এই দিবাকর
এই দিবাকর
আমাদের পরিবারের সদস্যরাই কি শুধু আমাদের আপনজন । আপনজন বলতে কি সত্যি তাই বোঝায় ........চলুন আজ আপনাদের কাছে আমার জীবনের নিজস্ব এক আভিঞ্জতার কথা তুলে ধরি ।
৬:৪৫ বান্ডেল লোকাল …আমি রোজ এই ট্রেন করেই বৈদ্যবাটী থেকে বালি স্টেশনে যেতাম অফিস যাবার জন্য ।
সেই ট্রেন থেকেই আমার একটা অভিজ্ঞাতা হয় । যা প্রমাণ করে দেয় যে ভালোবাসার টান শুধু আত্মিক সম্পর্কের মধ্যেই হয়না , ভালোবাসার অন্য রূপ অন্য সম্পর্কও আছে এই পৃথিবীতে ।
এই ৬:৪৫ এর ট্রেনে আমার সাথে যেতো আরো ৪ জন তারাও অফিস যেতেন আমার মতোই । এই ৪ বন্ধুর মধ্যে একজনকে রোজ দেখতাম যে শ্রীরামপুর আর রিষড়ার মাঝে একটা খোলা মাঠের কাছে এসে ট্রেনের গেট থেকে একটি লোক কে উদ্দেশ্য করে খুব জোরে মজা করে ডাক দিত “ এই…. দিবাকর” ….. আর সেই লোকটা তাকিয়ে থাকতো সেই ট্রেনের লোকটির দিকে । আস্তে আস্তে ট্রেন মিলিয়ে যেত দুরে সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটিও । এমনই দৃশ্য আমি রোজ দেখতাম । সেই দিবাকর লোকটিও রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো সেই মাঠের ধারে আর ট্রেনের সেই লোকটি সেই কৌতুকের ডাক দিতো “ এই দিবাকর” ।
প্রায়ই ১ বছরের উপর এই জিনিস আমি দেখে আসছি…….সোম থেকে শনি সেই একি দৃশ্য ।
কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই রুটিং তা বদলে গেলো । কারণ দেখলাম যে সেই ৪ বন্ধুর মধ্যে যে বন্ধুটি সেই কৌতুক ডাকটা দিতেন সে আর আসছেন না । এই ভাবেই প্রায় কেটে যায় ১০ দিন ।
একদিন আমি সেই ট্রেন এর সেই বাকি তিন বন্ধুর কথোপকথন থেকে জানতে পারি যে সেই বন্ধুটি যিনি ট্রেন থেকে সেই কৌতুক ডাকটা দিতেন তিনি মারা গেছেন।
কথাটা শুনে আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়……….
কিন্তু তার কিছু দিন পর ঘটলো এমন এক ঘটনা যা সত্যি আমার চোখে জল এনে দেয় ।
হঠাৎ একদিন সেই ট্রেনে শ্রীরামপুর থেকে উঠে একজন বছর ৫৫ এর লোক । সেই লোকটি ট্রেনে উঠে বেশ ব্যাকুল ভাবে চেয়ে থাকে সেই ট্রেনের গেট টির দিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলোর দিকে । সে যেন কিছু বলতে চায় এমন মনে হল।
যখন সেই মাঠের জায়গা টা এলো যেখান থেকে সেই ট্রেন যাত্রী লোকটি ডাকতো “ এই দিবাকর বলে “ ….
তখন সেই লোক টি গেটের আরো কাছে চলে আসে । মনে হল লোকটি যেন কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ওই গেটের দিকে চেয়ে । সেই মাঠের জায়গাটা পেরিয়ে যাবার পর , একটু উদাস ভাবে ওই ব্যক্তি তখন সেই গেটে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে । এক ভাই আমাকে এই গেট থেকে রোজ দিবাকর বলে ডাকতো ,,, সে এখন আমাকে অনেক দিন হলো আর ডাকেনা । আপনারা তাকে জানেন। এই কামরাতেই সে যেত , আর আমাকে ডাকতো "এই দিবাকর " ।
তখন সেই ৩ বন্ধু তাকে বলে তাদের সেই বন্ধু যে ডাকতো দিবাকর বলে তার সেই মৃত্যু সংবাদ ।
সেই কথা শুনে চোখে জল আসে সেই লোকটির । সে আর কোনো কথা বলতে পারেনা । রুমালে সে চোখ চাপা দেয়….
সেই ৩ বন্ধু তাকে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে । কিন্তু সেই লোকটি জল ভরা চোখে নেমে পরে পরের স্টেশনে ।
…………………তারপর থেকে আর সেই লোকটিকে সেই ট্রেনে করে যাবার সময় আর সেই মাঠে দেখতে পাইনি কোনো দিনও ।
আমি আজও বুঝিনি সেই লোকটি কেন কেঁদে ফেললো সেই মৃত্যু খবর শুনে। কেন তার বাক্য রোধ হল । তবে সেটা কি তার ভালবাসা ছিল সেই পরলোক গত ট্রেন যাত্রী টির প্রতি ।
সেই লোকটি হয়তো সেই কৌতুক ভরা ডাক এর মধ্যে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল ।
আমার মনে হয় ভালোবাসা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে । শুধু তাকে খুঁজে পাওয়ার মতো চোখ চাই ।