দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনা


মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল তনুজার। রাত্রি তিনটে পনেরোয় চৈতির ফোন! ঘুম চোখে রিসিভ করল, “কী রে! এত রাতে ফোন কেন?” বিপরীতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে মুহূর্তের জন্য ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে গেল! শরীরের ভেতর থেকে একটা কাঁপুনি দিচ্ছে তনুজার। বুকে যেন ড্রাম বাজছে ওর।
তনুজা বিউটি পার্লার থেকে ফিরছিল। পরদিন সন্ধ্যায় ওকে দেখতে আসবে। তাই পার্লারে টাচ-আপ দিতে গিয়েছিল তনুজা।
তনুজার বান্ধবী চৈতি সম্বন্ধটা এনেছে। ওর মাসতুত দাদার বন্ধু। তবে শতদ্রুর সাথে চৈতির সাক্ষাত হয়নি কখনও।
গত সপ্তাহেই শতদ্রুর বাবা মা তনুজাকে দেখে গেছেন। শতদ্রু তখন অফিসের কাজে চেন্নাইতে। বাবা-মায়ের সম্মতি পেয়ে আজ শতদ্রু আসবে ওদের বাড়িতে। ফোনে একবার তনুজার সাথে শতদ্রুর কথা হয়েছে। সাক্ষাৎ ঘটবে কাল।
পার্লার থেকে ফেরার পথে বান্ধবী চৈতির সাথে দেখা হয়ে যায়। দুজনেই কানে হেড-ফোন গুঁজে রেল লাইন পার হচ্ছিল। ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায়নি। আশেপাশের লোকজনদের সতর্ক বানীও কানে যায়নি ওদের। ছেলেটি ওদের সজোরে ধাক্কা মেরে রেল লাইন থেকে সরিয়ে না দিলে, দুজনের কেউই আজ প্রাণে বাঁচত না। কিন্তু ওদের ধাক্কা দিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। আর ঠিক সেই সময়েই উলটো দিক থেকে আসা একটি ট্রেন ওকে আঘাত করে। গুরুতর ভাবে আহত হয়ে রেল লাইনে পড়ে গিয়ে কাতরাতে থাকে ছেলেটি। চৈতি ও তনুজা তা দেখে ভয়ে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে পালিয়ে যায়। কৌতূহলী জনতা নীরব দর্শক হয়ে ছেলেটাকে দেখতে থাকে।
ঠিক যেভাবে দুর্গন্ধ বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পরে, সেভাবেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পথ চলতি মানুষরা যেই দেখছে, সেই তীব্র সমালোচনা করছে।
“মানুষের কাণ্ডজ্ঞান দেখুন। ছেলেটা যে রেল লাইনে শুয়ে কাৎরাচ্ছে, সেই দিকে কারও নজরই নেই!”
“নিজেরা না
করুক রেলের পুলিশকে তো ডেকে আনতে পারে।”
“আরে জি.আর.পি ঠিকই খবর পেয়েছে। জেনেও চুপ করে আছে।”
“আর এই এক হেড-ফোন হয়েছে। এইজন্য যে কত অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, প্রায়ই তো খবরের কাগজে দেখি ...”
ছেলেটা রেল লাইনে ঘণ্টা দুয়েক পরে থাকার পর তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। অবস্থা খুব গুরুতর দেখে সেখান থেকে কোলকাতার একটি নামী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হল তাকে। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার সাথে সাথে ভর্তি করা হলে, রোগীর অবস্থা এই রকম আশঙ্কা-জনক হোতো না। অবিলম্বে রোগীকে রক্ত দিতে হবে। খবর পাওয়া মাত্রই ছেলেটির কয়েকজন বন্ধু রক্ত দিতে ছুটল। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে গেল। কারণ এই ঘটনারই প্রতিবাদে রেল অবরোধ করেছে ক্ষুব্ধ জনতা। শয়ে শয়ে লোক রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে রেল চলাচল সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। অফিস ফেরত যাত্রীরাও পড়ল বেশ সমস্যায়।
তনুজার দু-চোখ জুড়ে শতদ্রুর স্বপ্ন। ছেলেটির সাথে দু-চারটে কথা বলেই বেশ লেগেছে তনুজার। আর শতদ্রুর বাবা-মার সাথে প্রথম দিন কথা বলেও নিজের লোক বলে মনে হয়েছে। কাল অনুজাদের বাড়ি আসছে শতদ্রু। দুজনের প্রথম সাক্ষাত। উৎকণ্ঠায় ঘুম আসছে না তনুজার। শোয়ার বহুক্ষণ পরে চোখ লেগে এলো ওর। ঠিক সেই সময়ে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চৈতি ফোন করেছে।
হ্যালো তনুজা, আমাদের বাঁচাতে গিয়ে যে ছেলেটার আজ একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে সেই শতদ্রু। ঘণ্টা দুয়েক ও রেললাইনে পড়েছিল। অথচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দূরে থাক, আমাদের কেউ খবরটা দেয়নি পর্যন্ত। আমাদের ওকে ফেলে চলে আসা ঠিক হয়নি রে।
আরও অনেক কথাই ভেসে আসছিল ফোনের ওপার থেকে। কিন্তু শেষের কোনও কথাই আর তনুজার কানে পৌঁছল না। ফোন ছেড়ে নির্বাক হয়ে বসে রইল।