বৃষ্টির রাতে
বৃষ্টির রাতে
কলিগের বিয়েতে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ির পথে এবার রওনা দেওয়ার কথা, ওয়েদার বলতে বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি সেই বিকেল থেকেই ঝরছিল; ঐ মাঝে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটু ধরেছিল। তারমধ্যেই আমরা তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম কোনোক্রমে; যাইহোক এবার তো ফিরতেই হবে। তার বারবার বলা সত্ত্বেও আমরা কেউই গ্রামে নিশিযাপন করতে রাজি হলাম না একবারও; অগত্যা তিনিও আমাদেরকে সাবধান করে বিদায় জানালেন। মার্চ মাস, কালবৈশাখীর সময় হলেও সেবার থাবা বসিয়েছিল নিম্নচাপ, তাই সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে আমরাও খানিকটা রহস্যের বশেই ড্রাইভারকে নিয়ে পাঁচজনে আনন্দ মজা করতে করতে এগিয়ে চললাম; গাড়ির ভেতরেই জমে উঠেছিল গল্পের আসর।
ড্রাইভার বাবাজীর বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে হলেও তার ছিল ঝুলি ভর্তি অভিজ্ঞতা, এবার সমস্যা হল ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা পার করে ফেলেছে ইতিমধ্যে আর তার ঝোলা থেকে বেরোচ্ছে সব ভৌতিক কাহিনী। কখন কোথায় কিভাবে সে কোন ভূতের দেখা পেয়েছ তার ইতিহাস সে আমাদের রসিয়ে বশিয়ে শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা ছিলাম পেছনের সিটে, আর তার পাশে থাকা কৌশিকদা তখন প্রাণপণে হনুমানজীর নাম জপ করতে শুরু করে দিয়েছেন। সাহসী যে যেমনি হোক না কেন, ভূতে বিশ্বাস করব এতটাও দুর্ভাগ্য আমাদের হয়নি। তাই আমরাও সবাই তার সব গল্পকে গুজব মনে করেই গিলছিলাম বলা যেতে একপ্রকার। রাত যত বাড়তে লাগল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বৃষ্টি, যোগ দিয়েছিল ঝোড়ো হাওয়া। আমরা যে পথে গিয়েছিলাম, ফেরার সময় তার উল্টোপথে আসাটাই শ্রেয় মনে করেছিল আমাদের ড্রাইভার। তেমন বিশেষ কারণ ছিল না, শুধু ঐ ওয়েদার খারাপ থাকায় যদি একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায় বেশ এইটুকুই।
এরই মাঝে বিয়েবাড়িতে খেয়ে আর এরকম মনোরম পরিবেশে আমার চোখটা কখন লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি; হঠাৎ ব্রেকের ঝাঁকুনি। কি হল দাদা? শেয়াল-টেয়াল নাকি? শেয়াল কিন্তু এরকম গ্রামের দিকে খুবই সাধারণ এক প্রাণী বলা যেতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে ড্রাইভার আর তার পাশে বসে হনুমানজীর নাম জপ করতে থাকা কৌশিকদার চোখে-মুখে নিস্তব্ধতা; বিপদ আসন্ন। আমরা তখনও ঠিক করে কিছুই বুঝতে পারিনি, তবে এরপর যা দেখলাম এরকম শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই চাক্ষুস করে এসেছি এতদিন যাবৎ। গাড়ির ডানদিকে একটু দূরে অবস্থিত এক পুরানো বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে এক অশীতিপর বৃদ্ধা ও সঙ্গে তার ছোট্ট নাতনি; নির্বাক পাঁচমূর্তি। আমাদের ড্রাইভার যে এতক্ষণ ধরে সাহসিকতার গল্প শোনাচ্ছিল সেসব এখন ইতিহাস হয়ে গেছে, আর আমাদের পাঁচজনের জীবনের হয়তো এটাই শেষ নিমন্ত্রণ! সায়েন্স-আর্টস-কমার্স মিলেমিশে তখন সবই ভৌতিক বিশ্বাস; কি করব, কিভাবে এগোব – আদৌ এগোতে পারব কিনা – সর্বোপরি এই অবস্থায় সাহায্য করা উচিত কিনা – এ সকল ভাবনার সম্মিলিত উত্তর নিরুত্তর ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। তবে এখানে যে দাঁড়িয়ে থাকা বেশীক্ষণ ঠিক হবে না তা বুঝতে একটুও দেরি ছিল না, চারপাশে কয়েকটা টালির ঘর আর বাকিটা ধূ-ধূ জমি – এরকম পরিবেশে সাহসিকতার পরিচয় দিতে যাওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের পরিচয় হবে না। অতঃপর এক্সালেটারে রাখো পা আর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গতিতে বেরিয়ে যাও, এর বাইরে দ্বিতীয় ভাবনার অবকাশ ছিল না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ – ড্রাইভার সহ আমরা সবাই শক্ত হয়ে একে অপরকে ধরে বসলাম; বর্তমানের ভূতকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ানো। একশোর বেশী গতিতে ছুটল গাড়ি; কিন্তু অকস্মাৎ যেই আমরা ঐ বটগাছের সামনে এলাম অমনি সেই বৃদ্ধা আর নাতনি আমাদের সামনে – হয় মারো আর নয় মরো;
বেশ চোখের পলকেই গাড়ি সোজা বেরিয়ে গেল; পেছনে কি হল তা দেখার মতন সাহস বা অবস্থা কিছুই ছিল না। যতক্ষণ না আমরা বাসরুটে এসে উঠলাম ততক্ষণ অব্দি কোথাও থামার প্রশ্নই ছিল না। মোড়ে আসতেই ড্রাইভার বলল, একবার সামনেটা দেখলে হয় না? না, মানে এবার তো মেনরোডে উঠছি, যদি সামনের অংশ বেঁকে গিয়ে থাকে বা তাতে রক্ত লেগে থাকে তাহলে কেউ দেখে নিলে সমস্যা হতে পারে। আমাদেরও মনে হল কথাটা ভুল নয়; বিপদ কাটলেও আতঙ্ক কাটেনি। তাই ধীরেসুস্থে আমরা নামলাম গাড়ি থেকে; কিন্তু একি! গাড়িতে তো কোথাও কিছু নেই, কিন্তু যে গতিতে ধাক্কা লেগেছিল তাতে মিনিমাম হেডলাইট তো ভাঙতেই পারত একটু হলেও, কিন্তু কৈ, সেসব তো কিছুই হয়নি। তাহলে কি আমরা সত্যি অশরীরীর কবলেই পড়েছিলাম? হাত - পা আরও ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগে বাড়ি ফিরে আসাটাই শ্রেয় মনে হল, ইতিমধ্যে বৃষ্টিটাও ধরেছে। রাত এমনিতেই গভীর, চলো আজ ফেরা যাক্...
তবে যা দেখলাম তা কি সত্যিই বাস্তব নাকি ভ্রম? একসাথে সবার ভ্রম হওয়া সম্ভব? উত্তর খুঁজতে আসব অবশ্যই, তবে আজ আর নয়...হয়তো তিনিও অন্য শিকারের খোঁজে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছেন বটগাছের তলায়...

