Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Crime

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Crime

বংশ রক্ষা ১ম পর্ব প্রথম অধ্যায়

বংশ রক্ষা ১ম পর্ব প্রথম অধ্যায়

17 mins
340


 বকুল ডাঙ্গা বেশ বড় গ্রাম , সদর বর্ধমান থেকে কাটোয়া বরং কাছে। উগ্রক্ষত্রিয় মানুষের বাস বেশী। বাসুদেব দে ,ছোট চাষী। যেমন কৃপন তেমনি পরিশ্রমী। বাপের সম্পত্তি ভাগাভাগির পর চার বিঘা চাষ জমি ভাগ পেয়েছিল। পৃথক হয়ে বিশ বছরে আরও পাঁচ বিঘা জমি কিনেছে। এখন নয় বিঘা চাষ জমি। অবিভক্ত সংসারের বাপের সমতুল্য পনের বিঘা না করে সে ছাড়বেই না।তার আগেই যদি মারা যায়,ওর আত্মা বোধহয় মুক্তি পাবে না।ভুত হয়ে ছেলেকে হয়ত বলবে তাপস পরিশ্রম কর আরও বেশী বেশী খাটাখাটিতে মন দে,জোত জমি পনের বিঘে অন্তত কর! তাপসের বয়স একুশ বাইশ, এক জোড়া গরুর লাঙ্গলের চাষ, নিজেদের জমি ন বিঘায় চাষ আবাদ শেষ হলে, পরের জমিতে লাঙ্গল  ভাড়ায় খাটে।দৈনিক সে সময়ের ভাড়া কুড়ি টাকা। 

বর্ষার সময় জলে ভিজে রোদে পুড়ে গায়ের রং কেমন তামাটে, কিন্ত গায়ের রং ছোট বেলায় বেশ ফর্সা ছিল। তাই শুধু নয়,রক্ত স্বল্পতার লক্ষ্যন তার স্পষ্ট তবু বাবা মায়ের নজর পড়ে না। গ্রামেরই মাঝের পাড়ার তার বড় বোন রীনার বিয়ে হয়েছিল । বোন তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।ষোল সতের বছর বয়সে বাবা তার বিয়ে দিয়েছিল গ্রামের ধনী বনেদী বাড়িতে, ভেবেছিল খুব জিতে গেছি। এমন বিয়ে আর কজন বাবা দিতে পারে!

রীনার সেই কবে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বাড়ির কাজ কর্ম করত। উচু জেন্স সাইকেলে রং চটা খাটো ইজের আর ফ্রক পরে সিটে বসে,কষ্টসাধ্য কোনমত সাইকেলের প্যাটেল আলতো পায়ে ছোঁয়া পেতো। এই ভাবে হাড় কৃপন বাবার বড় মেয়ে রীনা সাইকেল চালিয়ে,ক্ষেতজমিতে কর্মরত তার বাপ দাদার দুপুরের সময় জল,খাবার দিয়ে আসত।

রোগাপাতলা দেহ, মুখোরা,দেখে মনে হত নিরীহ, রীনা একটু দীর্ঘ, মুখ চোখ বেশ ভালো,ফর্সা তবে পুষ্টিকর খাবার অভাবে মলিন শীর্ন,যৌবনে মেয়েলী গঠন তার বিয়ের সময়ও ঠিক পরিপূর্ণতা ছিল না।তার বিদ্যার দৌড় ফাইভ অবধি। তাপসের শিক্ষার গন্ডি একটু ভালো নাইনে বার দুই ফের করে সে গত পাঁচ বছর পড়াশোনা ছেড়ে বাবার সাথে চাষে লেগেছিল।

রীনার শ্বশুর বাড়ি সচ্ছল বনেদী ঘর । ত্রিশ বিঘা জোত জমি চাষবাস থাকলেও, তার শ্বশুর স্বামীরা মাঠে যায় কম।জনমজুর কিষান দিয়ে কাজ সাড়ে। তার শ্বশুর নিতাই সামন্ত বেশ সৌখিন লোক। সেই পঞ্চাশ বাহান্ন সালে গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাটিক পাশ করে কলকাতায় আই এ ভর্তি হয়েছিল। পাশ না করুক শহুরে আদব কায়দাটা সে ভোলেনি। বাংলা নয় ,ইংরেজী দৈনিক খবর কাগজ পড়ে।কখন পড়ে, কতক্ষণ পড়ে সেটাই প্রশ্ন! কেউ কেউ মজা করে বলে, নিতাই সামন্ত নাকি ইংরেজী  পেপার উল্টে ধরে পড়ে। এটাই তার ফ্যাশন, কিছু বুঝুক আর না বুঝুক ইংরেজী পেপার পড়া সে যুগের কৌলিন্য।এটাই তার উদ্দেশ্য।

একটা হাস্কিং মিলও আছে, বানীতে চলত, ভালো চালু,বড় গ্রামে তখন একটাই হাস্কিং মিল। যাবতীয় গ্রামের চাষীবাসীদের ধান ভানাই হত। সকাল ছটা থেকে রাত দশটা অবধি। মাঝে তিনঘন্টা বন্ধ থাকত, দুপুরের খাবার সময়ে বিরতি। চারটে কর্মচারী কাজের চোটে হিমশিম খেতো। নিতাই ক্যাশে বসত। ইদানিং ছেলে ভানুরাম ক্যাশে বসে মাঝে মাঝেই বাবাকে সাহায্য করত।সে তাপসের বোন রীনার স্বামী।

এই বাড়ির আসল মালকিন হল, ভানুর মা নারায়ণী। পাড়ার লোকে বলত স্বামী ছেলেকে সে নাকি শাড়ির আঁচলে ভরে ঘুরে বেড়ায়।তার মুখোরা স্বভাব, পাড়ার মানুষ ভয় পেতো। ধনীর ঘরের বৌ এখন গিন্নি।তার একটা বড় গুণ ছিল দান ধ্যান কর্তব্য,তবে সবার জন্য নয়, নিজের স্বার্থ থাকবে সে সব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। তাপসের যখন রক্ত স্বল্পতার ভাব দেখা দিল, বৌমার দাদাকে  বাড়িতে ডেকে এনে বাড়ির গরুর দুধ ঘী, হাঁসের ডিম,পুকুরের টাটকা মাছ অনেক কিছু  বাড়িতে বসিয়ে যত্ন করে জামাই আদরে বোনের  শাশুড়ি নারায়ণী খাওয়াতো।রীনার সবে তখন ভানুর  সাথে বিয়ে হয়েছিল।

বাসুদেব অস্বচ্ছল  শিক্ষা দীক্ষা নেই,মেঠো চাষা।মূর্খ আনকালচার বংশের মেয়ে রীনা,সেই বৌমার বাবা মা দাদা সবাইকে এমন বনেদী সচ্ছল সৌখিন পরিবারের মালকিন,ছেলের মা হয়ে নারায়ণীর এত খাতির করে কেন! কেনই বা,এত গরীব ঘরের এক অশিক্ষিত কম বয়সের মেয়ের সাথে তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিল! গ্রামের মানুষের মনে এ প্রশ্ন কিন্ত আসত না। ধুরিবাজ নায়ায়নী অনেক মেপেই খেলার দান ফেলেছিল।তার দুই কন্যার বিবাহ হয়েছিল বেশ ভালো ঘরে।সচ্ছল ঘর, সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েদের বিয়ে ভালোঘরে সক্ষম চাকুরী বা ব্যবসায়ী বর পাওয়া তো স্বাভাবিক!

বড় জামাই সরকারী চাকুরে, কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে থাকত।ছোট জামাই একটু দুর গ্রামের ধনী, পাইকারি ধান্য ব্যবসায়ী,আবার এক রাইস মিলের অংশীদার। ছোট জামাই সুধাময় এই গ্রামে মাঝে মাঝেই আসত তার ব্যাবসা ও মিলের কাজে। ভানু ছিল একটু যেন অন্যরকম, বয়স আটাশ । দুই বোন স্বাভাবিক হলেও সেছিল মানসিক ও শারীরিক ভাবে কমজোরী।উচ্চতা পাঁচ ফুটের কম ,আর দেহের তুলনায় মাথাটা ছিল বেশ বড়।বামন ঠিক নয়। তবে তেমনই হাবভাব। কথাবার্তা একটু ধীরে ধীরে টেনে বলত। স্পষ্ট কিন্ত কেমন যেন তার অস্বাভাবিক গলার স্বর।ক্লাস টেন অবধি পড়াশোনা পাশ না করুক,ভানু হিসাবটা একটু বোঝে,তাই হাস্কিং মিলে ক্যাশে বসত।

পাড়ার মানুষ আড়াল বলত, ভানু নাকি জড়বুদ্ধির মানুষদের মত,বেশীদিন ও বাঁচবে না।নারায়ণীর সামনে এসব কথা বললে তাকে ঝাঁটা মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে।তবে নারায়ণী নিজেও ছেলের খামতি জানত। যত বয়স বাড়ছে ততই যেন তার অস্বাভাবিকতা বাড়ছিল। নারায়ণী তিন সন্তানের জন্মের পর পরেই নিজেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যাবস্থা করে নিয়েছিল।তাই তার এত সম্পদ,ভোগ করতে, বংশে বাতি দিতে ছেলের বিয়ের দরকার।ছেলের জন্য বৌ,গরীবের মেয়ে হবে,দেখতে ভালো হবে, তবে তো তার পরবর্তী প্রজন্মের রূপ হবে! আর বয়স কম চাই,শিক্ষা কম চাই,যাতে বৌমার সাহস রুচীবোধ কম থাকে ,ভয় ভীতি থাকে।

অনেক ভেবেচিন্তে বাসুদেবের বড় মেয়ে রীনাকে নারায়ণী এক রকম নিজে যোগাযোগ করে ঘরের বৌ করেছিল। বাসুদেব গরীব কৃপন, ধনী ঘরের কাঙ্গাল, রুচী রূপের ধারধারেনা।আরও দুটো ছোট মেয়ে আছে। মেয়েদের ধনী সচ্ছল ঘরে বিয়েটাই আসল, খাওয়া পরার কখনও অভাব হবে না। আরামে থাকবে।সমাজে প্রতিষ্ঠিত এমন পরিবার তার আদর্শ, তাতে পাত্র একটু দেখতে খারাপ হলে দোষের কী! সোনার আংটি আবার সোজা বাঁকা হয় নাকি! সবই সম দামি।

রীনাকে শাশুড়ি তার নিজের গহনায় ফুল শয্যার রাতে শরীর ভরিয়ে দিয়েছিল। রীনা অবাক বিষ্ময়ে ভাবছিস এত গহনা সব সোনার! চল্লিশ ভড়ি তো হবেই। শাশুড়ি নারায়ণী বলেছিল, এসব আমার মানে আজ থেকে তোমার। তুমিই তো এ বাড়ীর ভবিষ্যত প্রজন্মের মা।রীনার মন খুসীতে ভরে গেছিল।গরীব ঘরের মেয়ে এমন বড় ঘরে বিয়ে ভাবতে পারছিল না।বড় বিল্ডিং বিদ্যুতের আলোয় সারা বাড়ি ঝলমল করছে।সেটা আটের দশকের প্রথম।গ্রামে বিদ্যুত এসেছে তখন দশ বছর।তার বাপের বাড়িতে তখনও বিদ্যুত ছিল না। তাদের মাটকোঠার ঘর। অভাবী গরীব গরীব মনের রীনার মন হতচকিত।

ছোট দুই ননদ বেশ সুন্দরী আধুনিকা আর বয়সে বেশ বড়।তাদের মুখে বৌদি ডাক শুনে কেমন লজ্জা করে। আবার ননদের বর গুলো তার সাথে রসিকতা করছে !ছবি তুলছে !বৌদি বৌদি ডাকে সে তো রীতিমত নার্ভাস বোধ করছিল। নারায়ণী তার ভুলটা ভেঙ্গে দিল। "তুমি সম্মানে ওদের চেয়ে বড়। বয়সটা কোন ব্যাপার নয়।এটাই এই বাড়ির রীতি। নিজের সম্মান নিতে শিখবে।"

ফুল শয্যার অনুষ্ঠানের দিন সন্ধের সময় স্বামী তার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল মিটমিট করে,কোন কথা বলেনি । তার আত্মীয়স্বজন রীনাকে নিয়ে মেতে উঠেছিল। নিরীহ ভানু কেমন একা একা বোকার মত একটা চেয়ারে নীরবে বসেছিল। কেমন যেন অনাহুত! অস্বস্তিতে ছিল। ফুল শয্যার রাত,মেয়েদের একটা অন্যরকম আবেগ ভয় আনন্দ অনুভূতি থাকে। যাদের প্রেমে বিয়ে, বর  পূর্ব পরিচিত তাদের ব্যাতিক্রম হতেই পারে।কিন্ত এক অপরিচিত পুরুষের সাথে প্রথম রাতটা এক থাকা রীতিমত সংশয় উদ্বেগের।বিশেষত এই ষোল সতের বছর বয়সে, রীনার খুব ভয় করছিল। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy