JAYDIP CHAKRABORTY

Romance Tragedy

2  

JAYDIP CHAKRABORTY

Romance Tragedy

কেউ কেউ কথা রাখে

কেউ কেউ কথা রাখে

7 mins
487


সমৃদ্ধ, হৃদয়পুর থানার ওসি হয়ে এসেছে সদ্য। এসেই এমন একটা কেসের মধ্যে পড়েছে যে, সারাদিনে নাওয়া খাওয়ারই সময় পাচ্ছে না ও। এই গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান সুবিমল মাইতি খুন হয়েছে। খুনের জায়গায় আজ দিনের আলোতে আরেক বার যাবে ও। খবর পেয়ে খুনের রাতে দুজন পুলিশ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় সমৃদ্ধ। বডি পোস্ট মর্টেমে পাঠিয়ে, ঘরটাকে সিল করে চলে এসেছে ও। ঘরটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি ওদের। তারপর দু-দিন ওখানে যাওয়ার আর সময় পায়নি সমৃদ্ধ।

সুবিমল মাইতি লোকটি এলাকায় বেশ পরিচিত। স্থানীয় অঞ্চলের অনেক উন্নয়ন হয়েছে এই লোকটির জন্য।  সমৃদ্ধর মামার বন্ধু ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে সমৃদ্ধও ভদ্রলোককে বেশ ভালোভাবে চিনতো।  

 ছোটো বেলা থেকেই এই গ্রামের সাথে সমৃদ্ধর একটা নিবিড় সম্পর্ক। এই গ্রামে ওর মামার বাড়ি। তাই ছুটি পেলেই ও মামাবাড়ি চলে আসতো। সমৃদ্ধর হৃদয় হৃদয়পুরকে পছন্দ করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। গ্রামের গাছপালা, মাঠঘাট, ওকে ভীষণ টানত। গাছে উঠে ফল পাড়া, পুকুরে স্নান করা, মাছ ধরা, এসবের মধ্যে সমৃদ্ধর দিন বেশ আনন্দে কাটত। 

এসব ছাড়াও সমৃদ্ধর এই হৃদয়পুরে আসার আরেকটি আকর্ষণ ছিল। সেই আকর্ষণ হল পিউ। মামাবাড়ির পাশের বাড়ি থাকত ও। সমৃদ্ধর থেকে বছর তিনেকের ছোটো। বেশ প্রাণোচ্ছল, ডানপিটে মেয়ে পিউ। সমৃদ্ধ হৃদয়পুরে থাকাকালীন পিউ বেশিরভাগ সময়ে সমৃদ্ধর সাথেই থাকত। এভাবেই প্রকৃতির নিয়মে ওরা দুজনে বড় হয়ে উঠল। সমৃদ্ধ হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে শহরের কলেজে পড়তে চলে গেল। হস্টেলে থেকে পড়ছে ও। তাই হৃদয়পুরে আসা কমেছে। একদিন ছুটির দিনে হৃদয়পুরে এসে পিউর জন্মদিনে ওর সাথে দেখা করতে গেল সমৃদ্ধ। দিনটা এগারোই ফেব্রুয়ারি। পিউ তখন ক্লাস নাইন। বয়সটা প্রেমে পরার বয়স। আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে পিউর হাত দুটো দু-হাতে ধরে সমৃদ্ধ বলল,  

- এখন পড়াশোনার বেশ চাপ, তাই আগের মত রেগুলার আসা হবে না। তাছাড়া তোর আমার ব্যপারটা মামাবাড়িতে সবাই জেনে গেছে। এখন কদিন না আসাই ভালো। 

- ঠিক আছে, তোমাকে এখন আর আসতে হবে না। ভালো করে পড়াশোনা করে, ভালো চাকরি পাও। আমিও মন দিয়ে পড়াশোনা করি। নিজেকে তৈরি করি। তারপরে দুজনে দেখা করব। এর মাঝে আমি আর তোমার সাথে দেখা করব না। 

- সে তো অনেক বছর লেগে যাবে রে। 

- লাগুক। ফোনে তো যোগাযোগ থাকছেই। দেখাটা অনেক বছর পরেই হোক। তবে সেটা হবে এই তারিখে, এই সময়ে, এখানে। মনে থাকবে তো?

- সে তো মনে থাকবেই। এগারোই ফেব্রুয়ারি তোর জন্মদিন। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি। সেদিন এখানে আসবোই। আজ তোর জন্য জমানো টাকা দিয়ে মুক্তোর এক জোড়া কানের দুল এনেছি। দেখত পছন্দ হয় কিনা?

- দারুণ। ভীষণ পছন্দ হয়েছে। দেখা না হলেও প্রতি বছর গিফট কিন্তু চাই। 

- সে তো পাঠাবোই। আর যেদিন দেখা হবে সেদিন এমন একটা গিফট দেবো যা তোকে সারা জীবন মনে রাখতে হবে।  

এরপর বছরের পর বছর কেটে গেছে। সমৃদ্ধ কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে, চাকরির পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে, চাকরিতে জয়েন করেছে। কর্ম ব্যস্ততায় পিউর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্কে কোনও ভাঁটা পড়েনি। মূলত পিউর সাথে সম্পর্কের দৃঢ়তা আনতেই এই থানাতে চাকরি নিয়ে এসেছে সমৃদ্ধ। এসেই জানিয়ে দিয়েছে যে এবছর পিউর জন্মদিনে সমৃদ্ধ ওর সাথে দেখা করবে।   

জীপ থেকে নেমে তালা খুলে সুবিমলের ঘরে ঢুকল সমৃদ্ধ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরের প্রতিটি কণা দেখল ও। যে করেই হোক এই কেসটা ওকে সলভ করতে হবে। এর ওপর ওর চাকরীর উন্নতি নির্ভর করছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আজ সকালেই এসেছে। মাথার পেছনে কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে ওনাকে। কিন্তু সেই আঘাত করার জিনিসটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভালোভাবে ঘরের সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহজনক যা কিছু পেল সব কিছু সংগ্রহ করে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো সমৃদ্ধ। 

ওখান থেকে বেরোনোর পর সমৃদ্ধকে বেশ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন লাগলো। পরদিন পিউর সাথে দেখা করার দিন। কিন্তু ওর জন্য কিছুই কেনা হয়নি। কি কিনবে ভেবে উঠতে পারছে না ও। আর তেমন ফুরসৎও পাচ্ছে না কেনার। 

পরদিন একটা সাইকেল জোগাড় করে খালি হাতেই ঐ আমগাছের তলায় গেলো সমৃদ্ধ। কিন্তু পিউর কোনও পাত্তা নেই। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাইকেলে উঠল ও। ঠিক তখনি একটা মহিলা কণ্ঠস্বর ওকে পেছন থেকে ডাকল।

আরে পুলিশ বাবু চললেন কোথায়? 

পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না সমৃদ্ধ। তারপর হঠাৎ একটা গাছের আড়াল থেকে শাড়ি পরা এক তরুণী বেরিয়ে এলো। 

আবছা আলোতেও বেশ কয়েক বছর আগে দেখা পিউকে সমৃদ্ধর চিনতে কোনও অসুবিধে হল না। মুখমণ্ডল ও শরীরের সর্বত্র অনেকগুলো বছর মেখে ও যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। 

- পিউ, তুমি এসেছ তাহলে? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আসবেই না। 

- সবাই এক রকম হয় না। কেউ কেউ কথা রাখে। এতো বছর ধরে এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। দিনটা এতো দেরিতে এলো, যে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

- কেন? কি হয়েছে পিউ? কোনও সমস্যা?

- হ্যাঁ, সমস্যা একটা ছিল। সেটা সরিয়ে দিয়েছি। ছাড়ো ওসব। তোমার কথা বল। তুমি তো এখন মস্ত পুলিশ অফিসার। সরকারি চাকরি। আমার মত সাধারণ একটা মেয়েকে যে তুমি মনে রেখেছ, এটাই আমার কাছে অনেক।

- কে বলল তুমি সাধারণ? তোমার কানের দুলটা এখনও আছে পিউ? এই গাছে নিচে দাঁড়িয়েই একদিন যেটা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম।

- সযত্নে রাখা আছে। সব সময় পরলে পাছে ওটা নষ্ট হয়ে যায়, তাই আলমারিতে তুলে রেখেছি।

এটা তবে কি? পকেট থেকে একটা কানের দুল বার করে পিউকে দেখায় সমৃদ্ধ। দুলটা দেখে ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ে থাকে পিউ। তার অল্পক্ষণ পরে মুখ খোলে ও।

- এই দুলটা তুমি কোথায় পেলে?

- ভয় নেই। এই দুলের কথা আমি ছাড়া কেউ জানে না। আর জানবেও না। পঞ্চায়েত প্রধানকে খুন করলে কেন পিউ? 

- ও, তুমি বুঝি এই কারণেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছ? 

- তুমি আমাকে সত্যি কথাটা বল। এতে তোমার ভালো ছাড়া খারাপ হবে না। 

- আমার আর ভালো কিছু হওয়ার নেই। পাপ সাফ করে দিয়েছি। এখন হাজত বাস করতে হলেও আমার কোনও দুঃখ নেই। 

- একদম গোড়া থেকে ঘটনাটা বলবে?

