তাহাদের কথা
তাহাদের কথা
জীবনপুর বলিয়া এক অখ্যাত অনাদৃত গ্রাম। শহর হইতে বেশ দূরে, নিরালা বিশুদ্ধ প্রকৃতির মাঝে, কয়েকঘর মানুষের বাস। মধ্য দিয়া বহিয়া গিয়াছে একটি ক্ষুদ্রা স্রোতস্বিনী , নাম রঙ্গিনী। খুব চওড়া না হইলেও নিকটবর্তী প্রধানা নদী এবং বৃষ্টির কৃপাদৃষ্টি লাভ করিয়া বেশ পরিপুষ্ট। সেই নদীতীরে বিদায়কালীন হেমন্তের রিক্তা প্রকৃতিদেবীর কোলে একদিন- প্রতিদিনের কাহিনী।
পশ্চিমাকাশে আবির মাখাইয়া সমগ্র বৎসরভর, ঋতু-কাল নির্বিশেষে, প্রত্যহ সায়নকালে সূর্যদেব বসন্তোৎসব করিয়া থাকেন। আজও ব্যতিক্রম নহে - নিজের অন্তিম কিরণটুকু মুছিয়া দিয়া আজিকার মতো কর্তব্য সারিয়া তিনি পৃথিবীর এই প্রান্ত হইতে বিদায় লইবার প্রস্তুতি লইতেছেন। আকাশের পাখিরা আপন আপন কুলায় মাঝে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে। নদীবক্ষ হইতে মাঝিরাও স্ব স্ব ক্ষুদ্র ডিঙ্গাগুলি লইয়া যে যাহার ঘরে ফিরিতে তৎপর। প্রত্যেকের শরীরে একাধারে দিবসান্তের ক্লান্তি, তথাপি নিজ নিজ বাসায় পরিবারের সাদর আশ্রয়ে ফিরিবার এক প্রশান্তির রেশমিশ্রিত মধুর অনুভূতি।
নদীতে জোয়ার আসিয়াছে, অবারিত উর্মিমালা নদীতটে আছড়াইয়া পড়িতেছে। প্রত্যহ সায়ংকালে এই সময়টিতে ছেলেটি আসে নদীতীরে। তাহার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার মাঝে বসিয়া, ঝুমকোলতার পত্র-পুষ্প আবৃত বৃক্ষচ্ছায়ে, নীরবে নিভৃতে লোকচক্ষুর আড়ালে, তাহার বিশেষ বান্ধবীর সহিত সাক্ষাৎ করে।
ছেলেটি বাকি সমবয়স্ক অপেক্ষা আলাদা, তাহার নিজের চিন্তাধারা আর পাঁচজন হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র । অন্যদের নিকট নিজের কষ্টগুলি বুঝাইবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করিতে করিতে সে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। সবাই তাহাকে টিটকারি মারিতে থাকে। সে যেন ঠিক মানাইয়া উঠিতে পারেনা সমাজে। নিজের সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মনের সমস্ত কথা ও কাহিনী, ভালোলাগা, মন্দলাগা, প্রেম - অপ্রেম- অভিমান ইত্যাদি আরো হরেকরকম অননুধাবনেয় আবেগ ছেলেটি এইসময়ে আসিয়া চুপিচুপি উজাড় করিয়া দিয়া যায় তাহার একমাত্র সখীর কাছে। তাহারা বাল্যকালের বন্ধু।
ছেলেটির অন্তর্জগৎ কয়েকদিন যাবৎ বিষন্নতায় পরিপূর্ণ হইয়া আছে। সেই কথাই অদ্য সন্ধ্যায় সে তাহার বান্ধবীর নিকট নীরবে ব্যক্ত করিতেছে।ঋতুরাজের হাত ধরিয়া কয়েকমাস পূর্বে সমগ্র চরাচর রঙিন হইয়া উঠিয়াছিলো, পরবর্তীতে দেবরাজের অবারিত আশীর্বাদে চতুর্দিকে যে সবুজ সতেজতার উচ্ছাস আসিয়াছিল, আজ হেমন্তের শেষ প্রান্তে দাঁড়াইয়া কেমন যেন মন -কেমন করা রিক্ততা আসিয়া ধীরে ধীরে গ্রাস করিয়া লইতেছে ছেলেটির বর্ণময় পৃথিবী।
পর্ণমোচী বৃক্ষগুলি সমস্ত ফুল ঝরাইয়া দিয়া অন্তিম গুটিকয়েক পাতা সম্বল করিয়া ধুঁকিতেছে। তাহার প্রিয় ফুলগুলি সব ঝরিয়া গিয়াছে, নিবিড় বনানী বেশিরভাগ পত্ররাশি হারাইয়া নিপীড়িতা লুন্ঠিতা রূপধারণ করিয়াছে। সবুজ মোহময়ী প্রকৃতিতে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে। উত্তরের হিমশীতল বাতাস সমস্ত প্রাণের উপস্থিতি এবং অন্তিম উত্তাপটুকু হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছে।
ছেলেটি মনে মনে পরিযায়ী হইয়া উড়িয়া যাইতে চাহে - নববর্ণের, নবপ্রাণের সন্ধানে এই স্থান ছাড়িয়া পলায়ন করিতে চাহে । কিন্তু তাহার বাল্যসখী, এই বৃক্ষরাজি- লতাগুল্ম - আপনমনে প্রস্ফুটিত বনফুল, এই মাঠের ঘাস- ইহারা সকলে জন্মাবধি তাহার পরম আপনজন। সমৃদ্ধির সময়ে ইহারা তাহাকে দু'হস্তে আগলাইয়া বক্ষে জড়াইয়া রাখিয়াছে, আজ রিক্ততায় সে তাহাদের ছাড়িয়া যাইবেনা। সে প্রশান্তচিত্তে অপেক্ষা করিয়া থাকিবে, আবার ঋতুরাজ আসিবেন তাঁহার ঝুলি লইয়া, চরাচর রাঙাইয়া দিতে, সমস্ত গ্লানি মুছাইয়া দিতে। প্রকৃতির নিয়ম মানিয়া প্রকৃতি চলিবে, কেহই তাহার ব্যতিক্রম হইবেনা।
ছেলেটির অন্তরতম ভাবাবেগ - বিষন্নতা, আনন্দ, অভিমান, হীনন্মন্যতা, এবং আরো অনেক কথা ও কাহিনী ছেলেটি তাহার সখীর কানে কানে কহিয়া যায়। সখীটি যেন তাহার সখাকে জড়াইয়া রাখিয়াছে। একাকী সখার মনোভাব উজাড় করার স্থান সখীর নীরব উপস্থিতি, তাহার সখার জীবনে সে এক অমূল্য দুষ্প্রাপ্য উপহার; তাহা সখী অবগত। সখা সখীর নিকট নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করিয়া মানসিক আশ্রয়লাভ করিয়াছে, যে কথা কাহাকেও বলা চলেনা তাহা সে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করিতে পারে তাহার সখীর কাছে। সখী কোনো মন্তব্য করেনা, তাহাকে বাধা দেয়না, কেবল নিমগ্নচিত্তে সখার সকল কাহিনী কান পাতিয়া শুনিতে থাকে ।
বস্তুত, মানুষের জীবনে এসদৃশ সঙ্গী সত্যই দুর্লভ, যে কোনোপ্রকার ঠিক-ভুল, উচিৎ-অনুচিতের বিচার-বিশ্লেষণ না করিয়া কেবল মনের কথা শুনিয়া যায়, যাহার সম্মুখে অনর্গল বাঁধাহীনভাবে হৃদয়ের সমস্ত চাহিদা, ইচ্ছা, দুর্বলতা বা ক্লেশ মেলিয়া ধরা যায়, যাহার সহিত কোনোরূপ প্রকাশ্য বার্তালাপ ব্যতীতই মনোভার নামিয়া যায়, যাহার কেবলমাত্র অস্তিত্ব এক ঝলক সুনির্মল বাতাসের ন্যায় আমাদের মানসিক ক্লেদের করালগ্রাস হইতে মুক্তিদান করিয়া থাকে, তাহাদের নিবিড় সখ্য সময় - কাল - স্থান - পাত্র- জীবন- মরণের সীমানা অতিক্রান্ত হইয়া গভীরতর ক্ষেত্রে উপনীত হইতে থাকে। এ বন্ধুত্ব অনুধাবন করা কঠিন, প্রকাশ করিয়া বুঝাইয়া বলা কঠিনতর। ইহা জাগতিক ভালোবাসা - মান- অভিমান -ক্ষোভ -বিদ্বেষ -মোহ- কামনা -লালসাবিহীন এক অপার্থিব পবিত্র ভরসার সম্পর্ক, এক দৈব মায়ার বন্ধন, যাহাকে এড়াইয়া যাওয়া অসম্ভব এবং সর্বোপরি, নিষ্প্রয়োজন।
অদৃষ্ট ইহাই যে কেহ বলিতে ব্যাকুল, শুধাইবার লোক নাই; আবার কেহ শুনিতে আকুল, বলিবার লোক নাই।
গ্রামবাসী বা সমাজও আমাদের ন্যায় তাহাদের সম্পর্কটি ঠিক ধরিতে পারে নাই অদ্যাবধি। এই দুজন পাত্র-পাত্রী কি কেবলই বাল্যকালের বন্ধু? অন্যপ্রকার গভীরতর কোনো ইঙ্গিত কি লুকাইয়া আছে? তাহারা বুঝিতেও পারেনা, ভাবিতেও পারেনা, বাধাও দেয়না।
আমরাও ভাবিবোনা। ছেলেটি যদি নিভৃতে অন্তরালে তাহার প্রিয় সখীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, দুই দণ্ড আলাপপূর্বক আপন সকল হৃদয়াবেগ ও মনোভার উজাড় করিয়া শান্তিতে থাকিতে চাহে, তাহাতে এ জগতে কাহারো কোনোপ্রকার ক্ষতি হইবার কথা নহে। আমরা কেহই সেই বিচার করিবার ক্ষমতা বা অধিকার রাখিনা। ইহা কেবল তাহাদের কথা; ইহাদের সম্পর্ক দেশ -কালের উর্দ্ধে, ইহার মধ্যে আমরা কোনোপ্রকার অন্য ইঙ্গিত খুঁজিতে যাইবোনা।
****************
এই সন্ধ্যার পর চারমাস কাটিয়াছে। পুনরায় দখিনা বাতাসকে সঙ্গী করিয়া ঋতুরাজ ফিরিয়া আসিয়াছেন, সখা ও সখী উভয়েরই প্রাণে আনন্দের জোয়ার; ঝুমকোলতা, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার সহিত সমগ্র বনানী বসন্তোৎসবে পুনরায় মাতিয়া উঠিয়াছে, সখা আজ প্রসন্নচিত্তে বাঁশিতে খুশির সুর তুলিয়া তাহার সখীকে শুনাইতেছে। সখী সম্পূর্ণ নিমগ্না সেই সুরমাধুর্যে।
এইবার পরিচয়পর্ব সারিয়া ফেলি - এই আলেখ্য যাহাদের ঘিরিয়া- ছেলেটির নাম রঙ্গন ও তাহার সখীর নাম রঙ্গিনী -একজন একাকী লাজুক নিতান্ত প্রকৃতিপ্রেমী গ্রাম্য বালক এবং তাহার প্রিয়সখী একটি নদী।
