বিকৃত কামনিবৃত্তি
বিকৃত কামনিবৃত্তি
বাসের অপেক্ষায় স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে আরও দু-চার জন দাঁড়িয়ে। আমি তাকিয়ে আছি বাসটির আসার গতিপথের দিকে। "সকল ভীড় বাসে একজন অন্তত বিকার-মনস্ক পুরুষ ওঠে...।" আমার মনে হলো, কাঁধের ওপর দিয়ে কেউ কথাটা বললো। ওটা শুনে চমকে উঠে বাঁদিকে তাকালাম। চোখে পড়লো, সামনের দাঁতগুলো বার করে সেই ব্যক্তি শব্দহীন হাসি নিয়ে ঠিক আমারই দিকে তাকিয়ে। একেবারে অচেনা এক লোক। জিজ্ঞেস করলাম, "ব্যাপার কী? কী যেন একটা বললেন?" তৎক্ষণাৎ আমার প্রশ্নের কোনো জবাব পেলাম না। একইভাবে দাঁত ছড়িয়ে সে আমাকে প্রশ্ন করে, "আপনি কি ভীড় বাসে ওঠেন?" তার একথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো না তবুও আমি বললাম, "বেশিরভাগ সময় উঠিনা। একান্ত বাধ্য হলে কী করবো, আমাদের গাড়িগুলোর যা বিচ্ছিরি অবস্থা! সবসময় তারা গাদাগাদি করে লোক তোলে।" সে তার মধ্যে জমে থাকা কথা কাউকে বলার সুযোগ পেয়েছে এমনভাবে আমার দিকে কৌতূহলভরে তাকালো। মনে মনে ভাবছি, আমাকে এসব কথা সে বলছে কেন? সে সেই একই ভঙ্গিতে আবার বলা শুরু করলো, "একটি ভীড় বাস মেয়েদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। কত রকমভাবে তারা হেনস্তা হয় জানেন? ...আমি কিন্তু জানি। আসলে নারী ও পুরুষ হলো সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্য। যেমন ধরুন, খড় আর আগুন। অযাচিত হস্তগত হলে যেকোনো সম্পত্তির অপব্যবহার ঘটবে, এটি জেনে রাখবেন। হ্যাঁ, বিশ্বাস হোক বা না হোক এটাই বাস্তব।" অপরিচিত লোকটির এই কথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ হতবাক হয়ে গেলাম। আমার নির্ধারিত বাসে ওঠার কথা আমি ক্ষণেকের জন্য ভুলে গেলাম। কিন্তু তখনও তার কথা শেষ হয়নি। সে বলতে থাকে, "আপনি যেভাবে ভাবতে পারেন সেভাবেই একজন নারী ভীড়ের মধ্যে হেনস্তা হতে পারে। তবে অনেকসময় তারা খেয়াল করে দেখে না, সেটা ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে করা হচ্ছে। চতুর শিকারীরা হিসাব কষে এগোয়। তারপর সে তার নিজের হিসাবটা বুঝে নেয়। আপনি হয়তো ভাবছেন এটা কী রকম এক মারাত্মক কথা হলো! তাই না? হ্যাঁ, ঠিক তাই। আর এই অবস্থার সাথে কিসের তুলনা করা যায় জানেন?...জলে ডোবা কোনো বস্তু। জল ডুবন্ত বস্তুকে সর্বদিকেই চাপ দিতে পারে, আর্কিমিদিস বলেছেন। তখন নিজের গন্তব্যস্থল কতক্ষণে আসবে এটা ভাবা ছাড়া তাদের কিছু করার থাকেনা, লজ্জার ভয়ে শুধু। বলছি কী, আপনি বিয়ে করেছেন?" হঠাৎ একি এক অদ্ভুত প্রশ্ন! ভিতরে ভিতরে খানিক বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, "হ্যাঁ, করেছি, কিন্তু কেন এমন প্রশ্ন করছেন!" আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো, "ভীড়ঠাসা গাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে উঠতে যাবেন না যেন।" তার এই অতি পাগলামি শুনতে শুনতে ইতিমধ্যেই আমি আমার রুটের দু'খানা বাস মিস করেছি। তার কথা শেষ হতে মাত্র ভীড়ে ঠাসাঠাসি করা একটা বাস এসে স্টপেজে দাঁড়ালো। হঠাৎ সে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে সে শেষ বাক্যটি বললো, "ওই যে আমার বাস এসে গেছে - আমার কথাটা ভুলে যাবেন না, এখন আসছি।" একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির এইরূপ অদ্ভুত আলাপে কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে গেলাম। জনাকীর্ণ সেই বাসটি এবার চলতে শুরু করলো। বাসের ভেতর যতটুকু দৃষ্টি যায় দেখতে পেলাম, সে আস্তে আস্তে ওর মধ্যে নিজের সুবিধামতো জায়গা করে নিচ্ছে।
© এবার আমিও বিদায় নিচ্ছি।