STORYMIRROR

Nityananda Banerjee

Fantasy

4  

Nityananda Banerjee

Fantasy

এ তুমি কেমন তুমি

এ তুমি কেমন তুমি

4 mins
419

প্রথম অধ্যায়

ঝুমরি তিলাইয়া থেকে হাজারীবাগ যাবার আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে চলল কিংস্টন সাহেবের মার্সিডিজ বেঞ্জ

গতিবেগ বৃদ্ধি করবার উপায় নেই। সর্পিল অপ্রশস্ত পথ। ডাইনে পাহাড়ের দেওয়াল ; বাম দিকে খাত । একসাথে বিসরীতগামী দুইটি গাড়ি কোনমতে নিজেদের স্পর্শ ছাড়িয়ে যেতে পারে । বামদিকের গাড়ি একফোঁটা এদিক ওদিক করেছে তো সোজা খাতে ঝাঁপ দিবে ।

পাহাড়ের গায়ে শালবন , খাতের নীচে বেশ কিছুটা গড়িয়ে নেমে গেলে চাষের উঁচুনিচু জমি । কিংস্টন সাহেব অতি সাবধানে ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন । অপর দিক থেকে বাস লরি বা অন্য যান এলে হয় গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছেন নতুবা খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছেন ।

চার্লস কিংস্টন রেডিও শ্রীলঙ্কার প্রধান কর্মাধ্যক্ষ । তখন ১৯৬০-৬১ অর্থবর্ষের মাঝামাঝি সময় । অর্থাৎ জুন বা জুলাই মাস। প্রবল বর্ষণের আশঙ্কা উপেক্ষা করে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে এসেছিলেন ঝুমরি নাচ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবার জন্য ।

তিন মাস কাল সময় অতিবাহিত করে আদিবাসী রমণীদের নৃত্যের ব্যাপারে একরকম গবেষণা করতেই এসেছিলেন ।

তাঁর মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অনেক আদিবাসী তরুণ-তরুণী তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করেছেন । ফলে অনেকের সঙ্গে সখ্যতা হয়েছে। শেষে চম্পা নামের এক তরুণীকে তাঁর মনে ধরে যায় । চম্পার ডাকনাম ছুটকি।

তিনি বলতেন চুটকি । ছুটকির সঙ্গে দেবল নামের এক আদিবাসী তরুণের অন্তরঙ্গ হৃদ্যতা ছিল । ক্রমে তা প্রেমে পরিণত হলে ছুটকির বাবা কালীচরণ হাঁসদার ক্রোধের শিকার হয়ে দেবল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে । এই কালীচরণকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন কিংস্টন সাহেব । কারণ দেবল নামের তরুণটি গোরা সাহেবকে একদম পছন্দ করত না । তার ছুটকিকে নিয়ে নাচের বাহানা করে ফষ্টিনষ্টি করতে দিতে চাইত না দেবল ।

অথচ কিংস্টন সাহেবের অর্থে কালীচরণ আর্থিক ভাবে বেশ পুরুষ্ট হয়েছিল বলে মেয়েকে কিংস্টনের নিকট ইচ্ছা করেই পাঠিয়ে দিত । দেবল তা' মানতে পারেনি;বিদ্রোহ করে বসেছিল । তারই পরিণতিতে কালীচরণ তাকে গলা টিপে মেরে ফেলে এবং গলায় ফাঁস লাগিয়ে মহঙয়াবনে একটি গাছে টাঙিয়ে দেয় ।

আর তখন থেকেই কালীচরণের ভেতরে অশান্ত প্রেতাত্মা আশ্রয় নেয় । সম্ভবত এই প্রেতাত্মাটি মৃত দেবলের । দেবল জানত না ছুটকি তাকে ভালবাসত কি না । অথচ অঙ্গে অঙ্গ রেখে বসা, হাসি, গল্প কোন কিছুর অভাব ছিল না তাদের ।

মহুয়া তলে গান গাইত দেবল - ' কালো জলে কুইচলা তলে ডুবল সনাতন ।'

ঝুমুরের তালে তালে আর সঙ্গীতের মূর্ছনায় ভরে যেত মহুয়া গাছের তলদেশ । পাখিরা নিজেদের কলরব ছেড়ে মোহিত হয়ে শুনত তার গান, আর ছুটকির নূপুরের বোল ।

ঝর্ণার কলরোল মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।

দেবলের গলাটি ছিল ঈশ্বর প্রদত্ত । লোকসঙ্গীত ছাড়াও চটুল হিন্দি গানে মাতিয়ে ফেলত আসরের পর আসর । অথচ আশ্চর্য্য এই - কিংস্টন সাহেবের কানে সেই সুর বাজলেও তিনি দেবলের বিষয়ে আশ্চর্য্যজনক ভাবে নীরব ছিলেন । অথচ ছুটকির নৃত্যকলায় আমোদিত হয়ে তাকেই আহ্বান করেছিলেন রেডিও স্টেশনে ডিশনের জন্য ।

চম্পা মানে ছুটকি বেশ আনন্দিত। প্রচুর অর্থ লাভের আশায় কিংস্টন সাহেবের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল । কিন্তু এর জন্য অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন । হাজার টাকার বাণ্ডিল কালীচরণের হাতে অর্পণ করে বলে - গোরা সাহেব দিয়েচে। আরও দেবে বলেছে। তবে আমাকে রেডিও ইস্টিশানে যেতে বলচে !

কালীচরণ এক ঝটকায় টাকার বাণ্ডিল ছুঁড়ে দিয়ে মেয়েকে শাসায়- খবরদার ছুটকি ! সায়েবের ফাঁদে পা দিসনি। ওরা আমাদের ধম্মকম্ম বুঝে না ।

অবাক হয়ে যায় ছুটকি । এই তো সেদিনও কত আদর করে কালীচরণ বলেছিল গোরা সায়েবের তোর উপর নজর পড়েচে । এই সুযোগে কিছু বাগিয়ে নে ।

আজ এমন হঠাৎ করে টাকার বাণ্ডিল ছুঁড়ে দিল কেন?

প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেও ছুটকি যখন কোন সদুত্তর পেল না; মনের দুঃখে মহুয়া তলায় গিয়ে বসল । তখন গাছে সবে মৌল এসেছে । মাঝেমধ্যে দু'চারটে বোল কোলে ঝরে পড়ছে । সেই গন্ধ নাকে নিয়ে ছুটকির মনে পড়ল দেবলকে ।

কৃষ্ণকায় সুঠাম দেহ । পুরুষ্ট বাহুবন্ধন। ওর কবজীতে ভীষণ জোর । একবার জড়িয়ে ধরলে সেই বন্ধন ছাড়ানো যায় না ।

ছুটকির মুখে মহুয়া ঢেলে দেয় দেবল । বাধা দেয় না ছুটকিও । এক সময় মহুয়ায় মাতাল হয়ে দু'জনে গেয়ে উঠে - ' কাদা দিলি; কেনে তুই কাদা দিলি সাদা কাপড়ে '।

কালীচরণ দেখে । প্রথম দিকে দেখে খুশি হত । এখন আর ভালো লাগে না । মনে হয় কি আছে ওর ! ভাত রান্না করা মাটির হাঁড়ির মত কুৎসিত শরীর, ধবধবে দু'পাটি দাঁত আর ছুটকিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মত অদম্য সাহস । ঘরে তো চালচুলো নেই । ঝুমরিতিলাইয়ার একটা হোটেলে বারো টাকা মাইনের এঁটো বাসন ধোয়ার কাজ । এর চেয়ে গোরা সায়েব ছুটকিকে অনেক অনেক বেশি টাকা দেয় ।

দেবলের গান শেষ হয়। ছুটকির নাচাও । কালীচরণ আসে। ওরা দুজন দু'দিকে তফাত যায়। বাপটা আজ অমন চোখ নিয়ে চেয়ে আছে কেন?

(ক্রমশ )


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy