চিন্তাহরণ
চিন্তাহরণ
প্রতুল ভাবতেই পারেনি যে চাকরিটা এভাবে যাবে। এমনকি প্রতুলের বাড়ির লোকেরাও না। প্রতুল একটি ফুড ডেলিভারি সংস্থার সাথে যুক্ত ছিল। বাড়িতে, অফিসে অর্ডার করা খাবার পৌঁছে দিত। কোভিডের ফলে অর্ডারের সংখ্যা কমে আসলেও, তাকে যে তার চাকরি খোয়াতে হবে তা কখনই ভাবেনি। হঠাৎ একদিন বস অফিসে ডেকে পাঠায় এবং বলে, ‘কাল থেকে তোমায় আর কাজে আসতে হবে না। আমরা এখন লোক ছাটাই করছি। ব্যাবসার অবস্থা ভালো না। তোমার যা পাওনা আছে তা নিয়ে নিও আজ যাওয়ার আগে’। প্রতুলের মাথায় যেন বাজ পড়ে। প্রতুলের বাড়িতে বউ-বাচ্চা রয়েছে। চাকরি ছাড়া চলবে কীভাবে? প্রতুল ভেবে পায়না কি করবে? বাড়িতে জানানোর পর বউও চিন্তিত হয়ে পড়ে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
পরের কয়েকটা মাস প্রতুল বিভিন্ন ধরনের কাজ করে অর্থ উপার্জনের জন্য। কখনও সে গ্যারাজে গাড়ি সারাবার কাজ নেয়, আবার কখনও ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনও কাজই বেশিদিন টেঁকে না। তার কারণটাও সে বুঝতে পারে। কারন ওর কোনও বিষয়েই পারদর্শিতা নেই। তাই কোনও কাজই ভালোভাবে করতে পারেনা।
যেটুকু টাকা জমানো ছিল তা ফুরিয়ে গেলে, বউ-বাচ্চাকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে আসে। বাড়িতে কিছুদিন একা থাকার পর প্রতুল ঠিক করে এই জীবন আর রাখবে না। বাড়ির সামনের বড় ব্রিজটা থেকে ঝাঁপ মেরে জীবন শেষ করবে ঠিক করে নেয়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। সেদিন রাতেই ব্রিজের সামনে গিয়ে হাজির হয়। ঠিক যে মুহূর্তে ঝাঁপ দিতে যাবে, তখনই একটা কালো রঙের গাড়ি প্রতুলের সামনে এসে ব্রেক কষে দাড়ায়। গাড়ি থেকে একজন লোক বেড়িয়ে আসে এবং প্রতুলের উদ্দেশে চিৎকার করে বলে ‘দাড়াও প্রতুল’।
লোকটির চেহারা এবং পোশাক দেখে বোঝা যায় হোমরা-চোমরা গোছের কেউ একজন। কিছুটা এগিয়ে এসে লোকটি নিজের পরিচয় দেয় এবং করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। পরিচয়ে তিনি বলেন তার নাম তিলক দত্ত এবং পেশায় একজন বিল্ডিং কনস্ট্রাক্টর। পুরো ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক যে প্রতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
‘কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনলাম না!’, প্রতুল খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলে।
‘তোমার আমাকে চেনার কথাও না। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি’, তিলকবাবু বেশ দৃঢ় স্বরে বলেন।
প্রতুল বুজতে পারে তার আর আজ আত্মহত্যা করা হবে না। প্রতুলের মনের কথা তিলকবাবু বুঝতে পেরে যায়।
‘তোমাকে ঝাঁপ দেওয়া থেকে থামালাম তার কারন এই কাজটা তোমার জন্য নয়’, তিলক দত্ত কথাটি বলে হাসতে থাকে।
‘আপনি জানেন যে আমার কাজ নেই? বউ-বাচ্চাকে খাওয়াতে পারছিনা’।
‘জানি।তোমার সংসারের হাল ফেরানর জন্যই আমি তোমার কাছে এসেছি’। তিলক দত্ত কিছুটা জোর গলায় কথা গুলো বলে।
প্রতুল কিছুটা আমতা আমতা করে। শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, ‘কিন্তু, কিভাবে’?
তিলক দত্ত একবার চারপাশটা দেখে নেয়। তারপর বলে ‘সেটা এখানে বলা যাবে না। তোমাকে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হবে’।
প্রতুল কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর গাড়িতে উঠে বসে। গাড়িতে যাওয়ার সময় কেউ কোনও কথা বলেনা। প্রতুলও ভাবতে থাকে কি এমন কাজ যে রাস্তায় বা গাড়িতে বলা যাবেনা।
গাড়ি একটি তিনতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। বাড়িটি শহর থেকে একটু দূরে। বাড়ির ভিতরের আতিশয্য দেখে প্রতুল আশ্চর্য হয়ে যায়। আরামের যা যা উপকরন থাকতে পারে তা সবই রয়েছে। তিলকবাবু প্রতুলকে বাড়ির নিচে একটি গুপ্তঘরে নিয়ে যায়। নিচে নামার সময় প্রতুল ভাবতে থাকে কি এমন কাজ যে তার জন্য গুপ্তঘরে যেতে হচ্ছে।
ঘরটিতে পৌঁছে তিলকবাবু একটি চেয়ারে বসে এবং প্রতুলকে উল্টোদিকের চেয়ারে বসার জন্য অনুরোধ করেন। প্রতুলও তিলকবাবুর কথা মতন চেয়ারে বসে পড়ে এবং দুজনে মুখোমুখি কথা বলতে শুরু করে।
‘আমার তোমাকে চাই তার কারন আমি তোমাকে অনেকদিন ধরেই নজর রাখছি। নজর রাখছি তোমার কাজের ওপরও। তুমি যে নিষ্ঠার সাথে কাজ কর, তা আজকের দিনে দেখা যায়না’, তিলকবাবু বলে।
‘কিন্তু আমি কোনও কাজ টিকিয়ে রাখতে পারছিনা’। প্রতুল খেদোক্তি করে।
‘তার কারন তোমায় কেউ তোমার মনের মতন কাজটি দেয়নি’।
‘আমার মনের মতন কাজ’? প্রতুল প্রশ্ন করে।
‘হ্যাঁ। আমি তোমায় তোমার মনের মতন কাজ দেবো’, তিলক দত্ত জানায়।
‘কিন্তু আমার লেখাপড়া তো বেশি নয়। আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারব’? প্রতুল জানতে চায়।
‘লেখাপড়া বিশেষ লাগেনা এই কাজে। যা লাগে তা আমি শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবো’।
‘কাজটা কি’? এতক্ষণে প্রতুল জানতে চায়।
‘চিন্তাহরণ’। তিলকবাবু গলার আওয়াজ খানিকটা নামিয়ে বলে।
এমন কাজের নাম প্রতুল জন্মেও শোনেনি। প্রতুল সে কথা তিলকবাবুকে জানায়ও। তিলক দত্ত প্রতুলের অবস্থা বুঝতে পেরে সবিস্তারে বলতে শুরু করে।
‘তোমাকে লোকের চিন্তা ধরে করে আনতে হবে’।
‘কি চিন্তা? কার চিন্তা? চিন্তা কিভাবে ধরা যায়?’ এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসে প্রতুল।
তিলকবাবু এবার খুলে ব্যাপারটা বলতে শুরু করে।
‘তোমাকে একটা যন্ত্র দেওয়া হবে। যন্ত্রের ব্যাবহারও শিখিয়ে দেওয়া হবে। তোমার কাজ হবে কিছু লোকের চিন্তা সেই যন্ত্রের সাহায্যে হরণ করা’, কথাগুলি তিলকবাবু বলেন এক নিঃশ্বাসে।
‘এরকম কাজ হয় নাকি? এত চুরি করার মতন’, প্রতুল বলে।
চুরি শব্দটা শুনে তিলকবাবু চুপ করে যায়। কোনও কিছু বলেনা। এর মাঝে, একটি লোক এসে গ্লাসে পানীয় রেখে চলে যায়। প্রতুল কি করবে বুঝতে পারেনা। প্রতুল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘এত লোক থাকতে আমায় কেন’?
‘তোমার কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং যে ধৈর্যের সাথে কোনও কাজ করো তা আমায় অবাক করেছে। তাছাড়া তোমার চেহারা খুবই সাধারন। তুমি খুব সহজেই ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পারবে’, তিলকবাবু কথা শেষ করে পানীয়তে চুমুক দেয়।
‘কিন্তু যদি ধরা পড়ে যাই? তাহলে পুলিশ-কাছারি হবে না তো’, প্রতুলকে কিছুটা উদ্বেগের সাথেই কথা গুলো বলে।
‘এই যন্ত্র আমি বিদেশ থেকে আনিয়েছি। ভারতের লোক এখনও এর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয়। তাই ভয়ের কোনও কারন নেই’, তিলক বাবু কথা গুলি বলে মুচকি হাসে।
সব শুনে প্রতুল মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে কাজটা সে করবে। এই মন্দার বাজারে একটা কাজ পাচ্ছে এটার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?
‘কত মাইনে পাব’, প্রতুল জানতে চায়।
‘৫০০০০ টাকা’।
‘এক বছরে’?
‘না প্রতি মাসে’, তিলক দত্ত বেশ জোরের সাথেই বলে।
এই কথা শোনার পর প্রতুল আর দেরি করে না। প্রতুল ভাবতেই পারেনা এরকম একটা কাজের জন্য কেউ এত টাকা দিতে পারে। প্রতুল কাজের জন্য রাজি হয়ে যায়।
প্রতুল রাজি হয়ে যাওয়াতে, তিলকবাবু প্যান্টের পকেট থেকে একটি টিনের চারকোনা কৌটো বার করে এবং প্রতুলের হাতে তুলে দেয়।তিলকবাবু যন্ত্রটার নাম রেখেছে থ্যাচার। ইংরেজি শব্দ থট এবং ক্যাচার মিশিয়ে নামটি রেখেছেন। যন্ত্রটি খুলে প্রতুল দেখতে পায় তার ভিতরে পেন্সিলের শিষের মতন কতগুলি লম্বা লম্বা সাদা রঙের বস্তু। চিন্তা ঢুকে গেলে সেগুলি কালো রঙের হয়ে যায় এবং সাদা কাগজে ঘষলে তা থেকে শব্দ তৈরি হয় তা আসলে কোনও একটি মানুষের চিন্তা।
প্রতুলের কাজ হবে, তিলকবাবুর দেওয়া নামের লিস্ট থেকে লোকের নাম খুঁজে তার আসে পাশে থাকা এবং যন্ত্রের বোতাম টিপে চিন্তা হরন করে নেওয়া। পেন্সিলের শিষের মতন বস্তুগুলি কালো হয়ে গেলে তা তিলকবাবুর কাছে তুলে দেওয়া।
প্রতুল পরের দিনই কাজ শুরু করে দেয়। তিলকবাবু প্রতুলকে একটি লিস্ট দেয়। প্রতুলও লিস্টে থাকা লোকেদের কাছাকাছি থাকা শুরু করে দেয়। কখনও পাগল সেজে আবার কখনও ভিখারির বেশে তাদের আসে পাশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। প্রতুল তখনই চিন্তা সংগ্রহ করতে পারে যখন সে লোকগুলির কাছে যেতে পারে। তার ফলে প্রতুলকে বেশিরভাগ সময়টা রাস্তায় কাটাতে হয়। কারন যে সকল লোকেদের চিন্তা সংগ্রহ করতে হয়, তাদেরকে হাতের কাছে পায় প্রতুল একমাত্র রাস্তাতেই। তারা বেশিরভাগ সময়েই অফিস বা বাড়ির ভিতর থাকে।
কিছুদিন কাজ করার পড়ে প্রতুল বুঝতে পারে যে যাদের চিন্তা সে সংগ্রহ করে আনে তারা আসলে তিলকবাবুর ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী। এইসব লোকেদের চিন্তা জেনে তিলকবাবু তা নিজের ব্যাবসায় কাজে লাগায়। প্রতুলের সংগ্রহ করা চিন্তাগুলি আসার পর থেকে তিলকবাবুর ব্যাবসায় উন্নতি শুরু হয়। তিলক বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের খুব সহজেই পরাজিত করতে থাকে।
কিন্তু তিলকবাবু এতে খুশি হয়না। যেহেতু ব্যাবসায়ি মানুষ, তাই আরও চাই। অল্পতে খুশি থাকতে পারেনা। তিনি ভাবতে থাকেন কি উপায়ে আরও বেশি পরিমানে চিন্তা সংগ্রহ করা যেতে পারে। শেষে প্রতুলের মাথাতেই চিন্তাটা আসে। প্রতুল ঠিক করে সে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। নিজেকে একজন গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আসল উদ্দেশ্য হল, সমাজের ধনী এবং প্রতিষ্ঠিত লোকেদের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের চিন্তা চুরি করা।
তিলক দত্ত প্রতুলকে একজন গুরুর কাছে পাঠায়। এক বছরের মধ্যেই প্রতুল একজন গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তিলক দত্তও বিজ্ঞাপনের পিছনে অনেক খরচ করে। কিছুদিনের মধ্যেই তিলক দত্তের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে একে প্রতুলের কাছে এসে হাজির হয়। তাদের প্রতুলের কাছে আসার একটাই উদ্দেশ্য- যে ভাবেই হোক ব্যাবসায় তিলক দত্তর মতন সফল হওয়া।
প্রতুল, যার বর্তমান নাম অতুলানন্দ, সে বিভিন্ন লোককে অনেক উপদেশ দেয় কি ভাবে ব্যাবসায় সফল হওয়া যায়। উপদেশ বাদে যেটি দেয় তা হল একটি করে থ্যাচার যন্ত্র। প্রতুলের কথায় মন্ত্রপূত যন্ত্র। প্রতুলের আদেশ থাকে ভক্তদের প্রতি যে, যন্ত্রটিকে সব সময় নিজের কাছে চালু অবস্থায় রাখা। প্রতি মাসে একবার করে দর্শন দিতে থাকেন ভক্তদের জন্য প্রতুল। তখনই পুরনো থ্যাচার পালটে নতুন থ্যাচার দেওয়া হয়। পুরনো থ্যাচার খুলে তিলকবাবু তার প্রয়োজনের চিন্তা সংগ্রহ করেন এবং শিষের মতন বস্তুগুলি ফেলে দেন। মাঝে সাঝে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাবসাতে ছোটখাটো সাহায্যও করেন যাতে তাদের প্রতুলের ওপর বিশ্বাস থাকে। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা কখনই ব্যাবসাতে তিলক দত্তকে টপকাতে পারে না।
তিলক এবং প্রতুলের এই জঘন্য ব্যাবসা দিব্যি চলছিল। কিন্তু ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে যখন পুলিশ কমিশনার একদিন প্রতুলের কাছে হাজির হয় একজন দর্শনার্থী হিসেবে। পুলিশ কমিশনার তার আসার কারন হিসেবে বলে সে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছে না। তারও একটি যন্ত্র চাই। কিছুটা দোটানায় থাকলেও, প্রতুল একটি থ্যাচার দিয়েই দেয়। তারও লোভ হয় পুলিশ কমিশনার কি চিন্তা করে তা জানার।
একমাস পড়ে পুলিশ কমিশনার এসে হাজির হয়। মুখ-চোখ দেখে বোঝা যায় যে তিনি বেজায় খুশি। জানান যন্ত্রে দারুন কাজ হয়েছে। পুরনো যন্ত্র জমা দিয়ে নতুন যন্ত্র নিয়ে চলে যান। এদিকে তিলক দত্ত এবং প্রতুল দুজনেই উৎসুক, পুলিশ কমিশনারের চিন্তা জানার জন্য।
পুরনো থ্যাচার নিয়ে তিলকবাবু এবং প্রতুল তিলকবাবুর গুপ্তঘরে প্রবেশ করে এবং শিষের মতন বস্তুগুলিকে ঘষতে থাকে। যত পেন্সিলের শিষের মতন বস্তু গুলো তিলকবাবু কাগজে ঘষতে থাকেন, দুজনে তত শিহরিত হতে শুরু করে। পুলিশ কমিশনারের চিন্তার মধ্যে রয়েছে কি ভাবে তিলক দত্ত এবং প্রতুল লোকেদের চিন্তা চুরি করেছে। পুলিশ কমিশনারের চিন্তার ভিতর এও রয়েছে কিভাবে তাদের আটক করবে। তিলক দত্ত এবং প্রতুল চিন্তা করতে থাকে কি ভাবে তারা পালাবে। তখনই দরজায় ধাক্কা। ভিতর থেকে প্রতুল জিজ্ঞেস করে, ‘কে’? বাইরে থেকে উত্তর আসে, ‘পুলিশ’।
