ভাইরাসের কড়চা#৮ | এপ্রিল ফুল
ভাইরাসের কড়চা#৮ | এপ্রিল ফুল


০১ এপ্রিল ২০২০
পৃথিবী জুড়ে এখন একটাই খবর। ভাইরাস। যে কোনো মিডিয়া -- টিভি, খবরের কাগজ, ফেসবুক, হোঅ্যাটসঅ্যাপ, টুইটার আর যা যা আছে -- সব কিছুতে আমিই কেন্দ্রবিন্দু। সর্বত্রই যা কিছু আলোচনা চলছে তা আমাকে ঘিরে। আমিই সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশন, সেন্টারস্টেজ আমার দখলে, র্যাম্পে আমিই হাঁটছি - নানান রূপে, নিত্যনতুন ছন্দে। এই বাস্তবটার কথা ভাবলে বুকটা গর্বে ফুলে ওঠার কথা! আপনারা কি বলেন!
মনে মনে চিন্তা করছিলাম অন্য কথা। আর এক অন্য জাতের ভাইরাসকে নিয়ে। আজ থেকে ঠিক এগারো বছর আগে সেও কিন্তু গোটা পৃথিবীতে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। এক অসতর্ক মুহূর্তে টুক করে শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ে বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছিল বাহককে। মনে পড়ে তাকে? এই ডায়রি পড়া থামিয়ে গুগল করে বার করুন তো দেখি...
না সোয়াইন ফ্লু বা এইচ ওয়ান এন ওয়ান ভাইরাস নয়। ইবোলা, জাইকা? উহুঁ, তাও হলো না! একটা সঙ্কেত দিই?
সেই বিদিকিচ্ছি পরিস্থিতিতে এক বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা এক বিশাল পরিমাণ অর্থ, ২৫০ মিলিয়ন ডলার, মঞ্জুর করেছিল ঐ ভাইরাসকে সাবাড় করার জন্যে। সংস্থাটি মাইক্রোসফট। হ্যাঁ, ওটা ছিল একটা কম্পিউটার ভাইরাস। নামটাও মজাদার - এপ্রিল ফুল ভাইরাস। তার আসল লক্ষ্য ছিল মাইক্রোসফ্টের উইন্ডোজ এক্সপি আর উইন্ডোজ নাইন্টিফাইভ ও.এস অর্থাৎ অপারেটিং সিস্টেমে চলা কম্পিউটারগুলোকে বিগড়ে দেওয়া। অটোমেটিক আপডেট যারা অফ করে রেখেছিল, তারাই খুব সহজে এই ভাইরাসের শিকার হয়েছিল।
লকডাউনের একেবারে গোড়ার ক'দিন হকাররা বাড়িতে কাগজ বিলি করা বন্ধ করেছিল। ই-পেপারই ছিল ভরসা। সকলে অবশ্য সেটা পড়ার সুযোগ পেত না। অবস্থা শুধরেছে। এখন আগের মতোই রোজ খবরের কাগজ পৌঁছে যাচ্ছে বাড়িতে, লোকগুলোর হাতে গ্লাভস পরা।
মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বয়স্ক ভদ্রলোক, প্রবোধ সরকার, তাই একটু নিশ্চিন্ত। কাগজে চোখ না বোলালে হয়। এই অনন্তকাল বাড়িতে বন্দী হয়ে থাকার সময়টাতো কাটে! তা এহেন প্রবোধবাবু আজ সকালে খবরের কাগজ পড়েই চমকে উঠলেন। ডান হাতটা আপনা থেকেই মাথায় গিয়ে ঠেকল। বারান্দার চেয়ার ছেড়ে সোজা ছুটলেন গিন্নির উদ্দেশে।
লকডাউন শুরু হতে কিছু ঋণ প্রকল্পে তিনমাসের ই এম আই পরে দেওয়ার ছাড় ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সে খবরটা পড়ে কর্তা-গিন্নি দুজনেই খুব খুশি হয়েছিলেন। হবেন নাই বা কেন! একমাত্র ছেলে, বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে। কাজের সূত্রে দিল্লীতে থাকে। বউকেও নিয়ে গেছে সেখানে। ওখানেই থাকতে হবে জেনে দেখেশুনে সুবিধেমত একটা ফ্ল্যাটও কিনেছে আগের বছর। প্রবোধবাবুরা এর মধ্যে একবার ঘুরেও এসেছেন সেখানে। থ্রি বেডরুমের খোলামেলা ১১২০ স্ক্যোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। পরিবেশটা ভালো। বৌমা সাজিয়েছেও ছিমছাম। প্রবোধবাবু আড়ালে গিন্নিকে বলেছিলেন, দেখতে হবে তো কার ছেলে! এই বয়সেই কি বিচক্ষণতা! গিন্নিও হারতে চান নি। মুচকি হেসে বলেছিলেন - সে তুমি তোমার পুত্তুরকে নিয়ে গর্ব করো, বলার কিছু নেই। কিন্তু ঘরের লক্ষ্মীটা তো আমার পছন্দ, সেটাও স্বীকার করো!
কাগজটা হাতে নিয়েই প্রবোধবাবু আজ রান্না ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে বললেন - গিন্নি এই দ্যাখো...সরকারি এপ্রিল ফুল কাকে বলে! গিন্নি জয়তী বললেন - তুমি আবার কাকে এপ্রিল ফুল করলে, বাইরে বেরিয়েছিলে নাকি? ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে প্রবোধ বাবু বললেন - আরে না না, আমি না; এপ্রিল-জুন এই তিনমাসে সবরকমের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার ৭০ থেকে ১৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার!
টিভি চালানোও আজকাল দায়। সারাদিন প্রায় সবকটা চ্যানেলেই দিগগজদের সব আলাপ-আলোচনা আমাকে নিয়েই। দিনরাত এই মড়কের খবর চলে বলে কত্তা-গিন্নি বেজায় বিরক্ত। মনটাও দমে যায়। গিন্নি তো সেদিন বলেই বসলেন - কি দিনকাল দেখতে হচ্ছে! আর পেরে উঠি না বাপু। লোকে জীবনে ঈশ্বরের করুণা পেতে চায়, আর দেখো, বলিহারি যাই , আপদ এক করোনা করুণা বিলোচ্ছেন! এইজন্যেই বলে ঘোর কলি। কাল রাতে টিভি চলেই নি। মহানন্দে গান শুনছিলেন দুজনে বিছানায় শুয়ে। দু বছর কেনা সারেগামা কারভাঁতে। তাই আজ সকালে উঠেই এপ্রিল ফুল...
আরেক সরকারি এপ্রিল ফুলের কথাও আজ বিকেলে শুনলাম দুই সাংবাদিকের মধ্যে। ফোনে নিজেরা বলাবলি করছিল।
প্ৰথমজন - উত্তর কোরিয়ার কি খবর রে? বরাবর বলে চলেছে করোনা ওখানে থাবা বসায় নি। ওদের মধ্যে নাকি কোনো কোভিড আক্রান্ত নেই।
দ্বিতীয়জন - আজ সকালের বুলেটিনে নাকি ওরা বলেছে তিনজন আক্রান্ত!
প্রথমজন - এই নাকি মানে কি?
দ্বিতীয়জন - একটু আগেই ব্যাটারা রোল ব্যাক করেছে। বলেছে ওটা ভুল খবর ছিল। কেউ আক্রান্ত নেই ওদের দেশে এখন! বোঝাও যায় না কোনটা বেঠিক, কোনটা সঠিক!
প্রথমজন - হ্যাঁ, সেটা হতেও পারে...
দ্বিতীয়জন - কি ফালতু বকছিস্ তুই। এরকম আবার কখনো হয় নাকি, কনফার্মড না হয়েই ফার্স্ট বুলেটিন দিয়েছিল বলছিস্? তাও আবার সরকারী নিউজ চ্যানেলে!
প্রথমজন - আরে না না, ভেতরে খোঁজ নিয়ে দ্যাখ্, ওই তিনজনকে সেকেণ্ড বুলেটিনের আগে গুলি করে দিয়েছে হয়তো! হিসেব বরাবর!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়