বিদায় বেলা
বিদায় বেলা
[এই গল্পটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত ও চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে লেখা। কারও চিন্তাভাবনায় যদি আঘাত লাগে সেটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং এর জন্য আমি দুঃখিত।]
আজকাল প্রায়শই আনমোনা হয়ে পড়ে। অনেক রকম চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। ভাবনাগুলো আদোও যুক্তি সঙ্গত কিনা তা সে নিজেই জানে না। তবুও ভাবনাগুলোকে আটকে রাখতে পারে না পিউ। কেউ ডাকলে সহজে সাড়া দেয় না। মা তো তাকে প্রতিদিন বলে-
" কি এতো ভাবিস বলতো? "
এর উত্তরে পিউ কোনো উত্তর দেয় না। হয় হাসে নাহলে শুধু হুম্ করে। তার খালি মনে হয় যদি আরএকবার ছোট বেলায় ফিরে যাওয়া যেত। তাহলে মা-বাবার আদর বকুনিগুলো আবার করে প্রান ভোরে উপভোগ করত। কারণ মা-বাবাও যে আজকাল তাকে আর বকে না। পিউ মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যায়। কেন তারা আর তাকে বকে না? বিয়ে হতে তো এখনও এক মাস দেরি আছে। এখনি কি সে পর হয়ে গেল? তার ভাইও আর তার সাথে মারপিঠ করতে আসে না। পিউ যদি ওর ভাইকে চিমটি কাটে তাহলে ভাই শুধু উহ্ করে। কিন্তু প্রতিবাদে পিউকে চিমটি কাটতে আসে না। যেটা আগে কখনও হয়নি। পিউ যখন বসে থাকে তখন ওর ভাই মাঝে মধ্যে এসে ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর পিউরও কেমন জানি কান্না পায়। তার বাবা মাঝে মাঝে একটা কথা বেশ বলতেন-
" মেয়েরা হল অন্যের সম্পত্তি। তাদেরকে যত্ন করে রাখতে হয়। "
পিউ যখন ছোট ছিল তখন এই কথাটার মানে বুঝত না। কিন্তু যত সে বড়ো হতে লাগল তত সে বুঝতে শুরু করল মেয়েরা সারাজীবন চাইলেই নিজের মা বাবার কাছে থেকে যেতে পারে না। মেয়রা সত্যি অন্যের সম্পত্তি। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। মেয়েরা কি সত্যি অন্যের সম্পত্তি? বিয়ের সময় বাবারা যে নিজের মেয়েকে অন্যের কাছে দান করে দেয় কন্যা দান রীতি অনুযায়ী। মেয়রা কি কোনো পণ্য যে তাদের দান করে দেওয়া হয়? এই প্রশ্নটা বেশি করে পিউর মাথায় গেঁথে গেছিল বন্ধুদের সাথে নন্দনে " ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি " সিনেমাটা দেখতে গিয়ে। বাড়ি এসে সে মাকে এই প্রশ্নটাই করেছিল যেমনটা সিনেমায় ছিল। তার মা উত্তরে বলেছিলেন-
" ঐসব সিনেমাতেই ঠিক আছে। বাস্তবে এসব হয় না। যেই নিয়ম যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে সেটাই তো পালন হবে নাকি? "
মার এই কথায় পিউর সেদিন খুব রাগ হয়েছিল। তার মা তো নিজেও একজন মেয়ে। তাহলে সে কি করে এই কথাটা বলতে পারে?
আসলে মায়েদের কি দোষ? আমাদের সমাজে আদি অন্তকাল ধরে যা সব নিয়ম চলে এসেছে তার গণ্ডি থেকে তো আজ পর্যন্ত আমরা কেউ বেরোতে পারলাম না। আমরা যতই পড়াশুনোর জন্য বা চাকরির জন্য দেশ-বিদেশে ঘুরি না কেন অথবা আধুনিক মতামত গুলো নিয়ে যতই সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করি না কেন আচার-অনুষ্ঠানের সময় সেই পুরাতন নিয়মের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে যাই।
তিন বছর আগে পিউ যখন একটি দীর্ঘকালীন প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে বেড়িয়ে এসেছিল সেদিন সে নিজের মনে মনেই ভেবে রেখেছিল কখনও কাউকে বিয়ে করবে না। কিন্তু মানুষের মন তো সব ধরনের কাঠিন্যকে মেনে নিতে পারে না। পিউর একাকীত্বটা তার বাবা খুব ভালো করেই বুঝেছিল। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন যে এবার তার মেয়র একজন জীবনসঙ্গী দরকার। যদিও পাত্র খোঁজার আগে মেয়ের মতামতটা চেয়ে নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি পিউকে বলেছিলেন-
" পিউ মা তোর কিন্তু এখন একজন কাউকে দরকার। সে তুই নিজে মুখে স্বীকার না করিস্ তবে আমি কিন্তু বুঝি। একটা বয়সের পর ছেলে কি মেয়ে সবারই একজন কাউকে দরকার। "
" কেন? তোমরা আছো তো। আমার আর কাউকে দরকার নেই। আমি এইভাবেই ভালো আছি। "
পিউর বাবাও নাছরবান্দা। তিনি বললেন-
" সে তুই যাই বলিস্। আমরা তো আর সারাজীবন থাকব না। আমাদের অনুপস্থিতিতে কেউ একজন তোর পাশে থাকলে তাহলে আমরা মরে গিয়ে শান্তি পাব। "
" তাই কি বাবা? সত্যিই কি তোমাদের থেকে কেউ আমাকে বেশি ভালবাসতে পারবে? মা-বাবার উপরে তো কেউ যেতে পারে না। "
পিউর বাবা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিয়ে বললেন-
" সেটা হয়তো নয়। তবুও কেউ একজন থাকাটা দরকার। পেপারে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে তোর মতামতটা জানতে আসলাম। "
" আমার মতামত জানতে এসেছ নাকি নিজেদের মতামতটা জানাতে এসেছ? "
তিনি এবার গলার স্বর কঠিন করে বললেন-
" ছোটবেলা থেকে তোর ইচ্ছে গুলোকেই গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু আজ শেষ বারের মতো আমাদের কথা শোন। এরপর কখনও কিছু বলব না। "
তিনি ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে পিউর চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। নিজে মনে মনে ভাবে সন্তানের জন্য মা-বাবাদের যে চিন্তা হবে এতাই তো স্বাভাবিক। তবে পিউর যে মাঝে মাঝে একা লাগে এটা সে অস্বীকার করতে পারবে না। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যতই থাকুক না কেন তাদের সাথে তো সব কথা শেয়ার করা যায় না।
চার মাস হল অনির্বাণের সাথে পিউর আলাপ হয়েছে। যার সাথেই এক মাস পর পিউর বিয়ে। ছেলেটির হাসিটা পিউর খুব পছন্দ হয়েছে। এমন মিষ্টি হাসি সচরাচর ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। পাকা কথা বলার আগে ছেলেটার সাথে পিউর খুব বিশেষ কথা হয়নি। একবার ভিক্টরিয়ায় দেখা করা আর বার কয়েক ফোন কথা বলার পরই দুজনেই নিজের মতামত বাড়িতে জানিয়ে দেয়। সেদিন দু-বাড়িতেই আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। অনির্বাণ একদিকে ভালোই। এখনও অব্দি খারাপ কিছু পিউর চোখে পড়েনি। কিন্তু শেষমেশ একটা খটকা থেকেই যায়। এই কয়েকটা মাসে কি আর একটা মানুষকে চেনা যায়?
সময়তো নিজের ছন্দেই চলে। সে কারও জন্য থেমে থাকে না। তাই পিউর মনের দোলাচলকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বিয়ের দিনটাকে সাথে করে নিয়ে ঠিক সময় মতো হাজির হয়েছে চলমান সময়। গত সাতদিন ধরেই বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আজকে তো তিল ধারনের জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। বাড়ি ভর্তি গম গম করছে লোকজন। সকাল থেকে তার বন্ধুরাও এসে গেছে। সবার কথা বলা, হাসি ঠাট্টা নিয়ে পিউ এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে মন খারাপের সুযোগটাই পাচ্ছে না।
বিয়ের সাজে পিউ যখন একটু একটু করে সেজে উঠছিল তখন তার মনে হচ্ছিল এই সাজের মতোই একটু একটু করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গুলো তার জীবনে প্রবেশ করছে। বিয়ের সময় কন্যা দান করতে গিয়ে পিউর বাবা যখন তার হাতটা অনির্বাণের হাতে তুলে দিল তখন তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। সে তো কোনো বস্তু নয়। একটা মানুষকে কেন এইভাবে দান করা হবে? তার বাবাও এটা কিভাবে করতে পারলেন? হয়তো ওনারও মনটা ভেতর থেকে কেঁদে উঠেছিল। অনির্বাণ সেই সময় হাসি মুখে পিউর দিকে তাকালেও সে মাথা নিচু করেই ছিল। তার মনে হতে লাগল আমি তো কারও সম্পত্তি নই। তাহলে এই ভাবে কেন আমায় দান করে দেওয়া হল? কিন্তু প্রতিবাদের কোনো জায়গা যে নেই। সেও যে সমাজের চিরাচরিত বন্ধনে আবদ্ধ।
বিয়ের সবথেকে শিহরণ জাগানো মুহূর্তে পিউর চোখের জল আর কোনো বাঁধ মানেনি। সিঁদুর দানের পর তার জীবনের সব নিয়ম গুলো উলটপালট হয়ে গেল। এক লহমায় তার জীবন অনেকটাই ভারি হয়ে গেল যেই ভার তাকে সারাজীবন বইতে হবে।
বিদায়ের দিন সকাল থেকে পিউর মনটা খারাপ। তার কারণটা বলার আর দরকার নেই। যেটুকু হাসছে সবটাই কৃত্তিম। মা-বাবার মন খারাপ থাকলেও তারা সেটা প্রকাশ করছেন না। সন্ধ্যেবেলায় সাজগোজ করে সবার থেকে আশীর্বাদ নিয়ে পিউ যখন বিদায় নেবে তখন তার আশেপাশে প্রায় সকলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু সে একটাই প্রশ্ন সবাইকে করতে চাইল। আমার বিদায়ে যদি সবার এতো কষ্ট হয় তবে কেন এতো আয়জন করে আমার বিদায়ের ব্যবস্থা করলে? কোথায় অনির্বাণকে তো নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে আমার বাড়িতে থাকতে হবে না। তবে কেন আমাকেই সব ছাড়তে হবে? কারণ আমি মেয়ে বলে? একটা মেয়ে যখন তার সব কিছু ছেড়ে স্বামীর কাছে চলে যায় তখন সেটা অনেকটা একটা গাছকে শেকড় উপড়ে অন্য মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার মতো। যুগ যুগ ধরে কেন মেয়েরা এই শাস্তিটা পেয়ে আসছে তার উত্তর কারও জানা নেই। পিউ যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখন তার ভাই পাশে এসে বলে-
" দিদি এই নে। এটা তোর জন্য। তুই তো রাতে টেডি ছাড়া ঘুমাতে পারিস না। তাই এটা তোর জন্য। "
পিউ টেডিটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই তার ভাই দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। হয়তো ঘরে এক কোণায় বসে কাঁদবে। এতোক্ষণ ধরে তার চোখ দিয়ে কোনো জল পড়ছিল না। এবার সে টেডিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। এরপর পিউর বিবাহিত জিবনটা কেমন যাবে জানা নেই। সেটা যেমনি হোক না কেন। তবে এই বিদায় বেলাটা সব মেয়েদের জীবনে একবার হলেও আসে। যেইসময় একটি মেয়ে তার সব থেকে প্রিয় মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে, নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা গুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একটা নতুন জীবনের পথে পা বাড়ায়।