Kingkini Chattopadhyay

Classics Others

4.5  

Kingkini Chattopadhyay

Classics Others

দোল দোল দুলুনি

দোল দোল দুলুনি

2 mins
214


সে অনেক বছর আগেকার কথা - একটি ছোট পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মোড়া একটি দাদা আর একটি বোনের কাহিনী। 

প্রথমে দাদার কোথায় আসি. সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব, পেশায় ডাক্তার। দূরদূরান্তে গ্রাম গ্রামান্তরে গিয়ে রুগী দেখে ওষুধ দিয়ে ফিরতেন – পয়সাকড়ি নিতেননা। দাদা বয়সে বেশ খানিকটা বড় বোনের থেকে। বোনটি একেবারেই ছোট নেহাত ছেলেমানুষ – দাদার প্রতি তার ভালোবাসা ও ভক্তিভাব অসীম। দুজনের মধ্যে বয়সের ফারাক থাকলেও ছিলো তুইতোকারির সম্পর্ক। 

সকাল হতেই বোনটির ইস্কুল যাবার তাড়া। তার মা তাকে খাইয়ে পরিয়ে তৈরী করে দেন। দাদার হাত ধরে বোন চলে ইস্কুল এর বাস এ উঠতে। সারাদিনের জন্য দাদার থেকে আলাদা হয়ে গেলো – এই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বোন ইস্কুল যায়। দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে ফেরে, চোখদুটি খেলার সাথী দাদা কে খুঁজে বেড়ায়,সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা করে নেয় চটপট। দাদা ফিরলে আর এক মুহূর্ত ও নষ্ট করা চলবে না।

 দরজার গোড়ায় রিকশা এসে দাঁড়ায় – বোনের কান সতর্ক হয়ে ওঠে ..“বোন বোন আমি এসে গেছি… ব্যাগটা নিয়ে যা তো ” - রুগী দেখে ফিরে ডাক দেন দাদা। অমনি ছোট্ট বোনের পৃথিবী থেকে আর সব কিছু মুছে যায় - দাদার সঙ্গে সারাদিন পর দেখা হবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে সে। 

 কোনোরকমে এক হাতে পুতুল আর নিজের ঝলঝলে জামা সামলাতে সামলাতে ভারী ব্যাগ কোনোমতে টেনে টেনে ওপরে এনে তোলে। দাদা কোনদিন বোনের জন্য আনেন ফল , কোনদিন আনেন কৃষ্ণগড়ের মাটির পুতুল কোনদিন বা এসে খালি একটা স্নেহসিক্ত চুম্বন করেন বোনের গালে। অধীর আগ্রহে বোন অপেক্ষা করে থাকে কখন শ্রান্ত মানুষটি হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একটু সুস্থির হয়ে বসবেন – অমনি সে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর কোলে আর শুনবে দাদার সারাদিনের দিনলিপি। তারপর সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজের সারাদিনের সমস্ত ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দেবে দাদাকে। অতঃপর বাড়ির সবার সাথে দাদা আর বোন নৈশাহারে বসে। নিজে হাতে না খেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে বোনটি .. বাড়ির সবার বকুনি খায় নিত্যদিন সে এই জন্য। দাদা প্রায়ই নিজে হাতে করে পরমযত্নে খাইয়ে দেন বোনকে। তারপর দুজনে রাতে গল্প করতে করতে একসাথে ঘুমায়। 

 ছুটির দিনে দাদার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে সে। সকাল থেকে উঠে গাছে জল দেয়া , একসাথে দুধ আনতে যাওয়া , বাজার করা ইত্যাদি আরো অনেক কাজে দাদার সহকারী সে। বেলা বাড়লে দাদার কিছু বন্ধুবান্ধব আসেন – তাদের সাথে দাদা আড্ডা দিতে দিতে চা খান। বোন কিন্তু সেখানেও উপস্থিত , ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে থাকে , পুতুল খেলে ছবি আঁকে – দাদা কে বিরক্ত করেনা , আবার দাদার কাছ ছাড়াও হয়না। দুটিতে আবার একে অপরের পিছনে লাগে , উত্যক্ত করে মজা পায় , তাই নিয়ে ঝগড়াও করে ..কথা কাটাকাটি মনোমালিন্যও হয় – কিন্তু সেসব ক্ষনিকের। 

দুপুরে একসাথে খাওয়াদাওয়া করে গল্প করতে করতে দাদা বোনকে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করেন। বোন কিছুক্ষণ বিছানাময় দাপিয়ে বেরিয়ে দাদার পেটের ওপর বসে নানারকম দুষ্টুমি করতে করতে শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুম দেয়। সেই ফাঁকে কিছু দরকারি কাজ সেরে নেন দাদা। বিকেল হলে আবার বোনকে নিয়ে পার্কে যাওয়া , দোলনায় দোলান আবার গলা ছেড়ে গান করেন – দোল দোল দুলুনি। সেই বেসুরো গান শুনে বোন হেসে গড়াগড়ি যায়। এই গানটি তার খুব প্রিয় - ঘুমের সময়েও এই গানটি দাদার গলায় তার শোনা চাই ই। 

ছুটির দিনের সন্ধ্যেবেলা কাটে দাদার সাথে খোশগল্পে – দাদা কতরকম গল্প করেন , শিশুমন উপযোগী করে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনান। বোনের আবদার চলতে থাকে – দাদা এইবার আমায় রাখিতে একটা সাইকেল দিবি রে ? চালাবো ? তোকে নিয়ে বাজারে যাবো , দুধ আনতে যাবো ? দাদা হাসেন ..বলেন "আচ্ছা তুমি ভালো করে মন দিয়ে লেখা পড়া করবে কথা দাও ..সাইকেল দেখা যাবে'খন "। বোন মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

ভাইফোঁটায় সর্বাগ্রে বোন দাদার কপালে ফোঁটা দেয় – মায়ের কাছে আবদার করে একটি পাঞ্জাবি উপহার দেয় , দাদাও বোনকে আদরে স্নেহে ভরিয়ে দিয়ে উপহার দেন। রাখী     উপলক্ষে দশদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ভুলে বোন দাদার জন্য নিজে হাথে রাখী প্রস্তুত করে, রাখীর দিন ভোরবেলা স্নান সেরে সেটি দাদার হাথে পরিয়ে তার শান্তি। আবদার করে সেটি দাদা কে দুদিন পরে থাকতেই হবে – দাদা সেই আবদার মেনে নেন। বোনের এযাবৎ দেওয়া সবকটি রাখীই দাদা পরমযত্নে তুলে রেখেছেন।

এইভাবে দুই অসমবয়সী ভাই – বোন এর সম্পর্ক পরম স্নেহ মমতায় আবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলে। বোনের অন্য বন্ধু দরকার পড়েনা , দাদাও বোনকে পেয়ে খুব খুশি – একে অপরকে ভরিয়ে রেখেছে। 

 এইরকম এক বছর রাখী পুর্ণিমার দিন দশেক আগের কথা। বোন অত্যুৎসাহে রাখী তৈরী করছে। দাদার হাতে বাঁধা হবে। দাদাও চুপিচুপি বোনের উপহারের বেবস্থা করে রাখেন। নির্দিষ্ট দিনে আনবেন। একে অপরকে রাখীর উপহার দেবার জন্য তৈরী – এমন সময়ে বিধাতা অলক্ষ্যে  থেকে এক নিষ্ঠুর হাসি হাসলেন। 

সেই রাত্রে দাদা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। বাড়ির লোকজন দাদা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বোন সঠিক বোঝেনা ব্যাপারটা কতটা গুরুতর .. কিন্তু ভীষণ কিছু গোলমালের ইঙ্গিত পায় তার শিশুমন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে এই বুঝি বাবা মা দাদা কে নিয়ে ফিরলেন। দাদার জামাকাপড়ে হাত বুলোয় ..ব্যাগ গুছিয়ে রাখে , দাদার গাছগুলিকে যত্ন করে আর রাখী তৈরি রাখে। তার স্থির বিশ্বাস রাখির আগে দাদা নিশ্চয়ই ফিরবেন। 

দাদা বাড়ি ফেরেন শেষবারের মতো রাখীর দুদিন আগে - ফুলমালা সজ্জিত হয়ে পরম শান্তিময় চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে। ওভাবে দাদাকে দেখে বোন অবাক হয়ে যায় – "এতো মালা পড়েছিস কেন দাদা ..এবার ওঠ ঘুম থেকে" – ডাকতে থাকে সে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারে দাদা আর উঠবেন না কোনোদিন , বোন বলে ডাকবেনা ..খেলবেননা – দোল দোল দুলুনি গাইবেননা। বোনটি জীবনে প্রথম প্রিয়জনের মৃত্যুশোক পায় – দাদা নেই এ সে কিছুতেই মানতে পারেনা – খালি ভাবে তার কোথায় ভুল হয়েছিল - দাদা কেন চলে গেলো তাকে ছেড়ে – রাখী পছন্দ হয়নি ? সাইকেল চেয়ে ভুল করেছে কিছু ? “দোল দোল দুলুনি ” কি তবে দাদার প্রিয় গান নয় ? বোনটির জীবন হঠাৎ স্বাদহীন বন্ধুহীন শূন্যবৎ হয়ে যায়। রাত্রে ঘুমে দাদাকে স্বপ্ন দেখে , শোনে দাদা গান করছেন – “দোল দোল দুলুনি ”, দাদার কাছে একবার যাবার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে ..দাদার জামাকাপড়ের স্পর্শে দাদাকে পাবার বিফল চেষ্টা করে। তার শেষ রাখীটি সে তুলে রাখে – সেই থেকে আজ অবধি আর কারো হাথে রাখি পরায়নি সে , আর কোনোদিন রাখীবন্ধন উৎসব পালন করেনি। 

কালস্রোতে সব ক্ষত সেরে যায় , সব শূন্যতা পূর্ণ হয় – দাদার অভাব শিশু মনকে তীব্র ভাবে পীড়া দেয় – কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাও সহনীয় হয়ে ওঠে। দাদা কে দেওয়া শেষ প্রতিশ্রুতি রেখে বোন খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করেছে। আজ সে বড়ো হয়েছে অনেক। আজও সেই শেষ রাখীটি রেখে দিয়েছে। দাদার মৃত্যুর পর দাদার আলমারিতে পাওয়া গেছিলো বোনের দেয়া আগের সব বছরের রাখি - সেই সবকটিই রাখা আছে সযত্নে। দাদা আর নেই কিন্তু তাঁর স্পর্শময় রাখী গুলি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। 

অনেক গল্প কথা বললাম। কিন্তু যাদের কথা এতক্ষণ হলো – পাঠক কি জানেন তারা করা ?

তারা আমার অতি পরিচিত দুজন। পাঠক হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন – বোনটি হলাম আমি ..এই কাহিনীর সূত্রধর - আর দাদাটি ছিলেন ...না তিনি আমার সহোদর বড়ো ভাই নন , আমি বাপ-মায়ের একটি মাত্র কন্যা। 

আমার দাদাটি ছিলেন আমার ঠাকুরদাদা , যাঁকে আমি আদর করে দাদা বলতাম , আর উনি আমায় বোন বলতেন। দাদু নাতনির সম্পর্ক নয় – আমাদের মধ্যে দাদা -বোনের সম্পর্কটিই মুখ্য ছিল –তিনি একাধারে ছিলেন আমার খেলার সাথী , আমার দুস্টুমির দোসর ও আমার সকল আবদার -বায়না মেটানোর মানুষ। দাদা চলে গেছেন আজ ছাব্বিশ বছর হলো। আজও যেন আমি স্বপ্নে দাদার সাথে সেই শিশুকালের পার্কে খেলার মুহূর্তগুলি দেখতে পাই , “দোল দোল দুলুনি ” শুনতে পাই , আমাদের পালিত কয়েকটি রাখীপূর্ণিমার আনন্দের স্মৃতিতে চোখ আর্দ্র হয় – সে স্মৃতি কণামাত্র মলিন হয়নি – হবেও না কোনোদিন। 

তথাকথিত ভাই -বোনের সম্পর্ক ছাড়িয়ে আমার জীবনের এক অসমবয়সী বৃহত্তর নিবিড়তর সম্পর্কের এই অধ্যায়টি রাখীপূর্ণিমার পুণ্যতিথি উপলক্ষ্যে আমার প্রাণাধিক প্রিয় "দাদা" কে উৎসর্গ করলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics