Ajoy Kumar Basu

Abstract

2  

Ajoy Kumar Basu

Abstract

বোমাবাজি

বোমাবাজি

6 mins
733


আলী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় ছোট সেক্রেটারিয়েটে।

 আমার একটা ছোট ওয়ার্কশপ আছে। গ্রামের আর শহরের কিছু কিছু ছেলেকে কারিগরি শেখাই। বিশাল কিছু নয়, সাইকেলের, মোটরসাইকেলের, জলের পাম্পের, বাড়ীর বিজলীর, রাজমিস্ত্রির কাজ। প্রথমে একই করতাম, তারপর প্রতি ব্যাচ থেকে একজন দুজনকে বেছে আখ পঁচিশ জন ট্রেনার নিয়ে আমার সাম্রাজ্য। ভালো কাজ, আনন্দের কাজ, আয়টা অল্প, সবাই মাইল ভাগ করে নিয়ে সংসারটা চলে যায়।

সরকার থেকে কিছু অনুদান পাই, কিন্তু টাকা পেতে জুতোর সুখতলা ছিঁড়ে যায়। আমার তো উপায় নেই,তাই ধৈর্য্য না হারিয়ে বারবার অফিসে যেতেই হয়। আলী সাহেব ওই অফিসে একটা আর্দালীর কাজ করেন। একদিন নিজে থেকে আলাপ করলেন। বলেন যে আমাকে দেখে ওনার ভালো লাগে। এতবার আসতে হচ্ছে অল্প কটা টাকার জন্যে। কিন্তু আমার মুখটা সবসময়ে হাসিভরা। আর সবাইকে বন্ধু করা আমার নাকি খুব সহজ কাজ। শুনে ভালো লেগেছিলো - আমার কাজে সরকারি অফিসে কেউ প্রশংসা করবে এটা উপরি লাভ। সবাই তো ভিখিরীর চোখে দ্যাখে, ওটাই মেনে নিতাম। দেশের কাজ করে সরকার থেকে বাহবা পাওয়া আমাদের দেশে হয় না, সরকারি কর্মচারীর চোখে আমার মতো লোকেরা একেবারে অচ্ছুৎ। মাস গেলে মাইনে পেলে তবেই না উঁচু জাত।

আলাপটা আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের পর্যায়ে এসে গেল। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে চা খাই, প্রাণের কথা বলি। আলী সাহেব কী জাদু মন্ত্র জানে বুঝিনি, কিন্তু দেখলাম আমার ফাইল ছোটো বাবুর টেবিল থেকে বড় বাবুর টেবিলে তাড়াতাড়ি পৌঁছচ্ছে। আগে যতবার ধর্ণা দিতে হতো তার চেয়ে অনেক কমেই আমার টাকাটা বেরোচ্ছে সরকারি তহবিল থেকে।

একদিন কথায় কথায় জানালেন তাঁর সমস্যা। এক ভাইয়ের ছেলে সেকেন্ডারি পাশ করে বেকার হয়ে বাড়ীতে বসা তিন বছর। অসৎ বন্ধু জুটেছে। আলী সাহেবের পরিবার বেশ চিন্তায় আছে।আমার যতটুকু জানা আছে বললাম।আমাদের দেশে প্রতি বছর দু কোটি ছেলে মেয়ে সেকেন্ডারি পাশ করবার বয়সে পৌছোয়। তাদের মধ্যে মেরেকেটে ষাট লাখের পড়বার কিংবা শেখবার ব্যবস্থা আছে। বাকি এক কোটি চল্লিশ লাখ কিচ্ছু করতে পারে না পনেরো-ষোলো -সতেরো বছর বয়সে। আইন করে শিশু শ্রমিক বন্ধ, নাবালিক বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। অতি উত্তম কথা। কিন্তু আমাদের নেতা আর সরকার নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, কিকরে চেয়ারটা সামলানো যায়, পয়সা জোগাড় করা যায়, এই সব অত্যন্ত দরকারি কাজে মন তাদের। মাত্র দেড় কোটি তরুণের কি হলো, কী করলো এসব মামুলি সমস্যার কথা ভাববার সময় তাদের নেই। এদের একটা নাম দিয়েছে, SCHOOL- DROP -OUT. ব্যস এতগুলো বাচ্ছা এই পরিচয়ে ঘরে বসে বুড়ো আঙ্গুল চুষবে এটাই দেশের বিকাশের পরিকল্পনা।

বোঝালাম ঠিকই, কিন্তু মনটা মানতে চাইলো না। একটা অপরাধ বোধ থেকেই গেল। ডেকে পাঠালাম আলী সাহেবের ভাইপোকে।

সুন্দর ছিপছিপে চেহারা, রাস্তায় রাস্তায় রোদ্দুরে ঘুরে রংটা ঝলসে গ্যাছে। নাম বাশিদুদ্দিন, সবাই ডাকে বশির নামে। কাজের কথা হলো। একটা ছোট পড়ার ঘর, লাইব্রেরি করতে হবে। মাইনেটা কম, তবে ভালো কাজ। ব্যস্ত থাকলে মনটা ভালো থাকবে। বশির শুরু করলো কাজ। সব ঠিকঠাক চললো মাস দুয়েক। তারপর ঝামেলা শুরু। মাঝে মাঝেই কাজে আসেনা। পড়ার ঘরটায় ঝাঁট পড়েনা, সময়মতো তালা খোলেনা। অন্যরা অসন্তুষ্ট, প্রায়ই অনুযোগ আসে বসিরের বিরুদ্ধে; নেশা করে,খারাপ ব্যবহার করে সকালের সঙ্গে। কবার ডেকে বোঝালাম, বকাঝকা করলাম - কদিন ঠিক থাকে, আবার যথা পূর্বং। বাধ্য হলাম তিন মাসের মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে। কাজটা করে ভালো লাগেনি।

একদিন নিজের ঘরে বসে লিখছি। দরজায় টোকা না দিয়ে বশির সোজা আমার টেবিলের সামনে। একটু অবাক হলাম আর একটু বিরক্ত। দেখেই বুঝলাম কিছু নেশা করে এসেছে, চোখদুটো হলদেটে ভাসা ভাসা। কোনো কথা না বলে টেবিলে রাখলো শণের দড়ি বাঁধা দুটো বল। এগুলো আমার চেনা। কলকাতায় কলেজে পড়বার সময়ে নকশাল আন্দোলন দেখেছি - একদিন রাস্তায় পরা এইরকম বল দেখেছিলাম -সবাই বললো হাতবোমা, যে কোনো কারণে ফাটেনি। পুলিশ এসে জলের বালতিতে করে নিয়ে গ্যালো।

আমার নাড়ির ভেতর থেকে একটা যন্ত্রনা, গলাটা চেপে বাঁধা। কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। বসিরই ক্লুটা ধরিয়ে দিলো:

'দেখছেন এগুলো কী?'

ভাষা ফেরত পেলাম। 'সেদিন দুপুর বেলা গান এলো মোর প্রাণে' ; আমার অন্তর্নিহিত সুবক্তা বেরিয়ে এলো ঝর্ণার বেগে। ভালো করে বস্তু দুটোকে নিরীক্ষণ করলাম কয়েক সেকেন্ড। তারপর শুরু হলো আমার জীবন বাঁচানোর বক্তৃতা :

'দেখে মনে হচ্ছে হাত বোমা। একটা নয়, দুটো। তবে বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না এগুলো আসল না নকল। আর আসল হলেও কত শক্তি এর মধ্যে আছে সেটাও এস্টিমেট করতে পারছি না।'

আমার স্বরে কৌতূহল আর কৌতুক মিলে এক সরবত। বশির সেটা বুঝে বেশ রেগেই গেল :

'এগুলো আপনাকে মারলে কী অবস্হা হবে জানেন ?'

আমার দেহের ২৭০টা হাড় জানে। আমি বিশ্লেষণ করতে থাকলাম,

"যদি এগুলো শুধু পটকা হয় তাহলে গায়ে পড়লে একটু ঝলসে যাবো, First degree burn; মলম লাগালে ঠিক হয়ে যাবে। যদি মাঝারি শক্তির হয় তাহলে নির্ভর করবে কোথায় বোমাটা মারা হলো তার ওপর। আমার টেবিলের তলায় মারলে টেবিলটা উল্টে যাবে,পায়া গুলো ভাঙবে-কটা ভাঙবে বলা মুশকিল -কিন্তু ভাঙবে। যেহেতু আমার পাদুখানা টেবিলের তলায়, তারা কিন্তু অক্ষত থাকবে না। কটা হাড় তো ভাঙবেই, পায়ের মাংস খুবলে যাবে, বেশ রক্তারক্তি ব্যাপার হবে। আমাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে চালান করতে হবে।

আর যদি তুমি আমার টেবিলের ওপরে মারো, তাহলে আমার একটুও ভালো লাগবে না। প্রথমতঃ টেবিলের দরকারি কাগজপত্র পুড়বে ,এই যে গত কঘন্টা ধরে যে বক্তৃতাটা লিখছি সেটাকে আবার লিখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ আমার মুখটা ঝলসে আমি মুখপোড়া হুনুমান হয়ে যাবো, সেটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। তৃতীয়তঃ, আমার চোখদুটো পার্মানেন্ট ড্যামেজ হতে পারে -সেটা খুব দুঃখ্যজনক ঘটনা, কারণ যতদিন বাঁচবো, তোমার মতো কাউকে খুঁজে বার করতে হবেএর অনুনয় করতে হবে,"আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা,আমি যে চোখে দেখিনা।'

যদি তোমার হাত কাঁপাকাঁপিতে বোমাটা ঘরে কোণায় গিয়ে পড়ে তো দুম করে আওয়াজ হবে, দেয়ালের বিশেষ ক্ষতি হবেনা। তবে লোকজন ছুটে আসবে, বোমাহীন বশিরকে প্রথমে নিজেরাই ধোলাই দেবে আর তারপর পুলিশের লোক তোমার ওপর ডান্ডা প্র্যাক্টিস করবে; সেটা তোমার -আমার পছন্দ নয়। তাই বলছি বোমাটা এদিক ওদিক ফেলে নিজের বিপদ ডেকে এনোনা।"

আমি থামিনি। বোমাদের ক্লাসিফাই করলাম। তিন রকমের উঁচু জাতের বোমা আছে -তাদের প্রতিটির Destrutive Power বোঝালাম বিস্তৃতভাবে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেকচার পুরো ৪৫ মিনিটের ক্লাস। রেকডিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না, তাই বিশ্বজন লেকচারের কোহিনূর হারিয়ে ফেলেছে।

এরপর আমার স্বর করুণার ধারা,"বসো, একটু জল খাবে?"

বশিরের গলায় অনুযোগের সুর, "আপনি আমার কষ্টে মজা করছেন ?"

আমি আমাতে ফিরলাম, জানি বিপদ নেই।

"মজা করি কী করে বলতো? তোমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে আমিও কষ্টে আছি। এর আগে কখন কাউকে ছাড়াইনি, আমাকে অনেকে ছেড়েছে ভালো কাজ পেয়ে। আমার ভালো লেগেছে। এই প্রথমবার নিজেথেকে ছাড়িয়ে কষ্টটা বুঝলাম।"

কী যে হয়ে গেল! বশির ধপ করে চেয়ারে বসলো, দুটো হাতে মুখ ঢাকা আর হাউ হাউ করে সে কি কান্না। আমার অজান্তে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে বুকের মধ্যে থেকে নিঙড়ে।

 আমি দেখছি আমার কোটি কোটি ছেলেমেয়েকে। বছরের পর বছর তরুণের স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা বড়রা নিজেদের নিয়ে নোংরামি করছি - জাতি, ধৰ্ম, উঁচু-নীচু- সবাইকে ছোট করতে করতে করতে পুরো দেশটাকে নরকের রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছি।

হটাৎ আমার সুপ্ত বিদ্রোহীটা মাথা তুললো। অদ্ভুত শান্ত গলা আমার, নিজেই চিনতে পারছি না।

"বশির, মনে করতো তুমি যখন মাধ্যমিক পাশ করলে তখন কি হবার স্বপ্ন দেখতে?"

বশিরের কান্না ভেজা কণ্ঠে স্বপ্নের আমেজ,

"একটা অটো রিকশা চালাবো একটা অটো রিকশা সারানোর দোকান করবো। কত চেষ্টা করলাম, অটো কেনার পয়সা জোগাড় করতে পারলাম না। নিজেকে ছোট চোখে নিজেই দেখতে শুরু করলাম। আর আমার ভেতর থেকে একটা রাগ বাঘের মতো বেড়িয়ে এলো। সব কিছু ভাঙ্গতে ইচ্ছে করতো, সাহসে কুলতোনা। নেশা ধরলাম। ছিনতাই করেছি। তবু ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে ঘুরেছি। টাকা পাইনি আমার হয়ে কেউ গ্যারান্টি দেয় নি। আমাকে আটকাতে পরিবারের সবাই মিলে বিয়ে দিলো। কেন যে রাজি হলাম জানিনা। বিবি একটা ছোট নার্সিং হোমে আয়ার কাজ করে, মাঝে মাঝে ডাক পরে। ওই ছোট মেয়েটা হাল ছাড়েনি এখনো। আর আমি নিজের কাছে আরও ছোট হয়েই চলেছি।"

ডেকে পাঠালাম যে ছেলেটি টাইপ করে তাকে। লিখলাম আমার ব্যাংকের ম্যানেজারকে। বশিরকে একটা অটো কেনবার লোন দেওয়া হোক -আমি গ্যারান্টিয়ার থাকছি।

বশিরকে শাসালাম,'কিস্তিগুলো ঠিক সময়ে দিও, নইলে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে।'

বোমাগুলো আমার টেবিলে ফেলে বশির উঠে পড়লো। আমি ডাকলাম ওগুলো নিয়ে যেতে। বশিরের চোখে মুখে হাসি, "কি হবে ওগুলো দিয়ে ?"

আমার মুখ খুব গম্ভীর," কাজে লাগবে যদি ম্যানেজারটা ঝামেলা করে। আর শোনো বৌমাকে বোলো ওর বরটা খুব ভালো, ওরই মতো স্বপ্ন দেখে।"

বোমাদুটো হাতে নিয়ে বশির গেল। জানলা দিয়ে দেখি বশির ছুটছে আনন্দ -পথ ধরে। পাশেই বড় পুকুর। বশির বোমা দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিলো পুকুরের মাঝ বরাবর।

বছর দুই লেগেছিলো বশির মিয়াঁর অটো সারাবার কারখানা শুরু হতে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract