চন্দ্রাবেশ
চন্দ্রাবেশ
এই ছোট্ট কাহিনীর উৎস একটি স্বপ্ন। আবার সেই স্বপ্ন অনুপ্রাণিত বাস্তবে ঘটে যাওয়া কতকগুলি পরস্পর সম্পর্কহীন টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে। সুতরাং এই সাহিত্যের অনুপ্রেরণা স্বপ্ন নাকি স্বপ্নারূঢ় বাস্তব - পাঠকগণ নিজ নিজ ভাবনানুসারে নিজেরাই নির্ণয় করে নেবেন।
বাস্তব ঘটনাগুলি অতি সাধারণ... এইরূপ - কোনো এক বছরে গ্রামবাংলায় বেড়াতে গিয়ে মাছধরার প্রতিযোগিতা দেখেছিলাম। নীল আকাশের নীচে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি পরিবেষ্টিত বেশ বড়ো একটি ঝিলে ডিঙি নৌকা চেপে মাছ ধরা চলছে। মাছ ধরে ছিপ থেকে খুলে চুবড়ি তে রাখা হচ্ছে। হৈহৈ আনন্দময় গ্রামীণ পরিবেশ।
ভ্রমণান্তে যথাসময়ে বাড়ি ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা ষষ্ঠ বর্ষীয় পুত্রকে নিয়ে রোজকার মতো পড়া পড়া খেলা। রোজই আমরা কিছু না কিছু নতুন বিষয় নিয়ে কথা বলি। আজ তাকে সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহগুলির নাম ও কিছু তথ্য দেবো। মানবচক্ষুর অন্তরালে দূর আকাশে ছড়িয়ে থাকা এক একটি মস্ত গ্রহ - সেই অসীম কুল কিনারাহীন মহাজাগতিক রহস্যের একটা ধারণা দেবার ইচ্ছা পুত্রের শিশুমন কে।
এইবার আমার কাহিনী শুরু।
কলকাতাবাসীরা অবগত আছেন - অধুনা কলকাতার পূর্বদিকে চিংড়িঘাটা ও রুবি হাসপাতালের মধ্যবর্তী এলাকায় একাধিক ভেড়ি অবস্থিত। সন্ধ্যাবেলা ভেড়ির দিকে কোনো আলোই থাকেনা.. রাস্তার আলো বা কখনো আকাশে চাঁদের আলোয় ভেড়ির জল অস্পষ্ট দেখা যায়।
তেমনি এক সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়কার ঘটনা। আলোকোজ্বল শহরের রাস্তা পেরিয়ে ভেড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ যেন আলোর রূপ বদলে গেলো। নির্জন প্রায়ান্ধকার ভেড়িগুলি যেন হঠাৎ অপরূপ মোলায়েম অথচ উজ্জ্বল এক6 স্বর্গীয় দ্যুতিতে উদ্ভাসিত। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ভেড়ির ধারে রীতিমতো ভিড়। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি - একি কান্ড - এ যে সত্যি সত্যিই চাঁদের হাট বসে গেছে। আকা
শে দৃশ্যমান অসংখ্য চাঁদ..তেরোটি তো আমি গুনলাম ই। কতকগুলি পূর্ণচন্দ্র, কোনটি অর্ধেক, কোনটি সিকিভাগ, কোনটি প্রায় নখের মতো, কোনটিতে গ্রহণ লেগেছে, কোনটির রং চটে গেছে, কোনটি উদীয়মান, কোনটি অস্তগামী। অতোগুলি চাঁদ মিলে আকাশ ও পৃথিবীতে হুলুস্থূল অবস্থা। সেই সবকটি চাঁদ ই প্রতিফলিত হচ্ছে ভেড়ির জলে -সে এক অভূতপূর্ব শোভা।
ভেড়ির ধারে জটলার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি সেখানে প্রতিযোগিতা চলছে - চাঁদ ধরার প্রতিযোগিতা! আকাশের চাঁদ জলে প্রতিফলিত হয়েছে - অত্যুৎসাহী চাঁদ ধরিয়েরা ছিপ হাতে চুবড়ি নিয়ে জলের পারে বসে গেছে। একটি একটি করে জল থেকে চাঁদ তুলে চুবড়ি তে রাখা হচ্ছে। সে এক অভূতপূর্ব প্রতিযোগিতা - যতক্ষণ না পৃথিবীর আকাশে আবার একটাই চাঁদ অবশিষ্ট থাকবে, ততক্ষণ চলবে চাঁদ ধরা। আমিও ছিপ নিয়ে বসে গেলাম - বারোটি চাঁদ উঠল আমার ভাগে ! আমার ঝুড়িভর্তি ঝলমলে চাঁদ !
এদের নিয়ে কি কর্তব্য বুঝে উঠতে পারিনি। মাঝেমধ্যে অমাবস্যার রাতে একটি দুটি বার করার ইচ্ছে মনে জাগে.. কিন্তু পৃথিবীর নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কজনই বা কিছু করতে পেরেছে? আমিও পারিনি। তাই আপাতত আমার চুবড়ি বোঝাই ডজনখানেক চাঁদ আলমারিতে রাখা আছে।
রাত্রিশেষে সকালের প্রথম আলো চোখে লেগে ঘুম ভাঙলো। দেখলাম অদূরেই রাখা রয়েছে পুত্রের বইটি - তাতে বৃহস্পতি গ্রহের তেরোটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ, পৃথিবীর নিরিখে চাঁদ ই বটে - আকৃতি ও নামসহ শোভা পাচ্ছে। বাংলার গ্রামীণ সেই মাছ ধরার দৃশ্য তথা পুত্রকে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন গ্রহের কথা বলার সম্মিলিত ফল আমার এই মায়াময় স্বপ্নটি।
চন্দ্রময় নিদ্রাবেশ কাটিয়ে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠলাম। বাস্তব ও কল্পনা মিশ্রিত স্বপ্নবেশি রূপকথারা মুহূর্তমধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেলো।
আমার কথাটি ফুরোলো। নটে গাছটি মুড়োলো।