Dola Bhattacharyya

Abstract Classics

4  

Dola Bhattacharyya

Abstract Classics

বেদব্রহ্ম

বেদব্রহ্ম

9 mins
187


রোজ কাকডাকা ভোরে ওঠা অভ্যাস মল্লিকার। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সম্মার্জনী হাতে আশ্রম প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সে । আকাশ এই মুহুর্তে মেঘাবরণে আবৃত। গতকাল রাতেও হয়েছে প্রবল বর্ষণ। কর্দমলিপ্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে মল্লিকা। তারপর সম্মার্জনী হাতে নিয়ে গোশালায় প্রবেশ করে। 

গোশালার কাজ সেরে যখন বাইরে আসে মল্লিকা, পুবের আকাশে তখন আলোর আভাস ফুটে উঠেছে , ঈষৎ রক্তিম ছোঁয়া লেগেছে তাতে । খানিক বিচলিত হয় মল্লিকা, বিলম্ব হয়ে গেল না তো! এখনও তো কত কাজ বাকি। স্নান করে এসে পূজার ফুল তুলতে হবে। পুজার ঘর মার্জনা করার পর পিতাঠাকুর বসবেন পূজায়। তারপর আছে পাঠাভ্যাস ।বিলম্ব হলে বড় রাগ করবেন পিতাঠাকুর। তবুও আশ্রম সংলগ্ন পুস্করিনীর দিকে না গিয়ে নীলাঞ্জনা নদীর দিকে পা বাড়ায় আশ্রম কন্যা মল্লিকা। 


নীলাঞ্জনায় অবগাহন সেরে উঠে আসার সময় কি যেন দেখে সহসা কেঁপে ওঠে মল্লিকার কোমল তনুখানি। অদূরবর্তী তমাল তরুর আড়ালে বাতাসে কম্পিত কাষায় বসনের প্রান্তভাগ নজরে পড়তে, ত্রস্ত পায়ে ফিরে চলে আশ্রম অভিমুখে। আকাশের সমস্ত মেঘ সরিয়ে দিয়ে তখন উদয় হলেন ভানু , আলোর প্রথম কিরণখানি দিয়ে স্পর্শ করলেন পৃথিবীর মাটি। ফিরে যেতে যেতেও পশ্চাতে অণুসরনকারী দুটি ভ্রমর কালো চোখের অস্তিত্ব টের পায় মল্লিকা। 


"আজ পাঠে তোমার মন নেই পুত্র! কেন? হঠাৎ কি কোনো সমস্যার উদ্ভব হয়েছে?" কন্যা কে আজ বড়ই অন্যমনস্ক মনে হওয়ায় প্রশ্ন করেন ঋষি কৌস্তুভ। পিতার চোখে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় অধোবদন মল্লিকা, অবনত মুখে বলে, 

"না পিতা ঠাকুর। সব কিছু ঠিকই আছে।" আবার পাঠে মনোনিবেশ করে মল্লিকা। 

পাঠাভ্যাস শেষ হলে মাতা গায়ত্রীর সঙ্গে রন্ধনশালায় কাজ থাকে মল্লিকার। আজ যেন কোনো কাজেই মন বসছে না তার। থেকে থেকেই মনে পড়ছে ঘন কৃষ্ণ দুই ভুরুর নিচে উজ্জ্বল একজোড়া চোখ। 


     শ্রাবণী পূর্ণিমার রাত আজ বড় উজ্জ্বল। জ্যোৎস্নার বাণ ডেকেছে চারিদিকে ।আশ্রম প্রাঙ্গণে বসে এই মুহূর্তে দুই সখী যুথী আর কামিনীর সাথে অলস সময় যাপন করছে মল্লিকা। রাত ক্রমে গভীর হয়। নৈশ প্রহরী জাগে। ঘুমে ঢুলে আসে তিন কন্যার নয়ন। শ্রাবণী পূর্ণিমার চাঁদ ঢেলে দেয় তার কিরণ সুধা। সখীদের সাথে নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় মল্লিকা। 


পরদিন প্রাতে, গোশালার কাজ সেরে নীলাঞ্জনার দিকে পা বাড়ায় মল্লিকা। আজ যুথী আর কামিনী ও রয়েছে সাথে। অবগাহনকালে মল্লিকার নজর যায় সেই তমাল তরুর দিকে, বৃক্ষের অন্তরালে আজও লুকিয়ে রয়েছে সেই দুটি চোখ । আজ মিলন হল দুইজনার দুই জোড়া চক্ষুর । বৃক্ষের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসে সুঠাম দেহী এক ঋষি কুমার, গৌতম ঋষির শিষ্য ব্রহ্মদেব। প্রথম পরিচয় থেকে ক্রমে গভীর অনুরাগ। একে অপরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ পরিনত হয় শুচি স্নিগ্ধ ভালোবাসায়। 


মল্লিকার আজকাল কি যেন হয়েছে। অধ্যয়নে মন নেই। রন্ধন গৃহেও মন বসে না।অধ্যয়নে অমনোযোগ হেতু পিতা ঠাকুর রুষ্ট হয়েছেন। মাতা ঠাকুরাণিও যথেষ্ট বিরক্ত। নিজেকে কেমন যেন মনে হয় ওর । যুথী আর কামিনী মুখ টিপে হাসে। বলে, "ওলো সই, তুই যে মরেছিস।" উদভ্রান্তের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে মল্লিকা। সখীরা বলে, "উতলা হোস না সই। তুই যে ভালোবেসেছিস। পিরীত কাঁটার যে বড় জ্বালা রে সই। সহ্য করতে হবে বৈকি।" 


বর্ষা কেটে শরৎ এসেছে।পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। রোদের রঙে লেগেছে সোনালী আভা, ভোরের বাতাসে হিমের পরশ। আবক্ষ নীলাঞ্জনার জলে দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণাম করছিল মল্লিকা। চোখ মেলে তাকাতেই নজরে পড়ল নদীতে সন্তরণ রত ব্রহ্মদেবের বলিষ্ঠ ঋজু দেহখানি। ব্রহ্মদেবও দেখতে পেলেন, মল্লিকার মুগ্ধ দৃষ্টি পরশ করছে তাঁর সর্বাঙ্গে। আবক্ষ জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মদেব বললেন, "হে কন্যা, আজ এই নিখিল প্রকৃতি কে সাক্ষী রেখে তোমাকে গ্রহণ করতে চাই আমি, অবশ্যই তোমার অনুমতি সাপেক্ষে। তুমি কি সম্মত? বলো আমাকে।" লজ্জার অরুণ আভা মল্লিকার দুই গন্ডদেশে, চপল দুটি আঁখি খুঁজে ফেরে সখীদ্বয় কে, "ওলো সই, কোথায় তোরা?" ব্রহ্মদেবের আবির্ভাবে আড়ালে সরে গিয়েছিল যুথী ও কামিনী । মল্লিকার ডাকে এখন সারা দিল তারা,

" আছি সই। কাছেই আছি "। ব্রহ্মদেব বললেন,

" তোমার মত জানাও কন্যা। আমি তোমার পানিপ্রার্থী।" সম্মতি দেয় মল্লিকা। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠেছে তার বদনমন্ডল। এই প্রথম মল্লিকার করস্পর্শ করলেন ব্রহ্মদেব। তরুণ ঋষির প্রশস্ত বক্ষপটে নিজেকে সমর্পন করল মল্লিকা। আবেশে বিহ্বল তার তণু। ক্ষণকাল পরে ব্রহ্মদেবের ডাকে সাড়া দিয়ে মুদ্রিত নয়ন মেলে চায় মল্লিকা। ব্রহ্মদেব বলেন, "মল্লিকা, গুরুর আদেশে আরো উচ্চতর সাধনার জন্য সুদূর হিমালয়ে যেতে হবে আমাকে। সে বড় দূর্গম স্হান। কবে ফিরব আমি জানি না। শুভ যাত্রার আগে তোমাকে একবার নিবিড় করে পেতে চাই। আমাদের এই মিলনের ফলে জন্ম নেবে এক পুত্র সন্তান । তাকে রক্ষার দায়িত্ব তোমার। বড় হলে সে হবে এই বৈদিক যুগের এক মহা ঋষি। তার নাম রেখো বেদ।তবে আমার পরিচয় তুমি গোপন রেখো। এই পুত্র যখন বড় হয়ে তার বাবার কথা জানতে চাইবে, তখন তাকে দিও আমার পরিচয়। এসো কন্যা। সম্মতি দাও, আমি প্রবিশ্ট হই তোমার দেহের অভ্যন্তরে।"

ব্রহ্মদেব ও মল্লিকার মিলনের সাক্ষী হয়ে রইলো নীলাঞ্জনা নদী, শরতের নীল আকাশ আর সবুজ বনভূমি। 


এই ঘটনার পর কেটে গেল বেশ কয়েকটি মাস। ঝরা পাতার মরশুম চলছে তখন । নিজের সর্বাঙ্গ আবৃত রেখে আসন্ন মাতৃত্বের লক্ষণকে গোপন রেখেছে মল্লিকা। কিন্তু আর কতদিন! কন্যার শরীরের দ্রুত অবনতি ঘটায় চিন্তিত গায়ত্রী দেবী। তাঁর অভিজ্ঞ চোখে খুব শীঘ্রই ধরা পড়ে গেল মল্লিকা। লজ্জায় অধোবদন মাতা গায়ত্রী। কন্যা কে প্রশ্ন করেন, "কে এই সন্তানের পিতা? বলো পুত্রী!" মল্লিকা নিরুত্তর ।পিতা ঠাকুরের প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না মল্লিকা। অবশেষে ধ্যান যোগে সকল কিছু জ্ঞাত হন ঋষি কৌস্তুভ। মল্লিকা কে বলেন, "এক কঠিন দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছো তুমি। সে দায়িত্ব পালনে কারোকে সাথে পাবে না । এ কঠিন কার্য তোমাকে একাই সম্পূর্ণ করতে হবে। আজ থেকে আর এই আশ্রমে নয়, আশ্রমের শেষ প্রান্তে ঘর বেঁধে থাকবে তুমি। সেখানেই তোমার সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। একাই সেই সন্তান কে মানুষ করবে তুমি। যাও পুত্রী ।বুঝে নাও আপন করণীয়। আশীর্বাদ করি, এক দেবকল্প সন্তানের জননী হও।"

আশ্রমের শেষপ্রান্তে কুটির বেঁধে বাস করতে শুরু করে মল্লিকা। যুথী আর কামিনীও এসেছে ওর সাথে। খুব সহজে আসতে পারে নি তারা। অনেক অনুনয় করে ঋষি কৌস্তুভের অনুমতি মিলেছে। দিনের পরে কেটে যায় দিন, মাসের পরে মাস। মল্লিকা এখন আসন্ন প্রসবা। 

দশমাস দশদিন পর জন্ম নিল ব্রহ্মদেব ও মল্লিকার পুত্র বেদ। 


 কেটে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর। বেদ এখন পঞ্চম বর্ষীয় বালক। মল্লিকা নিজের সন্তানের শিক্ষার ভার নিজের হাতেই তুলে নিয়েছে। দুরন্ত বালক বেদ। এতটুকু বয়সেই তার জ্ঞানের পিপাসা প্রবল। সাধ্যমত চেষ্টা করে মল্লিকা, ওর অনুসন্ধিৎসা মেটাতে। 

ধীরে বড় হয়ে উঠছে বেদ। দেখতে দেখতে দশম বর্ষে পড়ল সে। এবার তার উচ্চশিক্ষা দরকার। ব্রহ্মদেবের সন্তানকে যে এ যুগের ঋষি শ্রেষ্ঠ করে তুলতে হবে। মল্লিকা তাকে পিতা ঠাকুরের কাছে পাঠিয়ে দিল। এবার থেকে সে ঋষি কৌস্তুভের কাছে শিক্ষা লাভ করবে। 

দশবছর কেটে যাবার পরও ব্রহ্মদেব ফিরলেন না। আজও পথ চেয়ে আছে মল্লিকা । দীর্ঘ অপেক্ষার ফলে আজ বড় ক্লান্ত সে। সমস্ত ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে কর্তব্যে অবিচল থাকে তবু । এভাবেই কেটে যায় আরও অনেকগুলো বছর। বেদ এখন সদ্য তারুণ্যে উপনীত। ঋষি কৌস্তুভের কাছে শিক্ষা শেষ হয়েছে তার। উচ্চ শিক্ষার জন্য এবার তাকে যেতে হবে আরও দূরে। গুরুগৃহ থেকে মায়ের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় সে। মায়ের কাছে বিদায় নিতে হবে যে।দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রশ্ন জমে আছে বুকের ভেতর। সেই প্রশ্নের উত্তরও জানতে হবে আজ। "বলো মাগো, আমার পিতার নাম কি! কি তাঁর পরিচয়!" 

মল্লিকা বলে অপূর্ব সেই প্রেমের কাহিনী। পুত্রের কাছে আবেদন রাখে, "তুমি পারবে পুত্র, তাকে খুঁজে এনে দিতে! যদি তোমার পিতার দেখা পাও, তবে বোলো, আমি আজও অপেক্ষায় আছি তার।" 

চোখের জল মুছে পুত্রকে বিদায় দেয় মল্লিকা। আজ বোধহয় সমস্ত কাজ শেষ হল তার। এবার শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষাই তো করে যাচ্ছে সারা জীবন। সেই মানুষটা কি একেবারেই ভুলে গেছে তাকে! আর একবারও কি দেখা হতে পারে না তার সাথে! 


আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা নর্মদা। পাঁচ বছর আগে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে এখানে এসেছিল বেদ, মহর্ষি বিবস্বানের কাছে। শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। এবার ফেরার পালা ।ফিরে যাবার আগে একটি কার্য বাকি রয়ে গেছে। আপন পিতা ব্রহ্মদেবের খোঁজ। কিভাবে শুরু করবে সেই কার্য! নর্মদার তীরে বসে এসকলই চিন্তা করছিল বেদ। মালিনীর ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হল সহসা। "কিছু বলবে মালিনী"? প্রশ্ন করে বেদ। 

"গুরুদেব স্মরণ করেছেন আপনাকে"। কথাগুলো বলে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে মালিনী। দূরারোগ্য ব্যাধির কারণে দুটি চোখ তার দৃষ্টিহীন। খুব ছোট বয়সে গ্রাম প্রধানের নির্দেশে গ্রামের লোকেরা তাকে ফেলে যায় নর্মদার তীরে এক দূর্গম স্থানে। মহর্ষি বিবস্বান তাকে নিয়ে আসেন এই আশ্রমে। গুরুমাতার সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠে মালিনী। কিন্তু চোখের দৃষ্টি আর ফেরে না। সেই থেকে এখানেই আছে সে। চলাফেরা দেখে বোঝাই যায় না, মালিনী দৃষ্টিহীন। 


মহর্ষি বিবস্বানের কক্ষে এসে দাঁড়ায় বেদ, "আমাকে ডেকেছেন গুরুদেব"? 

"হ্যাঁ বৎস ।" 

"আদেশ করুন গুরুদেব"। 

বিবস্বান বলেন, "বিদিশা নগরীর শাসক, মহারাজ বরুনদেব, এক তর্ক সভার আয়োজন করেছেন। বিভিন্ন দেশের সেরা জ্ঞান সাধকরা আসবেন এই সভায়। তর্ক যুদ্ধে যে জয়ী হবে, তাকে এ যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সাধকের শিরোপা দেওয়া হবে। আমি চাই তুমি এই তর্ক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করো। 

"আপনার আদেশ শিরোধার্য গুরুদেব। আমাকে যাত্রার জন্য অনুমতি প্রদান করুন"। 

"আমার কথা এখনো শেষ হয়নি বৎস।" 

"বলুন গুরুদেব" ।

"মহারাজ বরুনদেবের পিতার রাজত্বকালে এমনই এক তর্ক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ব্রহ্মদেব নামে এক মহান ঋষি জয়ী হয়েছিলেন সেই তর্কযুদ্ধে। তা সত্ত্বেও তাঁকে বন্দি করা হয়, মহিলাদের প্রতি অসম্মান জনক আচরণের কারণে। আজও তিনি বন্দি আছেন কারাগারে। "

চমকে ওঠে বেদ," পিতা "! 

" হ্যাঁ বৎস, তোমার পিতা। তাঁকে উদ্ধার করার দায়িত্ব এখন তোমার"। 

বিস্মিত বেদ প্রশ্ন করে, " কি কারণে বন্দি হতে হয়েছিল তাঁকে? "

বেদের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি বিবস্বান বলেন," সেই সময়ে বিদিশা নগরীর শাসক ছিলেন মহারাজ আদিত্য দেব, মহারাজ বরুনদেবের পিতা। তিনি এক তর্কযুদ্ধের আয়োজন করেছিলেন সেই সময়ে। ব্রহ্মদেব এবং আমি দুজনেই যোগ দিয়েছিলাম এই সভায় । তর্কযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ রাজবাড়ির সম্মানিত অতিথি। তাঁদের সেবার দ্বায়িত্বে ছিলেন আদিত্যদেবের ছোটরাণী দেবী মন্দাকিনী। তরুণ ব্রহ্মদেবের রূপে আকৃষ্ট হন মন্দাকিনী। দেহজাত লালসার ফাঁদে জড়াতে চান তিনি ব্রহ্মদেব কে। কিন্তু সফল হতে পারেন না। অসন্তুষ্ট হন ব্রহ্মদেব। প্রত্যাখ্যাতা রাণী রুষ্ট হন ব্রহ্মদেবের প্রতি। মহারাজের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করেন মন্দাকিনী। তর্কযুদ্ধে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও কারাগারে বন্দি করা হয় তাঁকে, রাজকুলবধুর প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করার কারণে ।"

মহর্ষি বিবস্বানের কথা শেষ হতে বেদ বলে," পিতা বিদিশা নগরীতে বন্দি দশায় কাল কাটাচ্ছেন! আমাকে এতদিন বলেননি কেন গুরুদেব? "

" নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বৎস। এখন এসেছে সেই সময়। যাও বৎস, মুক্ত করো আপন পিতাকে।"

গুরুদেব কে প্রণাম জানিয়ে প্রস্থান করে বেদ। 


বিদিশা নগরীর রাজপ্রাসাদে আয়োজিত পরপর তিনদিন ব্যপী তর্ক যুদ্ধে জয়ী হল বেদ। অগাধ পান্ডিত্য তার। স্বীকার করলেন দেশ বিদেশের জ্ঞান সাধকগণ। বৈদিক যুগের মহা ঋষির সম্মান পেল বেদ। মহারাজ বরুনদেব বললেন," হে মহান ঋষি, আমি আপনাকে কিছু উপহার দিতে চাই, আপনার ইচ্ছা ব্যক্ত করুন"। দৃপ্ত কন্ঠে বেদ বলে, "মহারাজ, আজ থেকে কিছু বছর আগে এই সভাগৃহে অনুষ্ঠিত আর এক তর্কসভায় মহর্ষি ব্রহ্মদেব জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে বিনা অপরাধে বন্দি করা হয়েছিল। আজও বন্দি আছেন তিনি। আমি চাই তাঁর অপরাধের সত্যাসত্য বিচার করে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হোক।" 

রাজ নির্দেশে ব্রহ্মদেবকে কারাগার থেকে নিয়ে আসা হল। মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন," বলো বন্দি, কি অপরাধ করেছিলে তুমি "? 

" কোনো অপরাধ আমি করিনি রাজন ", দৃঢ় স্বরে বলেন ব্রহ্মদেব। 

" তাহলে তোমার শাস্তি হয়েছিল কেন "! 

" রাজমাতা মন্দাকিনী দেবী অর্থাৎ তৎকালীন ছোটরাণীমার দেওয়া প্রস্তাব আমি অগ্রাহ্য করেছিলাম।তাই আজও শাস্তি ভোগ করছি আমি। " 

" কি প্রস্তাব ছিল! আমাকে বলুন ঋষিবর"। 

" ক্ষমা করবেন রাজন। সে কথা বললে রাজমাতার অসম্মান হবে। কোনো নারীকে আমি অসম্মান করতে পারি না। বন্দি অবস্থায় ভালোই আছি আমি। অনুমতি করুন, আবার কারাগারে প্রস্থান করি "। 

ব্রহ্মদেবের এই কথাতেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল। একদিনের মধ্যে রাজমাতার সমস্ত ক্ষমতা হ্রাস করা হল। রাজমহলে থাকলেও এক সাধারণ নারী হয়েই থাকতে হবে তাঁকে। সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হল ব্রহ্মদেবকে। 


মুক্তি লাভের পর নিজের সন্তানকে দেখে আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলেন ব্রহ্মদেব। প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন তিনি বেদ কে। একসময়ে নিজের উচ্ছ্বাস সংবরন করে বললেন, "এতদিন বন্দি থাকার ফলে আমার সমস্ত তপোবল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই জীর্ণ দেহে নতুন করে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। তাই মনস্থ করেছি দেহত্যাগ করবার।পূণ্যতোয়া নর্মদার জলে আমার অস্থি বিসর্জন দিও পুত্র। তোমার জননীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করা আশু প্রয়োজন। তিনি যে দীর্ঘদিন ধরে আমার অপেক্ষায় রয়েছেন "। নর্মদার তীরে নির্জন এক স্থান দেখে ধ্যানমগ্ন হলেন ব্রহ্মদেব। 


রোজকার মতো সন্ধ্যা প্রদীপখানি হাতে তুলসী মঞ্চের কাছে এসে দাঁড়াল মল্লিকা। প্রদীপখানি রেখে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করল। প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াতেই অপার বিশ্ময়!" একী! আপনি! এতদিনে দয়া হল আপনার!" দূর্বল শরীর, বিস্ময়ের আধিক্যে বেতস লতার মতোই কম্পমান। "মল্লিকা বলে, স্বামী, এলেন যখন, আপনাকে সেবা করার অধিকারটুকু দিন এই হতভাগিনী কে।" স্মিত মুখে ব্রহ্মদেব বলেন, "একটি মাত্র রাত, আমি ধন্য হবো তোমার সেবায়। কাল ভোরের আলো ফোটার আগেই বিদায় নেব আমি "। সাশ্রু নয়নে মল্লিকা বলে, "বেশ। তাই হোক তবে।" ।


রাত শেষ হয়ে এল প্রায় ।পুবের আকাশে সবে মাত্র আলোর আভাস ফুটে উঠেছে । নর্মদার তীরে বসেই জীবনের শেষতম নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ব্রহ্মদেব। নিজের হাতে পিতার নশ্বর দেহ চিতাগ্নিতে সমর্পন করলেন মহর্ষি বেদ। এবার তাঁর ফিরে যাওয়ার পালা। জননী যে পথ চেয়ে রয়েছেন তাঁর। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract