জীবন দেয়, সেই " জন্মদায়িনী" মা আজ শেষ বয়সে এসে সেই সন্তানের দ্বারাই আক্রান্থ হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, অত্যাচারিত হতে হচ্ছে, এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে এই জগতে? আরো অণুশোচনার কথা, এই বাড়ির এক মাত্র বৌমা, সেও একজন নারী, সেও একজন এই রকমই সন্তানেরই মা, তার হাত ও গিয়ে পৌঁছাচ্ছে আর এক বৃদ্ধ অসুস্হ অসহায় মা এর ওপর? কোথায় সেই হাত তাকে সযত্নে সেবা দেবে, ভালোবাসা দেবে, এখানে তা হয় না, অল্প টাকা পয়সা আর সম্পত্তির জন্য, এ কোন আধুনিক সভ্যতার দিকে যাচ্ছি আমরা? শিক্ষা দীক্ষা, মানবিকতা, মমতা এই সব শব্দগুলি কোথায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে? 

নীরবতায় ভরা এজ্ লাশে একটুখানি থেমে তারপর মহামান্য প্রধান বিচারপতি মহাশয় ক্ষোভের সাথে ঘোষণা করলেন," এই বিচারসভা আজ এখানেই শেষ হচ্ছে, আমি এই কেসের রায় ঘোষণা করব আগামী পরশু, বেলা একটায়, তবে এইখানে একটা কথা বলতেই হয়, এই বিচারে আমাকে কঠোরতার কথা চিন্তা করতেই হবে, আগামীদিনের কিছু ভালোর জন্য।


মহামান্য প্রধানবিচারপতি মহাশয়ের এই কথা ঘোষণার পরক্ষনেই নিজের ছেলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী বৃদ্ধ, মানসিক ভাবে বিপর্যস্হ পাঁচুবালা চক্রবর্তী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে প্রধান বিচারপতির আসনের দিকে এগোতে থাকলেন, এজলাশ্ ভরা মানুষের সামনে, সবাইকে স্তম্ভিত করে, হাত জোড় করে প্রধান বিচারপতির দিকে চেয়ে ভাঙা স্বরে বলতে থাকলেন," মহাশয়, কঠিন সাজা দয়া করে দেবেন না, ক্ষমা করে দিন, যতই হোক সে যে আমারই পেটে ধরা সন্তান, আমারই নাড়ী কেটে সে এই পৃথিবীর আলো দেখেছে, আমিই তাকে কত যত্নে বড়ো করেছি, ভুল করেছে, তাঁর কঠিন শাস্তি আমি সহ্য করতে পারবো না, এই বলে তিনি বিচারকের আসনের সামনে বসে পড়লেন, আমি যে জন্মদায়িনী মা, প্রধান বিচারক মহাশয় স্তম্ভিত চোখে আসন থেকে নেমে এসে মা এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন," মা আপনি আসুন, আপনার আর্জি আমি নিশ্চয়ই মাথায় রাখবো বিচারের ক্ষেত্রে, আপনি আর কাঁদবেন না মা; শান্ত হন, নচেৎ শরীর খারাপ হয়ে পড়বে আপনার। এই বলে বিচারপতি মহাশয় ধীর পায়ে এজলাশ্ থেকে বেরিয়ে গেলেন। 


ভরা বিচার সভায় উপস্হিত মানুষজন দেখলেন পরতে পরতে ঘটে চলা ক্ষয়িষ্ণু সমাজ তথা পরিবারের লোভ ও লালসার অনেক ঘটনা পরম্পরার একটি হৃদয়হীনতার কলঙ্কজনক বাস্তব ছবির পাশেই মায়া' মমতার বেদনাময় প্রতিচ্ছবি।


ডাঃ সত্যব্রত মজুমদার


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy