ছায়ানট ত্রিশতম পর্ব
ছায়ানট ত্রিশতম পর্ব
একটি বছর কেটে গেল আশায় আশায় । সেই প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে আজ ।
জেল থেকে ছাড়া পেলেন বিপত্তারণ এবং তক্ষশীলা দেবী। তাঁদের রিসিভ করতে এসেছেন পরিবারের সবাই।
বাদ যাননি রসময় বাবু, প্রভুদাস বাবুও । রমাদি জেলরের হাত থেকে তাঁদের গ্রহন করল । পাশে রজনীকান্ত বাবু।
আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন হয়েছে ওদের দুজনের। বিপত্তারণ বাবুর আগেকার কাঁচাপাকা চুলগুলো আরও পরিণত হয়ে সাদায় ছেয়ে গেছে । তক্ষশীলা দেবীর উজ্জ্বল ত্বক কুঁচকে গেছে । মাথায় সিঁদুর পরেছেন । লালপেড়ে গরদের শাড়ি এনেছিল রমা । পরিয়ে দিয়েছে।আর বিপত্তারণ বাবুকে ধুতি , পাঞ্জাবি আর একটা খদ্দরের চাদর দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে । যেন নতুন বিয়ে করে ঘরে আসছেন ।
অফিসায়াল ফরমালিটি শেষ করে তাঁরা যখন রাজপথে এসে দাঁড়ালেন ডক্টর বলের গাড়ি এসে থামল তাঁদের সামনে ।
ডক্টর বল বললেন - আজ মুক্তি পাবেন জানি। তাই এলাম দেখা করতে । আপনারা তো সোজা আপনাদের গ্রামের বাড়িতে চললেন ।
বিপত্তারণ বাবু রমার হাত ধরে বললেন - ও বৌমা ! হাড়মাসড়া যাবে নাকি ?
রমা হাসল । বিপত্তারণ বাবু বললেন - না মা . ওখানে আর কোনদিন যাব না । গাঁয়ের মোড়ল ছিলাম; লোকে কত গণ্যিমান্যি করত - এখন তো দেখলেই থুতু ফেলবে । আর সে ধাক্কা আর নিতে পারব না ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - আমাদের বরং কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিও মা । আর কোন অশান্তি হবে না ।
রমাদি বলল - তোমাদের কোথাও যেতে হবে না ।
রসময় বাবু, প্রভুদাস বাবু, এবং রজনীকান্ত বাবু বিপত্তারণের হাত ধরে বললেন - অত চিন্তা করছেন কেন বেয়াই মশাই ! রমা মা সঙ্গে আছে তো , কোন কিছুই আর ভাবতে হবে না । আমরাও বলে দিয়েছি সবাই মিলে এক অখণ্ড পরিবার তৈরি করে আমরা সবাই একসাথে থাকব ।
বিপত্তারণের সেই এক গোঁ । আর যাই হোক হাড়মাসড়া গ্রামে আর নয় । কই রে ভব ! খদ্দের দেখ। ওখানকার যাবতীয় সম্পত্তি বেচে দেব ।
রমাদি বলল - তোমাদের কিচ্ছুটি করতে হবে না । তোমরা শুধু আনন্দে দিন কাটাবে । যা করার আমরা ছোটরা করব ।
- কিন্তু এখন কোথায় যাব মা ?
রজনীকান্ত বাবু রমার হয়ে বললেন - আমাদের বাড়িতে।
- মানে ?
- দেউলটিতে । নিন গাড়িতে উঠুন । নইলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে । গাড়িতে সব বলব । ও মা রমা ! এঁদের উঠতে সাহায্য কর ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - না না বৌমা । আমরা নিজেরাই উঠতে পারব ।
রমাদি হঠাৎ একটু আড়ালে গিয়ে বমি করতে লাগল ।
রমা কোথায় - কলরব উঠতেই রমাদি বেরিয়ে এসে বলল - জেলের ভেতরে গিয়ে গা-টা কেমন গুলিয়ে গেছল। এখন ঠিক লাগছে । চল গাড়িতে গিয়ে বসি ।
দু'টো গাড়ি এনেছিলেন রজনীকান্ত বাবু। একটায় পুরুষেরা এবং অন্যটায় মেয়েরা উঠলেন ।
ঈশানি দেবীকে সরিয়ে তক্ষশীলা দেবী রমাদির পাশে বসলেন । তার শারীরিক খোঁজ খবর নিতে লাগলেন ।
রজনীকান্তের অখণ্ড পরিবারে পদার্পণ করলেন বিপত্তারণ এবং তক্ষশীলা দেবী । নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে এখানে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ।
কিন্তু মাগধী ও বৈশালীর থেকে কেমন যেন একটা অলিখিত দূরত্ব বোধ করলেন তাঁরা। রসযয় বাবু এবং প্রভুদাস বাবুর দিকে মুখ তুলে চাইতে পারছেন না ।
রজনীকান্ত বাবু খুবই মিশুকে প্রকৃতির বলে তাঁকে মেনে নিতে পেরেছেন ।
রমাদি দুই ননদকে সঙ্গে নিয়ে ওঁদের ঘরে ঢুকল । মাগধী ও বৈশালী যথাক্রমে মা এবং বাবার পায়ের কাছে মাটিতে বসে পড়ল । ওঁরা কেউ কোন কথা বলছেন না দেখে রমাদি নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলল - বাবা ! মা ! তোমরা এত চুপ করে রয়েছ কেন ? তোমাদের মেয়েরা কিছু কথা বলবে, শুনবে না ?
তক্ষশীলা দেবী মাগধীকে জড়িয়ে ধরলেন। অনুরূপভাবে বিপত্তারণ বাবুও বৈশালীকে কাছে টেনে বললেন - মা গো ! আমি জানি তোমাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছি তার কোন ক্ষমা হয় না । তবু যদি নিজগুণে মাফ করে দিস----
বৈশালী বাবার মুখ চেপে বলল - যা হয়ে গেছে সে নিয়ে আর মাথা ঘামাই না । তোমরা ফিরে এসেছ এতেই আমাদের সুখ ।
মাগধী বলল - তোমাদের কাছে কিছু গোপন করার নেই । আমার এবং রমাবৌয়ের তোমাদের কাছে একটা আর্জি আছে । যদি কিছু মনে না কর তো বলি !
বিপত্তারণ বাবু কৌতূহলী হয়ে বলেন - বল , বল মা । তোমাদের কোন আর্জি আর অপূর্ণ রাখব না । কি বৌমা ?
রমাদি বলে - আগে আর্জিটা কি শোনো বাবা !
বলে মাগধীর দিকে রমাদি চেয়ে ইশারা করল ।
মাগধী বলল - তুই বরং বল বৌ । সেই ভাল হবে ।
আগেকার দিন হলে তক্ষশীলা দেবী গর্জে উঠতেন । আজ তিনি তেমন করা তো দূর ; অনুনয়ের সুরে রমাদিকে বললেন - বউমা বল না ; এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন ।
রমাদি এগিয়ে এসে ওঁদের দু'জনের মাঝে এসে বসল । বলল - বাবা ! মা ! আমাদের সকলের ইচ্ছা বৈশালীর আবার বিয়ে হোক । ওর তো গোটা জীবন পড়ে আছে। অহেতুক বিধবা সেজে থাকলে কি চলে ?
তক্ষশীলা দেবী বললেন - আবার বিয়ে যখন দেবেই তখন মাগধীরও এক জন পাত্র দেখে বিয়ে দাও ।
সোজা হয়ে বসলেন বিপত্তারণ বাবু । বললেন - এই ক'দিনে আমরাও এ কথা ভেবেছি মা । ভয়ে বলতে পারিনি। নতুন করে আবার যদি তোমরা কিছু মনে কর।
আমার দুই বেয়াই মশাই যখন রাজী, আমরাও রাজী ।
রমাদি বলল - তাহলে বাবাকে ( রজনীকান্ত বাবুকে ) বলি খোঁজ নিতে ।
ঈশানি দেবী এসে বললেন - আমার সন্ধানে দুটি পাত্র আছে। খুবই গরীব কিন্তু চরিত্রবান । দু'জনেরই মা বাবা নেই । শিক্ষিতও বটে তবে চাকরি বাকরি করে না ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - বেয়ান , আমাদের যেটুকু আছে তাতে ওদের চাকরি করার দরকার নেই । আপনি কথাবার্তা চালিয়ে যান ।
মাগধী বলে উঠল - কথা হচ্ছিল একজনের ; এখন আবার আমাকেও জড়াচ্ছ কেন ?
বিপত্তারণ বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন । মাগধীর হাত ধরে ওকে ওঠালেন । তারপর বুকে জড়িয়ে বললেন - কারণ বাবা হয়ে তোমাকে বৈধব্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চাই। তুই আর অমত করিস না মা ।
রমাদির ডক্টর সুবীর বলকে মনে পড়ে গেল । ডাক্তারের রূপে স্বয়ং ভগবান যেন অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। এই মানুষ দুটো এমন বদলে গেছে যে ভাবাই যায় না ।
ভবতারণ এসে ঘরে ঢুকল ।
- আয় আয় বোস । তক্ষশীলাদেবী বললেন - হাসপাতালের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিস শুনলাম । এবার কি করবি ?
ভবতারণ বলল - তার আগে তোমরা বল , হাড়মাসড়ার ঘরবাড়ি, জমি সম্পত্তিগুলো নিয়ে তোমরা কি করবে ?
বিপত্তারণ বাবু বললেন - অনেক হয়েছে , আর না । এবার তোরা সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নিবি আমরা চোখ বুঁজে সই করে দেব । কারণ ওখানের প্রতি আমাদের আর কোন টান নেই । এতদিন জেলে ছিলাম। সবকিছু ছেড়েই তো ছিলাম । শুনেছি বেয়াইদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে । আর তা নাকি বৌমার নামে করে দেওয়া হয়েছে। দলিল দস্তাবেজ নিয়ে আয়; আমরাও মাকে দান করে দেব ।
অর্থই যত অনর্থ । এ কথা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি ।
রমাদি বলল - আর পুরানো প্রসঙ্গ তুলবে না কেউ । অনুশোচনাও করবে না ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - বৌমা আমার স্বয়ংসিদ্ধা । বুঝে গেছি ।
( ক্রমশঃ )
