Sayandipa সায়নদীপা

Tragedy Drama

4  

Sayandipa সায়নদীপা

Tragedy Drama

চক্রাবর্তন - প্রথম পর্ব

চক্রাবর্তন - প্রথম পর্ব

5 mins
1.1K


বন্দিনী           


অনেক্ষন ধরেই শব্দটা কানে আসছিল কিন্তু ঘুমের ঘোরে বাপন ঠিক ঠাহর করতে পারেনি প্রথমে, এতক্ষনে পরিষ্কার বুঝল কোথাও থেকে একটা মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে বাপন। তবে কি শ্মশানে কোনো মৃতদেহ আনা হয়েছে দাহ করার জন্য! কিন্তু তা কি করে হয়, এমনিতেই এই শ্মশান তো প্রায় পরিত্যক্ত, কদাচিৎ কোনো মৃতদেহই আসে দাহ করার জন্য। এখন তো আবার গুরুদেব আসার পর থেকে এই আশ্রমের আশেপাশে দাহ করা নিষেধ তাছাড়া এতো রাত্রে দাহ করতে আনলেও কোনো মহিলা সাথে আসবে বলে তো মনে হয়না! ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো সে, নাহ আওয়াজটা খুব স্পষ্ট, মানে এতটাই স্পষ্ট যেন এই ঘরের মধ্যেই কেউ কাঁদছে। বাপনের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। আজ তিন বছর ধরে গুরুদেবের সাথে এ শ্মশানে সে শ্মশানে ঘুরে তার কলিজা যথেষ্ট শক্ত হয়ে গেছে এতদিনে কিন্তু তাও মাঝে মাঝে কেমন যেন ভয় ভয় লাগে আজকাল। ভেতর থেকে আরেকটা সত্তা যেন বলতে চায় “পালা বাপন পালা।অনেক হয়েছে আর না।” কেন এমন হয় বাপন নিজেই বুঝতে পারেনা।


  মেয়েলি গলার কান্নার আওয়াজটা এখনো অব্যাহত। গুরুদেব আজ আশ্রমে নেই, তাই ভয়টা আর একটু বেশি করেই ঘিরে ধরছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, বাপনকে খুঁজতেই হবে এই কান্নার উৎস। ঘরের চারিদিকে চোখ চালাতে চালাতে দরজার দিকে চোখ যেতেই ওর দৃষ্টি আটকে যায়। কদিন আগেই পূর্ণিমা গেছে, চুঁইয়ে পড়া চাঁদের আলোয় বুঝতে অসুবিধা হয়না দরজার সামনে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকা ওই অবয়বটাই কান্নার উৎস। বাপন কি আজ শোয়ার আগে দরজা লাগায়নি! কে জানে ঠিক মনে পড়ে না, এখানে তো সবই যেন কেমন গোলমাল হয়ে যায়।

“ এই কে তুমি? এই?” বাপন প্রশ্ন করে কিন্তু কোনো উত্তর আসেনা, মেয়েটা একই রকম ভাবে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। বাপন উঠে দাঁড়ায়, মেয়েটার দিকে একটু এগিয়ে যায় কিন্তু কাছ পর্যন্ত যেতে ঠিক যেন সাহস হয়না। আবার প্রশ্ন করে, “ এই কে তুমি? কথা বলো।” 

মেয়েটা একই রকম ভাবে নিরুত্তর থাকে এবং কান্না চালিয়ে যায়। বাপন সাহস করে আরো একটু কাছে এগিয়ে যায় কাছে; আর তখনই মেয়েটা হঠাৎ তড়াক করে উঠে বাপনকে জড়িয়ে ধরে, বাপন থতমত খেয়ে যায়। “এই … এই কে তুমি? কি করছো এসব?” বাপন বিস্মিত কণ্ঠে বলে ওঠে। আরও কয়েক মুহূর্ত এই ভাবে কাটে তারপর মেয়েটা আস্তে আস্তে মাথা তুলে বাপনের দিকে তাকায়। বাপন চমকে ওঠে, “ছায়া!”

“হ্যাঁ,আমি। আমি আর পারছিনা বাপন, আমাকে মুক্তি দাও, আমাকে মুক্তি দাও।” ছায়া আবার ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে।

হতভম্ভ বাপন বলে, “তুমি এখানে কি করে এলে ছায়া? তুমি চলে যাও। গুরুদেব জানলে রক্ষা থাকবে না।”


“তোমার গুরুদেব তো আজ নেই।”


“ হ্যাঁ নেই কিন্তু তুমি তো জানো ওনাকে।”


“নাহ, আমি কিচ্ছু জানিনা, কিচ্ছু না। আমি শুধু জানি একমাত্র তুমিই পারো আমাকে এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিতে।”


“আ… আমি! কিভাবে?”


“তুমি তো গুরুদেবের কাছে অনেক কিছু শিখেছ, তুমি পারোনা আমায় ওই শয়তানটার হাত থেকে উদ্ধার করতে?”


“না, পারিনা। ছায়া বিশ্বাস করো আমাকে গুরুদেব এমন কোনো কিছু সেখাননি যার থেকে তোমাকে মুক্ত করতে পারি।”


“তুমি মিথ্যে বলছো।”


“না ছায়া, আমি সত্যিই জানিনা। যদি জানতাম এই গুরুদেবের কাছে পড়ে থাকতাম না।”

“ কি করতে তুমি?”


“জানিনা। তবে নিজে স্বাধীন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করতাম। ছায়া শুধু তুমিই বন্দি নও এখানে, বন্দি আমিও। শুধু শেকলটা আলাদা।”


“তুমি যদি কোনোদিনও মুক্তি পাও আমায় মুক্ত করবে বাপন? বিনিময়ে যা চাইবে তাই দেব। আমি শুধু এখান থেকে মুক্তি চাই। আমার ভীষণ কষ্ট হয়, ভীষণ।”


চাঁদের আলো ছায়ার মুখে এসে পড়ছে, বাপন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। এত সৌন্দর্য বাপন এই পঁচিশ বছরের জীবনে আগে কখনো দেখেনি। ছায়াকেও এতো কাছ থেকে এত ভালো করে ও এই প্রথম দেখছে। ছায়ার ফর্সা হাতের তালু এখনো বাপনের বুক স্পর্শ করে আছে। বাপনের বুকে আলোড়ন শুরু হয়। আদিম রিপু গ্রাস করতে শুরু করে ওর চেতনাকে, নিজের বলিষ্ঠ দুহাতের বন্ধনীতে জড়িয়ে ধরে ছায়ার কোমর। ছায়ার নরম শরীরে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে।


আশঙ্কা


“বাপন… এই বাপন … ওঠ না ছোঁড়া… মরে গেলি নাকি?”

দরজার বাইরে থেকে আসা হাঁক ডাক আর ক্রমাগত দরজা ধাক্কানোর আওয়াজটা গভীর ঘুমে অচেতন বাপনের মস্তিষ্কের কোষে কোষে পৌঁছাতে একটু সময়ই লাগে। ঘুম ভাঙার পর নিজের সম্পূর্ণ চেতনায় ফিরতেই বাপন হুড়মুড়িয়ে গিয়ে দরজা খোলে। যা ভেবেছিল তাই… গুরুদেব রক্ত চক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টি তে। বাপন দরদর করে ঘামতে শুরু করে। 

“কাল রাতে কি করছিলি?” বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন গুরুদেব।

“আজ্ঞে কিছু না তো।”


“সত্যি কথা বল।”

গুরুদেবের গলার স্বর আগের মতোই গম্ভীর। বাপন মাথা চুলকতে শুরু করে, কাল রাত্রের কথা ওর এখন মনে পড়ছে বটে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না সেটা স্বপ্ন না বাস্তব ছিল। মনে তো হচ্ছিল যেন সব সত্যি, ছায়ার স্পর্শ যেন এখনো ওর শরীরে লেগে কিন্তু তা কি করে সম্ভব! ছায়া কি করে আসবে তার কাছে! অনেক সময় হয় আমাদের স্বপ্নও এমন জীবন্ত ভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয় যে ঘুম ভাঙার পর বাস্তবের সাথে তার পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে; বাপন এখন ভেবে নেয় কাল রাতে সেরকমটাই হয়েছিল তার সাথে।

“কি রে ছোঁড়া মুখে কথা ফুটছেনা কেন?” গুরুদেবের স্বরে তাঁর ক্রোধ স্পষ্ট।


“না গুরুদেব সত্যি বলছি কাল রাতে হেভি ঘুমিয়েছি। আর কিচ্ছুটি করিনি।”


“তাই?”

গুরুদেবের গলার স্বরে বাপনের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে, সে ভেবে পায়না গুরুদেব তাকে হঠাৎ এভাবে জেরা করছেন কেন!


“হ্যাঁ।”


“কাল রাতে এখানে কে এসেছিল বাপন?”


বাপন চমকে ওঠে কিন্তু কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয় , “কেউ না তো।”


“সত্যি কথা বল।”


“আমি সত্যি কথাই বলছি, আপনি বিশ্বাস না করলে কি করবো?”


“বাপন !”


“মাফ করবেন গুরুদেব, আমি আজ তিন বছর আপনার সাথে আছি, আপনার সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছি আর আপনি আমায় এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না!”


“বিশ্বাস! হাঃ হাঃ হাঃ … এই লাইনে বিশ্বাস শব্দটা চলে না রে ছোঁড়া। তা ভালোয় ভালোয় বল কাল কে এসেছিল?”


“আপনি যতবার শুধোবেন ততবারই একই উত্তর পাবেন কারণ কাল কেউ আসেনি।”


“নিশু ডোম তাহলে কাল তোকে কার সাথে কথা বলতে দেখলো?”


“নিশু! আমি জানিনা। গুরুদেব আপনি ওই মাতালটার কথা শুনে আমাকে অবিশ্বাস করছেন! ওই নিশু রাতে আর নিজের মধ্যে থাকে! মদের ঘরে বেঁহুশ পড়ে থাকে আর সে কি না কি দেখলো আর আপনি ….”


“আচ্ছা আচ্ছা। তুই যা এখন। তোর কাজ কর গে যা।”


বাপন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কিন্তু তার মনের অস্বস্তি দূর হয়না। নিশু কাল কি দেখলো! কাল কি সত্যিই সব স্বপ্ন ছিল!


   বাপনের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন গুরুদেব। তার মনটা অজানা শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই তার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে কিন্তু এই কটা দিনই যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বাপন তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো! গুরুদেব এ আশঙ্কা মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারেননা। কিন্তু কি করবেন তাঁর যে বাপনকে দরকার। বাপনের মূল প্রয়োজন যদিও মিটে গেছে কিন্তু এই মুহূর্তে বাপনকে আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দেওয়াও তাঁর কাছে বিপজ্জনক। সত্যি বলতে তাড়াবার কোনো কারণও তো ঘটেনি। নিশু ডোম সত্যিই রাত্রে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তার কথাকে বেশি গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো।


ক্রমশ...



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy