Kingkini Chattopadhyay

Comedy Others

2  

Kingkini Chattopadhyay

Comedy Others

আকাশে..

আকাশে..

4 mins
465


আজ একটি বিশেষ সন্ধ্যাবেলার কথা বলবো। 


বর্ষা সবে ঋতুচক্রের পালকি চেপে বিদায় নিয়েছে - সদ্য আগত শরতের সন্ধ্যাবেলা, কালচে নীল আকাশে ছড়ানো ছিটানো মেঘের ভেলা , ইতিউতি তারার দল উঁকি মারতে শুরু করেছে সবে। গ্রীষ্মের সেই ভয়ানক তাপপ্রবাহের অবসান ঘটিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, শীতের কনকনানি আসতে ঢের দেরি আছে। আমি এসময়ে একাকিনী ছাদে থাকতে বরাবরই খুব পছন্দ করতাম আর এখনো করি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায় , আমার কোনো হুঁশ থাকেনা। সময়ের শুরু নেই শেষ নেই -আমার মন যেন এই পৃথিবীর বাইরে কোন সুদূর আকাশপ্রাঙ্গনে ওই নভোচর মহাজাগতিক বন্ধুগুলির সঙ্গে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। প্রকৃতিদেবীর রাত্রিকালীন সৌন্দর্য বরাবরই আমায় মুগ্ধ করে। এমনি এক সন্ধ্যার পটভূমিকায় আমার এই উপস্থাপনা। 

 

বেশ কয়েকবছর আগেকার কথা। কিছুদিন আগে থেকে টিভিতে ঘোষণা করা হচ্ছিলো যে সেদিন মঙ্গলগ্রহ নিজের আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর খুব নিকটে এসে পড়বে , তাই তাকে অনেক বৃহদাকারে পরিষ্কার দেখা যাবে। আকাশের কোন কোণে সন্ধ্যার কোন সময় থেকে রাত্রির কোন সময় অবধি কলকাতাবাসী মঙ্গলগ্রহ কে দেখবার সুযোগ পাবেন, সেই সমস্তই বারবার টিভিতে ও সংবাদপত্রে জানানো হয়েছিল। আমি অত্যুৎসাহী হয়ে মহাজাগতিক এই দৃশ্যের চাক্ষুষ সাক্ষী থাকার জন্য ছাদে মাদুর পেতে বসে গেছি সেই বিকেল থেকেই। যতক্ষণ মঙ্গলের দর্শন পাবো, প্রাণ ভরে দেখবো। 


সারাদিন ধরেই হালকা মেঘলা ছিল আকাশে, তাই উৎকণ্ঠায় ছিলাম সন্ধ্যায় হঠাৎ অতিরিক্ত মেঘের আকস্মিক সমাগমে এই মহাজাগতিক দৃশ্যটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া না হয়ে যায়। সূর্যদেব অস্ত গেছেন ঘন্টা দেড়েক হলো, দিনের শেষ রশ্মিটুকু মুছে যাবার পর পূব আকাশে রুপোর বড় থালার মতো ঝকঝকে দ্বাদশীর চন্দ্রদেব শোভাবর্ধন করেছেন আকাশের। প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো অবশেষে - এইবার দেখলাম তাকেও। 


চাঁদের কাছেই স্বমহিমায় ভাস্বর, হালকা লাল বর্ণের দীপ্তিময় গ্রহটি জ্বলজ্বল করছে। অন্যদিনের থেকে অনেক বড়, অনেক বেশি উজ্জ্বলরূপ নিয়ে সে আজ পৃথিবীবাসী কে অভ্যর্থনা করতে এসেছে। কতক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারিনা , কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পাবার সাথে সাথে মনে হলো এই অপরূপ দৃশ্য আমার সবাইকে ডেকে দেখানো উচিৎ -যারা দেখছেনা তারা জানেওনা কি দৃশ্য থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। হঠাৎ যদি আরো মেঘ এসে যায় তাহলে আর বেশিক্ষন দেখা যাবেনা। 


তৎক্ষণাৎ ছুটলাম নীচে। তড়বড়িয়ে দু -তিনটে করে 

সিঁড়ি টপকে নেমে এসে সবাইকে ডাকতে শুরু করলাম - মা মাসি পাশের বাড়ির কাকিমা, যে যেখানে ছিল সবাইকে জানাতে লাগলাম যে মঙ্গলগ্রহ দেখা গেছে, সবাই যেন দেখে ..এ দৃশ্য আর দেখবেনা হয়তো জীবনে। কয়েকজন ইতিবাচক সাড়া দিলেন, কেউ কেউ জানালেন অতো তাড়ার কিছু নেই, পরে দেখলেও চলবে।  


এতদূর অবধি সব ঠিক ছিল – এরপর পাশের বাড়ির কাকিমার থেকে যেটা শুনলাম তার জন্য একেবারেই তৈরী ছিলাম না –


“কোথায় দেখলি রে মঙ্গলগ্রহ? কোথায় দেখা যাচ্ছে? "


এ আবার কি প্রশ্ন – গ্রহ তারা কোথায় দেখা যাবে? বললাম “ কোথায় আবার – আকাশে !”


পাল্টা প্রশ্ন কানে আসলো , প্রশ্নকারিনীর গলার স্বরে অবাধ বিস্ময় – “আকাশে? কই না তো !”


আমার অন্তরাত্মা কাতর স্বগতোক্তি করে উঠলো - “যাহ এই কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো মেঘে ঢেকে গেছে ”। 


আবার পড়ি কি মরি করে ছাতে ছুটলাম দেখতে – না তো গ্রহটি যেখানে থাকার ঠিক সেখানেই আছে – আরেকটু মনে হয় উজ্জ্বল হয়েছে রংটা। 


নেমে এসে জানালাম – “না দেখতে পাচ্ছি তো এখনো। তুমি দেখতে পাচ্ছনা ?”


অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর এলো – “না রে ভালো করে দেখ – আকাশেই তো ?”


আচ্ছা ফ্যাসাদ তো – একই আকাশের নীচে, একই ছাতের তলায় পাশাপাশি বাড়ি অথচ আমি দেখছি, উনি দেখছেন না কিভাবে সম্ভব ?


আবার প্রশ্ন এলো – “ওরে বলরে কোথায় – কখন থেকে জিগ্যেস করছি। "


কাকিমার উপর রাগ হচ্ছিলো। ছাতে ওঠার কষ্টটি না করে হয়তো ওপাশের বারান্দা থেকেই দেখার চেষ্টা করছেন । আমি তিতিবিরক্ত হয়ে বললাম – “আকাশেই আছে খুঁজে নাও। নইলে এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। ”

 

“ও তাহলে তোদের বাড়িতে আসছে, আমার এখানে না। ”


আমার আরো অবাক হবার পালা - আরে আসবেটা কি ? মঙ্গলগ্রহ হেঁটেচলে বেড়ায়না বলেই জানি। পৃথিবীর এতো কাছে তো এসেছে, এবার কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কলিং বেল বাজাবে? উফফ অন্যকে দেখাতে গিয়ে আমারই দেখা মাটি হয়ে যাচ্ছে । 


বললাম “থাক – তোমার দেখে কাজ নেই - আমিই দেখি বরং। "


কাকিমা তখনো হাল ছাড়েননি – চিৎকার করে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে চলেছেন – “হ্যাঁ রে ঠিক বলছিস তো ? আকাশেই দেখবো তো ? কিন্তু অনেক্ষন ধরে খুঁজছি - আকাশে তো দেখছিনা রে – তখন খবর হচ্ছিলো এখন বিজ্ঞাপন হচ্ছে তো!”


খবর ? বিজ্ঞাপন? আকাশে ? ওহঃ হা ঈশ্বর !! কাকিমার না দেখতে পাবার আসল কারণটি বোঝবার পরে আমারই মাথায় তখন মঙ্গলগ্রহ সমেত আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ জানালাম – “টিভির ঠেলায় আসল আকাশকেই ভুলে গেছো কাকিমা ? আকাশ চ্যানেলের কথা বলছিলাম না গো – তোমার বাড়ির ছাতে গিয়ে মাথার উপর চেয়ে দেখ ..ওই টিভির আকাশ চ্যানেল না দেখে সত্যিকারের আকাশের দিকে একবার চোখ তুলে তাকাও। ”


পুরোনো কলকাতার লাগোয়া বাড়ি সব – আরো অনেকেই হয়তো আমাদের উচ্চগ্রামের কথোপকথন শুনছিলেন । এই মুহূর্তে একটি হাসাহাসির রোল উঠলো আশপাশ থেকে। আর সেই সঙ্গে সেই মুকুরতে একটি চরম ভয়ানক সত্য ও উদ্ঘাটিত হলো আমার সামনে। 


মঙ্গলের নয়নভোলানো উপস্থিতির নীচে নিজেকে প্রশ্ন করলাম - প্রযুক্তির ঠেলায় আমরা কি প্রকৃতি কে ভুলে যেতে বসেছি ? নিজের সুবিধার্থে মানুষেরই তৈরী প্রযুক্তিগত সভ্যতা এখন এমনই নখদন্ত খিঁচিয়ে প্রকট হয়ে আছে যে আকাশ বললে এখন মানুষের মনে আকাশ চ্যানেলের কথা আগে আসে ! আমাদের মাথার উপর ছড়ানো এই সীমাহীন অনন্ত বিশাল শামিয়ানটির কথা কি আমরা আসতে আসতে ভুলে যাচ্ছি? এ অর্বাচীনতার জন্য প্রকৃতিলক্ষ্মী কি আমাদের ক্ষমা করবেন কোনোদিন ?


রাত্রির আকাশের তারকাখচিত নিঃসীম চন্দ্রোজ্জ্বল চাঁদোয়াটিকে উদ্দেশ্য করে আকুল প্রার্থনা জানালাম - এই সত্যটি উপলব্ধি করার সুবুদ্ধি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হোক। সারাদিন টিভি মোবাইল আর ল্যাপটপে ঘাড় না গুঁজে থেকে দিনের মধ্যে অন্তত একটিবার কিছুক্ষনের জন্য হলেও যেন আমরা ক্লান্ত চোখদুটি তুলে তাকাই .. এতো দূষণ আর দুর্নীতির পরেও প্রকৃতি সুন্দরী ও মঙ্গলময়ী .. চারদেয়ালে আবদ্ধ থেকেও নীল আকাশের মাঝে মেঘের ভেলায় পাখির সাথে নিজের মনটিকে যেন আমরা অবাধে উড়তে দিই।


এখনো সময় আছে ..নিজেদের আর পরবর্তী প্রজন্মের সূক্ষ্ণ অনুভূতিগুলিকে নষ্ট হয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচাতেই হবে।  

 বহিঃপ্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখে আগামী কেও যেন শেখাতে পারি । আমরা যেন নিজেদের চোখদুটি আর মনটিকে প্রতিদিন কিছুক্ষনের জন্য হলেও প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী ভয়ানক দাসত্ব থেকে ছুটি দিতে পারি, প্রকৃতির উদার সান্নিধ্যে স্বাধীন হতে পারি, মুক্ত হতে পারি। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy