ভাইরাস কড়চা#৪;নন্দীপুরের বন্দী
ভাইরাস কড়চা#৪;নন্দীপুরের বন্দী


২৮শে মার্চ, ২০২০
রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা, যাকে বলে শুনসান। দোকানপাট বন্ধ, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ নেই! প্রথম দিন এসে হর্নের আওয়াজে রীতিমত হকচকিয়ে গেছিলাম! যাইহোক, এখন বসন্ত চলছে; তাই কোকিলের কুহুকুহু মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছে ফুটপাথের ধারে থাকা গাছের পাতার আড়াল থেকে। খালি দু একটা এলাকার বাজারে এখনো বেশ ভিড় দেখছি। মনে হচ্ছে এসব এলাকার লোকের ঘটে বুদ্ধি কম। মুখে একটা পাতি মাস্ক পরে বা রুমাল জড়িয়ে এর ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাকসব্জি থেকে শুরু করে ডিম, মাছ, মুরগি সব কিনছে ব্যাগ ভর্তি করে।
এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জারী করা দূরে দূরে থাকার উপদেশ রেকর্ড করে পাড়ায় পাড়ায় কাল থেকে বাজানো হচ্ছে। তাও এদের কোন হুঁশ নেই। এদের দেশের সিনেমার মেগাস্টার টিভিতে বলছে হাত ধোও বারবার, হাঁচি, কাশি হলে মুখ রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে চাপা দাও। এমনকি মোবাইল ফোনে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে ডায়াল করলেই নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডারেরাও ঐ একই কথা রেকর্ডেড ভয়েস মেসেজে শুনিয়েই যাচ্ছে! কে শোনে কার কথা! ঐ যে বলে - চোরা না শোনে ধম্মের কাহিনী!
যাক, এতে আমারই পোয়াবারো! এরা যত থাকবে নির্বিকার ততোই বাড়বে আমার অত্যাচার!
তবে এই ব্যাপারে পুরোপুরি ক্রেডিট দেব বিলেত মানে বিদেশ ফেরত লোকেদের। ফিরে দেশের মাটিতে পা দিয়েই তেনারা অর্থাৎ সেই সব বাবু-বিবিরা এন্তার পার্টি করেছেন, মলে ঘুরেছেন, শপিং করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে পছন্দের সিনেমা দেখেছেন। কোথায় সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়িতে থাকবেন, তা নয়! আরো অনেককিছু করেছেন, মানে দু'তিন দিনেই সমাজটাকে চষে ফেলেছেন। এখন অনেক লোকজনকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের শোভা বাড়াচ্ছেন আই সি ইউ তে শুয়ে...
ওদিকে, যেদিন লকডাউন হলো, তার এক সপ্তাহ আগে নন্দীপুরের একজন ফিরলো লণ্ডন থেকে। অফিসের কাজে গেছিল একাই। বাবা, মা, বউ আর ছেলে বাড়িতে। এয়ারপোর্টে আসতে বারণ করে দিয়েছিল পরিবারকে। ছেলেকেও জানায়নি যে ও ফিরে আসছে। সর্দি কাশি কিচ্ছুটি নেই। এয়ারপোর্টের থার্মাল স্ক্রিনিং থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চড়ে বসলো অনেক বেশি টাকায় ভাড়া করা গাড়ির পেছনে - মাস্ক পরে। নিজের লাগেজে হাত দিতে দেয়নি ড্রাইভারকে। বাড়িতে ঢুকল দুপুর দুপুর। ছেলে তখন ভাতঘুম দিচ্ছে। বাকিদের সাথে দূর থেকে দেখা করে মালপত্র সমেত সোজা চলে গেল দোতলার একটা টয়লেট লাগোয়া ঘরে। নির্দিষ্ট সময়ে ডিসপোজেবল প্লেটে খাবার আসে ওর জন্য। দরজার তলা দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছিষ্ট ফেরত যায় একই ভাবে মুখবাঁধা প্লাস্টিকে। এই কদিন তালা দেওয়া আছে দোতলায়, যাতে ছেলে ওপরে যেতে না পারে। সে জানেও না যে বাবা ফিরে এসেছে। রোজ সন্ধ্যায় হোঅ্যাটসঅ্যাপ কল চলে বাবা ছেলের মধ্যে। সাত বছর বয়স হলেও টিভি দেখে ও অন্যদের কথাবার্তায় ছেলে বুঝতে পেরেছে যে বিদেশে এখন ঘোর বিপদ। তাই আজ সকালেই বলল বাবাকে - তুমি কালকেই আর্লিয়েস্ট অ্যাভেলেবল ফ্লাইটে চলে এস এখানে, কোয়ারান্টিনে থাকবে... ফোর্টিন ডেজ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়