লেটে প্রেম, চকলেটে প্রেম
লেটে প্রেম, চকলেটে প্রেম
সুপাত্র বিশ্বাস জন্ম সূত্রে ধনী। জমি, বাড়ি, বিষয় সম্পত্তির অভাব নেই। রয়েছে পারিবারিক ব্যবসা। ব্যবসাটি ঘরে বানানো চকলেটের। আর এই ব্যবসার সুবাদেই বিশ্বাস পরিবার আজ বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। শহর থেকে খুব দূরে নয়, এমন শহরতলীতে তাদের বাড়ি। একদা এই অঞ্চলটি প্রত্যন্ত গ্রাম থাকলেও আজ শহরের বেশীরভাগ সুবিধেই এখানে পাওয়া যায়।
একটি সচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও সুপাত্র এখনও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে উঠতে পারেনি। অথচ মেঘে মেঘে বেলা কম হল না। প্রায় তিন ডজন বসন্ত পার করে দিতে চলেছে সুপাত্র। কিন্তু তার মনের মত পাত্রীর সন্ধান এখনও মেলেনি। আর সেই পাত্রীর সন্ধান আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সেটা বলাও বেশ কঠিন।
কারণটা সুপাত্র নিজেই। সে পাত্রীর রূপ, যৌবন, বিদ্যা-বুদ্ধি, বা ধন সম্পত্তি দেখে পছন্দ করে না। পাত্রীর আকৃতি প্রকৃতির ওপরও সুপাত্রের বিশেষ নজর নেই। ওর সকল নজর পাত্রীর কণ্ঠস্বরের ওপর। কণ্ঠস্বর শ্রুতি মধুর হলেই সুপাত্র তাকে নিজের সহধর্মিণী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি। পাত্রী দেখতে গিয়ে বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজি এই তিন ভাষাতে কথা বলিয়ে পাত্রীর কণ্ঠস্বরের পরীক্ষা করে সুপাত্র। আর সেই পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত কোনও মেয়েই উত্তীর্ণ পারেনি।
প্রতিটি রবিবার ও ছুটির দিনের সন্ধ্যেটা কোনও না কোনও কন্যা-দায়গ্রস্ত পিতার বাড়িতে তার মেয়ে দেখেই কাটায় সুপাত্র। এই রবিবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে যাত্রাপথের। সাধারণত নিজেদের চার চাকার যানবাহনে ভর করেই যাতায়াত করে সুপাত্র ও তার পরিবার। কিন্তু এ যাত্রায় সুপাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে রেলপথে পাত্রী দেখতে যাবে। তবে তার এই সিদ্ধান্তের পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গন্তব্য-স্থল রেলপথে গেলে বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করে ধীরে সুস্থে বেরোলেই চলবে। অন্যথা বেশ সকাল সকাল বের হতে হবে ওদের।
সুপাত্রদের বাড়ির কাছাকাছি রেল ষ্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। এ যাত্রায় সুপাত্রের সঙ্গী তার দুই বন্ধু সুজয় ও সুমন আর প্রায় সমবয়সী জাঠতুতো ভাই গৌরব। ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে আছে ওরা। মাইকে ট্রেনের ঘোষণা হল তিন ভাষায়। সবাইকে চুপ করিয়ে সুপাত্র সেই ঘোষণা শুনল মন দিয়ে। তারপর বলল, আমি আজ পাত্রী দেখতে যাবো না। আমার পছন্দের পাত্রী আমি পেয়ে গিয়েছি।
সুজয় - কি বলছিস তুই? কে সেই পাত্রী?
সুপাত্র- একটু আগে যেই মহিলা মাইকে ট্রেনের ঘোষণা করল সে। কি সুন্দর গলা। তিনটে ভাষাতেই বেশ দখল আছে ভদ্রমহিলার।
সুমন - আরে, ওটা রেকর্ডিং বাজানো হয়। কোনও মহিলা মাইকে ঘোষণা করে না।
সুপাত্র- কারো না কারো গলাই তো রেকর্ডিং করা আছে ওখানে। তোরা তাকে খুঁজে বার কর। আমি তাকেই বিয়ে করব।
গৌরব - সে যদি কারো গলা হয়েই থাকে, তার বয়সের কোনও ঠিক আছে। আমি ছোটবেলা থেকে এই অ্যানাউন্স শুনছি।
সুপাত্র- প্রেমের কোনও নির্দিষ্ট বয়স হয় না রে। যেকোনো বয়সের প্রেমেই যেকোনো বয়সের কেউ পড়তে পারে। প্রেম করা যায় না রে, প্রেম হয়ে যায়। তোরা ওকে খোঁজ। আমি বাড়ি চললাম।
ড্রাইভারকে ফোন করে বাড়ি ফিরল ওরা। সুপাত্রর বাবা সব শুনে বললেন, এতো দিনে ছেলের যখন কাউকে পছন্দ হয়েছে, তখন তার সাথেই আমি আমার ছেলের বিয়ে দেব। তোমরা যেখান থেকে হোক, পাত্রীকে খুঁজে বার কর।
হাই কমান্ড নির্দেশ। অমান্য করা যাবে না। অগত্যা খোঁজ চলল পাত্রীর। সুপাত্রের বন্ধুবান্ধবরা সবাই এ কাজে নেমে পরল। বিভিন্ন রেল স্টেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনও সদুত্তর মিলল না। বেশিরভাগ জায়গায় ওরা তেমন পাত্তাই পেল না। কেউ বা অতি আগ্রহে ওদের কথা শুনে সেটাকে হাসির উপাদান তৈরি করল। দিন সাতেকের মধ্যেই ছেলেগুলোর চোখে মুখে একটা ব্যর্থতার ছাপ ফুটে উঠল।
ক্লাব-ঘরে সবাই একত্র হয়ে যে যার ব্যর্থতার কথা বলছিল। সেই সময় সুজয় একটি ছেলেকে নিয়ে হাজির হল। ছেলেটি হরবোলা। মেয়েদের গলা নকল করে হুবহু ট্রেনের ঘোষণা করতে পারে। সুজয়ের অনুরোধে ছেলেটি কয়েকটি ঘোষণা শুনিয়ে সবাইকে অবাক করে দিল। গৌরব সব শুনে রেগে গিয়ে বলল, তুই কি খেপেছিস? কোনও ছেলের সাথে শেষে আমরা সুপাত্রের বিয়ে দেব?
ভালো কোনও মেক-আপ ম্যান দিয়ে মেক-আপ করিয়ে, শাড়ি গয়না পরালে এ যে নকল তা বোঝা যাবে না। বলল সুজয়।
বিয়ের আগে না বোঝা গেলেও বিয়ের পরে তো সুপাত্র সব বুঝতে পারবে। আমি সব জেনে শুনে ওকে ঠকাতে পারবো না। বেশ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বলল গৌরব।
আবার খোঁজ খবর শুরু হল। গৌরব একদিন অফিস থেকে পাবলিক বাসে ফিরছে। বাসটা ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে রাস্তার ধারে মঞ্চ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। একটি মেয়ে হরবোলা খুব সুন্দর ভাবে নানা রকম পশু পাখি, যানবাহন, প্রভৃতির আওয়াজ নকল করে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছে। জানালা দিয়ে গৌরব সেটা লক্ষ্য করে তৎক্ষণাৎ বাস থেকে নেমে গেল। মেয়েটির অনুষ্ঠান শেষ হলে তার সাথে দেখা করে ওর সাথে পরিচিত হল গৌরব।
মেয়েটির নাম সুকন্যা। কালোর ওপরে মুখশ্রী বেশ সুন্দর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ও। পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান করে সংসার চালায় সুকন্যা। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ ও ভাইয়ের পড়ার খরচও যোগাড় করতে হয় ওকে। একার হাতে আর পেড়ে উঠছে না ও। সব শুনে গৌরব বলল,
- আপনাদের আর্থিক অভাব কিছু থাকবে না। আপনার ভাইয়ের পড়াশোনা আর বাবার চিকিৎসার সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার বেশ ভালো জ
ায়গায় বিয়েও হবে।
- আমার বিয়ের কথা আমি ভাবি না। আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। আমার পরিবারের সবাই ভালো থাকলেই আমি খুশি।
- আপনার পরিবারের সবাই তো ভালো থাকবেই। একজন চকলেট ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে আপনিও ভালো থাকবেন।
- চকলেট ব্যবসায়ী! চকলেট আমার ভীষণ প্রিয়। যেখানেই অনুষ্ঠান করি, টাকা পয়সার সাথে চকলেট বা ক্যাডবেরি নেই আমি।
- আপনার শ্বশুর বাড়িতেই চকলেট তৈরি হবে। আপনি যত ইচ্ছে খান অসুবিধে নেই।
- কিন্তু হঠাৎ আমাকে এমনি এমনি এত সব আপনারা দিতে যাবেন কেন?
- এমনি এমনি নয়। বিনিময়ে আপনাকে শুধু রেল ষ্টেশনের অ্যানাউন্সমেন্ট হুবহু নকল করে শোনাতে হবে।
- সে আমি একটু ভালো করে শুনলেই তুলে নিতে পারবো।
- তাহলে তো কোনও সমস্যাই নাই। আপনি তৈরি হন। সাতদিন পর আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। আর তখনই আপনাকে কি করতে হবে, কি বলতে হবে, সব বলে দেবো।
সুকন্যার ফোন নম্বর নিয়ে ওর থেকে বিদায় নিলো গৌরব। বাড়ি গিয়ে কাউকে কিছু বলল না ও। সাতদিন পর সুকন্যার সাথে দেখা করল গৌরব। এই সাত দিনে রেলের সকল অ্যানাউন্সমেন্ট নিখুঁত ভাবে রপ্ত করেছে ও। সেসব শুনে গৌরব ভীষণ খুশি হল। সুকন্যাকে ওর করনীয় কাজ বুঝিয়ে বাড়ি চলে এলো।
বাড়ি গিয়ে গৌরব বলল, সম্প্রতি যে মেয়েটি রেলের অ্যানাউন্সমেন্ট করছে তার সাথে আলাপ হয়েছে। উনি ওনার ব্যস্ততার মধ্যেও আগামী রবিবার এই বাড়িতে আসতে রাজি হয়েছেন। বিনিময়ে ওনাকে চকলেট খাওয়াতে হবে।
কত চকলেট খাবেন উনি। এক পেটি দিয়ে দেব। বেশ উত্তেজনার সঙ্গে বলল সুপাত্র।
নির্দিষ্ট দিনে সুকন্যা সুপাত্রদের বাড়িতে এলো। গৌরবের এক সহকর্মী, সুকন্যার সহকারী সেজে ওর সাথে এলো। সহকারী ছেলেটি এসেই বলল,
গৌরবদার অনুরোধে ম্যাডাম এখানে এসেছেন, তবে ওনার হাতে বেশি সময় নেই। এখান থেকে বেরিয়ে ট্রেনের ভেতরের অ্যানাউন্সমেন্টের রেকর্ডিং করতে যেতে হবে। তাই যা যা শোনার ও জানার তা তাড়াতাড়ি শুনে ও জেনে নিন।
না, না বেশি সময় আমি নেব না। আমি শুধু ওনার কণ্ঠস্বর শুনেই ওনাকে ছেড়ে দেব। বেশ বিনয়ের সাথে বলল সুপাত্র।
সুপাত্রের অনুরোধে সুকন্যা বেশ কিছু লোকাল ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট করে শোনালো। হুবহু রেল স্টেশনের অ্যানাউন্সমেন্ট।
খুব সুন্দর কণ্ঠস্বর আপনার। শোনামাত্রই আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমার ভেবে ভালো লাগছে যে দেরিতে হলেও আমিও প্রেমে পড়লাম। সুকন্যাকে বলল সুপাত্র।
আপনার লেটে প্রেম, আর আমার চকলেটে প্রেম। আপনার আর আমার মধ্যে বেশ মিল, তাই না?
হ্যাঁ, আমি আপনার জন্য আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে স্পেশাল চকলেটটা আনিয়ে রেখেছি। এই নিন। সুকন্যার হাতে বাছাই করা চকলেটটাই তুলে দিল সুপাত্র।
হাতে পেয়েই প্যাকেট খুলে চকলেট খেতে শুরু করে সুকন্যা।
ঠিক আমি যেভাবে আপনার হাতে চকলেটের প্যাকেট তুলে দিলাম, সেভাবেই যদি আপনার বাবা আপনাকে আমার হাতে তুলে দিতেন, তবে কি ভালোই না হত।
সেসব আপনি আমার বাবা-মার সাথেই কথা বলবেন। সলজ্জে বলল সুকন্যা।
ব্যাস। মিয়া বিবি রাজি, তো কেয়া করেগা কাজি। দুই পরিবার কথা বলে সুকন্যা ও সুপাত্রের বিয়ে ঠিক করে ফেলল। সুকন্যার সম্পর্কে সুপাত্রকে যাই বলা হোক, সুপাত্রের বাড়ির সবাইকে সঠিক তথ্যই দিল গৌরব।
বিয়ের প্রস্তুতি চলল পুরো-দমে। সুকন্যা, সুপাত্রকে খুশি করতে রেলের সকল ঘোষণা অভ্যাস করতে থাকল। দুজনের বিয়েও হয়ে গেল ধুম-ধাম করে। বিয়েতে সুকন্যা তার শ্বশুর বাড়ির তরফ থেকে প্রচুর পরিমাণে চকলেট পেল। খুশিতে সুকন্যা আত্মহারা।
বৌভাতের দিন দুপুরে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান। সুকন্যার হাতে সুপাত্র ভাত কাপড় আর চকলেট তুলে দিল। এরপর পরিবারের সবাইকে ঘি-ভাত দেবে সুকন্যা। তাই সকলকে খেতে ডাকল ও। কিভাবে ডাকল? এইভাবে,-
অনুগ্রহ করে শুনবেন। পরিবারের সকলকে ঘি-ভাত খাওয়ার জন্য খেতে বসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। ধন্যবাদ। ক্রিপায়া ধ্যান দিজিয়ে,পরিয়ার কে সভী সদস্য-কো ঘি চাওল খানে কে লিয়ে বুলায়া যা-রাহা হ্যায়। অ্যাটেনশন প্লিজ, অল মেম্বার্স অব ফ্যামিলি আর রিকোয়েস্টেড টু কাম এন্ড হ্যাভ দা ঘি রাইস। থ্যাঙ্ক ইউ।
ঠিক যেন রেল স্টেশনে ঘোষণা হচ্ছে।
কয়েক ঘণ্টা পর সুকন্যা আবার ঘোষণা করল, অনুগ্রহ করে শুনবেন। অসুস্থতার কারণ বসত আমার বাবার এখানে আসা আজকের জন্য বাতিল করা হয়েছে। সকলের অসুবিধের জন্য আমরা দুঃখিত। ধন্যবাদ। বাংলায় ঘোষণার পর সুকন্যা চকলেট মুখে দেওয়ায় অন্যান্য ভাষার ঘোষণা আর শোনা গেল না।
ক্রমাগত অনুশীলনের ফলে সুকন্যা তার সব কথাই রেলের ঘোষণার মত করে বলছে। ফুলশয্যার রাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ঐ রাতে সুপাত্রকে সুকন্যা ঠিক কি বলেছিল, তা জানা যায়নি। সুপাত্রকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করলে ও বলেছে, সেটা বলা যাবে না। তা একান্তই ব্যক্তিগত। শুনে বন্ধুদের প্রশ্ন, সেটা চকলেট-গত নয় তো?
সহধর্মিণীর ঘোষণা শুনতে শুনতেই সুপাত্রের বিবাহিত জীবন তার সুস্বাদু চকলেটের স্থায়ী অংশীদার সুকন্যার সাথে অতিবাহিত হতে থাকল। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসের কোনও একটি নির্দিষ্ট দিনই নয়, প্রতিটি দিনই এখন সুকন্যার জীবনে চকলেট ডে। ওদের বিবাহিত জীবনের স্বাদেও চকলেটের মত তেতো ও মিষ্টির মিশ্রন রইল। এই স্বাদ শুধু চকলেটের নয়, প্রকৃত প্রেমেরও।