দিনটা ভালোবাসার
দিনটা ভালোবাসার
মিতা একটা কিছু বলবে বলে ঘরে ঢুকেই চিনুকে ফাইলের মধ্যে ডুবে থাকতে দেখে যেন জ্বলে উঠলো,
"তুমি আজকের দিনেও শুধু ফাইল মুখো হয়ে থাকবে? আমার জন্য কি তোমার কাছে একটুও সময় নেই? "
এত কিছু বলেও যখন দেখল চিনু শুধু একবার হু বলে আবার ফাইল এ মন দিয়েছে, এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, সোজা ফাইলটা হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে দিল , কিন্তু আশ্চর্য তাতেও চিনু বেশ ঠাণ্ডা মেজাজে ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ টা বার করে পড়তে আরম্ভ করলো। এই নিয়ে চিনু আর মিতার ঝামেলা লেগেই থাকে তবে আজ মিতা একটু ভালোবেসে কিছু বলতে এসেছিল কিন্তু চিনুর ব্যবহারে এখন তার মাথায় আগুন জ্বলে গেল
"কি গো তুমি জানো আজ কিসের দিন?"
চিনু খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিল
"কি আবার, হয় তোমার জন্মদিন যেটা বছরে 24 বার হয়ে থাকে, আর নয় তো আমাদের বিবাহবার্ষিকী, সেটাও তো বার দুই তিন বছরে বানাও তুমি তবে পল্টুর জন্মদিন নয় কারণ ওটা ছয় এপ্রিল সেটা আমার মনে আছে"
"আচ্ছা ছেলের জন্মদিন টা শুধু মনে রেখেছো বাকি আর কিছু মনে রাখার কোনো দরকার নেই তাই তো?"
এবারও চিনু চুপ। আসলে মিতা রেগে গেলে যা বলে চিনুর কানে কোনটাই ঠিক যায় না, মানে ও মিতার কথাগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। বছর বারো বিয়ের বয়স । সামনের বছর ওদের ছেলে পল্টু সাতে পড়বে। এখনও একান্নবর্তী পরিবার ওদের। বাবা মা আর জ্যাঠা জ্যাঠাইমা আর তাদের পরিবার, সব এক হাঁড়িতেই এখনও অবধি। অনেকে তো বলেই ফেলে
"তোদের মত পরিবার আর খুব একটা দেখা যায় না, সত্যি আর কিছুদিন পরে মিউজিয়ামে হয়ত জয়েন্ট ফ্যামিলি দেখতে যাবে মানুষ। হয়তো তাই যেভাবে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হতে আরম্ভ হয়েছে তাতে পরের প্রজন্ম শুধু ছবি বা বড়দের কাছে গল্পটাই শুনবে। মিতার গলা আরো জোর হলো
"তুমি তো তোমার অফিস আর টিভি তে খেলা ছাড়া আর কোনো খোঁজ রাখো না তাই আজ কি দিন বলতে পারছ না"
"আমি না জিজ্ঞেস করলেও যে তুমি ওটা জানিয়েই ছাড়বে সেটা আমি ভালো করেই জানি?"
চিনুর এই কথাটা মিতার রাগটাকে হু হু করে বাড়িয়ে দিল। পাশে রাখা মোবাইল টা তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। চিনু ভালো করেই জানে এবার মিতা মাকে ফোন করে বলবে
"মা আমি আজ তোমার কাছে থাকবো,
পল্টু স্কুল থেকে ফিরলে যাচ্ছি, তুমি রান্না করে রেখো, আর নয় অনেক হয়েছে, এবার আর ফিরবো না দেখে নিও"
মা মেয়ের এই আচরণের সাথে খুবই পরিচিত কারণ বছরে বার পাঁচেক তো এই ঘটনা ঘটেই। তবে মুখে শুধু আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেবে। পরে চীনুকে ফোন করে সব জানিয়ে তবেই ওনার শান্তি।
মিতা রাগে গরগর করতে করতে এবার শাশুড়ির ঘরে গিয়ে ঢোকে, ইন্দু তখন সবে স্নান সেরে পুজোর জন্য ধুপ জ্বালতে যাচ্ছিল, মিতাকে দেখেই বলে উঠলো
"কি রে এখনও তৈরি হোস নি, পল্টুর তো ছুটির সময় হয়ে এলো"
"হ্যা যাবো তবে এবারে আর ফিরবো না, তোমার ছেলে আমার বাঁচা দুর্দয় করে দিয়েছে, আমি পল্টুকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকবো"
ইন্দু বোঝে আবার স্বামী স্ত্রী তে ঝগড়া হয়েছে, এটা তারই প্রতিফলন। মুখে শুধু বললো
"তুই যদি কয়েকদিন থাকিস তো থাক কিন্তু পল্টুর স্যার তো পড়াতে এসে ঘুরে যাবে, সেটা কি ঠিক হবে, তোদের ঝগড়ার মাঝে ওর পড়াশুনা নষ্ট হতে দিস না"
কথাটা ঠিক, পল্টুর এক নতুন অঙ্কের স্যার কে অনেক কষ্ট করে রাজি করানো গেছে পল্টুকে একা পড়ানোর জন্য, উনি তো রাজি ই হচ্ছিলেন না। কোচিনে পাঠাতে বলছিলেন কিন্তু চিনু অনেক চেষ্টা করে ওনাকে রাজি করেছে তাই পল্টু কে এখানেই হয় তো থাকতে হবে। মিতা র চিন্তা গ্রস্ত মুখটা দেখে ইন্দু এবার বললেন
"শোন তুই পল্টু স্কুল থেকে ফেরার পর কুসুমকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাস, পরে তুই যদি না আসতে চাস তাহলে কুসুমি পোল্টুকে নিয়ে বাড়ি চলে আসবে"
শাশুড়ির এই কথাটা মিতার বেশ মনে ধরল। কুসুম ওর ননদ । জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেনা। চিনুর থেকে প্রায় বছর পাঁচেক এর ছোট। ভগবান ওকে রূপ দিতে কার্পণ্য করেননি কিন্তু মুখে কথাটাই দিতে ভুলে গেছেন। এত সুন্দর মেয়ে কিন্তু কথা বলতে পারে না । তাও পড়াশোনার কোনো খামতি রাখিনি পরিবার । বোবাদের স্কুল থেকে পাশ করে এখন বাড়িতেই কম্পিউটার শেখে। আসলে চিনু সব সময় বোনকে কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখতে চায়। আর এখন খুব দুরন্ত পল্টুর একমাত্র বন্ধু ওর কুসুম পিসি। একমাত্র কুসুমের কথাতেই পল্টু পড়তে বসে, আর শত বার অনুরোধ করলেও ওকে দিয়ে কোন
কাজ কেউ করাতে পারে না। এত সুন্দর বলে কুসুমের অনেক সম্বন্ধ এসেছিল কিন্তু চিনু চায় না বিয়ের পর কথা বলতে পারে না বলে কোন প্রবলেম হয় তাই ওরা রাজি হয়নি। মিতাও কতবার বুঝিয়েছিল যে বোবা মেয়েদের কি বিয়ে হয় না কিন্তু ইন্দু আর চিনু রাজি নয়।
সেদিন কুসুম আর পল্টু কে নিয়ে মিতা বাপের বাড়ি চলে গেল, যাবার সময় খুব চেঁচিয়ে বলে যেতে ভুললো না যে সে প্রাণ থাকতে আর এই বাড়িতে ফিরবে না। ইন্দু মিতার সামনে না হলেও ওর জায়ের দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো মুখটা ঘুরিয়ে কারণ ওরা জানে মিতা এই বাড়ি ছাড়া একটা দিনও বাপের বাড়িতে থাকতে পারবে না। ইন্দু আর ওর জা মানে চিনুর জ্যাঠাইমা মিতাকে বউ নয় , মেয়ের মতই ভালোবাসে। অবশ্য মিতাও কম করে না। তাই ওরা জানে মিতা শুধুমাত্র কয়েক্ ঘন্টা থেকেই আবার শ্বশুরবাড়ি মুখো ই হবে। চিনু মিতার ভাবগতিক দেখে আজ ঘন্টা খানেক আগেই অফিস বেরিয়ে গেছে। শান্তি প্রিয় চিনময় খুব একটা চেঁচামেচি পছন্দ করে না। সকালে বউকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে আর বাড়িতে থাকতে ওর সাহস হয়নি। ফোন করে অফিস থেকে বারকয়েক জেনে নিয়েছে বউ ফিরল কিনা। তবে সন্ধ্যেবেলা ফিরেও যখন দেখল পল্টু আর কুসুম ফিরেছে কিন্তু মিতা ফেরেনি তখন মনটা একটু খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে না দিয়ে ঘরে টিভি টা খুলে সোফায় বসে থাকে। তবে ওর মন কিন্তু বার বার বলছিল যে মিতা একটু পরেই ঠিক ফিরে আসবে। মোবাইলটা তুলে ও আবার নামিয়ে রাখে কারণ এখন মিতাকে ফোন করতে গেলে ওকে অনেক কথা শুনতে হবে। মোবাইলটা বেজে উঠতেই দেখে ওর শাশুড়ির ফোন
"হ্যাঁ বলুন মা"
"মিতা ঠিক পৌঁছে গেছে তো চিনু?
চিনু র কপালে ভাঁজ পড়ল
"না তো কখন বেরিয়েছে ও?"
"সেকি গো ও তো পল্টু রা যাবার আধঘণ্টা পরেই বেরিয়ে গেছে বলল আজকের দিনটা আমি চিনু আর পল্টু কে ছেড়ে থাকবো না পরে তোমার কাছে আবার আসব"
"আচ্ছা আমি দেখছি আর দেখা হলেই আপনাকে জানাচ্ছি"
"হ্যাঁ জানিও কিন্তু"
চিনু খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। ইন্দুদের জানাতে ওরাও খুব টেনশন করতে লাগলো কিন্তু মিতার মোবাইলটা সুইচড অফ পেয়ে আরো চিন্তা বাড়লো। কুসুম ইশারায় নানান রকম অঙ্গিভঙ্গি করে বোঝাতে লাগলো পাড়ায় গিয়ে খোঁজ নেওয়া দরকার। চিনু ভাবল এটাই ঠিক আগে রাস্তায় গিয়ে দেখতে হবে কোন বিপদ হলো কিনা। তারপর যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া যাবে।
"এখনই থানায় যাওয়াটা ঠিক হবে না চিনু"
চিনুর বাবা মনি বাবু বলেই ধপাস করে খাটে বসে পড়লেন। সবার মনের অবস্থা চিনু টের পাচ্ছিল কিন্তু মিতা এত বার বাপের বাড়ী গেছে কোন বার দু ঘন্টার বেশি থাকে নি তাহলে এবারে কি সত্যিই কোনো বিপদ ঘটল? আর ফোনটাই বা সুইচ অফ হবে কেন? এমন নানা প্রশ্ন চিনুর মনে ভীর করতে আরম্ভ করলো।
এবারে ফেব্রুয়ারি মাসেও শীতটা যাই যাই করেও যায় নি। ফেব্রুয়ারির 14 তারিখ মানে প্রায় মাঝামাঝি তাতেও রাত দশটার সময় বাইরে বেরোতে বেশ ঠান্ডা লাগছে। চিনু আলমারি থেকে চাদরটা বের করে গায়ে দিয়ে সদর দরজা কাছে যাওয়ার আগেই দেখল মিতা আসছে। ওর প্রাণটা যেন ঠাণ্ডা হল। কিন্তু দেখা মাত্রই আবার সেই সকালের কথা মনে পড়ে গেল। ওর এখনো মিতার থেকে অনেক মুখ শোনা পেন্ডিং।
সবাই মিতাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও চিনুর বুকটা বড়ই ধরফর করতে লাগলো। ও তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিল তার জন্য ভ্যালেন্টাইন্স ডের গিফট কিনতে যেটা সকালে মিতা বার বার মনে করাতে চেষ্টা করছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই চিনু সেটা বুঝছিলো না। এবার আর না করার কোন উপায় নেই।
মিতা সোজা ঘরে ঢুকেই চিনু কে কিছু বলতে যাবে এমন সময় চিনু ঘুরে বলে উঠলো
"সরি মিতা আজ আমি তোমার গিফট কিনতে ভুলে গেছি ওটা কাল দিয়ে দেব"
"তোমার গিফট এর জন্য আমি এত রাতে বাপের বাড়ি থেকে এলাম? শোনো তোমার যে আজকের দিনটা মনে আছে এটাই আমার কাছে যথেষ্ট, যেটা তুমি সকালে ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইছিলে না, আর গিফট তো তুমি প্রতিবারই আমাকে দাও এবার না হয় আমি তোমাকে গিফট দিলাম"
ক্লাসের জলটা খেতে গিয়ে প্রায় বিষম লেগে যাচ্ছিল চিনুর , মিতার কথাটা শুনে। কি করে এত পাল্টে গেল এই কয়েক ঘন্টায়?
এবার মিতা ওর ব্যাগ থেকে একটা ঘড়ি বার করে চিনুর হাতে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল
"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড"
চিনু খুব জোরে বুকের মধ্যে মিতাকে চেপে ধরে বললো
"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে মাই সুইট ওয়াইফ"