Sharmistha Mukherjee

Abstract Classics Fantasy

3  

Sharmistha Mukherjee

Abstract Classics Fantasy

বৃহন্নলা

বৃহন্নলা

6 mins
867


"বৃহন্নলা" সম্বন্ধে বহু সময় অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন বা লিখেছেন । তাস্বত্ত্বেও তাদের নিয়ে কিছু লেখার প্রবল ইচ্ছে আমার । তাই আজ লিখেই ফেললাম । লেখাটি আমার সামান্যতম প্রয়াস মাত্র । 


আমাদের সভ্য সমাজে "বৃহন্নলা"-দের

" হিজরা " নামে সবাই চেনেন । কিন্তু অনেকেই জানেন না কিভাবে এই "বৃহন্নলা" বা "হিজরা" শব্দটির উৎপত্তি অথবা তাদের জন্মবৃত্তান্ত । 


"হিজরা" শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ হিজরত বা হিজরী থেকে । অভিধানে যার অর্থ হল পরিবর্তন বা মাইগ্রেট । English- এ হিজরাদের বলা হয় Hermaphrodite বা Transgender বা Eunuch । যার অর্থ " নপুংসক " । Transgender বলতে বোঝায় এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থা যা সাধারণ মেয়ে বা ছেলের শ্রেণীতেই পড়ে না । জেনেটিক বিশৃঙ্খলতার কারণে একটি শিশু Transgender বা "হিজরা " ( বৃহন্নলা / অর্ধনারী ) রূপে জন্মায় । হিন্দীতে সভ্য ভাষায় এদের " কিন্নর "বলা হয়ে থাকে। 

আর নপুংসক শব্দটি হোলো সংস্কৃত শব্দ । 


" হিজরা "-দের বৃহন্নলা নামটি খুব পরিচিত মহাভারতের সময় থেকেই । 

অজ্ঞাতবাসের এক বছর ক্লীবরূপ ধারণ করে অর্জুন সেজেছিলেন " বৃহন্নলা " । বৃহন্নলা রূপে না সেজে তিনি কিন্তু অন্য কোনো রূপ ধারণ করতে পারতেন । কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন স্বনামধন্য যোদ্ধা এবং আজানুলম্বিত ( দীর্ঘ হস্ত ) তাই হিজরা রূপই ছিল শ্রেয় । এই হিজরা রূপে তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন " বৃহন্নলা " । "বৃহন্নলা" কথাটির অর্থ হোলো দীর্ঘভূজা । 

বৃহৎ নল আ = বৃহন্নলা 

মহাভারতে অর্জুন অজ্ঞাতবাসের প্রয়োজন স্বার্থে বলেছিলেন ::: আমি তৃতীয়া প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে অন্তরিত রাখবো অর্থাৎ " তৃতীয়াং প্রকৃতিং গতঃ "

এটি অর্জুনের মুখনিঃসৃত অসাধারণ দার্শনিক নির্বচন । সুতরাং হিজরা না বলে তাদের " বৃহন্নলা " বলাই অনেক বেশি সন্মানিত ও আদৃত । ভারতবর্ষে অতি পুরাকাল তথা পুরাকাল থেকেই "নপুংসক লিঙ্গ " বা " তৃতীয় লিঙ্গ " অথবা " কিন্নর " শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় । 


এই " বৃহন্নলা "- রা শারীরিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিক ভাবে নারী বৈশিষ্ট্য 

সম্পন্ন । এরা সন্তানোৎপদন এবং সন্তানধারনে অক্ষম । এদের জন্ম নিয়ে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে । কেউ বলেন সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ , কেউ বলেন স্বেচ্ছাচারী পিতামাতার দোষ আবার কেউ বলেন প্রকৃতির দান । 

চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাতৃজঠরে একটি শিশুর পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে সময় লাগে ২৮০ দিন অর্থাৎ ৯ মাস ১০ দিন । 

" XX " প্যাটার্ন ডিম্বাণু ( Ovum ) বর্ধিত হয়ে জন্ম দেয় নারী শিশুর । অপরদিকে " X - Y " প্যাটার্ন বর্ধিত হয়ে জন্ম হয় পুরুষ শিশুর । ভ্রুণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ ( Testicle / Scrotum ) এবং নারী শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ ( Ovary / Ovum ) সৃষ্টি হয় । অন্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় স্ত্রী হরমোন এস্ট্রোজেন । পরবর্তী স্তরগুলিতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজেনের প্রভাবেই তৈরী হয় । ভ্রুণের বিকাশ কালে নানা ভাবে এই সমতা ব্যাহত হতে পারে । 

প্রথমতঃ -- ভ্রুণের নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে ।

 যেমন --" X- YY " অথবা " XX - Y " 

" X - YY " প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী শিশুর মতোই কিন্তু একটি " X " - এর অভাবে নারী জনিত সকল অঙ্গ পূর্ণতা পায় না । তাই একে স্ত্রী হিজরাও বলে । অপরদিকে " XX - Y " প্যাটার্নের শিশু যদিও দেখতে পুরুষের মতো কিন্তু একটি বাড়তি " X " অর্থাৎ মেয়েলি ক্রোমোজোমের জন্য পৌরুষ প্রকাশে বিঘ্ন ঘটে । এটি একটি শারীরিক গঠন জনিত সমস্যা । এই প্রতিবন্ধকতার দরুন তারা হিজরা নামের 

" তৃতীয় লিঙ্গে " স্থান পায় । 


হিজরাদের শারীরিক গঠন মূলত তিন প্রকার : ~~

১ ) নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী যৌনাঙ্গ ( Female Genitalia / Vagina ) থাকে না । 

২ ) পুরুষদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ যৌনাঙ্গ ( Male Genitalia / Penis ) থাকে না । 

৩ ) অনেকের ক্ষেত্রে একই সাথে স্ত্রী যৌনাঙ্গ এবং পুরুষ যৌনাঙ্গ দুই বিদ্যমান । অর্থাৎ একই দেহে Vagina এবং Penis দুই থাকে । 


যদিও বা হিজরার জন্ম জন্মগত জেনেটিক ত্রুটির কারণে, কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট আরেক রকম হিজরা হয় । যাদের লিঙ্গ বা প্রজনন অঙ্গ কেটে ফেলা হয় । 

তাদের বলা হয় " খোজা " বা 

" Castration " । এদের কোনো যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকে না । পুরাকালে বহুবিবাহ , উপপত্নী ( Kept ) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে এই 

" খোজা " পুরুষদের প্রহরী হিসেবে নিয়োগ করা হোতো । 


নিজেদের জন্মের জন্য নিজেরা দায়ী না হলেও সমাজ মনে করে " হিজরা " বা 

" বৃহন্নলা " - রা অভিশপ্ত । সমাজ তো দূরের কথা আপন বাবা - মা , 

ভাই - বোন , আত্মীয় - স্বজন তাদের দিকে বাঁকানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে । তারা হয়ে ওঠে হাসি - তামাশার পাত্র । ফলে অবহেলিত হয়ে আমাদের মতোই সাধারণ ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তান হয়েও হিজরাদের দলে মিশে যেতে বাধ্য হয় জীবনধারণের জন্য । তারপর বাড়ি বাড়ি নাচ - গান করে মানুষের কাছে হাত পেতে করে জীবনধারণ ও ক্ষুধা নিবারণ । 


" হিজরা " বা " বৃহন্নলা " জন্ম কোনো অভিশাপ নয়, জন্ম সম্বন্ধীয় অর্থাৎ Genetic কারণে তাদের এই অর্ধনারী রূপ । তামিল নাড়ুর ভিল্লিপুরম জেলার " কুথান্ডাভর " মন্দিরে হিজরাদের

" কুভাগম " নামক একটি উৎসব পালিত হয় । এই উৎসব ১৮ দিন ব্যাপী চলে । কুথান্ডাভর ( Koothandavar ) মন্দির "আরোভন / ইরূভন "( Aravan / Iruvan )দেবের নামে উৎসর্গিত । আরোভন দেব হলেন তৃতীয় পান্ডব অর্জুন এবং নাগরাজ কন্যা উলুপীর পু্ত্র । 


মহাভারতে কৌরব ও পান্ডবদের যুদ্ধের ১৮ দিন পর যুদ্ধে নিশ্চিত জয়লাভের জন্য মহাশক্তি দেবী কালী মাতার কাছে পান্ডবরা বলি মানত করেছিলেন । অর্জুন নিজ পুত্রের বলি নির্ধারণ করেছিলেন । অর্জুন ও উলুপীর পু্ত্র আরোভনকে বলিপ্রদও করার কথা ঠিক হলে আরোভন তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করেন । আরোভন জানিয়েছিলেন মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিবাহ করতে চান অর্থাৎ তিনি বিবাহিত অবস্হায় মৃত্যবরণ করতে ইচ্ছুক । কারণ আরোভন জানতেন এরকম প্রস্তাবে কোনো নারী সম্মতি প্রদান করবেন না । 


এই বিবাহ এক অদ্ভুত ঘটনা । একদিনের জন্য বিবাহ এবং পরের দিন পতিবিয়োগ ও চিরকালীন বৈধব্য । সেযুগে কোনো নারী এরূপ বিবাহে সম্মত না হওয়ার ফলে পান্ডবরা খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন । তখন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ স্বয়ং "মোহিনী " অবতার অর্থাৎ অর্ধনারী রূপ ধারণ করেন । এই "মোহিনী " রূপে আরোভনের সাথে বিবাহ করেছিলেন । যথারীতি পরের দিন আরোভনকে কালীমাতার চরণে বলি দেওয়া হয়েছিল । 


তারপর থেকেই তামিল নাড়ুর কুথান্ডাভর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এবং আরোভনকে দেব রূপে ঐ মন্দির উৎসর্গ করা হয় । 


প্রত্যেক বছর তামিল মাস " চিত্রাই " ( April / May ) মাসে হিজরাদের " কুভাগম " উৎসব খুব ধুমধামের সাথে পালিত হয় । ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে " হিজরা " তথা Transgender - রা অংশগ্রহণ করে । এই উৎসবে তারা সম্পূর্ণ নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে বৈবাহিক বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা দেবতা আরোভনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই বৈবাহিক দিনযাপন চলে ১৮ দিনব্যাপী । এই ১৮ দিনের জন্য তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বৈবাহিক জীবন নাচ - গান বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খুব উৎসাহের সাথে পালন করে । ১৮ দিন পর ঠিক ১৯ দিনে শুরু হয় বিভিন্ন বৈধব্য আচার অনুষ্ঠান । তথা :::---- হাতের চুড়ি ভাঙা , সিঁদুর মুছে ফেলা , মাঙ্গলিক ডোর ( মঙ্গলসূত্র ) খুলে ফেলা , পতিবিয়োগান্তক হৃদয়বিদারিত কান্না ইত্যাদি । এই উৎসবের মাধ্যমে মাত্র ১৮ দিনের জন্য হিজরা বা বৃহন্নলা - রা হয়ে ওঠে বিবাহিত মোহিনী ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract