arijit bhattacharya

Horror Thriller

3  

arijit bhattacharya

Horror Thriller

চক্রব্যূহ

চক্রব্যূহ

15 mins
751



গ্রামের নাম বকুলপুর। পুরুলিয়া শহর থেকে দশ মাইল দূরে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে একটি ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। এত অপরূপ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে যেন মনে হয় কোনো সুনিপুণ চিত্রশিল্পীর হাতে আঁকা অনুপম মায়াবী ল্যান্ডস্কেপ। এক ঝলক দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।আর বিকেলে তো প্রকৃতিরাণী আরও অনুপমা হয়ে ওঠে। বয়ে যায় মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেওয়া ফুরফুরে হাওয়া।অস্তমিত সূর্যের রক্তিমতায় মনে হয় কেউ দিগন্তে এক মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে দিয়েছে।পাহাড়ের কোলে শাল পিয়ালের জঙ্গল অনন্ত শ্যামলিমা নিয়ে যেন কোনো স্বর্গীয় সঙ্গীত শোনায়। আর আছে পলাশ। বসন্তকালে লাল ফুলে ভরে যায় যেন মনে হয় সারা প্রকৃতির শরীরে কামনার আগুন জ্বলে উঠেছে।অরণ্যের শ্যামলিমা,পলাশের রক্তিমা ছাড়াও যেটা আছে সেটা হল এক অনন্য পাথুরে পরিবেশ যেটা বাংলার সবুজ শ্যামল পরিবেশের সাথে ঠিক মিল খায় না। যেমন রূপে অনন্যা এখানকার প্রকৃতি ,তেমনি সুন্দর এখানকার সহজ সরল আদিবাসী মানুষগুলি। না আছে তাদের মধ্যে কোনোরূপ যান্ত্রিকতা,না আছে তাদের মধ্যে কৃত্রিমতা। তারা সহজ-সরল,তারা প্রকৃতিমায়ের সন্তান। দিনে হাড়ভাঙা খাটুনি করা ,আর রাতে রুটি আর বাজরা দিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো -এভাবেই চলে তাদের জীবন। তারা পাথরকে পুজো করে ,পাথরকেই দেবতা বলে মানে। কিন্তু কিছুদিন হল এইসব মানুষদের মনে জন্ম নিয়েছে এক বিভীষিকা!


আগে ছিল বিহারের মানভূম,এখন হয়েছে আমাদের পশ্চিমবাংলার পুরুলিয়া।রাজ্য বদল হলেও খুব একটা পরিবর্তন আসে নি। তবে বর্তমানে ইলেকট্রিসিটি এসেছে। আদিবাসী ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে পিঠে বইভরা ব্যাগ ঝুলিয়ে এক ঝাঁক আলোকশিখার মতো স্কুলে যেতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা মেনেই তৈরি হয়েছে গ্রামের পাশে ঝাঁ চকচকে হাইওয়ে।সেই হাইওয়ের একদিকে পুরুলিয়া শহর,আরেকদিকে ঝাড়খণ্ড।মোটামুটি বলতে গেলে,পাথরের রাজ্যে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে।কিন্তু এক মাস হল এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তি নেই। এক অজানা আতঙ্কে কাঁপছে গোটা গ্রাম।

আতঙ্ক শুরু হয় আগের মাসের কুড়ি তারিখ,শনিবার দুপুরে। স্কুল থেকে দল বেঁধে পাহাড় জঙ্গলের গা বেয়ে ফিরছিল পড়ুয়ারা। গ্রামের কাছে এসেই তাদের চোখে পড়ল পরিবর্তন টা।আগে সোজা রাস্তা তাদের গ্রামে পৌঁছে দিত। কিন্তু এখন রাস্তা হয়ে গেছে দু ভাগ। এক ভাগ গেছে ডানদিকে ,মানে যেদিকে আছে অযোধ্যা পাহাড়ের মাঠাবুরু,আরেকটা রাস্তা গেছে বামদিকে মানে যেদিকে রয়েছে বাবলা আর ফণীমনসার ঝোপ আর পাহাড়ের গায়ে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। আর তাদের গ্রামের দিকে যাবার কোনো রাস্তাই নেই। চমকে গেল বাচ্ছারা!আগের দিনও তো রাস্তাটা সোজা তাদের বকুলপুর গ্রামে পৌঁছে দিয়েছে। তাহলে মাত্র একদিনে এতোটা পরিবর্তন! এ কি বাস্তব না পাহাড়ের ইন্দ্রজাল।বড়োদের কাছে তারা গল্প শুনেছে এখানে অরণ্যে দেবতা থাকেন। সেই দেবতা মানুষের ওপর ক্ষেপে গেলে তিনি তাদের এইভাবে বিভ্রান্ত করেন।আর এইভাবে অরণ্যে তারা পথ হারায়।


আশ্চর্যের ব্যাপার,এই বুড়ো লোকটা আবার কোথা থেকে এল। ষাট পঁয়ষট্টি বছর,রোগা,সাথে একটা পুরনো সাইকেল।পরণে নোংরা ফতুয়া আর আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজ আমলের ঢলঢলে হাফপ্যান্ট । ছেলেরা দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো লোকটা তার হলদে দাঁতগুলো বার করে অদ্ভূততভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে বলল,"এটাই তো পাহাড়ের মায়া। এই মায়াকে ছিন্ন করতে পারলে তবেই তোমরা বাড়ি পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু যাই হয়ে যাক না কেন,পিছনে একদম তাকানো যাবে না,আর পাথরের জগতে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে।"বলেই সাইকেল নিয়ে চলে গেল বুড়ো লোকটা,বলতে গেলে অদৃশ্যই হয়ে গেল। আর নিজের মনে মনে বাবলা ফণীমনসার ঝোপ ভেদ করে চলতে লাগল ছেলেমেয়ের দল।মনে মনে জপতে লাগল বোঙাদেবের নাম।


কিন্তু এ কি আলাদা এক জগৎ। চারপাশ যেন কে ক্যামেরার নেগেটিভ ফিল্টার করে এডিট করে দিয়েছে। সবুজ অরণ্য আর পাহাড়কে কালচে দেখাচ্ছে। দুপুর বেলা,আকাশে মেঘও নেই,কিন্তু দিনের আলো এতো মৃদু হয়ে গেছে কেন। মনে হচ্ছে যেন গোধূলি!এক অপার্থিব ফিকে নীলচে আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া, সেই হাওয়া ইহজগতের নয়,উঠে আসছে যেন নরকের অতল থেকে,চারিপাশ ভরে গেছে এক অপার্থিব হাসনুহানার গন্ধে,অথচ ধারেকাছে কোনো হাসনুহানা নেই। আর সহ্য করতে পারল না তারা। মা বাবার নাম ধরে চেঁচাতে লাগল,কান্নায় ভেঙে পড়ল।কিন্তু অরণ্যে রোদন,কেউ সাড়া দিল না তাদের কান্নায়। এ যেন আলাদা এক জগৎ।আকাশ কেমন অদ্ভূত গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে।


উড়ে বেড়াচ্ছে অনেকটা শকুনের মতো দেখতে কিছু পাখি। আশেপাশে শুধু কবর আর কবর। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তা,পৌঁছে দেবে তাদের নরকে।

না,সেইদিন আর গ্রামে ফেরে নি পড়ুয়া ছেলেমেয়ের দল। তাদের বাবা মা রা কতো কেঁদেছে,কতো খুঁজেছে পাহাড় জঙ্গলে,কিন্তু তাদের অস্তিত্বের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় নি। তারা যেন মুছে গেছে,জাস্ট মুছে গেছে। কেউ ইরেসার নিয়ে তাদের কে মুছে দিয়েছে বকুলপুরের চিত্রপট থেকে।কান্নায় ভেঙে পড়ল গোটা গ্রাম।

এর পরের ঘটনা ঘটল গ্রামের ঝিন্দারাম মুণ্ডার সাথে। ঝিন্দারাম শনিবারের দুপুরে ছুটি নিয়ে পুরুলিয়া শহর থেকে গ্রামে ফিরছিল। সামনের দৃশ্য দেখে চমকে গেল ঝিন্দারাম। রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে।কিন্তু এই রাস্তায় তো সে আগের দিনও পুরুলিয়ায় এসেছে। তখন তো রাস্তা একটাই ছিল। একদিনে এতোটা পরিবর্তন ।আচ্ছা,সে রাস্তা ভুল করে নি তো।এই তো একটা বুড়ো লোক,যেন হাওয়া থেকে উঠে এসেছে।আচ্ছা ,একে জিজ্ঞাসা করলে হয় না।

ঝিন্দারামকে অবাক করে বুড়ো লোকটা বলে উঠল যে ও রাস্তা ভুল করে নি ,দুটো রাস্তাই ওকে গ্রামে পৌঁছে দেবে,অবশ্য তার জন্য ওকে এই 'চক্রব্যূহ ' নামক খেলায় জয়ী হতে হবে।কিন্তু,থাকবে অনেক ফাঁদ, অনেক প্রলোভন। কিন্তু তাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে চলবে না। এই চক্রব্যূহ ভেদ করলেই পৌঁছানো যাবে গ্রামে।

তখনই ঝিন্দারামের কৌতুহলী নজর খুঁজে পেল সেই দৃশ্য, যা দেখতে অক্ষম হয়েছিল বাচ্ছা ছেলেমেয়েরা।বুড়োর গোড়ালি উল্টো,আর সেখানে বড়ো বড়ো লোমের গোছা। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হল না ঝিন্দারামের, সে বুঝতে পারল যে শয়তান এবার তাকে মারণখেলায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দু সপ্তাহ আগে স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে কি হয়েছে ,পরিষ্কার মনে রয়েছে ঝিন্দারামের । ছেলেমেয়েদের সেই দলে তার ভাইপোও ছিল। স্কুল থেকে বেরিয়ে তারা গ্রামে আর পৌঁছায় নি,নিখোঁজ হয়ে গেছিল। তাহলে এটাই কি সেই ফাঁদ!

