ডালপালা..
ডালপালা..
আজ আমার এক নিকটাত্মীয়ার কথা কহিব| শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী সদাহাস্যময়ী এই ভদ্রমহিলার কাছে আমি আমার জীবনের প্রায় পুরো সময়টি ই কাটাইয়াছি| বাপমায়ের ন্যায় ইনি আজীবন আমাকে সযত্নে পরিবৃত করিয়া রাখিয়াছিলেন বাৎসল্যস্নেহ, মমতা, শাসন ও ভালোবাসার বেড়াজালে| আজ আমার এই আত্মীয়ার চরিত্রের বিশেষ একটি মজার দিক উপস্থাপিত করিব|
ইঁহার অনেক বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম ছিল কোনো বিষয়ে কথাবার্তা চলাকালীন প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রটি সযত্নে বর্জন করিয়া নিমেষে একেবারে পরস্পর সম্পর্কহীন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ান্তরে উপনীত হওয়া| দেখিতে দেখিতে কথার সেইসব ডালপালা কলকাতার সন্নিকটে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনস্থিত সুপ্রাচীন বটবৃক্ষে পরিণত হইয়া দূর দূরান্তে ছড়াইয়া পড়িত| শ্রোতাগণ কথার তোড়ে হারাইয়া যাইতেন, নাকানি চোবানি খাইতে খাইতে হয় তাঁহারা আসল বিষয়টি বিস্মৃত হইতেন |ঝঞ্ঝাবিধস্ত সমুদ্রে দক্ষ মাঝি যেমন অসহায় খেয়াতরীর হাল ধরিয়া তাহাকে সঠিক পথে চালনা করে, শ্রোতাদেরও সেই অপ্রাসঙ্গিক বাক্যস্রোতের রাশ টানিয়া কথার মোড় ঘুরাইবার প্রয়াস পাইতে হইতো|
যে সময়কার কথা কহিতেছি তখনো আধুনিক যুগের মতো ঘরে ঘরে টেলিফোনের আবির্ভাব হয় নাই| পরস্পর খবরাখবর আদানপ্রদানের কাজ চলিত ইদানীংকালে প্রায় অবলুপ্ত চিঠিপত্র টেলিগ্রাম ইনল্যান্ড লেটার কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে| একবার কলেজ হইতে আসিয়া হাতমুখ ধুইতে ধুইতে নেহাতই এক সরল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম -
"দরকারি চিঠিপত্র কিছু এসেছে আজ ? "
আমি তখন কিরূপে জানিব যে ইঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর পাইবা অপেক্ষা স্বয়ং ডাকঘরে গিয়া খোঁজ করিয়া আসা অনেক সহজ !!
তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন -
"কি বললি, চিঠিপত্র? তা চিঠি কেই বা লিখবে- আজকাল কি আর অতো ধৈর্য আছে কারো? সবাই নিজের নিজের সংসার আপিস কাছারি নিয়ে ভীষণই ব্যস্ত| আর বলিস কেন, এই সেদিন গিয়েছিলাম পোস্টকার্ড কিনতে, হাবুলের মার সঙ্গে দেখা হলো| হাবুলের মাকে মনে আছে তো? বৌবাজারের সোনা পিসি রে- সেই যাদের বাড়ি গিয়ে তুই বাগানে গাছে উঠে কালো পিঁপড়ের কামড় খেয়েছিলি? তারপর তোর কি কান্না বাপরে.. এতো চেঁচাতেও পারতিস তুই ! অবশ্য তুই তখন খুবই ছোট, অতো কি আর মনে আছে? বৌবাজারের বাড়িতে আমাদের আলাদাই আদরযত্ন ছিল রে, তোদের বাবা কাকারা পারলে ওখানেই থাকে.. কতরকম আবদার.. বড়দার সেই যত্নআত্তি আর আস্কারা পেয়ে পেয়ে ছেলেমেয়েগুলো হনুমান হয়ে উঠতো|সে যাই হোক, কি যেন বলছিলাম.. হ্যাঁ.. হাবুলের মা বলছিলো যে রাঙাপিসির মেয়ের শ্বশুর খুবই অসুস্থ, কিন্তু এতো দূরে থাকেন ওঁরা যে যাওয়া হয়ে ওঠেনা.. চিঠিপত্র চালাচালিও প্রায় বন্ধ.. "
এই মাটি করিয়াছে.. আমার সহজ সরল স্বাভাবিক একখান প্রশ্নের উত্তরে ইনি কোথায় চলিয়াছেন? হাবুল বা তাহার মা কাহাকেও মনে পড়িলনা.. বহুবাজারের বাটিতেই বা কি ঘটিয়াছিল বিস্মৃত হইয়াছি| রাঙাপিসি নামটা শোনা শোনা ঠেকিলেও তাঁহার অসুস্থ বেহাইমশাইকে আমি কোনোকালেই চিনিতাম না |ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার ডালপালা দূরদূরান্তে ছড়াইয়া পড়িতেছে, ক্রমেই আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাইবে| হাতমুখ ধোয়া শেষ করিয়া আমি জামাকাপড় বদলাইতেছি তখন| অগত্যা রাশ টানিয়া ধরিলাম -
"ওহ আচ্ছা, এতো খবর জানতামনা| যাইহোক আজ চিঠিপত্র কিছু এসেছে কি ? "
তিনি বলিয়া চলিলেন-
"হ্যাঁ রে বাবা বলছি একটু সবুর করনা| তোদের খালি তাড়া সবসময়ে| দুই দণ্ড কথা বলার জো নেই| বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম দুপুরে| তা সদ্য শীত পড়ছে, খাওয়াদাওয়ার পর রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতে বেশ আরামই লাগে| মনে আছে তো সেই ছোটবেলার লেপকম্বল রোদে দেওয়া, কি আরাম করে গায়ে জড়িয়ে ঘুমোতিস তুই? তা যা বলছিলাম, দেখলাম রাখাল পিয়ন এদিকেই আসছে| ভাবলাম আমাদেরই কোনো চিঠিপত্র নিয়ে আসছে বুঝি| ওমা-কাছে আসতে দেখি রাখাল তো না - এ তো রাধু গোয়ালা|তুই তো জানিসই এরা দুজন একদম একরকম দেখতে, যেন আর জন্মে যমজ ভাই ছিল| রাধু গোয়ালাও আমাকে দেখতে পেয়েছিলো. জিগ্যেস করলো কেমন আছি .. তোদের কি খবর| দেখ রাধুকে তো আর এমনি ছাড়াইনি.. ওর দুর্নাম রটেছিল.. বেটার নিজের গরু, নিজেই দোয়ায়, সেই দুধে ভেজাল মেশাচ্ছিলো| নইলে হঠাৎ রাতারাতি গরুর দুধ খারাপ হয়ে যায় কি করে| বটতলার রামকৃষ্ণ বাবুর যে মেয়ের দিনাজপুরে বিয়ে হয়েছে.. ওরা এসেছিলো গেল বছর.. সেই নাতনির ওই দুধ খেয়ে কি বিপত্তি| রাধুকে তাড়াতে আমারো মন চায়নি রে.. এতদিনকার লোক..কিন্তু আমাকেও তো নাতি নাতনি নিয়ে ঘর করতে হয় বল, কোনো একটা বিপদ হলে তখন? রাধু তাও এদিকে আসলে একবার দেখা করে যায়..."
এই রে আবার সেই| কোন বটতলার কথা হইতেছে বুঝিলামনা| তস্য রামকৃষ্ণবাবু, তাঁহার কন্যা, নাতনি ইঁহারা সকলেই আমার কেন, বোধ করি আমার পিতারও অপরিচিত| আর আজ বাড়িতে কোনো চিঠিপত্র আসিয়াছে কিনা .. ইহার উত্তরে রাধুর গরু, তাহার দুগ্ধ, দিনাজপুরের নাতনি - এই সকল ইতিবৃত্তের অবতারণার সার্থকতা কোথায়? ইতিমধ্যে আমি আগপাতে সজনেডাঁটা চচ্চড়ি সমাপ্ত করিয়া ভাতে ডাল মাখিয়াছি| পুনরায় রাশ ধরিলাম -
"হ্যাঁ আজকাল অসুখ বিসুখ যা বেড়ে গেছে.. তা আজ চিঠিপত্র কিছু এসেছিলো কি.. "
তিনি সস্নেহে হাতায় করিয়া আমার পাতে তরকারি তুলিয়া দিতে দিতে কহিলেন -
"চিঠিপত্রের কথায় মনে পড়লো, আচ্ছা তোকে একখান চিঠি দিয়েছিলাম মেজবৌমার বাপের বাড়ি পাঠানোর জন্য, ডাকে ফেলেছিলি সেটা ? তোদের তো এককথা একশোবার না বললে কিছুই মনে থাকেনা | বেয়াইমশাই কি ভাববেন বলতো - সেই যে রানুর (মনে পড়িল রানু মেজবৌদির কনিষ্ঠা ভগিনীর নাম ) বাচ্চা হবার পর দেখা করে এসেছিলাম, প্রায় দুই মাস হতে চললো, একখান খোঁজ খবরও তো করা উচিৎ| বড়ো ভালোমানুষ ওঁরা..অমন বাপের বাড়ি না হলে মেজবৌমার মতো এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হয়? বড়ো ভাগ্যি করে ওকে এবাড়ির বৌমা করে পেয়েছি.. "
এই মরিয়াছে. . ইনি এবার রাধু গোয়ালাকে ছাড়িয়া আমার মেজবৌদির বাপের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন| এদিকে আমার আহার প্রায় সমাপ্ত.. আমিষপর্বের পর তখন চাটনিতে হাত দিয়াছি| ধৈর্যের অভাব আমার কোনোকালেই নাই, তাই পুনরায় শান্ত সংযত ভাবে কহিলাম -
"হ্যাঁ সে চিঠিখানা সেদিনই ডাকে দিয়েছি.. মেজবৌদি জানে তো.. তা আজ কিছু চিঠিপত্র এসেছে কি? "
দেখিতে দেখিতে আমার আহার সমাপ্ত হইলো| আমার প্রশ্নের সদুত্তর পাইবার আশা ততক্ষনে ত্যাগ করিয়াছি| আঁচাইয়া হাত মুছিয়া মুখে মশলা পুরিতেছি, এমন সময় তিনি আবার আসিলেন ও বলিতে শুরু করিলেন -
"দেখনা কবে থেকে ভাবছি একবার সেজদাকে দেখে আসবো, তা সেই বৈদ্যবাটী যাওয়া কি এবয়সে পোষায় বল, একখান চিঠি লিখবো আজ, কাল পরশু সময় করে একবার ডাকে দিয়ে দিস তো রে| কতদিন হয়ে গেল এবাড়িতেও কোনো চিঠিপত্র আসেনা, রাখাল পিয়ন কি ভুলেই গেল এবাড়ির রাস্তা.."
এমনি আরো অনেক কথাই তিনি বলিয়া চলিলেন, আরো কত প্রসঙ্গ পাড়িয়া আনিলেন, বর্তমানের সহিত যাহাদের কোনো সম্পর্কই নাই, এবং আমার স্থির বিশ্বাস সেই সকল বিষয়ে অবগত হইবার বিশেষ দরকারও নাই...
নিজের সৌভাগ্য কে নিজের ই বিশ্বাস হইতেছিলনা..মাত্র ঘন্টাখানেক চেষ্টার পরই জানিতে পারিয়াছি আমার প্রশ্নের উত্তর - যে আজ চিঠিপত্র কিছু আসে নাই|
একথা সত্য যে তখন আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততার মধ্যে তাঁহার এসমস্ত অবান্তর আলোচনা সময়ে সময়ে বিরক্তিকর ঠেকিত| কিন্তু তাঁহাকে এতোই ভালোবাসিতাম যে তাঁহার হাসি হাসি বাক্যালাপে অত্যাগ্রহী মুখখানি দেখিয়া প্রতিবাদ করি নাই কোনোদিনই| তিনি আমাদের পরিবারের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন| কি সুন্দর হাস্যমুখে সহজ বন্ধুভাবে কত কথা কহিতেন তিনি, সবার খবরাখবর রাখিতেন এবং দরকার না থাকিলেও সেই সমস্ত সংবাদ সকলকে জানাইতেন| বোধ করি একমাত্র তিনি ছিলেন বলিয়াই আমাদের পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের সহিত আমাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল| তাঁহার কথাবার্তার ডালপালা চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়া বাগ মানিতে না চাহিলেও ইহা অনস্বীকার্য যে আমাদের সুবৃহৎ পরিবার -পরিজন -আত্মীয় -বন্ধু ইত্যাদি প্রায় সমস্ত সম্পর্কের সুদূর প্রসারিত শাখা প্রশাখাগুলিকে তিনি একলাই সযত্নে কাছে টানিয়া আগলাইয়া রাখিয়াছিলেন|
যাঁহার কথা এতক্ষন কহিলাম তিনি আমার অতি প্রিয়জন - আমার পিতামহী | তাঁহার বাক্যালাপের স্বভাব তাঁহার জীবনের অন্তিম দিন অবধি বজায় ছিল| একদিন সহসা তিনি চুপ করিলেন.. তাঁহার বাক্যস্রোতের নদীপথ চিরতরে রুদ্ধ হইলো|নিরন্তর কথা ও কাহিনীর সব ডালপালা ফেলিয়া রাখিয়া, একান্ত প্রিয় সমস্ত সম্পর্কের বন্ধন ঘুচাইয়া দিয়া, কাছের দূরের সকল পরিচিতজনকে চিরতরে বিদায় জানাইয়া, আমাকে চোখের জলে ভাসাইয়া তিনি লোকান্তরিত হইলেন| তাঁহাকে শেষবার দেখিবার জন্য বোধকরি সব মিলাইয়া দুই শতাধিক মানুষ জড়ো হইয়াছিলেন - এমনি ছিল আমার ঠাকুরমার জনপ্রিয়তা, এতটাই আপন ছিলেন তিনি সবার কাছে |
আমি আমার ঠাকুরমার কাছে জন্মাবধি বড়ো হইয়াছি, বলাই বাহুল্য তাঁহাকে খুবই ভালোবাসিতাম| এখনো প্রায়ই অশ্রুমোচন করিয়া থাকি - যদি আরেকটিবার তাঁহার সহিত কথা কহিতে পারিতাম.. প্রাসঙ্গিকতার ঊর্ধ্বে উঠিয়া যদি একবার তাঁহার গলা শুনিতে পাইতাম.. কিন্তু হায়.. তিনি হারাইয়া গিয়াছেন চিরতরে.. একাকী আমার এই মনটি মৃত্যুর অমোঘ টান এড়াইয়া তাঁহাকে আরেকটিবার কাছে পাইবার নিষ্ফল ইচ্ছায় হাহাকার করিয়া ওঠে|
তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, এবং আমাদের এই আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্মকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করুন আমরাও যেন তাঁহার ন্যায় সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সবার সহিত সুন্দর এক সম্পর্ক রাখিয়া চলিতে পারি| আশা করি বৈকুণ্ঠলোকে বসিয়া তিনি মনের আনন্দে কথা বলিয়া চলিতেছেন অবিরাম.. ধৈর্যবান শ্রোতারও কোনো অভাব ঘটিতেছে না সেই স্থানে|