ধর্ম
ধর্ম


আজ লেখালেখি বন্ধ। ভাল লাগছে না। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বেশ মনোরম পরিবেশ। ফুরফুরে হাওয়া বইছে।
তবু কিছুতেই যেন মনের জট খুলতে চাইছে না।
পুকুরের পাড় দিয়ে হাঁটছি।
হঠাত লক্ষ্য করলাম। সূর্যদেব আমাকে হাত নেড়ে বলছেন,হ্যালো। কেমন আছো ভাই?..আজকাল লেখালেখি কেমন চলছে?
আমার মন বিচলিত। সেটা উনি বুঝেও ফেলেছেন। তাই দেরী না করে বলেই ফেললাম,আচ্ছা সূর্যদেব আপনার ধর্ম কী?
সূর্যদেব প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলেন।তারপর সহজভাবে বলে উঠলেন,আমার ধর্ম আলো দেওয়া। এই বিশ্ব চরাচরকে আলোকিত করা। অন্ধকারের অবসান ঘটানো।
উত্তর পেয়ে উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
দেখছি পুকুরের জলটা ছন্দ তুলে নাচানাচি করছে। কাছে আসার ইশারা পেয়ে, সামনে এগিয়ে গেলাম।
কাছে পৌছতেই ছলাৎ করে এক আঁজলা জল আমার মুখে দিয়ে বলে উঠলেন, আজকাল জেগে,জেগে স্বপ্ন দেখছ নাকি?... না নতুন কোন গল্পের প্লট ভাবছ?
আমি সহজভাবে বলে উঠলাম,মোটেও না। আচ্ছা জলরাণী আপনার ধর্ম কি?
জলরাণী নাচ থামিয়ে থির হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বলে উঠলেন,তৃষ্ণা মেটানো। বিশ্বের সমস্ত জীবের পিপাশা মিটিয়ে, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখাই আমার একমাত্র ধর্ম।
উত্তর পেয়ে আমি গটগট পায়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম।
হঠাৎ দেখি, একটা গাছ তার পাতাঘন সবুজ হাত দিয়ে আমার মাথাটা নেড়ে দিলেন। ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, আরে...আরে এত তাড়া কীসের লেখকভাই?
গিন্নী বকেছে নাকি?
আমি সব কটা দাঁত একসাথে বের করে বললাম, সে তো রোজকার জিনিস। কিন্তু আজ আমি একটা ধাঁধার উত্তর খুঁজতে বেরিয়েছি। কথাটা শেষ করে সেই একই প্রশ্ন তাকেও করলাম, আচ্ছা গাছসাহেব আপনার ধর্ম কী?
গাছসাহেব গলাটা ঠিক করে বলে উঠলেন,বাতাস দেওয়া। এই পৃথিবীর যত কার্বন ডাই অক্সাইড উড়ে বেড়াচ্ছে।তা গ্রহণ করে সমস্ত জীবকুলকে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দান করি। আর এটাই আমার একমাত্র ধর্ম।
উত্তর পেয়ে পুনরায় চলতে শুরু করলাম।
অল্প এগিয়ে দেখলাম। মাঠের পাঁকা ধান আমায় ডাক দিচ্ছে। পা চালিয়ে তার কাছে গেলাম।
ধান মা আমার পরিশ্রান্ত মুখখানা দেখে বলে উঠলেন,কেন বাছা!...আজ এমনভাবে মুখ লটকে চলেছো কেন?...লেখা থেকে ছুটি নিয়েছ নাকি?
আমি মনের যাবতীয় বিষন্নতা ঢেকে বলে উঠলাম,না...না। সেরকম কিছু না। এই একটু সার্ভে করতে বেরিয়েছি আর কি।অনেকদিন ধরে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে অনবরত শাবল চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আজ আর বসে থাকতে পারলাম না।আচ্ছা ধান মা, আপনার ধর্ম কি?একটু বলবেন?
ধান মা শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ক্ষুধা নিবারণ করা। এই জীবকুলকে অন্ন জুগিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখাই আমার একমাত্র ধর্ম।
উত্তরট শুনে সেখান থেকেও বেরিয়ে পড়লাম।
কিছূদূর এগিয়ে যেতেই এক জায়গায় হোঁচট খেলাম। পড়তে,পড়তে বড় জোর বাঁচলাম।
তাই দেখে মাটিবাবু হায়..হায় করে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,লাগেনি তো ভাই?...বড় আনমোনা হয়ে চলো আজকাল!.তাই বলি।.. লেখার জগত ছেড়ে মাঝে,মাঝে আমার বুকে হাঁটাহাঁটি করো। দেখবে উঁচু,নিচু,নরম,শক্তের সম্বন্ধে ভাল অভিজ্ঞতা হবে। সে যাই হোক। বলো লেখকভাই শরীর কেমন?
আমি নিজেকে ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছি। তাই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলাম, একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন মাটিবাবু?
কথাটা শুনে উনি মুখ চেপে অল্পমত হাসলেন।
আমি সেসবে কান না দিয়ে বলে উঠলাম, আচ্ছা আপনার ধর্ম কি?
দেখলাম উনার হাসি ক্রমশ চওড়া হচ্ছে।
এবার আমি বিব্রতবোধ করলাম।মনে,মনে অল্প রাগও হল। ভাবলাম চলে যাব। তাই পা বাড়ালাম। এমন সময় উনি আমার দিকে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, তার আগে বলো তো...তোমার ধর্ম কী?
আমি উত্তর দিতে গিয়ে বেমক্কা থমকে গেলাম। সত্যিই তো! আমার ধর্ম কি? আমতা, আমতা সুরে বলে উঠলাম,কে..কেনো? হিন্দু।
মাটিবাবু উত্তর শুনে হাসতে গিয়ে চেপে গেলেন। তারপর বলে উঠলেন, পৃথিবীর সব মানুষকুলের কী ওই একটাই ধর্ম?
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম।
সত্যিই তো। খাঁটি কথা। দুনিয়াতে একমাত্র মানুষের ধর্ম ভিন্ন,ভিন্ন।পৃথিবীটাকে দম্ভের নামে ভাগ করে মানুষ আলাদা,আলাদা দেশ,সীমানা তৈরি করে ফেলেছে। ধর্ম আর জাতির তার দিয়ে।
অথচ প্রকৃতির মধ্যে প্রত্যেক বস্তুর একটা নির্দিষ্ট ধর্ম আছে।
যার উপর নির্ভর করে আমরা মানুষেরা ভিন্ন রকম ধর্মের বড়ায় করি।
মাটিবাবুর প্রশ্নবাণে আমি আহত হয়ে ফিরে এলাম লেখার টেবিলে।
টেবিলের উপর চায়ের কাপ নামানোর শব্দ পেলাম।
চোখ মেলে দেখি, মন্দা উল্টো পায়ে রান্না ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
দেওয়ালে টাঙানো একটা ভগবানের ফটো। হাওয়ায় সামান্য দুলছে।
আমি আকুল নয়নে তার দিকে জোড়হাত করে বলে উঠলাম, হে ঈশ্বর...আপনার তাহলে ধর্ম কী?
তিনি নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন, সত্যকে বাঁচিয়ে রাখা।
আমি প্রশ্ন করলাম,
----তাহলে মানুষে,মানুষে এত ভেদাভেদ কেন?...ধর্মের নামে লড়াই কেন?বর্ণের নামে শোষন কেন?...এসব কী তাহলে মিথ্যে দম্ভ?...আর যদি তাই হয়।তাহলে কেন আপনি এসব মিথ্যের সংহার করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করছেন না?
ভগবান নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন,
---এ সবই তো ভ্রম বৎস! মানুষ তার ভ্রমের পিছনে দৌঁড় প্রতিনিয়ত দুঃখ পায়।নিজস্বতা ত্যাগ করে বানানো ভ্রম এর নামে নিজেদেরকে ভাগ করে রেখেছে। তাদের দুঃখে আমিও বড় দুঃখি।
সংহার করা তো সহজ বৎস।আমি চাইছি উদ্ধার করতে।
পিছন থেকে মন্দার আওয়াজ ভেসে এলো,পিওন এসেছে। একটা সই করে দিয়ে যাও।