ভুতকাকু
ভুতকাকু
সাতগ্রামের পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায় বলছি । রাতের ট্রেনে কেউ কখনও স্টেশনে নেমে একা একা বাড়ি যাবেন না । আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি তাদের কথা বলছি যারা শহর থেকে ফিরছেন রাতের বেলা এবং একলা ।
খুব সাবধান ! রাতের ট্রেনে নেমে এই গ্রামে আসেন তো সঙ্গে অবশ্যই লোকজন রাখবেন । নইলে আমার মত ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন । আপনাদের মঙ্গলের জন্য আমার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে গেলাম।।
উপদেশ হিসাবে মেনে চলুন অথবা পরিস্থিতির শিকার হোন। যেটা আপনাদের পছন্দ । এবার শুরু করি বলতে।
ট্রেন চলেছে মন্থর গতিতে। একে আড়াই ঘণ্টা লেটে রাণ করছে । তায় এই মন্দ গতি আমাকে বিস্তর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এ ভাবে চললে আমার গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যাবে ।
স্টেশনে নেমে দু'মাইল পথ হেঁটে তবে বাড়ি যাব । গ্রাম আর স্টেশনের মাঝে একটা মরা নদী রয়েছে। বর্ষার কয়েকটা দিন বাদ দিলে সারা বছরই নদীতে জল থাকে না। নদীর ঘাটে যে শ্মশান আছে তা' এড়িয়ে গ্রামে পৌঁছানো সহজ কাজ নয় ।
ট্রেনে উঠে খুঁজে বেড়িয়েছি কোন পরিচিত জন আছে কি না । কাউকে পাইনি । এদিকে এগারোটা দশ নাগাদ ট্রেন এসে থামল আমাদের ছোট্ট স্টেশনে । স্টেশন ঠিক নয়; আশপাশের গ্রামের লোকজন ডেপুটেশন দিয়ে দুজোড়া লোকাল ট্রেনের থামানোর বন্দোবস্ত করেছে। মানে হল্ট স্টেশন । কোন প্লাটফর্ম বা টিকিটঘর নেই । জাস্ট মাঝপথে ট্রেন থেমে গেলে যে অবস্থা তেমনি এই হল্ট স্টেশন ।
যাই হোক , কাউকে পাইনি সেটা বড় কথা নয় । বড় কথা হল স্টেশন থেকে বাড়ি যেতে ওই শ্মশান ঘাটটা। শুনেছি ওখানে নাকি শ্যাওড়া গাছে ভুত থাকে । দিনের বেলা হলে বিশ্বাস করতাম না । কিন্তু এই মাঝরাতে?
চার বছর যাতায়াত করছি । কোনদিন এই পরিস্থিতিতে পড়িনি । মেঠো পথ । ধানক্ষেতের আল ধরে এঁকেবেঁকে পথ করে নিয়েছি । নদীর পাড়ে পলাশ, শ্যাওড়া আর কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে শ্মশান ঘাটে নামতে হবে । তারপর বাড়ি যাবার মোরাম বিছানো রাস্তা ।
সেদিন কোন মড়া পুড়েছে কি না জানি না; তবে চাঁদের আলোয় যে টুকু মনে হল ওখানে সদ্য কাউকে পুড়িয়ে গেছে। এখনও কাঠ কয়লা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
উপায় তো নেই ; সাহসী হতেই হল । নইলে কোথায় রাত কাটাব ? সাহস করে নদীতে নেমে পড়লাম । জল তো নেই; তবে পায়ের জুতোটা ভিজে গেছে মনে হল । পায়ে হাত দিতে বোঝা গেল জল নয় ; তবে জলের মতই তরল নির্গত হয়েছে আর কোমরের নীচ থেকে পা পর্য্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে।
পাড় বেয়ে উপরে উঠছি মোরাম দেওয়া রাস্তা ধরব বলে।
পিঠে একটা আলতো ছোঁয়া পেলাম। ঘাড় না ঘুরিয়ে আর একটু জোরে পা চালিয়ে দিলাম। কানের কাছে মুখ রেখে কে যেন বলল - ভাইপো ! এত রাতে কোথা থেকে আসছিস?
এবার পিছনে ফিরতেই হল । দেখি হরিকাকা। কিন্তু হরিকাকা তো ভীষণ অসুস্থ! কি করে এত রাতে তিনি এখানে আসবেন ?
খোনা খোনা গলায় হরিকাকা বললেন - ভয় পেলি নাকি বাছা ?
এ যে নাকীসুর ! আমার খুবই চেনা । এর আগেও আমি এই সুরে জ্যান্ত মানুষের কন্ঠস্বর শুনেছি। তাই সাহস করে বললাম - ভয় ? হে হে হে ! কি যে বল না কাকা !
- আমি বলছি না রে । আমার প্রেতাত্মা কথা বলছে।
বলে তিনি আমার হাতটা ধরলেন । একটা হিমশীতল পরশ পেয়ে এবার সত্যিই চমকে উঠলাম। শুনেছি ভুত প্রেত শাঁকচুন্নীদের শরীর নাকি বরফের মত ঠাণ্ডা । ভয় পেলাম । কিন্তু সাহস করে বললাম - তুমি তো কয়েকমাস ধরে বিছানায় পড়েছিলে !
- ছিলাম । এখন এখানে অবস্থান করছি ।
- মানে ? তুমি কি মরে গেছ ?
হরিকাকা এক লহমার জন্য আমাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা ঢাকা । গোটা শরীরে আগুন লেগে আছে যেন । সোনালী হাড়গুলো পুড়ছে ।
বললেন - মুখটা দেখাব নাকি ?
আবার হাত ধরলেন । সেই একই অনুভূতি। হিমের পরশ পেলাম। অথচ দেখতে পাচ্ছি আগুনের লেলিহান শিখা।
আর সাহস ধরে রাখতে পারলাম না। তখন যেন অজ্ঞান হবার দশা । তবু মনে মনে ভাবলাম পরিচিত লাশের ভুত। ভাইপো বলে ডেকেছে যখন ; নিশ্চয় কোন ক্ষতি করবে না।
কিন্তু সে ধারণা যে কত ভুল ; পরক্ষণেই টের পেলাম। আমাকে চিতায় তুলে দিয়ে হরিকাকা নাকীসুরে বলতে লাগলেন - আছ ক'মাস খেতে পারিনি রে , আজ পেট পুরে খাব।
অবাক কাণ্ড ! চিতায় শুয়ে আছি অথচ আমার শরীরে কোনরকম আগুনের আঁচ পাচ্ছি না । সামনেই একটা শেয়াল ছোক ছোক করছে। আধ পোড়া হাড় মাংস টেনে টেনে খাচ্ছে ।
বললাম - কাকা ! তুমি তো এমন নিষ্ঠুর ছিলে না ! আমাকে কতবার ছোলা ভাজা খাইয়েছ । আজ কি এমন করলাম যে তুমি আমার মাংস খেতে চাইছ ?
- আমি কেন খাব রে ! দেখছিস না ! শিয়ালটা কি করছে। ও: বাবা রে বারে বাবা ! মরেও শান্তি নাই !
বললাম - কাকু ( ভয়ে কাকা থেকে কাকু বলে আদুরে ডাক দিলাম ) । প্লীজ তুমি আমাকে বাঁচাও।
হরিকাকা বললেন - বাঁচিয়ে দিলাম তো । একা একা এত রাতে কেউ শ্মশানে আসে ? ওই দেখ শাঁকচুন্নীগুলো কেমন জটলা পাকাচ্ছে। নেহাৎ আমি নতুন; এখনও পরিচয় হয়নি । ওরাই তো তোর পিছু নিয়েছিল । তোকে খাবে বলে উল্লাস করছিল । ঠিক সময়ে আমি এসে তোর পথ না আটকালে কি দশা করত তোর , বল তো !
দেখলাম শ্যাওড়া গাছে ওরা পা দুলিয়ে গল্প করছে।
ওর তলা দিয়েই তো রাস্তা ! গেলেই গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত । বললাম - আমাকে চিতায় শুইয়ে রেখেছ কেন ? শেয়ালটা যদি কামড়ে দেয় ?
- ধূরর ! ও জ্যান্ত মানুষ খেতে পারবে না । দেখছিস না আধপোড়া টুকরোগুলো ঠুকরে ঠুকরে বের করছে !
বললাম - ও কাকা! আমাকে বাড়ি যেতে হেল্প কর না ।
- আরে সে কথাই তো ভাবছি । কোন পথ দিয়ে যাই। ওগুলো তো এখনও ঝুলছে ।
এবার ভয় কমল । হরিকাকার নির্দেশ দিলেন চল আজ ঘুরপথ ধরি।
কাকার কথায় অন্য পথ ধরে চলেছি। কিন্তু অতক্ষণ চলছি শ্মশানের শ্যাওড়া তলাতেই বারবার ফিরে আসছি।
একটা শাঁকচুনী হরি কাকাকে ধরে ফেলে - এঁই তেঁই কেঁডা?
দেখলাম হরিকাকা ঠকঠক করে কাঁপছে।
- আমি ফরি। এইমাত্র আমাকে পুড়িয়ে দিয়ে গেল ।
- ওঁ নোতুঁন এঁইচিস। আঁয় আঁয় বোঁচা। আঁমি খেঁচি। ভাল হল। এঁবার এঁকটা মরদ পেঁলুম ।
কাঁপতে কাঁপতে কাকা বলছেন - আমার বৌটা খুব কান্নাকাটি করছে রে । একটি বার দেখে আসি।
ওরা হি হি করে হাসছে। কারণ হরিকাকা আর মানুষ নেই, এখন মরে ভুত হয়ে গেছে।
- তোর পেঁচনে ওঁটা কেঁ রেঁ ! বেঁশ নাদুসনুদুস দেখতে!
হরিকাকা আমাকে লুকোবার চেষ্টা করতেই ওরা পাচ পাঁচজন শাঁকচুন্নী ঝপাঝপ গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে এল । হরিকাকার সে কি রুদ্রমূর্তি ! এই মারে কি সেই মারে। কিন্তু ওই তর্জন গর্জনই সার । রোগা পটকা হরিকাকা ওদের কাছে হেরে গিয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই আমি ওকে ধরে ফেললাম ।
আমার এই কাজে শাঁকচুন্নী বুঝি খুশি হল । আমাকে বলল - চল তোমাকে বাড়িতে রেখে আসি ।
আমি তো ভয়েই অস্থির । চেনাজানা ভুত ছেড়ে শাঁকচুন্নীর শরণ নিতে আমার মনুষ্যত্বে ঘা লাগল ।
কিন্তু নিরুপায় । বাড়ি তো পৌঁছাতেই হবে যে করেই হোক।
কাকা বলল - পাঁচু , যাবিনে - মারা পড়বি । ওই শাঁকচুন্নী
আমার আগের পক্ষের বৌ। ঠিক চিনতে পেরেছে। আর তোর বাবা ওর সাথে আমার ডিভোর্স করিয়ে দিয়েছিলেন বলে সুযোগ পেয়ে তার বদলা নিতে চাইছে। পালিয়ে আয়।
পালাব কি করে ? নরকস্থ কাকিমা যে আমার ঘাড় ধরে আছে !
এবার আমার পুরুষত্বে আঘাত লাগল । একটা পেত্নির কাছে পুরুষত্ব বিকিয়ে দেব ! নাহ্ তা তো হয় না । আমি সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম । তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘুরে চড়টা আমার ঘাড়েই পড়ল । আর পেত্নিটা তখন ছেড়ে দিয়েছে বলে আমিও লাফ দিলাম একটা - ব্যাঙের মত। হরি কাকা সুযোগ পেয়ে আমাকে নিয়ে কেটে পড়ল।
বাড়ি এসে দরজায় ঠকঠক করলাম । আসলে হাত দুটো ঠকঠকিয়ে কাঁপছিল তো - তাই কড়াটা ধরতেই নিজে থেকেই নাচতে লাগল ।
বাবা এসে দরজা খুলতেই বললেন - এসেছিস ? আমি তো ভাবলাম হরিকে সৎকার করে স্টেশনে চলে যাই তোকে নিতে---- । জানিস আজ বিকেলে হরিটা চলে গেল ।
আমি বললাম - যায়নি বাবা। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ওই দেখ ।
বাবা তো কাকাকে দেখে দাঁতি লেগে পড়ে গেলেন ।
আমি দেখলাম হরিকাকা পোড়া মুখ পিছন দিকে আমার দিকে ঘুরিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে থুড়ি এগিয়ে যাচ্ছে যে পথ ধরে এলাম সেই পথ ধরে ।