- বলছি। সুবিমল মাইতি ও আমার বাবা একই রাজনৈতিক দলের লোক।এক সময়ে দলের হয়ে অনেক কাজ করেছেন আমার বাবা। সুবিমল মাইতিকে ভোটে জেতানোর পেছনে বাবার অবদান অনেক। সুবিমল মাইতিও বাবাকে অনেক ভাবে সাহায্য করেছেন। উনি না থাকলে বাবা আমাকে আর বোনকে পড়াশোনা করাতেই পাড়তেন না। আমার বোন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলে অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন হয়ে পরে। এদিকে আমিও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বসে আছি। অনেক চেষ্টা করেও কোনও চাকরি জোটেনি আমার। বাবা সুবিমলের কাছে গেলেন। উনি বললেন, পিউকে পাঠিয়ে দিও। আমি ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবো। আর ওর হাতে কিছু টাকাও দিয়ে দেব। পিউ বেতন পেয়ে তা আস্তে ধীরে শোধ করে দিলেই হবে। বাবার কথা শুনে আমি ওনার কাছে গেলাম। তখন ঘরে আর কেউ ছিল না। উনি আমার বেশ কাছে এসে বললেন, তোর বোনের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সব খরচ আমার। তোরও একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেবো শিগগিরি। তোকে শুধু মাঝে-মধ্যে আমাকে একটু সেবা যত্ন করতে হবে। কথাগুলো বলতে বলতে আমার সারা শরীরে বিচ্ছিরি ভাবে হাত বোলাতে শুরু করেন উনি। ওনার ওপর এতদিনের সব ধারনা এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। উনি কি বলতে চান, আমার বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না। বেশি কিছু না বলে, ভেবে জানাবো, বলে ওখান থেকে আমি সেদিন চলে এসেছিলাম। বাড়ি এসে কাউকে কিচ্ছু বলিনি। কি করব ভাবছি। তোমাকে জানাবো ভেবেও শেষে পারিনি। তারপর একদিন আমার বোন, আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও একটা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আনতে সুবিমলের কাছে গিয়েছিল। উনি আমার বোনের বুকে পিঠে হাত দিতে দিতে বলেছেন, এইভাবে বাইরে থেকে দেখে আমি তোমার চরিত্রের সার্টিফিকেট কিভাবে দেব? এর জন্য তো সব খুলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শুনে আমার মাথায় খুন চেপে বসল। ঠিক করলাম পাপটাকে শেষ করে দেবো। একদিন সকালে ওনার কাছে গিয়ে বললাম, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। আপনি আমাকে যা খুশি করুন, আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে। উনি বললেন, সে নিয়ে তুমি ভেবো না। কাকপক্ষীতেও টের পাবে না। আমি বললাম, আজ তবে রাত আটটা নাগাদ আসবো। কেউ যেন না থাকে। আমার কুমারীত্ব ঘোচানোর সাক্ষী রাখতে চাইনা কাউকে। ও আমাকে ভরসা দিলে, আমি চলে এলাম। রাত আটটার সময় চলে গেলাম। একটা চাদর দিয়ে আপাদ মস্তক ঢেকে গেলাম। যাতে কেউ আমাকে ওখানে ঢুকতে দেখলেও চিনতে না পারে। আর চাদরের তলায় লুকিয়ে নিয়ে গেলাম একটা শক্ত গাছের ডাল। উনি একা। আর কেউ নেই। আমি ঘরে ঢুকলে উনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি বললাম, আপনি পেছন ঘুরুন। আমি জামা কাপড় খুলবো। আপনার সামনে খুলবো না। খোলার পরে দেখলে ক্ষতি নেই। উনি একটু হেসে আমার কথাটা মেনে নিলেন। আমি চাদরটা খুলে রেখে, হঠাৎ গাছের ডালটা দিয়ে সজোরে ওনার মাথার পেছনে আঘাত করলাম। এক বাড়িতেই শেষ। তাড়াতাড়ি আবার চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। এসেই কাঠের ডালটা টুকরো টুকরো করে কেটে মায়ের রান্না করার কাঠের সাথে মিশিয়ে দিলাম। এতো দিনে সে কাঠ পুড়ে ছাই।  

- এ যে এক্কেবারে নিশ্ছিদ্র প্ল্যান। 

- নিশ্ছিদ্র আর রইল কোথায়? কানের দুলের জন্য তোমার কাছে ধরা পড়ে গেলাম যে। চাদর খোলার সময় চাদরে লেগে একটা কানের দুল কখন যে খুলে গিয়েছিল, টেরই পাইনি। এই কটা বছর ধরে আমি শুধু ঐ দুলটাই পরেছি। 

- এই নাও, তোমার কানের দুল। পুলিশের কাছে আর কোনও প্রমাণই রইল না। 

- আমাকে অ্যারেস্ট করবে না। তোমার প্রমোশন আটকে যাবে যে!

- যাক। সমাজের আবর্জনা সাফ করেছ তুমি। আইনের চোখে তুমি যাই হও না কেন, আমার চোখে তুমি অপরাধী নও। তোমাকে মুক্তি দিলাম। তাছাড়া এসব ঝামেলায় পড়ে তোমার জন্মদিনের কোনও গিফটই কেনা হয়নি। এটাই আমার গিফট। আজ তো প্রমিস ডে। এই দিনে প্রমিস করলাম যে সারা জীবন তোমায় এমন ভাবে আগলে রাখবো যাতে সুবিমল মাইতিরা আর কখনো তোমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে না পারে। 

সমৃদ্ধর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল পিউ। এক অঙ্গীকারের বন্ধনে দুজন দুজনকে আবদ্ধ করেছে। সেই বন্ধন চিরদিনের, সেই বন্ধন চিরকালের। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance