JAYDIP CHAKRABORTY

Romance Fantasy

1  

JAYDIP CHAKRABORTY

Romance Fantasy

এনজয় লাইফ

এনজয় লাইফ

6 mins
597



নে তোকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছি। একসেপ্ট করে নে। ফ্রি ফায়ারে ডুয়ো ম্যাচ খেলব। মোবাইলে চোখ রেখেই পারিজাতকে কথাগুলো বলল ঋষভ। 

একসেপ্ট করে নিয়েছি। পারিজাতের মনও মোবাইলের অন লাইন গেম, ফ্রি ফায়ারে। 

মায়েদের মোবাইল নিয়ে খেলার ছলে যুদ্ধে মেতেছে দুই বালক ঋষভ ও পারিজাত। এক জনের বয়স দশ, অপর জনের সাত। দুজন একসাথে দল বেঁধে অন লাইনে থাকা অন্য খেলোয়াড়দের সাথে লড়াই করছে। 

আরে, পিকে নাম। ওখানেই সব নুবরা গুলো বসে থাকে। হেবি কিল করা যাবে।

কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না দাদামনি। 

তুই আগে কে.ডাবলু.এম বন্ধুকটা নে। তারপর দেখছি।  

খেলার মাঝপথের উত্তেজনার সময় একটা ফোন এসে বেশ বিরক্ত করল পারিজাতকে। না, মা টয়লেটে গেছে। আপনি একটু পরে ফোন করুন। কোনোরকমে উত্তর দিয়ে ফোন কাটল পারিজাত।

আরে, এয়ার-প্লেন মোড করে দে না। আর ফোনই আসবে না। দেখছিস না, আমার মোবাইলে কোনও ফোনই আসছে না। পারিজাতকে পরামর্শ দেয় ঋষভ।

ঋষভ ও পারিজাত মামাতো পিসতুতো ভাই। ঋষভ আজ ওর দাদু ঠাম্মার বিবাহ-বার্ষিকী উপলক্ষে ওর মামা বাড়িতে। কচিকাঁচারা একসাথে খেলায় মেতেছে। তবে ছুটো-ছুটি হুটোপুটির খেলা নয়। বসে বসে ক্যারাম, দাবা, লুডোও নয়। মোবাইলে অন লাইন গেম। গুলি চালিয়ে মানুষ মারার খেলা। 

পারিজাতদের দ্বিতল বাড়িটি বছর দুয়েক আগে প্রস্থে বেড়েছে। অর্থাৎ বাড়ির পেছনের ছোটো বাগানটি এখন আর নেই। কাটা পড়েছে পারিজাতের ঠাকুর্দার নিজের হাতে লাগানো পেয়ারা গাছ, আম গাছ। আর তার সাথে কিছু ফুলের গাছ। বাগান এখন টবের সাহায্যে ঝুলন্ত বারান্দায় বাড়ন্ত। তবে বাড়িতে ঘরের সংখ্যা এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে। ওপর নীচ মিলে শোবার ঘর পাঁচটি। এছাড়া খাওয়া ও বসার ঘর তো রয়েছেই। তাই ছোটো-খাটো অনুষ্ঠান, গেট-টুগেদার এই বাড়িতে এখন বেশ ভালো ভাবেই হয়।

পারিজাতের বাবা সম্বিৎ আইটি সেক্টরে বেশ উচ্চ পদে রয়েছে। আমুদে হুল্লরে লোক। ছুটির দিন বেছে কারণে অকারণে প্রায়ই নিজের বাড়ি বা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে জমায়েত হয়ে আড্ডার আসর বসায়। আজ বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে বাড়িতে এমনি এক জমায়েত ও হই হুল্লরের আসর বসিয়েছে।

আজকের আসরে আমন্ত্রিতদের মধ্যে রয়েছে সম্বিতের বোন বিদিশা ও তার পরিবার। সপরিবারে দুই বন্ধু। বাড়ির লাগোয়া দুই বাড়ির পরিবার। প্রত্যেকেই নিজেদের সম-বয়সীদের বেছে নিয়ে এক একটি ঘরে নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছে, আর নিজেদের মতো করে উপভোগ করছে।    

দোতলার কোনের ঘরটি চারজন অল্প বয়সী মেয়ের দখলে।একজন ষষ্ঠ, দুজন সপ্তম ও একজন নবম শ্রেণীর ছাত্রী।বিভিন্ন ভঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে সেলফী তুলে, মোবাইল আপ্লিকেশনের সাহায্যে সেই ছবিগুলোতে নানারকম ফিচার যোগ করতে ব্যস্ত তারা। ছবি তোলার আগে আয়নার সামনে নিজেদের উপস্থাপন যোগ্য করার চেষ্টাও চলছে। সেই সঙ্গে চলছে একে অপরের পেছনে লাগা, বিভিন্ন প্রকার মন্তব্য ও হাসি ঠাট্টা। 

 সম্বিতের স্ত্রী সপ্তমিতা রান্নাঘরে ব্যস্ত। বাবা-মার একমাত্র এই মেয়েটি রন্ধন শিল্পে বেশ নিপুণ। আজ রাতের খাবার হোম সার্ভিস থেকে এলেও, স্টার্টারের দায়িত্ব সে নিজের কাঁধেই রেখেছে। হাড় বিহীন মুরগির মাংসের সাথে পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম ও মশলা সহযোগে মুখরোচক খাদ্য প্রস্তুত করছে সে। তার ননদ বিদিশা রয়েছে সহযোগিতায়।

বিদিশার শ্বশুর বাড়ি ও বাপের বাড়ির দূরত্ব সাইকেল বা রিক্সায় মিনিট দশেকের। নিজের পছন্দের ছেলে অনুব্রতকে বিয়ে করেছে ও। অনুব্রতর ফার্নিচারের ব্যবসা। যেকোনো আসর জমাতে দক্ষ। আজকেও ও সেই দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।  

 সপ্তমিতার বাপের বাড়ি চার স্টেশন পরে। বাবা-মা সেখানে একাই থাকেন। এক বছর আগেও এরকম অনুষ্ঠানে ওনারা মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে গেছেন। কিন্তু এখন আর পারেন না। দুজনের শরীরেই নানারকম রোগ বাসা বেঁধেছে।সবসময়ের কাজের লোক ছাড়াও ওদের ভাড়াটে প্রিয়াংশু এই প্রৌঢ়দ্বয়ের বেশ খেয়াল রাখে।   

সকলের উপস্থিতির পর কেক কাটার আয়োজন হল। সম্বিতের বাবা মার ডাক পড়ল। ওনারা তখন নিজেদের একতলার ঘরে টেলিভিশন ধারাবাহিকে ব্যস্ত। সপ্তমিতার ফোন ওর ছেলের দখলে। সম্বিতের মোবাইল চার্জ শেষ হয়ে সুইচ অফ হয়ে গেছে। কেক কাটার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িকে দোতলায় ডাকতে, অনুব্রতর ফোন নিয়ে ওনাদের ঘরের ল্যান্ড ফোনে ফোন করল সপ্তমিতা। কোনও সারা নেই। দুজনেই কানে কম শোনেন। তাই বেশ জোরে টিভি চালিয়ে ধারাবাহিক দেখতে ব্যস্ত ওনারা। অনেকক্ষণ পর বৌমার ফোন ধরলেন শ্বশুর-মশাই। সপ্তমিতা ওনাদের তাড়াতাড়ি ওপরে আসতে বললেন। কোনোরকমে ফোন রেখে দোতলায় উঠলেন ওনারা।

দুজনে একত্রে কেক কাটলেন।একে অপরকে কেক খাওয়ালেন। সেই মুহূর্তগুলো একাধিক মোবাইলে বন্দী হল। বেশ কয়েক বছর ধরে ছেলে ও মেয়ের কল্যাণে এভাবেই নিজেদের বিয়ের দিনটি স্মরণ করছেন ওনারা। কেক কাটা ও বিতরণের পর আবার যারা যেভাবে এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছিল, সেভাবেই করতে লাগল। সপ্তমিতা ও বিদিশার মোবাইল আবার তাদের ছেলেদের হাতে চলে গেল। 

দোতলার বারান্দায়, হালকা আলোতে অনুব্রত, সপ্তমিতা, বিদিশা, সম্বিৎ ও তার বন্ধু বান্ধবরা সুরা-পানের আসর বসিয়েছে। বিলেতি কারন-সুধার সাথে সপ্তমিতার বানানো চিকেনের রেসিপি। সেই সঙ্গে খোশ-গল্প আড্ডা ও হাসি তামাশা সমান ভাবে চলছে। কোনও অসম বয়সের অনুপ্রবেশ ঘটেনি এখানে। বয়োজ্যেষ্ঠরা দূরদর্শন দর্শনে ব্যস্ত। কনিষ্ঠরা একনিষ্ঠ ভাবে মুঠোফোনের মুঠোয়। তাই এই সুরা সহযোগে আড্ডার ছন্দ-পতন করাতে কারও মুঠোফোনই বেজে উঠছে না। 

সুরার সাথে সুরের সংযোগ ঘটাল সপ্তমিতা। রেওয়াজ না করা গলা, তবে আওয়াজ শুনে বোঝার উপায় নেই। পুরনো দিনের কিন্তু কখনই পুরানো হবে না এমন একটি বাংলা গান গাইল ও। সঙ্গে সঙ্গতে সম্বিৎ। একটা বাক্স জোগাড় করে তাল সংযোগ করছে ও। 

এই গানটা তুমি তোমার বাসরে গেয়েছিলে না বৌদি? স্মৃতি হাতরে বলে অনুব্রত।

হ্যাঁ, তোমার মনে আছে? 

আরে তোমার বাসর কি ভোলা যায়? কি যেন নাম তোমাদের ভাড়াটে ছেলেটার? বেসুরো গান গেয়ে বাসরের আসর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল।

 প্রিয়াংশু। ওফ, যা খোরাক করেছিলে তোমরা ওকে! তবে ছেলেটা কিন্তু ভীষণ সরল সিধে। অনেকদিন ধরে আমাদের বাড়িতে ভাড়া আছে। আমাদের পরিবারের মতো হয়ে গেছে।

ওকে আজ এখানে ডাকতে পারতে তো। আসর একদম জমে যেতো।

এসে গেছে। প্রিয়াংশু এসে গেছে। বারান্দার রেলিং থেকে প্রিয়াংশুকে লক্ষ্য করেছে বিদিশা।

প্রিয়াংশু আমাদের বাড়িতে? তুমি কি ওকে নিমন্ত্রণ করেছিলে নাকি? বেশ অবাক হয়ে সম্বিৎকে প্রশ্ন করে সপ্তমিতা।

ধুর, আমি কেন ওকে বলতে যাবো? 

সম্বিতের উত্তরে অপেক্ষা না করে কৌতূহল মেটাতে দ্রুত নিচে নেমে যায় সপ্তমিতা। 

মিতা দি, তোমাদের ফোনগুলো কি হয়েছে? সপ্তমিতাকে দেখা মাত্রই প্রিয়াংশুর প্রশ্ন।  

- কেন? কি হয়েছে? ফোন তো ঠিকই আছে। 

- মেশোমশাই বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। মনে হচ্ছে একটা অ্যাটাক্ হয়ে গেছে। অনবরত তোমার ফোনে, সম্বিৎদার ফোনে, তোমাদের ল্যান্ড-লাইনে চেষ্টা করে, এমন কি বিদিশাদির ফোনেও লাইন না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমি চলে এলাম। 

বাবা এখন কি বাড়িতেই আছে?

না, পাশের বাড়ির শ্যামল দা, বুবাই দা মিলে মেশোমশাইকে ট্রিটমেন্ট নার্সিং হোমে নিয়ে গেছে। 

বাড়ির অতিথিদের আপ্যায়নের দায়িত্ব বিদিশার ওপর দিয়ে সম্বিৎ, সপ্তমিতা ও অনুব্রত নার্সিং হোমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। সম্বিৎ গাড়ি বের করতে করতে সপ্তমিতা দেখে নিলো বাড়ির ফোন গুলোর অবস্থা। ল্যান্ড ফোনটা ঠিক মত রাখা নেই। সম্বিতের ফোন সুইচ অফ হয়ে যাওয়ার পর চার্জে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর সুইচ অন করা হয়নি। আর ওর ফোন ছেলের হাতে।

কিরে, আমার ফোনে কল এসেছে। কল রিসিভ করিসনি কেন? বেশ ঝাঁজালো গলায় পারিজাতকে বলল সপ্তমিতা। 

ফোন আসবে কি করে? ফোন তো এয়ার প্লেন মোডে। 

ফোন এয়ার প্লেন মোডে রেখে দিয়েছিস? জানিস কত দরকারি ফোন আসতে পারেনি তোর জন্য?

আমি কি করব? দাদামনিই তো বলল। 

ও এটা তোর বুদ্ধি? তোদের টাইম পাসের জন্য আমরা তোদের ফোন দি, যাতে তোরা কোনও ভাবে বোর না হোস। আর তোরা ফোনটাকেই অকেজো করে রেখেছিস? সপ্তমিতার আক্রোশ এবার ঋষভের ওপর। 

এমনি এমনি কি ফোন দিয়েছ? তোমরা ড্রিঙ্ক করে লাইফ এনজয় করছ। যাতে তোমাদের আমরা বিরক্ত না করি, তাই মোবাইল দিয়ে দিয়েছ। আমরাও লাইফ এনজয় করছি।আর সেখানে যেন কোনও ডিস্টার্ব না হয় তাই ফোন এয়ার প্লেন মোডে রেখেছি। সপ্তমিতার মুখে মুখে উত্তর দিল ঋষভ। 

হঠাৎ বাবার এরকম একটা খবর শুনে সপ্তমিতার মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। নিজেদের ভুলে সময় মত খবরটাও পায়নি ও। তার ওপর ননদের ছেলের এমন উত্তরে নিজের রাগকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পাড়ল না। সজোরে এক থাপ্পড় মাড়ল ঋষভের গালে। 

থাপ্পড় খেয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল ঋষভ। সবাই ছুটে এলো। ঋষভ বিদিশার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদিশা কিছু বলার আগেই ওর বাবা ওকে বললেন, 

বৌমাকে এখন কিছু বলিস না রে মা। ওর এখন মাথার ঠিক নেই। কথার ওপর কথা বেড়ে চলবে। ওদের নার্সিংহোমে যাওয়া হবে না।বৌমা তুমি এখন কথা না বাড়িয়ে নার্সিং-হোম যাও। আর সবাইকেই আমার একটা কথা বলার আছে। তোমরা জীবন উপভোগ কর। আনন্দ কর। তবে তোমাদের আনন্দ যেন অপরের দুঃখের কারণ না হয় সেটা খেয়াল রেখো। আর সন্তানদের উপদেশ দিয়ে নয়, নিজেদের জীবন-যাত্রা দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা কর। 

অল্পক্ষণের নিস্তব্ধতা। সপ্তমিতারা নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ঋষভ বিদিশাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে মা। আমিই দুটো ফোনকে এয়ার-প্লেন মোড করে রেখে ছিলাম। আর কোনোদিন হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। 

দু-চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে ঋষভের। পারিজাতের চোখেও জল। এই জল অনুশোচনার, এই জল অনুতাপের। কোনও কথা না বলে, দুজনের চোখের জল মুছিয়ে, দুজনকেই বুকে টেনে নিলো বিদিশা।  

 


       

      

  

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance