JAYDIP CHAKRABORTY

Romance

3  

JAYDIP CHAKRABORTY

Romance

অবশেষে প্রেম

অবশেষে প্রেম

7 mins
809


মুখশ্রী যতটা চিত্তাকর্ষক হলে যেকোনো মানুষের পক্ষেই একবার নজরে এলে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না, শারীরিক গঠন যেমনটি হলে অনেক পুরুষের স্বপ্নে অবাধ বিচরণ করা যায়, নমৃতা ঘোষ ঠিক তেমনটাই। কথাবার্তাও খুব নম্র ও পরিমিত। তবে প্রয়োজনে উচিৎ কথা বলতে কখনও দ্বিধা বোধ করে না। পড়াশোনাতেও নমৃতা প্রথম সারিতে। কৃতিত্বের সাথে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে, ফ্যাশন ডিজাইন পাশ করে আপাতত চাকরীর সন্ধানে রয়েছে ও। আর ওর পরিবারের লোকজনেরা রয়েছে ওর উপযুক্ত সুপাত্রের সন্ধানে। আর এমন রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী মেয়ের পাত্র সন্ধান যে সহজ কাজ নয় তা বলা বাহুল্য।

নমৃতা এখনই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি নয়। এর কারণ দুটো। এক, ও আগে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে চায়। দুই, নিজের পছন্দ মত ছেলের সন্ধান নমৃতা এখনও পায়নি। তাছাড়া একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওর ওপর ছেলেরা এমন ভাবে হামলে পড়েছে, যে ছেলেদের প্রতি ওর আকর্ষণটাই চলে গেছে। কোনও কিছু অতিরিক্ত পেলে সেটার ওপর সবার যেমনটা হয়। 

নমৃতার পরিবার বলতে ওর বাবা, মা আর ঠাম্মা। বাবা মার চেয়ে ঠাম্মার সাথেই নমৃতার বন্ধুত্ব বেশী। নাতনি বাড়িতে থাকলে নাতনির সাথে, আর না থাকলে স্মার্ট ফোন ও স্মার্ট টিভির সাথে সময় কাটায় এই বৃদ্ধা। স্মার্ট নাতনি, স্মার্ট ফোন ও টিভির কল্যাণে এই প্রাচীনপন্থী বয়স্কা ভদ্রমহিলাটিও স্মার্ট ও সমকালীন হয়ে উঠেছে।

- দিদিভাই, এবারে একটা বিয়ে কর। আমি নাত জামাইয়ের মুখ দেখে স্বর্গে যাই।

- আগে চাকরি পাই, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। তাছাড়া তেমন ছেলে তো চোখেই পড়ছে না। 

- আমার বালা জোড়া রেখেছি, তোমাকে আশীর্বাদ করার জন্যে। সেটা আর দিয়ে যেতে পারবো না মনে হয়।

- কেন, সামনেই তো আমার জন্মদিন আসছে। তখন ওটা দিয়ে আশীর্বাদ কর।

- না, জন্মদিনে আংটি দেবো। দিদিভাই এই তামার আংটিটা তোমার ঠিক হয় কিনা দেখ তো। 

- হ্যাঁ ঠিকই আছে। এই মাপেই বানিও।

দোলের দিন সকালে নমৃতাদের বাড়িতে একটা ছেলে এসে নমৃতার আংটিটা দিয়ে গেল। তখনো রঙ খেলা তেমন ভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু ছেলেটির সারা মুখ নানা রকম রঙ ও আবীরে ভর্তি। তবে তার গায়ে মুখে যতই রঙ থাকুক না কেন আংটির বাক্সটা এমন প্যাক করে এনেছে যে তাতে একটুও রঙ লাগেনি। আংটিটা নমৃতার বেশ পছন্দ হল। দুদিন পরেই ওর জন্মদিন। ঐদিনই আংটিটা পাবে ও।

জন্মদিন চলে এলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নমৃতা একটা অচেনা নম্বর থেকে হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ পেলো। 

“শুভ জন্মদিনের নিও শুভেচ্ছা। পূর্ণ হোক মনের সকল ইচ্ছা।”  

মেসেজটা কার পাঠানো তা কোনও ভাবেই অনুমান করতে পারল না ও। সেই নম্বরে ফোন করলেও ওই ব্যক্তির সন্ধান পেল না। “নম্বরটি উপলব্ধ নয়” বার্তা ওকে হতাশ করল। ঐ নম্বরে হোয়াটস-অ্যাপ করে ঐ ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইল নমৃতা। কিন্তু তার কোনও উত্তর মিলল না। সারাটা দিন বেশ ভালো ভাবে কাটলেও মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই গেল ওর। 

এর কয়েকদিন পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে নমৃতা। এমন সময় ঐ অজানা নম্বর থেকে আবার একটা হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ এলো।

“সময় নিলে সময় পাবে, অসময়ও সময় দেবে।” মেসেজটা নমৃতাকে বেশ অবাক করল। ও কিছু ভেবে ওঠার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। বাবা ফোন করেছে।

- কিরে তুই কোথায়? 

- জানোই তো ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। কেন?

- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। দরকার আছে।  

- এখনও অনেক ক্যান্ডিডেট আছে। দেরী হবে। 

অল্প কথায় ফোন রাখল নমৃতা। তারপর কি একটা ভেবে একটু দেরী করেই বাড়ি ফিরল ও। বাড়ি ফিরে বাবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলার কারণটা জানতে পারে নমৃতা। বাবার এক বন্ধু সস্ত্রীক ওদের বাড়ি এসেছিলেন। ওনাদের ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত। মেয়ের সঙ্গে ওনাদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নমৃতাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলেছিলেন উনি। কারণটা জানার পর নমৃতা ভাবল ভাগ্যিস ও তাড়াতাড়ি ফেরেনি।      

বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরীর সন্ধান পেল না নমৃতা। কয়েকদিন পরে ওই নম্বরটি থেকে আবার একটা মেসেজ এলো।

চাই যেটা তোমার, তার সাক্ষাৎকার, আগামী বুধবার। প্রস্তুতি দরকার। পোষাকেও প্রস্তুতি, নিলে উত্তম অতি। চাও যদি ডিটেল, চেক কর ইমেল।

মেসেজটা দুবার পড়েই এটা যে ইন্টারভিউর খবর, তা নমৃতা আন্দাজ করতে পাড়ল। মেল চেক করে ইন্টারভিউর বিস্তারিত খবর জেনে নিজের অনুমানকে মান দিল। আর উপদেশটাও বেশ মনে ধরেছে নমৃতার। সত্যিই তো, ফ্যাশন ডিজাইনারের ইন্টারভিউতে যদি নিজের পোশাকে নিজের বিদ্যার পরিচয় দেওয়া যায়, তাহলে মন্দ হয় না।  

দুদিন ধরে ভেবে, নিজের পোশাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোলাজ করে একটা ফিউশন তৈরি করল নমৃতা। তারপর মাকে দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ একটা ছবি তুলিয়ে, তা ঐ নম্বরে পাঠিয়ে দিল। আর নিচে লিখল, চলবে?

একটু রাত করে তার উত্তর এলো। 

লাগছে তোমায় ভীষণ ভালো।

কানের দুলটা খুলে ফেল।

কানে পর গোল্ড রিং,

বুধবার তোমার দিন। 

এই অজানা শুভাকাঙ্ক্ষীর উপদেশ অনুযায়ী সেজে ইন্টারভিউ দিতে গেল নমৃতা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ইন্টারভিউ হল ওর। নমৃতার পোশাকের প্রশংসাও করলেন ইন্টারভিউয়াররা। তবে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটা পাবে কিনা তা কোনও ভাবেই বুঝতে পারল না নমৃতা। কিন্তু তারপরের দিনই সেই অজানা নম্বর থেকে চাকরি পাওয়ার জন্য অভিনন্দন মেসেজ এলো। নমৃতা ঐ মেসেজের উত্তরে শুধু ধন্যবাদ জানাল।

কয়েকদিন পরে ঐ মেসেজের সত্যতা প্রমাণ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে এলো। নমৃতার বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাই ও ভীষণ আনন্দিত হল। ঐ নম্বরে ও অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে, এই অজানা মানুষটির পরিচয় জানার জন্যে আকুতি করল। কিন্তু অপর পক্ষের সারা মিলল না।

এরপর প্রতিদিন ঐ নম্বর থেকে গুড মর্নিং মেসেজ, কুশল সংবাদ বিনিময়, এবং নানা রকম পরামর্শ, ও উপদেশ আসতে লাগল। নমৃতা এই পরামর্শ, ও উপদেশে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। 

- দেখুন আপনার সাথে রোজ হোয়াটস-অ্যাপে কথা হয়, কিন্তু আপনার নামটাই জানা হয়নি।

- আমার নাম? বলছি। “একারের আকার বদলে ঈকার যখন হবে। অনেক, কিছু বদলে আমার নামটা তুমি পাবে।” কি বোঝা গেল?

- না, তবে আমি একটু ভেবে দেখি। 

রাতে শুয়ে অচেনা লোকটির হেঁয়ালি নিয়ে ভাবতে লাগল নমৃতা। অনেকের পরে কমা কেন? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মনে হল অনেকের ন-এর একার বদলে ঈকার দিলে তো অনীক হয়। তবে কি ছেলেটির নাম অনীক। সঙ্গে সঙ্গে ঐ অজানা নম্বরে হোয়াটস-অ্যাপ করল নমৃতা। 

- আপনার নাম কি অনীক?

- ধরে ফেলেছেন তাহলে? হ্যাঁ, আমার নাম অনীক বোস।

- আচ্ছা, আপনি এমন লুকোচুরি খেলছেন কেন? আপনি চান কি বলুন তো?

- সব চাওয়া কি বলা যায়? 

- বললে পড়ে সেই চাওয়াটা তো পূর্ণও হতে পারে। 

- অভয় দিচ্ছেন? অফার লেটারটা পাঠাবো তাহলে?

- পাঠিয়ে লাভ না হলেও, লোকসান কিছু হবে না আশাকরি।

- পরদিন পরদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরা মাত্রই হোয়াটস-অ্যাপে একটা বড়সড় কাব্যিক প্রেমপত্র পেল নম্রিতা। 

তুই আমায় চিমটি দিবি, যদি দুষ্টু কথা কই,

তোর চোখে এই ছেলেটা, রবে অসভ্যই।

তোর কাছে ক্যাবলা হব, এখন যতই স্মার্ট।

তোর নাম হবে আমার ইমেল পাসওয়ার্ড।

তুই এসে বদলে দিবি আমার লাইকিং,

তোর জন্য বাড়বে গতি, মোবাইল টাইপিং।

মোবাইলের মেমরি ফুল তোর সেলফিতে,

তোর অ্যাডভাইস থাকবে লেগে গোঁফ, ঝুলফিতে।

তোর কথা, তোর ছোঁয়া করব রোমন্থন।

তুই শুধু একটিবার দে না আমায় মন।

নম্রিতা বহু ছেলের বহু রকম লাভ প্রপোজাল পেয়েছে। কেউ ফোনে, কেউ সামনা সামনি, কেউ চিঠি বা ইমেল লিখে প্রপোজ করেছে ওকে। কিন্তু এই রকম অভিনব ভাষায় প্রেম নিবেদন ওকে কেউ কখনো করেনি। এরকম প্রপোজালকে নাকচ করাও যায় না, আবার প্রপোজাল গ্রহণ করতেও দোটানায় পরতে হয়। অনেক ভেবে একটু রাতের দিকে অনীককে ফোন করল নম্রিতা।  

- আচ্ছা, কেউ যদি চাকরীর অ্যাপলিকেশনের সাথে তার বায়োডাটাটা না দেয়, তাহলে কি তার চাকরি হওয়া সম্ভব? আপনি আপনার প্রেমের প্রস্তাবনার সাথে নিজের সম্পর্কে তো কিছুই লেখেননি। আপনি কি করেন, কোথায় থাকেন, কিছুই তো জানি না। আপনার আকৃতি প্রকৃতি না জেনে আপনার প্রস্তাবে রাজি হই কি করে বলুন তো?

- আগে প্রকৃতি মানে পরিচয়টা দেই। ওটা পছন্দ হলে আকৃতিও দেখানো যাবে। আমি অনীক বোস। জুয়েলারির ব্যবসা করি। আমাদের তিনটে জুয়েলারির দোকান আছে। আপনার হাতের আংটিটা আমার নিজের ডিজাইন করা। আর আমি নিজেই ওটা দিতে সেদিন আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই মুখে রঙ মেখে গিয়েছিলাম, যাতে কেউ চিনতে না পারে। প্রকৃতি পছন্দ হল?

- ভেবে দেখছি। তবে ঘোষে বোসে কি বিয়ে হয়?

- পাত্র, পাত্রী রাজি থাকলে ঘোষে বোসে কেন, বোসে বোসে, এমন কি ঘষে ঘষেও বিয়ে হয়। 

- ওকে, প্রকৃতি দেখানোর ব্যবস্থা করুন। সামনা সামনি মতামত দেব।

- সামনের চোদ্দ তারিখ করুন না। ভ্যালেন্টাইন ডে। দিনটা বেশ ভালো।

- হু, বুঝলাম। ঠিক আছে। ঐ দিনই দেখা করব তাহলে। ভেনুটা হোয়াটস-অ্যাপে জানিয়ে দেবো।  

পরদিন সকালে নমৃতাকে ওর ঠাম্মা ডেকে বলল,

- কি দিদিভাই, অবশেষে প্রেমে পড়লে তাহলে?

- ভাবছি।  

- আর ভাবনা চিন্তা না করে লেগে পড়। ছেলেটি খুবই ভাল।

- তুমি ছেলেটিকে চেনো নাকি?

- চিনি মানে? তোমার সব খবর তো আমিই ওকে দিতাম।

- ও, এসব তবে তোমার চক্রান্ত?

- কি করব? তুমি যখন একা কিছুই করে উঠতে পারছিলে না, তখন তো সাহায্য করতেই হয়।

মনের মধ্যে যেটুকু দ্বিধা ছিল, ঠাম্মার কথা শুনে সবটাই কেটে গেল। দুই পরিবারের মধ্যে কথা-বার্তা মোটামুটি হয়েই ছিল। নম্রিতার সম্মতি পেয়ে বিয়ের তোরজোড় শুরু করল দুই পরিবার। নম্রিতা ও অনীক হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট ও ভিডিও কল করে দুজন দুজনার সাথে দু-তিন দিনের মধ্যেই বেশ পরিচিত হয়ে গেল। অবশেষে ভ্যালেন্টাইন ডে তে মিট করল ওরা। 

- নমৃতা, তোমার পছন্দের রঙ কি? সেইমত আমার বাড়ির লোক তোমার শাড়ি কিনবে। 

- নীল। আমার ব্লু ভীষণ পছন্দের রঙ। 

- তুমি কি শাড়ি, চুড়িদার, বেডকভার, ফিল্ম, পর্দার কাপড় সবকিছুই ব্লু পছন্দ কর?

- ফিল্ম? (একটা চিমটি কাটল নমৃতা।)

- আঃ, চিমটি কাটছ কেন? 

- তোমার প্রপোজাল কন্ডিশনে তো সেটাই ছিল। দেখি তোমার মোবাইলটা দেখি। (অনীকের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো নমৃতা।)তোমার মোবাইলে তো আমার ছবিই নেই বললেই চলে। এমনটা তো কথা ছিল না। তোমার ইমেলের পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছ?

অনীক নমৃতার কথার উত্তর না দিয়ে কি যেন ভেবে চলেছে। নমৃতা অনীকের কাঁধ ধরে ঝাঁকায়। কি হল? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে?

- তোমার কথা ও স্পর্শ রোমন্থন করছি।

- অসভ্যের একশেষ। 

দুজনেই হেসে ওঠে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance