Kingkini Chattopadhyay

Others

4.3  

Kingkini Chattopadhyay

Others

ধূমকেতু

ধূমকেতু

4 mins
508


এই কাহিনী নিতান্তই আমার বাল্যকালের - আশির দশকের কোনো এক বৎসরের কলকাতার বাহিরের এক গন্ডগ্রামের|আধুনিক ব্যবস্থা তখনো সেই স্থানে পৌঁছায় নাই , আধুনিক আদবকায়দা জাকঁজমকগুলিও সেই স্থানকে কলুষিত করিয়ে তুলিতে পারে নাই| নিতান্তই সরল সাদাসিধা গ্রাম্য পরিবেশে চারধারে জাম শাল পিয়ালের বন দিয়ে ঘেরা , ছোট একটি কল্লোলিতা উপলধারার সন্নিকটে আকণ্ঠ স্নেহ ও ভালোবাসা পরিবেষ্টিত একটি ছোট্ট গৃহস্থালির একটি বিশেষ চরিত্র কে কেন্দ্র করিয়া এই আলেখ্য |


আমরা কলিকাতার পুরোনো বনেদি পরিবারগুলির একটির মধ্যে গণ্য হইতাম| কলিকাতায় মূল বসতবাটি থাকার পাশাপাশি তখনকার দিনের অনেক অবস্থাপন্ন বাঙালিদের মতো আমাদেরও একটি দেশের বাড়ি ছিল – সেইস্থানে আমার বাল্যকালের কয়েক বৎসর কাটিয়াছে | বাবা কাকারা ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই কলকাতার বাড়িতেই থাকিতেন| জায়গাটি অধুনা ঝাড়খন্ড প্রদেশ স্থিত দেওঘরের সন্নিকটে মোহনপুর গ্রামে| আশপাশ প্রধানত ফাঁকা ..কয়েকটি কাঁচা মাটির বাড়ির ব্যতীত কিছুই নাই. ময়ূরাক্ষী নদীর একটি অনাদৃত শাখা নিজের খেয়ালবশে চলিতে চলিতে খালের ন্যায় এক শুঁড়িপথ ধরিয়া , নিতান্তই মন্দস্রোতা হইয়া গৃহের নিকট দিয়া প্রবাহিত হইয়াছিল| সংসারের কোনো তাড়া নাই, চাহিদা নাই , আদি -অন্ত -জন্ম -মরণ -সময় -কালের হিসেব নেই.. এই নদীটি যেন এখানকার গ্রাম্য জীবনযাত্রাটির  পরিচায়িকাস্বরূপ.. সে নদীতে হাঁটুও ডুবিতনা , কোনো বড় মানুষ দশ-বারো পা গিয়াই তাহা অনায়াসে টপকাইতে পারিতেন| নদীর জলে নুড়ি নিক্ষেপ ছিল আমার খুব প্রিয় একটি খেলা| এমনি একদিন নদীর ধারে বসিয়া আছি - আমার জীবনে অতর্কিতে ভ্যাবলার আগমন ঘটিল|


নিতান্তই রাস্তার একটি নেড়ি – গায়ের রং ধূসর পাটকিলে , পিঠের উপর ও মাথায় কানের কাছে সাদা ছোপ| ঠিক করিয়া খাইতে পায়না, পঞ্জরের হাড় ক'খানি গোনা যায় | খাদ্যের লোভে সেটি আশপাশের ছড়ানো শুকনো শালপাতাই চাটিতে লাগিল বারংবার| আর আমার দিকে জুলজুল আশাপূর্ণ চক্ষে তাকাইতে লাগিল| আমি মজা পাইয়া গেলাম – তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলাম – "কি বোকা রে তু্ই, দেখছিসনা খাবার নেই ? কি চাটছিস অতো ?" যেন প্রত্যুত্তরেই সে আমার দিকে আবার চক্ষু তুলিল – বড় নিষ্পাপ , কিছুটা বোকা বোকা| রাস্তার নেড়িদের যে একটি সতর্ক তীক্ষ্ণতা থাকে , তাহা একেবারেই অনুপস্থিত| তাহার বুদ্ধিহীনের ন্যায় চাহনি দেখিয়া তাহার নাম রাখিলাম – ভ্যাবলা|


কিছুক্ষণ তাহার সহিত বকবক করিয়া, হাতের সবকটি নুড়ি একে একে জলে নিক্ষেপ করিয়া আমি বাড়ির পথ ধরিলাম| দেখিলাম ভ্যাবলাও আসিতেছে পিছুপিছু – এতক্ষণের বাক্যালাপে সে আমাকে তাহার পরম বন্ধু মনে করিয়াছে| আমিও তাহাকে বন্ধুভাবে নিজের বাড়ির পথ দেখাইয়া লইয়া আসিলাম – আরম্ভ হইলো একটি অদ্ভুত বন্ধুত্বের কাহিনী যা হয়তো না ঘটিলেই ভালো হইতো – যা এমন এক রেশ রাখিয়া গেল – যে এতদিন পরও আমাকে পীড়া দেয়| 


বেলা হইয়া গিয়াছে দেখিয়া বড়োদের বকুনি এড়াইতে ঝটপট স্নানাহার সারিতে উদ্যত হইলাম , ভ্যাবলার কথা আর মনে রহিল না| দ্বিপ্রহরে খাবার পাট চোকাইবার পর বারান্দায় রোদ্দুরে আসিয়া বসিয়াছি , নীচে তাকাইয়া দেখি ভ্যাবলা বসিয়া একদৃষ্টে বাড়ির ভিতর দিকে তাকাইয়া আছে| বুকের মধ্যে মোচড় দিয়া উঠিল, আহারে হয়তো অভুক্ত রহিয়াছে ..ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপিতেছেও অল্প| দৌড়াইয়া নীচে নামিয়ে রাঁধুনে বামুনকে বলিলাম  উহাকে খাইতে দিতে| পাছে ভ্যাবলা ভয় পায় , তাই আমরা আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম – কি পরম তৃপ্তিভরে সে তাহা খাইতেছে ..খাদ্য সম্পূর্ণ নিঃশেষিত করিয়া পাশের একটি ডোবা থেকে জল খাইতে লাগিল| আশ্চর্য.. এতক্ষন খেয়াল করি নাই , এ যাবৎ অন্য কোনো কুকুর বা বিড়াল এই খাবারে ভাগ বসাইতে আসে নাই| ভ্যাবলা সম্পূর্ণ একলা, অতিশয় নির্বান্ধব ও নিঃশত্রু| বামুন কে বলিয়া পুরোনো চটের পাপোশ দিয়া ভ্যাবলার শীতবস্ত্র তৈয়ারি করিলাম|


ভ্যাবলা অত্যন্ত বাধ্য ছেলেটির মতো পোশাক পরিধান করিয়া বালির গাদায় গিয়া উঠিল| রাত্রে উহার বাহিরে ঠান্ডা লাগিবে এই ভাবিয়া আমি চিন্তিত হইয়া জেদ ধরিলাম যে উহাকে বাড়ির ভিতরের রোয়াকে থাকিতে দিতে হইবে| সবাই বলিতে লাগিলেন -"রাস্তার কুকুরকে একবার ঘরে ঢোকাইলে উহা নোংরা করিবে ও পরবর্তীকালে বাড়ি ছাড়িয়া যাইতে চাহিবেনা| এই যে আমি উহাকে নিয়মিত খাওয়াইয়া শোবার জায়গা দিয়া আরামের অভ্যেস করাইতেছি, আমরা না থাকিলে তখন উহার কি হইবে ? কে দেখিবে তখন ?" হায় শিশুমন – এই অত্যন্ত কঠিন বাস্তব তখন অনুধাবন করিতে পারি নাই, ভ্যাবলাকে গৃহে ঢোকাইবার জেদ আমার অক্ষুণ্ন রহিল| অদৃষ্ট অলক্ষ্যে অশ্রুত হাসি হাসিলেন|


দেখিতে দেখিতে বৎসরকাল কাটিয়া গেল| ভ্যাবলা নিয়মিত খাইতে পাইয়া ও আরামপ্রদ জায়গায় থাকিতে পাইয়া একটু সুস্বাস্থের অধিকারী হইয়াছে- আর সেই ক্ষীণজীবী মৃতপ্রায় হাড় জিরজিরে কুকুরটি নাই ..তাহার চলনেও বেশ একটি আত্মবিশ্বাস আসিয়াছে – আর সে পথে পথে ঘোরেনা ..একটি আশ্রয় পাইয়াছে | সে আমার নিত্যদিনের বন্ধু ..নদীর ধার হউক কি গ্রামের রাস্তা – ভ্যাবলা সর্বদা আমার পাশে থাকে |


উহাকে লেখাপড়া শেখাইবার ও চেষ্টা করিয়াছি - কিন্তু যতটা সহজ ভাবিয়াছিলাম অতটা নহে | উহার পক্ষে মুখে বলা বা গণিতের সমাধান করা বা লেখা একেবারেই অসম্ভব বুঝিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়েছিলাম |


ভ্যাবলা আমাকে গ্রাম্য রাস্তার বিপদ হইতেও বাঁচাইয়াছে| একবার এক ক্ষেপা ষাঁড় ছুটিয়া আসিতেছিল, ভ্যাবলা প্রচন্ড ঘেউঘেউ শব্দে সেটিকে তাড়া করিয়া যায়| আরেকবার একটি পাগলা গোছের ক্ষেপা লোক আমার পিছু নিয়েছিল – ভ্যাবলা তাহাকেও তাড়াইয়া এলাকা ছাড়া করে|


সে যেন একাধারে আমার অবলা বন্ধু, অত্যন্ত অনুগত বাধ্য এক শ্রোতা, আমার সকল কর্মের ও দুষ্কর্মের সঙ্গী ও ভয়ানক সতর্ক এক নির্বাক রক্ষক| ভ্যাবলার পিঠে পা দিয়া ছোটোখাটো গাছেও চড়িয়াছি| নদীর ধারে গিয়া বসিলে সেও পাশে জড়োসড়ো হইয়া শুইয়া থাকে , কথা বলিলে অত্যন্ত উৎকর্ণ হইয়া শোনে| মাঝেমাঝে কাগজের গোলা বানাইয়া খেলি তাহার সহিত| রাত্রিকালে কতবার তাহাকে লইয়া বাড়ির বাইরের বাগানে বসিয়া তারা দেখিয়াছি ..মাথার উপর মেঘহীন জোছনা পরিস্ফুট আকাশে ঝিকমিক করিতেছে নক্ষত্ররাজি – ভ্যাবলাকে চিনাইতাম ওই কালপুরুষ,  ওই সপ্তর্ষিমণ্ডল | ভ্যাবলা এক মনে শুনিত ও লেজ নাড়িয়া সায় দিতো ..তাহার নির্বাক চক্ষে প্রতিফলিত হইতো কালো আকাশের নিকষ গভীরতা | আমার মন সর্বদা ভরিয়া থাকিত এমন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী পাইয়া| আমি যখন যাহা খাইতাম, ভ্যাবলাকেও দিতাম, এছাড়া বাড়িতে তাহার চারবেলার খাদ্য বরাদ্দ হইয়া গেছে, শোবার জায়গাও অপরিবর্তিত আছে| এই অবলা প্রাণীটির সাথে আমার অসম বন্ধুত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ..অতিশয় আনন্দে আমার সময় কাটিয়া ` যাইতেছে ..জীবনকালে ইহার সহিত বিচ্ছেদ হইবেনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি একপ্রকার| চুপিসারে যে কি ভীষণ মায়ার বন্ধনে জড়াইয়া পড়িতেছি তাহা বুঝিতে পারিনাই তখনো|


একদিন সহসা বজ্রাঘাত হইলো| হঠাৎ শহর হইতে খবর আসিলো যে বাবাদের ব্যবসাসংক্রান্ত মারাত্মক কোনো এক ⁹ উপস্থিত হইয়াছে , একটি আকস্মিক অগ্নিকান্ডে কয়েকটি গুদাম ভস্মিভূত হইয়াছে , সুতরাং ভয়ানক দুর্যোগের সম্মুখীন গোটা পরিবার| অবিলম্বে “দেশের বাড়ির " পাট চুকাইয়া আমাদের অকুস্থলে ফেরত যাইতে হইবে| আমরা হয়তো আরো মাসকয়েক থাকিয়া ফিরিতাম , ভ্যাবলাকে রাখিয়া যাইতাম বামুনের আশ্রয়ে. .কিন্তু এক্ষেত্রে পরদিনই তল্পিতল্পা গুটাইয়া রওনা হইতে হইবে , আবার কবে ফেরা হইবে জানা নাই| উপযুক্ত ক্রেতা পাইলে এ বাড়িও বেচা হইতে পারে –এমন কোথাও কানে আসিতে লাগিল|


শিশুমন দিশাহারা হইয়া গেল| ব্যাপারটির গাম্ভীর্য বা আমাদের অস্তিত্বের বিপন্নতা অতো বুঝিলামনা – মা ও পিসীরা আগলাইয়া দাঁড়াইলেন– কি ভয়ঙ্কর দুর্দিন আসিতেছে কল্পনাও করিতে পারিলামনা| চোখের জলে ভাসিয়া গেলাম ভ্যাবলার কথা ভাবিয়া| তাহাকে যে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ছাড়িয়া চলিয়া যাইবো – আমাদের একান্তে কাটানো মুহূর্তগুলি , যেগুলি আমার শিশুমনকে পরিপূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে , আমার একমাত্র বন্ধু - যাহাকে ছাড়া আমার জীবন অচল, যাহাকে একদিন সহসা পথপার্শ্বে কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম তাহাই আজ আমার প্রাণাধিক প্রিয় | হায় অবলা জীব , সে বুঝিতেও পারিতেছেনা কি ঘটিতেছে – মালপত্র এদিক ওদিক সরানো গোছানো হইতেছে দেখিয়া খালি আমার পায়ে আসিয়া মুখ ঘষিতেছে| কাহাকেও এই ছোট্টমনের কষ্ট বোঝাইতেই পারিতেছিনা – সম্মুখে অতো বড় বিপদ – আজ আমার মতো এই অর্বাচীনের 'সামান্য' কুকুরপ্রীতি লইয়া কাহারো  মাথা ঘামাইবার সময় নাই|


কিরূপে কাহাকেও বোঝাইবো ও আমার বন্ধু – উহার আমি ছাড়া আর কেহই নাই – কতখানি ভালোবাসা এই ছোট্ট হৃদয়টিতে আছে কি করিয়া কাহাকেও দেখাইবো ? এই যাওয়া কিরূপে আটকাইবো ? ভ্যাবলার অস্তিত্ব আমার জীবন হইতে মুছিয়া যাইবে- এ আমি বিশ্বাস করিতে পারিতেছিনা| আমি তো একাকিনী ছিলাম – তাহা হইলে কেন ভগবান ইহাকে পাঠাইয়া আমার নিঃসঙ্গ মনটিকে এতো নির্মল সখ্য ও আনন্দ ভালোবাসা মায়ায় পরিপূর্ণ করিলেন – তাহাকে এমন ভাবে কাড়িয়াই লইবেন যদি ..আমাদের পরস্পরকে একে অপরের জীবনে আনিলেন কেন? ভ্যাবলা অকস্মাৎ মরিয়া যাইলে হয়তো আমি কম দুঃখ পাইতাম, এখন কেমন যেন শোকমিশ্রিত আতঙ্ক চাপিয়া ধরিল – ঘোর বাস্তব বুঝিলাম এতক্ষনে - আমরা সকলে চলিয়া যাইলে উহার কি হইবে – এই জনহীন প্রান্তরে যে আমি উহার সব ছিলাম| কাল হইতে হঠাৎ সদরে তালা দেখিয়া উহার কি অবস্থা হইবে ভাবিতেও পারিলাম না ..ক্রমাগত ক্রন্দনের ঠেলা সামলাইতে না পাড়িয়া কাশিতে কাশিতে হেঁচকি তুলিতে লাগিলাম| ভ্যাবলা অদূরে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল – আসতে আসতে চলিয়া গেল| বড়ই মর্মান্তিক সেই চাহনি - কত কি বলিতে চাহিল সেই জানে | সেই তাহার সহিত আমার শেষ দেখা|


সে রাত্রে আমার নিদারুন জ্বর আসিল| চোখের সামনে আর সব ধূসর হইয়া গেল – কেবল ভ্যাবলার মুখটাই দেখিতে লাগিলাম| পরদিন ভোরবেলা উঠিয়া স্টেশন হইতে গাড়ি আনানো হইল – মাল উঠিতে লাগিল , বামুন এক কোণে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে – উহারও  ভবিষ্যৎ অন্ধকার| এই বাড়ি আর আমাদের থাকিবে কিনা কেহ জানিনা – হঠাৎ সব ছাড়িয়া যেন কোন অনির্দিষ্টের পথে চলিয়াছে গোটা পরিবার| 


সকালে ভ্যাবলাকে অনেক খুঁজিলাম – কোথাও পাইলামনা| এমন তো কখনো হয় নাই ? কোথায় গেল সে ? কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও যে কাছ ছাড়িয়া যায় নাই , সে আজ আমার বিদায় লইবার সময়ে কোথায় অন্তহৃত হইলো ? আমার কষ্ট বাড়াইতে চাহেনা বলিয়াই কি আর আমার সম্মুখে আসিবেনা ? সশব্দে আছাড়ি পিছাড়ি খাইয়া কাঁদিয়া উঠিলাম – বুঝাইয়া বলিতে পারিলামনা – কান্নাস্রোত আসিয়া কণ্ঠ বক্ষ রুদ্ধ করিয়া শ্বাসরোধ করিবার উপক্রম করিল - ভ্যাবলা একবার আয় ..যাবার আগে শেষ একটি বার দেখি তোকে ..


আমরা রওনা দিলাম| যতক্ষণ বাড়িটা পিছনে দেখা যাইতে লাগিল – সবাই সেই দিকেই চাহিয়া রহিল – বামুন একলা দাঁড়াইয়া আছে ..হাত নাড়িতেছে ..মা কাকিমারা কাঁদিয়া বুক ভাসাইতেছেন , বাবা কাকারা অসম্ভব গম্ভীর| আমি একদৃষ্টে তাকাইয়া আছি অপসৃয়মান রাস্তাঘাট পুকুরগুলির দিকে, এইসব রাস্তায় কত খেলিয়াছি ভ্যাবলার সহিত , ভ্যাবলার আগমন ঘটিবার পূর্বেও কতদিন নিজেই একাকিনী ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি| আমার শিশুমন জুড়িয়া ছিল আমার শৈশবের এই সমস্ত মুহূর্ত| এই গাছপালা , প্রত্যেকটা পাথর, নদীর ধার এইসবই যে আমার অস্তিত্বের মূলধন!


বাবা মা কোন অস্তিত্ব বিপন্ন কহিতেছেন জানিনা তবে সেদিন আমার কাছে ইহার তুলনায় বড় অস্তিত্বের বিপন্নতা হয়তো আর কিছু ছিলনা| বাড়ির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত বুঝিলাম, কিন্তু কিছু আছে, তাহার ভরসায় আবার শুরু করা যাইবে ..কিন্তু আমার যে এই গ্রাম্য পরিবেশে কাটানো মুহূর্তগুলি ব্যতীত আর কিছু নাই| ভ্যাবলা আসিয়াছিল – সেও হারাইয়া গেল | হয়তো কিছুদিন পর অভ্যাসবশতঃ সে আবার আসিবে ..বাড়ি তালাবন্ধ দেখিয়া এদিক ওদিক ঘুরঘুর করিবে, নিজের সেই খড়ের বিছানায় বসিবে কিছুক্ষন ..নিষ্ফল অপেক্ষা করিতে করিতে আবার একদিন পথের কুকুর পথেই আশ্রয় লইবে …আমি তখন কতদূরে রহিয়াছি | সর্বসময়ে আমরা একে অপরের স্মৃতিতে থাকিব কিন্তু দুঃসময়ের মর্মান্তিক আঘাতে কেউ কাউকে দেখিতে পাইবোনা , একটি বার ছুঁইতে পারিবনা.. কেবল হাহাকার করিব মনে মনে..


স্টেশনে আসিয়া ট্রেনে চাপিলাম| একটিবার ভ্যাবলাকে দেখিতে পাইবার আশায় বাহিরে তাকাইয়া রহিলাম| সে চূড়ান্ত অভিমান করিয়াছে ..আর আমাকে দেখা দিলনা| শহরে ফিরিয়া বড়োদের শুরু হইলো ক্ষয়ক্ষতি সামলাইয়া পূর্বেকার জীবনে ফিরিবার লড়াই| আমি একেবারে মনেপ্রাণে  নিঃসঙ্গ হইয়া গেলাম এই অচেনা পারিপার্শ্বে অনভ্যস্ত জীবনে| কিন্তু সময় থামিয়া থাকেনা ..ধীরে ধীরে মানিয়া লইতে শুরু করিলাম| বহুদিন পর একটু সামলাইয়া উঠিয়া সেই গ্রামে ফিরিয়া গিয়াই ভ্যাবলার খোঁজ লইয়াছিলাম ..কিন্তু আর তাহাকে দেখি নাই| আমাদের চেনা জায়গাগুলিতে গিয়া কত তাহার নাম ধরিয়া ডাকিয়াছি| সে ছুটিয়া আসেনাই লেজ নাড়িতে নাড়িতে ..বামুন বলিয়াছিল যে সে যে কদিন ছিল আমরা চলিয়া যাইবার পর – ভ্যাবলা আর কখনো আসে নাই| সে যেন চিরতরে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে |


ভ্যাবলার উপস্থিতি আমার জীবনে একটি ধূমকেতুর ন্যায় | এই ছোট্ট উচ্ছ্বাসহীন নির্বান্ধব একাকী শিশুমনে সে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, আবার হঠাৎ কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে| রাখিয়া গিয়াছে প্রচুর বাল্যস্মৃতি এবং একটি উত্তরহীন প্রশ্ন – সে সেদিন দুপুরে অকস্মাৎ কোথায় চলিয়া গেল ? অতি বাল্যকালেই আমায় সে  চিনাইয়া দিয়া গিয়াছিল মানবজীবনের সবচেয়ে কঠিন অমোঘ বন্ধন – মায়া| আজ অবধি কোনো পুষ্যি ই আর ঘরে আনিতে সাহস করি নাই পুনরায় তাহাকেও হারাইবার ভয়ে| ভ্যাবলার একটি ছবিও নাই আমার কাছে| আজও ঐরকম সাদা ছোপযুক্ত রাস্তার নেড়ি দেখিলেই ভ্যাবলাকে লইয়া আমার বাল্যকালের স্বর্ণস্মৃতি ফিরিয়া আসিয়া এই চক্ষু ভিজাইয়া দেয়|


Rate this content
Log in