বুড়োকে অবাক করে পুরুলিয়ার দিকে ছুটতে লাগল ঝিন্দারাম। পিছন থেকে ভেসে আসতে লাগল রক্ত জল করা বুড়োর অপার্থিব হাসির শব্দ।


--------------------------------------------------------------------

হাতিবাগানে নিজের বাড়িতে বসে ব্ল্যাক কফি খাচ্ছিল সুনীপ। বিকেল বেলা। কোলকাতা শহরে এখন অ্যাডভেঞ্চারার হিসেবে সুনীপের বেশ নাম হয়েছে। কোরবাতে দুর্জন সিং আর রূপকুণ্ডে তান্ত্রিক অঘোরীচণ্ডের সাথে সুনীপের ডুয়েলে সফলতা পাওয়ার সাথে সাথে সুনীপকে সবাই চিনে গেছে।পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে অসীম সাহসিকতার জন্য পুরস্কারও পেয়েছে,আবার প্রচুর ফলোয়ারও তৈরি হয়েছে।

এই সুনীপ সাহার কাছেই এখন সাহায্য চাইতে এসেছে সাঁওতাল যুবক ঝিন্দারাম।ঝিন্দারামের মুখ থেকে বিষয়টা পুরোপুরি শুনে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল সুনীপের কাছে। মনে পড়ল জিরো এনার্জি ইউনিভার্স বা ব্রহ্মাণ্ডের মোট শক্তি শূন্য হবার তত্ত্ব। হ্যাঁ,ডার্ক এনার্জি ওয়ার্ল্ড, বা এক অন্ধকার জগৎ। যেটা হুবহু আমাদের পৃথিবীর মতোই কিন্তু ডার্ক এনার্জি বা নেগেটিভ এনার্জি তে পূর্ণ।এর নেগেটিভ এনার্জি যদি আমাদের বিশ্ব বা ব্রহ্মাণ্ডের পজিটিভ বা ধনাত্মক এনার্জির সাথে যুক্ত করা হয় ,তাহলে নীট যোগফল হবে শূন্য।যেমন ভালো সত্ত্বা আর খারাপ সত্ত্বা মিলে একজন মানুষের মধ্যে বৌদ্ধিক ভারসাম্য তৈরি করে,তেমনই পজিটিভ আর ডার্ক ওয়ার্ল্ড এই সৃষ্টিতে ভারসাম্য তৈরি করে। এটা পদার্থবিদ্যারই কথা।

সুনীপের যেটা মনে হল কোনোভাবে মাঠাবুরুর এই অঞ্চলটাতে আমাদের এই পৃথিবীর সাথে ডার্ক ওয়ার্ল্ডের কোনো একটা লিঙ্ক হয়ে যায়। এই লিঙ্কটার নামই চক্রব্যূহ।যারা ঐ লিঙ্কে হারিয়ে যায়,তারা ঐ অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। এই জগতে আর ফিরতে পারে না। কিন্তু বাচ্ছাদের উদ্ধার সে করবেই। রূটকুণ্ডের পরে এটাই তার নেক্সট মিশন।


হাওড়া আদ্রা চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে পরের দিন সকালে পুরুলিয়া পৌঁছাল সুনীপ ঝিন্দারামের সাথে। একাই। বন্ধুদের জানিয়েছে কয়েকদিনের জন্য কোলকাতার বাইরে যাচ্ছে। হ্যাঁ,এটা তার একার মিশন। সেখানে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ট্রেকারে মাঠাবুরু। সেখান থেকে হাঁটা পথে যখন বকুলপুরে পৌঁছাল তখন সূর্যদেব অস্তাচলে ঢলে পড়েছেন। গোধূলির মিষ্টি এক আলো! সন্ধ্যা আগত প্রায়।শিয়াল আর ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে!

গ্রামবাসীদের সাথে আলাপ করল সুনীপ। একটা ব্যাপার দেখে অবাকই হল যে গ্রামবাসীরা কেউ বিশ্বাসই করছে না যে ,তাদের গ্রামের কাছাকাছি এরকম এক অদ্ভূত ইন্দ্রজাল থাকতে পারে।তাদের বিশ্বাস হয় ছেলেমেয়েগুলিকে হুড়ালে( এক ধরণের নেকড়ে) নিয়ে গেছে নয় মুণ্ডেশ্বরী নদীতে তারা ভেসে গেছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস হল না সুনীপের।কারণ হুড়ালে নিয়ে গেলে তাদের ক্ষতবিক্ষত আধখাওয়া মৃতদেহ আর ছিন্নভিন্ন পোষাক এই পাহাড় জঙ্গলে ঠিক পাওয়া যেত। আর নদীতে ভেসে গেলেও তাই। ঝিন্দারামের কথা অনুসারে খোঁজাখুঁজি তো এরা কম করেনি।

মোড়লের বাড়িতে রাত কাটানোর প্রস্তাব মনঃপূত হল সুনীপের। গভীর রাতে শুনতে পেল দূর থেকে ভেসে আসা এক অপার্থিব ক্রন্দনধ্বনি। সকাল হতেই ফ্রেশ হয়ে নড়েচড়ে বসল সুনীপ। আজ শনিবার। আজ বারবেলাতে আবার আবির্ভূত হবে চক্রব্যূহের ইন্দ্রজাল!

হ্যাঁ,সুনীপ ঝিন্দারামের কাছে শুনেছে একমাত্র শনিবার বারবেলাতেই চক্রব্যূহের ইন্দ্রজাল আবির্ভূত হয়।কারণ ঐ অভিশপ্ত বিকালের পরের দিন মানে রবিবার সকালে ঝিন্দারাম ওখানে গিয়েছিল। কোথায় আর রাস্তা দু'ভাগে ভাগ হয়েছে ,রাস্তা তো সোজাই তার গ্রামের দিকে যাচ্ছে। তাহলে কি আগের দিন সে ভুল দেখেছিল! কিন্তু আগের দিন সে তো মহুয়া খায় নি। সম্পূর্ণ হুঁসেই ছিল। অদ্ভূত বুড়োটাকে আর ওর কথাগুলি ঝিন্দারামের এখনো কানে বাজছে।"যে এই চক্রব্যূহে পথ হারায় ,সে না নিজের সময়ে ফিরতে পারে,না নিজের জগতে ফিরতে পারে।"

কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে ঝিন্দারাম গ্রামে ফিরে মোড়লকে সব জানায়। মোড়ল চিন্তিত হয়ে যোগাযোগ করেন ওঝার সাথে। ওঝা বলে,"দেবতা ক্ষুধার্ত হয়েছেন। এই চক্রব্যূহ হল দেবতার অভিশাপ।গ্রামের মানুষের কোনো অন্যায়ের ফলে দেবতা রুষ্ট হয়েছেন।" তিনি এও বলেন,ঈশ্বরপ্রেরিত কেউ আসবে খুব তাড়াতাড়ি এই গ্রামে,যে চক্রব্যূহের ইন্দ্রজাল ভেদ করে গ্রামের মানুষকে অভিশাপের হাত থেকে মুক্তি দেবে।


সকালবেলা আদিবাসীদের লোকনৃত্য দেখে মন ভরে গেল সুনীপের। এইসব উপজাতিদের সংস্কৃতি জনজীবন,ভাষা,লোকনৃত্য তাকে বরাবরই টানে। এখানে আসার আগে সাঁওতালদের নিয়ে পড়াশুনা করেছে সুনীপ।

ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিদের মধ্যে একটি হল সাঁওতালরা। মুণ্ডা জাতির অন্তর্ভুক্ত। আর্যরা ভারতে আসার আগে এরা থাকত ভারতের বৃহত্তম অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চল যেটা মধ্য ও পূর্ব ভারতে বিস্তৃত ,সেই দণ্ডকারণ্যে। এরা বরাবরই সৎ ,পরিশ্রমী আর সাহসী। আর্যরা এদের বলত রাক্ষস।ওদের উপাস্য দেবতা মারাঙ্গ বুরু বা যেই নাম অধিক প্রচলিত বোঙা। এখনোও ভারত ছাড়া নেপাল ও বাংলাদেশে সাঁওতালদের দেখতে পাওয়া যায়। উৎসব বলতে সোহরাই,বাহা,করম।

বেলা তিনটের সময় রওনা হল সুনীপ নিজের লক্ষ্যস্থলের দিকে। গ্রামের পাশেই সড়ক। চলে যাচ্ছে শাল শিমূলের অরণ্য ভেদ করে সোজা পুরুলিয়া থেকে ঝাড়খণ্ডের দিকে। সোজা চলে গেছে। তাহলে কি ঝিন্দারাম মিথ্যে গল্প ফাঁদছে!

তারপরই চোখের সামনে যা দেখল তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না বুদ্ধিদীপ্ত তাজা যুবক সুনীপ সাহা। এক নিমেষে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেল। নিমেষে বদলে গেল আশেপাশের প্রকৃতি। আর যেন শূন্য থেকে আবির্ভূত হল অদ্ভুত পোষাক পরা এক বৃদ্ধ।

বুড়ো লোকটা বলেছিল,"তুমি যদি সাইকেল করে এই রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পার,তাহলেই এই খেলায় তুমি বিজয়ী। কিন্তু একটা কথা মনে রাখ,আসে পাশে অনেক ফাঁদ পাতা রয়েছে। যাতে পা দিলেই অনন্তকালের জন্য নিজের সময় থেকে হারিয়ে যাবে তুমি। এটা এতটাই দুরূহ ,যে আগে কেউ সফল হতে পারে নি। জিতলে তুমিই হবে সেই প্রথম ব্যক্তি,যে সফলভাবে 'চক্রব্যূহ' থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।"

অবাক হয়ে গেল সুনীপ। রাস্তা আর শেষই হচ্ছে না। আকাশটা কেমন যেন লাল বর্ণ ধারণ করেছে! অদ্ভূত সুন্দর হাসনুহানার গন্ধে ঢেকে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর,যদিও আশেপাশে কোনো ফুলের নামগন্ধ নেই। ধূ ধূ মাঠ। এক অপার্থিব মৃদু নীল আলোয় ঢেকে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। বইছে হিমেল হাওয়া,এই হাওয়া কি উঠে আসছে নরকের কোন্ অতল গভীর থেকে।

সুনীপ বুঝতে পারল সে ডার্ক ওয়ার্ল্ডের লিঙ্কের মধ্যে প্রবেশ করেছে।ডার্ক ম্যাটার এখানেও নিজের মায়া দেখাতে শুরু করেছে। বাচ্ছারা ভগবান না করুন,যদি ডার্ক ওয়ার্ল্ডে চলে যায় তাহলে ওদের ফেরত আনা যাবে না। কিন্তু এখানে থাকলে সে মরণপণ চেষ্টা করবে। আর এই লিঙ্কটাকে ভেঙে দেবে। না,এই খেলায় সে জয়ী হয়ে ফিরবেই। এটাই তার অদম্য প্রতিজ্ঞা।

আশেপাশে কোথাও ডাকছে একপাল নেকড়ে । সুনীপ জানে এখানে কোনো নেকড়ে নেই,এ শুধু ডার্ক ওয়ার্ল্ডের মায়া।এরপর শুনতে পেল পেঁচার ডাক।না পেছন ফেরা যাবে না জানে সুনীপ। পেছন ফিরলেই সে হারিয়ে যাবে এই ধাঁধার মধ্যে।

আকাশটা কেমন যেন লাল হয়ে এসেছে। আকাশে ওগুলো কি উড়ছে। ওগুলোও কি মায়া,নাকি ডার্ক ওয়ার্ল্ডের জীব। পাখিগুলোকে দূর থেকে দেখে শকুন বলে মনে হয়। কিন্তু আকারে শকুনের থেকে অনেক বড়ো। চোখগুলো কেমন যেন ক্ষুধা আর হিংস্রতায় জ্বলছে। মুখ থেকে ধোঁয়াও বেরোচ্ছে। তাহলে এগুলোই কি উপকথার ড্রাগন!

না তাকে খুব শিগগিরি এই ফাঁদ থেকে বেরোতে হবে। নাহলে আজকে এই ড্রাগনের পাতের আইটেম সে হতে চলেছে। কিন্তু আর কতো দূর রাস্তা চলছে তো চলতেই। সে সাইকেল ভালোই জোরে চালাচ্ছে ,কিন্তু এই মায়াবী পথ শেষ হবার নামই নিচ্ছে না।

"এই পথ যদি না শেষ হয়",নিজের মনে মনেই হেসে উঠল সুনীপ।তখনই মনে আরেক ভয় দেখা দিল।আচ্ছা বুড়োটা মিথ্যে কথা বলে নি তো!কিন্তু এই ধাঁধা থেকে বেরোতে তাকে হবেই।কিন্তু সামনে পথ তো আর নেই। হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সুনীপ। হাতের ঘড়ি যে কখন থেমে গেছে,তা সে খেয়ালই করে নি।তখনও তিনটে দশ।অথচ ব্যাটারি তো গত পরশু সকালেই ভরেছে। ঠিকই আছে। অসুবিধা কোথায় হল!

সুনীপ বুঝতে পারল এখানে সময়ও থেমে যায়।কিন্তু সামনে আর কোথায় যাবে। আর পথের চিহ্নমাত্র নেই।সামনে মাটি যেন কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে সরে গেছে। আর সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে নক্ষত্র,উল্কা আর গ্যালাক্সি সমন্বিত কালো মহাকাশ।এবার কি করবে সুনীপ!

কিন্তু সুনীপ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে এভাবে এগিয়ে গেলে ডার্ক ওয়ার্ল্ডের মধ্যে প্রবেশ করতে হবেই তাকে। ড্রাগনগুলো হয়তো লক্ষ্য করেছে তাকে!ধেয়ে আসছে তার দিকেই । শূন্য খাদের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিল সুনীপ।


মায়া মায়াই থাকে,মায়া কখনো বাস্তব হয় না।অতল গহ্বরের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিল সুনীপ। ধেয়ে এল হিংস্র ড্রাগনগুলি। কিন্তু চোখের নিমেষে কোথায় মিলিয়ে গেল সেই অতল গহ্বর,সামনে ঝাঁ তকতকে রাস্তা।শূন্যে মিলিয়ে গেল মহাকাশ আর গ্রহ -নক্ষত্রের প্রহেলিকা। চিহ্ন রইল না কিছুর। তার দিকে গতিতে ধেয়ে আসা ড্রাগনগুলিও মিলিয়ে গেছে। সুনীপ বুঝতে পারছে যে, পরীক্ষার প্রথম রাউন্ডে সে পাশ করেছে।হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে।

সামনে আবার রাস্তা। চলছে তো চলেইছে। সুনীপের হাসি পেল,"এই পথ যদি না শেষ হয়........................".কিন্তু বাচ্ছাদের যে বাঁচাতেই হবে।

হঠাৎই গরম এক হলকা হাওয়া লাগল সুনীপের গায়ে । সামনে এক অদ্ভূত প্রাণী। না মানুষ,না জানোয়ার। মানুষ আর সরীসৃপের মাঝামাঝি এক জীব।লম্বা জীব বের করে সুনীপকে গ্রাস করতে চাইছে। এবারও ভয় পেল না সুনীপ। গতি বাড়াল সাইকেলের। বেশ জানে সে এই সব তাকে ভয় দেখানো ছাড়া তার আর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। জন্তুটার শরীর ভেদ করে এগিয়ে গেল সাইকেল। বেশ বুঝল সুনীপ। সেকেণ্ড রাউন্ডের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

পরিবেশের উত্তাপ আসতে আসতে বাড়ছে। কাছাকাছি কোথাও নেকড়ে ডাকছে। এ যেন পুরুলিয়ার ছোটনাগপুরের চিরাচরিত প্রকৃতি নয়। এই প্রকৃতির সাথে হুবহু মিল আছে পূর্ব ইউরোপের কার্পেথিয়ান পর্বতসঙ্কুল অঞ্চলের প্রকৃতি।

কিন্তু কি মুশকিল,রাস্তা তো সামনে আবার দুভাগ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে গেল সুনীপ। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হুবহু একই রকম দুই জন লোক। তার চেয়েও বড়ো আশ্চর্যের সেটা হল,এই দুইজনই হুবহু আগের বুড়ো লোকটার মতো । সামান্য একটু তফাৎ ছাড়া। একজনের চোখ ঘোলাটে,আরেকজনের চোখ নীলাভ,প্রখর দৃষ্টি।

নীলাভ চোখওয়ালা লোক বলল,"তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি সাহসী!কিন্তু এখন জানলাম তুমি বুদ্ধিমানও বটে। তুমি সত্যিই এই খেলা জেতার দাবিদার। সাবাস জানাই তোমায়।"

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সুনীপ ,নীরবতায় কাটল কিছু মুহূর্ত। তারপর সুনীপ কোমল অথচ দৃঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করল ,"কে তোমরা?"উত্তর এল "আমরা তোমায় চক্রব্যূহ ভেদ করার রাস্তা বলে দিতে পারি।এই দুটো রাস্তার মধ্যে একটা তোমাকে অভীষ্টের দিকে পৌঁছে দেবে ,আরেকটা রাস্তা তোমাকে পৌঁছে দেবে সোজা নরকে।" চমৎকৃত হল সুনীপ।তাহলে এই তাপ আর কিছুই নয়,নরকের আগুনের আঁচ। এই রাস্তা দুটোর মধ্যে একটা তাকে নিয়ে যাবে নরকে! খেলা তো কঠিন হতে শুরু করেছে ক্রমশ।

এবার সুনীপ বুঝতে পেরেছে এরা কে! এরা যক্ষ।এবার ঘোলাটে চোখওলা লোকটা বলল,"তুমি আমাদের কাছে সঠিক রাস্তা জানার জন্য একটাই প্রশ্ন করতে পার।একবারই যেকোনো একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করবে। এখানে ব্যঞ্জনা হল,আমাদের মধ্যে এর উত্তরে একজন সঠিক বলবে ,আরেকজন মিথ্যা বলবে। কিন্তু তুমি একজনের কাছে একবারই জিজ্ঞাসা করতে পারবে। দ্বিতীয়বার করলে বাচ্ছাদের মতো এই অন্ধকার জগতে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে।এবার ঠিক কর,তুমি আমাদের মধ্যে কার কাছ থেকে জানবে।"

চোয়াল দৃঢ় করে স্থিরভাবে চিন্তা করতে লাগল সুনীপ। প্রশ্ন বেশ জটিল এবার!নীল চোখওয়ালা লোক বলে উঠল,"কি হল!সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে। ভাবার জন্য আর কতোক্ষণ নেবে!"প্রশ্নকর্তাকে চমকে দিয়ে ঘোলাটে লোকওয়ালা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল এক অদ্ভূত প্রশ্ন,"আপনার সঙ্গীকে আমি যদি জিজ্ঞাসা করি,কোন্ রাস্তাটা ধরলে আমি সোজা নরকে গিয়ে পৌঁছাব!কারণ আমি নরকে যেতে চাই।" দুজন লোক পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল,তাহলে কি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এই প্রশ্নও ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা ডানদিকের রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করল। তাদের হতবাক করে সুনীপ সাইকেলে উঠে গতি নিয়ে ডানদিকের রাস্তা নিল। প্রতিপক্ষের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে দুজনেই হতবাক। আর সুনীপের মনে একরাশ আনন্দ। সে এখন খেলার দ্বিতীয় রাউন্ডে সফল হয়ে তৃতীয় রাউন্ডে প্রবেশ করেছে। কিন্তু নেকড়ের ডাক এতো কাছ থেকে ভেসে আসছে কেন!


একপাল নেকড়ের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাচ্ছে সুনীপ। আর কতদূর! পথ তো শেষ হবার নামই নিচ্ছে না। আচ্ছা সে পথ ভুল করে নি তো! উত্তাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নরকের দিকে চলছে না তো সে! ঐ তো সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে লেলিহান বহ্নিশিখা!যদি তার অন্তিম পরিণতি নরক হয়ে থাকে ,তাহলে হোক না। কিন্তু কে বলতে পারে যে,এই আগুনও মায়া নয়। সে জানে,অশুভ যতই শক্তিশালী হোক না কেন,সবসময় শুভ শক্তিই জয়ী হয়। আর বরাবরই তাই হয়ে এসেছে। যাই হোক,সেই লেলিহান বহ্নিশিখার ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিল সুনীপ। না পুড়ল না সে,একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস জুড়িয়ে দিল তার প্রাণ। চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল আগুন। সামনে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে চলেছে রাস্তা।

এ কি! রাস্তাটা মনে হচ্ছে শেষ হতে চলেছে। কিন্তু সামনে শুধুই কুয়াশা। এই শরৎকালে এত ঘন কুয়াশা কি করে এল,অবাক হয়ে গেল সুনীপ। আর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বুড়ো লোকটা। কোথা থেকে ভেসে আসছে কোনো ক্রুদ্ধ ক্ষুধার্ত জানোয়ারের এক অপার্থিব গর্জন। আর ধীরে ধীরে সেই ধ্বনি কাছে এগিয়ে আসছে।ভয় পেল সুনীপ এই প্রথমবারের জন্য। কিন্তু সে জানে যে,সে এখন খেলার শেষ রাউন্ডে প্রবেশ করেছে। এখন খেলা খুব কঠিন হবে,তার অশরীরী অপার্থিব প্রতিপক্ষ নিজের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাবে।

সুনীপের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বৃদ্ধ লোকটি। খেলায় প্রতিপক্ষকে অসম্মান বা ঘৃণা করা স্বাভাবিক। কিন্তু এ কেমন প্রতিপক্ষ যাকে সম্মান বা শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। সুনীপ শরীরী,সে অশরীরী।কিন্তু শরীরী হয়েও সে বেশি শক্তিশালী,বেশি সুনিপুণ। আগে কোনো মানুষই এই খেলায় এতদূর আসতে পারে নি। হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে,ভয়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে আর নয়তো বুদ্ধিবিভ্রমের ফলে যক্ষের হাতে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে।কিন্তু সবকটা স্তরেই তার প্রতিপক্ষ জয়ী হয়েছে। এ কি সাধারণ কোনো মানুষ না এর মধ্যে আছে অলৌকিক কোনো শক্তি,মাথার ওপর আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

চোখ বুঁজে মা বাবার কথা মনে করল সুনীপ।অনুভব করতে চাইল তাদের,অন্তর থেকে চাইল তাদের আশীর্বাদ।ছোটবেলা থেকেই তার মা বাবাকে সে ঈশ্বর বলে মেনেছে।

ওদিকে তার প্রতিপক্ষও সতর্ক। এখনি তাকে করতে হবে চরম আঘাত। সে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল,"শেষ ধাঁধা। আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেই তুমি রাস্তার শেষপ্রান্তে পৌঁছাতে পারবে। তারপর তুমি মুক্ত। কিন্তু তোমাকে আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে হবে।"চমকে উঠল সুনীপ। সে জানে তার জন্য চরম কঠিন কোনো প্রশ্ন অপেক্ষা করছে। কিন্তু সে এখন পাবে না গুগল এর সাহায্য।এই লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে। পারবে কি সে এই শয়তানী চক্রব্যূহ ভেদ করতে!উত্তেজনায় ঘামছে সে,শুকিয়ে আসছে তার গলা প্রবল উৎকন্ঠায়।

কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে বৃদ্ধ লোকটি বলল,"না কোনো কঠিন প্রশ্ন করব না। তোমাকে শুধু বলতে হবে ,আমি কে!"

যা বাবা,এটা আবার কেমন প্রশ্ন। চমকে গেল সুনীপ।বুড়ো লোকটা কে,তা সে জানবে কি করে!কিন্তু লোকটা যেন অন্তর্যামী। মৃদু হেসে বলল,"আমার মনে হয় তুমিই এই খেলার বিজয়ী হবার দাবি রাখ। তাই আমি তোমাকে খুঁজছিলাম।কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি আমি। এই পথের ,এই অন্ধকার দুনিয়ার শেষ পরিণতি আমিই। তাই আমি এই খেলার সবশেষে এসেছি।" সুনীপ বাকরুদ্ধ।বুড়ো বলল,"শুধু তাই নয়,তোমার ,তোমাদের এই দুনিয়ার শেষ পরিণতি আমিই। বলো,আমি কে?"

বিদ্যুতের মতো উত্তর খেলে গেল সুনীপের মনে। আরে,এই বুড়োটাকেই তো সে খেলার শুরুতে দেখেছিল। এই বুড়ো থেকেই শুরু হয়েছিল এই খেলা,আর এই বুড়োতেই শেষ হল। খেলার মাঝেও বুড়োটা এসে হাজির হয়েছিল ,আবার সেটা দুটো প্রতিরূপ নিয়ে-একজন ভালো,আরেকজন খারাপ। মানে একজন ধনাত্মক বা পজিটিভ,আরেকজন ঋণাত্মক বা নেগেটিভ।দুজনেই একরকম আর এই বুড়োটা তাদের যোগফল। ভাবতে থাকল সুনীপ,তাদের দুনিয়া আর ডার্ক ওয়ার্ল্ড এই বুড়োটা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আর ধ্বংসের পর এর মধ্যেই লীন হয়ে যাবে।

সুনীপ জেনে গেল যে,উত্তর কি হবে!ওদিকে বুড়োটার ঠোঁটের কোণে হাসি।সে বুঝতে পেরেছে,তার প্রতিপক্ষ হারতে চলেছে। না ,এবারও কেউ ভেদ করতে পারল না চক্রব্যূহ,উপরন্তু এর বলি হল এক অসাধারণ মানুষ।

কিন্তু বুড়োটাকে স্তম্ভিত করে আচম্বিতে বলে উঠল সুনীপ।"শূন্য। তোমার নাম শূন্য।ইউ আর জিরো।"

নিমেষে মিলিয়ে গেল কুয়াশা।সামনে দাঁড়িয়ে আছে একঝাঁক পাখির মতো স্কুলপড়ুয়া বাচ্ছা।তাদের দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র তারা স্কুল থেকে ফিরছে। মুখমণ্ডলে কিছুটা ভয়,কিছুটা ক্লান্তি আর কিছুটা বিস্ময়।সুনীপকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল,"বাড়ি যাব।"নিমেষে ব্যাপারটা বুঝতে পারল সুনীপ।সময় এখানে স্থির। তাই দু সপ্তাহ কেটে গেলেও এদের মনে হচ্ছে যে,এরা চক্রব্যূহের মধ্যে আজই বন্দি হয়েছে।

সুনীপকে অবাক করে বুড়োটা বলে উঠল,"সাবাস,ভেঙে দিয়েছ তুমি আমার চক্রব্যূহ।আমি এতদিন তোমাকেই খুঁজছিলাম। আজ আমি নিশ্চিত হলাম যে,এই গ্রহের সর্বোৎকৃষ্ট জীব মানুষ এখনো পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর হয়ে যায় নি। আজও তাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা,অপরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার প্রবণতা,বুকভরা সাহস আর উপস্থিত স্থিরবুদ্ধি।তুমি অনেক দূর যাবে।সামনে এই গ্রহের প্রয়োজন পড়তে পারে তোমাকে। তৈরি থেকো সেদিনের জন্য।"

যেমন শূন্য থেকে উপস্থিত হয়েছিল,তেমন করে শূন্যেই মিলিয়ে গেল বুড়োটা। আর নিমেষে বদলে গেল চারদিকের প্রকৃতি। মাঠাবুরুর ছোটনাগপুরের পরিবেশ ফিরল তার স্বাভাবিক রূপে।মাথার ওপর জ্বলন্ত দিবাকর।ঘড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। হাতঘড়ি দেখল সুনীপ,সাড়ে তিনটে বাজে। মানে তার চক্রব্যূহ ভেদ করতে জাস্ট কয়েক সেকেণ্ড লেগেছে!নিজের মনেই হাসল সুনীপ।

বাচ্ছাদের ফিরে পাওয়ায় গ্রামে অকাল উৎসব।মোড়ল চেয়েছিলেন সুনীপ কিছুদিন থেকে যাক। কিন্তু সুনীপ খুব ব্যস্ত,তাকে ফিরতে হবে কোলকাতায়। বিদায় নেবার সময় মোড়ল অশ্রুপূর্ণ চোখে কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞাসা করল,"আর কি দেখা হবে না আমাদের।"সুনীপ একরাশ হেসে বলল,"অবশ্যই হবে।নতুন কোনো সময়ে।আবার আমরা দেখা করব নতুন কোনো গল্প সাথে নিয়ে।"

সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror