Rima Goswami

Tragedy Inspirational Thriller

3  

Rima Goswami

Tragedy Inspirational Thriller

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব 7

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব 7

14 mins
489


নেশাদায়ক পদার্থ বলতে এমন বস্তুসমূহকে নির্দেশ করা হয় যারা শরীরে প্রবেশ কররে কিছু স্নবয়বিক প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক ঘটে এবং এসব দ্রব্য গ্রহণে আগ্রহ জন্মায়। নেশাদায়ক পদার্থের  মধ্যে নিকোটিন, মরফিন, হেরোইন, এলএসডি., কোকেই প্রভৃতি প্রধান। আর এসবের একটা রমরমা ব্যবসা চলে পৃথিবী জুড়ে । কাঁচামাল আদান প্রদান হয় চড়া দামে কালোবাজারে । সেই ব্যবসাতে হাত পাকিয়েছে সাইফুল তারপর সে এতে রত্নাকেও জয়েন করিয়েছে নিজের স্বার্থে । প্রথমে বিজলি মাসির মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসে রত্না মেয়ে পাচারের কাজে নামে আর সেখান থেকেই সাইফুলের সাথে আলাপ ।


রাত অনেক হয়েছে প্ল্যান অনুযায়ী সাইফুলের কাছে উর্যা আর চিনিকে পাঠানো হবে । ওখান থেকে ওদের বর্ডার পাস করিয়ে জাল পাসপোর্ট বানিয়ে দুবাই পাঠানোর কাজ সাইফুল করবে । রত্না অপেক্ষায় কখন রাত ঘন হবে তবেই এলাকা ফাঁকা হবে আর তখনই মাল দুটোকে পাচার করবে এরশাদকে দিয়ে । এমনিতেই নার্কটিক্স ডিপার্টমেন্ট পিছনে কি করে লেগে গেছে তা জানা নেই সাইফুলের । পার্টির ক্ষমতার জোরে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছে সে না হলে কবেই সদলবলে ধরা পড়ে যেত । এই প্রমান লোপাট করতেই তো পলাশ আর নান্টুকে শেষ করে দিতে হয়েছে । নান্টুকে মারার পর পলাশকে গুলি করে মেরে ফেলতে হয় কারণ একটা অজ্ঞাত ফোন বার বার আসছিল সাইফুলের কাছে । অচেনা কন্ঠস্বর বলছিল পলাশ উর্যাকে দলে যোগ করে নার্কটিক্স ডিপার্টমেন্ট এ গুপ্তচর হয়ে কাজ করতে চাইছে । সাইফুল লক্ষ করে দেখে ঠিক ! উর্যা আর পলাশ ইদানিং বেশ মেলামেশা করছে । তাই সাইফুল সুটার দিয়ে পলাশ যখন উর্যার ঘরে ছিলো তখনই ওর কাম তামাম করে দেয় । এতে করে উর্যাকে দমন করা হলো আর পথের কাঁটা পলাশ ও মরলো ।


রত্না সাইফুলের কাছে গেছে ডিলের টাকা ফাইনাল করতে । আর কথা আছে এরশাদ রাত বেড়ে গেলে কাজ শুরু করবে । ততক্ষণে সে একটু মদ খেয়ে নেশা উপভোগ করছিলো । এবার দরজাতে টোকা পড়তে আরম্ভ হলে এরশাদ উঠে বসে ...ধুস্, নেশাটাই চটকে গেল! আপদ মেয়েছেলেটা যে এত রাতে কোথায় গিয়ে মরল, কে জানে!....... ভাবতে ভাবতে এরশাদ টলমল করতে করতে দরজার কাছে এল। দরজা খুলে বাইরে বেরোনোর আগে এরশাদ অবশ্য এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়েছে।


কী এমন তারা হয়েছিল যে মাঝরাতে একেবারে লোপাট হতে হবে রত্নাকে ! বেশি ন্যাকামো ! এরশাদ বিড়বিড় করে চলে নেশার ঘোরে। এরশাদ দরজা খুলে বাইরে দেখে একটা মেয়ে ওড়না জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মুখটা দেখা যাচ্ছে না পরিস্কার । এরশাদ বলে , কি চাই এখানে ?


অচেনা মেয়েটি বলে , রত্না মাসির সাথে দরকার ছিলো । এরশাদ বিরক্ত হয় , বলে মাসি নেই তুমি পরে আসবে । মেয়েটি নাছোড় সে বলে তবে ভিতরে একটু বসতে দিন । আমি অপেক্ষা করবো । এরশাদ মেয়েটিকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় । মাহি ওড়নার আড়ালে ভিতরে ঢুকে পড়ে সঙ্গে আছে সায়ানাইড । এরশাদ ওকে ভিতরে ঢুকিয়ে একটু হাল্কা হতে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে যায় । ভিতরে ঢুকে মাহি আবিস্কার করে উর্যা আর চিনি অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে । হাতে সময় কম তাই মাহি একটু সায়ানাইড মিশিয়ে দেয় মদের গ্লাসের গায়ে । তারপর আবার মুখ ঢেকে বসে যায় । এরশাদ ভালো করেই চেনে মাহিকে তাই মুখ দেখে ফেললেই বিপদ । এরশাদ ভিতরে ঢুকে আসে আবার । মদ নিয়ে আবার বসে যায় । মাহি নিশ্চিন্ত এক চুমুক দিলেই মালটা শেষ হয়ে যাবে । সে আস্তে আস্তে এরশাদের পাস থেকে বেরিয়ে আসে বাইরে ।


এরশাদের নেশাটা তখন একটু পাতলা হয়েছে, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল অচেনা মেয়েটা কোথাও নেই। তখন নিজের কীর্তির কথা মনে পড়ল , যা এটা কি হলো ? একটা অচেনা মেয়েকে এভাবে ঘরে ঢুকিয়ে কি ভুল করলো এরশাদ ? তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে ভিতর থেকে চারিদিক দেখলো , না মেয়েটা কোথাও নেই। নেশাটা ফিকে হচ্ছে ধীরে ধীরে। এরশাদ বাইরে এসে এই মেয়ে এই মেয়ে বলে ডাকতে থাকল একটু চাপা গলায়। তারপর গলার আওয়াজ একটু বাড়ালো.... কিন্তু কেউ সাড়া দিল না.... মোহময়ী চাঁদ শুধু বাঁকা হাসি হেসে রহস্যময় চোখে তাকিয়ে থাকল!


ধুর আর ভালো লাগছে না ওর । রত্নাকে ফিরে এলে একটু মিথ্যে তোয়াজ করে ভোলাতে হবে.... আজ ডোজটা একটু বেশিই হয়ে গেছে! অচেনা মেয়রটাকে ঘরে ঢোকানোর কথা রত্নার কানে গেলে একটু মুশকিল আছে।

এরশাদ আবার দরজা বন্ধ করে গ্লাস নিয়ে বসে পড়ে । একটা চুমুক জাস্ট দিতে না দিতে গলাটা জ্বলে ওঠে ওর ।

আচমকাই হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে এসে বিপুল জোরে লাবডুবের তাল ঠুকতে লাগল..... হাত পাগুলো এমন অবশ হয়ে গেল যে এরশাদ আর মাদুর ছেড়ে ওঠার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলল! কিন্ত তার এ অবস্থা হল কী করে? ওঠার তো ক্ষমতা নেই, আস্তে করে বালিশে মাথা রেখে অসাড় বিস্ফারিত চোখে পড়ে রইলো এরশাদ প্রাণহীন ।

বাইরে লুকিয়ে মার্কণ্ডেয় আর মাহি ছদ্মবেসে । এদিক ওদিক দেখে এবার পালা ভেতরে ঢুকে চিনি আর উর্যাকে উদ্ধার করা । ঠিক এই চরম মুহূর্তে একটা জিপ এসে হাজির হলো রত্নার ঘরের বাইরে । জিপ থেকে নেমে এলো রত্না আর সাইফুল । প্রমোদ গুনলো মার্কণ্ডেয় আর মাহি । এবার কি হবে ? ওরা ভিতরে ঢুকে এরশাদকে মৃত পেলে ? মাহি ঠান্ডা মাথায় ভেবে বললো , কোন খুনের প্রমান সামনাসামনি নেই তাই বুঝতে পারবে না মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক । ওয়েট করে যেতেই হবে কিছু করার নেই । সাইফুলের সাথে আর্মস থাকে তাছাড়া ওর ছেলেরা বস্তির বাইরে অপেক্ষমাণ । তাহলে এখন কি করবে ওরা দুজন ? সাইফুল আর রত্না ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় । সামনেই পড়ে আছে এরশাদ , দেখেই বোঝা যাচ্ছে জান নেই শরীরে । রত্না হাউমাউ করে ওঠে , সাইফুল ওকে চুপ করতে বলে । এরশাদের পালস চেক করে সাইফুল বোঝে এরশাদ মারা গেছে । পাশেই পরে লোকাল চোলাই মদ । তবে কি মদ থেকে বিষক্রিয়া হলো ? কারণ শরীরে কোন আঘাতের চিন্হ নেই । সাইফুল রত্নাকে বলে বেশি সময় নেই হাতে মেয়ে দুটোকে পাচার করার পথেই এরশাদের বডি কোন ফাঁকা জায়গা দেখে বর্ডারের কাছে ফেলে দেওয়া বেস্ট হবে । কারণ একটা দিনে অনেক গুলো মৃত্যু হয়েছে এই এলাকাতে । পুলিশের নজর পড়লেই মুশকিল । তাছাড়া খুন না নিছক মদের বিষক্রিয়াতে মৃত্যু সেটাও একটা প্রশ্ন ! ওরা উর্যা আর চিনিকে গাড়িতে তুলে নেয় । এখান থেকে গাড়ি সোজা বিহার বর্ডার পর্যন্ত যাবে । রত্নার সামনেই মরা কুকুরের মতো এরশাদের লাশটা তুলে চালান করে দেয় জিপের এক কোনে । রত্নার মনটা খারাপ হয়ে যায় । একই সময়ে ছেলেটা আর নাগরটা দুটোই গেল । এ বয়সে টাকা তো রত্না কমাবে অসৎ পথে কিন্তু ভালোবাসার মত কাউকে পাবে না আর । গাড়িটা জাস্ট স্টার্ট দিতে দিতেই মার্কণ্ডেয়র ডাকা নার্কটিক্স ডিপার্টমেন্ট আর পুলিশের দল চলে আসে এলাকায় । তারা ঘিরে ফেলে গোটা এলাকা । বিপদ বুঝে সাইফুলের গোটা দলটা পালায় । রত্না ,সাইফুল আর ড্রাইভার সহ অচেতন দুটো মেয়ে আর মৃত এরশাদকে পাওয়া যায়। রত্নাকে আর সাইফুলকে পুলিশে তুলে নিয়ে যায় । উর্যা আর চিনিকে মাহি চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে । সেদিনের মতো ব্যাপারটা এখানেই মিটে যায় । রত্না পুলিশ গাড়িতে ওঠার সময় এরশাদের মুখে হাত দিয়ে একবার দেখছিলো । সেই সময়ই ওর হাতে সায়ানাইড লেগে যায় । আর অজান্তে হাত মুখে দিয়ে ফেলে রত্না , সাইনাইড গিয়ে তারও মুখে মিশে যায় । সঙ্গে সঙ্গে রত্নার ও মৃত্যু হয় । পুলিশ ভ্যান থেকে নামতে গিয়ে সকলে আবিষ্কার করে রত্না মৃত । বাকি থেকে যায় সাইফুল । কেস দেওয়া হয় তার উপরে অনেক কিন্তু নিজের প্রভাব বিস্তার করে সাইফুল বেরিয়ে আসে বেল পেয়ে । আর জেল থেকে বের হয়ে ওর একটাই উদেশ্য ... মার্কণ্ডেয় , মাহি আর উর্যাকে শেষ করে দেওয়া । সাহায্য করে বেল পেতে হেল্প করলেও সাইফুলকে পার্টি থেকে বহিস্কার করা হয়েছে । পার্টি কোন মাদক ও নারী পাচারকারী চক্রের সাথে জড়াতে চায় না । এদিকে এই দুই মাসে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে । ট্রিটমেন্ট হওয়াতে উর্যা বেশ ভালো আছে এখন মার্কণ্ডেয়র বাড়িতে । সতী তাকে নিজে নিয়ে এসেছে বাড়িতে । চিনিকে মাহি একটা হোস্টেলে রেখে দিয়েছে । যাতে পড়াশোনা করে মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে । গুনগুনকে মাহি আপাতত উর্যার কাছেই এনে রেখেছে । থাকনা মায়ের সাথে বাচ্চা মেয়েটা ? বেশিদিন তো পাবে না গুনগুন ওর মাকে । খুব সাধারণ ভাবে বিয়ে সেরে মার্কণ্ডেয় আর মাহির পারিবারিক জীবনটা একেবারে শান্ত, সুখী,মায়াভরা।একটা নিটোল মুক্তোদানার মতো,স্নিগ্ধ। কিন্তু শুধু সুখে মানুষের মন ভরে না,বিশেষত মাহির মতো মানুষের। কিছুদিন একটা NGOর সাথে যে কাজ ও করেছিল।সমাজের ঘাগুলোকে সে খুব কাছ থেকে দেখেছিল।সেটাই ওর মনে কাঁটার মতো বেঁধে। আর এটাও জানে যে সহজে যে যুদ্ধ ওরা জিতেছে সেটা যে কোন মুহুর্তে বিপদে পড়তেই পারে । সাইফুল একবার সুযোগ পেলেই আঘাত হানবে । সেটাও সময়ের অপেক্ষা মাত্র । সতী এখন চায় পুরোনো সব কিছু ভুলে ছেলে বউ সংসার করুক । তার স্বামীর অপরাধীরা ও শাস্তি পেয়েছে । আর কি চাই ? মাহির ভয় , আবার নতুন করে সাইফুলের সাথে লড়াই করার কথা শুনে সতী রাগ করে । সতী মাহিকে বলে শান্তিতে ঘর করবি না তো কি চারপাশে আগুন জ্বেলে বিদ্রোহ করতে চাস?তাহলে কোন একটা দলে নাম লেখা,বক্তৃতা দে। বড়লোক ঘরে বিয়ের পর এতদিনে হয়ত ওসব পরোপকারের ভূত মাথা থেকে নেমে যেত,কিন্তু ভাগ্যক্রমে মাহি একজন আমূল পরিবর্তন হওয়া হৃদয়বান,প্রগতিশীল মানুষকে পাশে পেয়েছিল।মার্কণ্ডেয় আর মাহি শুধূ শখের সমাজসেবা করতে চায় না।বরং নারীদের অধিকার ও সুরক্ষা দেওয়ার মতো অন্তত একটা কাজ সে করতে চায় জীবনে।তাই মাহি যখন বারবার বিপদে পড়া মানুষ গুলোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার কথা বলত মার্কণ্ডেয় নিজেও সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেনি। কেমো নিয়ে নিয়ে উর্যার চুল সব উঠে গেছে । তাকে দেখে আর বোঝাই যায়না একদিন এই মেয়েটা কত রূপসী ছিলো । ওর মন ভালো রাখার জন্য মার্কণ্ডেয় প্ল্যান করে সকলে মিলে উটি যাবে । পাহাড় আর জঙ্গল যদি মন ভালো করতে পারে ওদের সবার । সবাই এই বছর কাউকে না কাউকে হারিয়েছে । যন্ত্রনা , বিরহ সকল মনকে ভরাক্রান্ত করে দিয়ে গেছে । সতী বাতের ব্যাথা নিয়ে আর কোথাও যেতে রাজি হয়না । চিনিকে হোস্টেল থেকে আসতে বলা হলে সেও মানা করে দেয় । মা রমলার মৃত্যুর পর চিনি এখন একটু একা নিজের মতো করে থাকতে চায় । তাই শেষমেষ উর্যা গুনগুনকে নিয়ে মাহি আর মার্কণ্ডেয় রওনা দেয় উটি । সকালের ফ্লাইটে কলকাতা হয়ে ওরা পৌঁছে যায় অন্তর্দেশীয় বিমানবন্দর কোয়েম্বাটোর। এমনিতেই কোয়েম্বাটোরের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য শহরের যোগাযোগ খুবই ভাল। তারপর কোয়েম্বাটোর পৌঁছনোর পর পাঁচজন ক্যাবে করে উটি পৌঁছায় ।

প্লেনে চড়তে পেয়ে ছোট্ট গুনগুন খুব খুশি । সে তো জন্ম থেকে কোথাও বেড়াতে যায়নি । ঘুপচি স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে কেটেছে জীবনের তিনটে বছর তারপর মা ওকে পাঠিয়ে দিলো হোস্টেল । ওখানে সব ভালো , খাওয়া থাকা সব । তবু মায়ের কোল ছিলো না বলে মনে মনে গুমরে দিন কাটছিল গুনগুনের । তারপর মার্কণ্ডেয় কাকা ওকে নিয়ে এলো ওদের বাড়ি । মাকে ও এনে রেখেছে । ওরা খুব ভালো । ঠাম্মিটাও খুব ভালো , গুনগুনের জন্য কত কিছু এনে দেয় ।

রিসর্ট পৌঁছে উর্যাকে রেস্ট নিতে বলে মাহি । আফটার অল উর্যা অসুস্থ মানুষ । রাতের বেলা মার্কণ্ডেয় বারান্দার আলোয় লনে বসে থাকা উর্যাকে দেখে , গুনগুনের সাথে গল্প করছে ।শারীরিক ক্লান্তির চেয়ে যেন চোখে মানসিক ক্লান্তির ছায়া বেশি,শরীরটা ভেঙে গেছে, ক্ষীণ হয়ে গেছে মানুষটা । "-সাহাব!"

সুনীল ডাকলো।

-" আপ লোগোকা খানা লাগা দিয়া সাহাব ।

মার্কণ্ডেয় বলে -"তুমি যাও,আসছি।

মাহিকে আর গুনগুনকে নিয়ে ডিনারে বসলো মার্কণ্ডেয় । উর্যার টিনের প্যাকিং ডায়েট , ওর যা কন্ডিশন তাতে করে নরমাল স্পাইসি খাবার ওর চলে না । খাওয়া ভালোই হলো। রান্নার বাবুর্চির হাত নেহাৎ মন্দ না,তবে ঝালটা গুনগুনের জন্য একটু বেশি। আফটার ডিনার একটা বাথ সেরে নিয়ে আবার রিসোর্টের বারান্দায় এসে বসল মাহি আর মার্কণ্ডেয় । কাল থেকে ঘুরতে আরম্ভ করবে ওরা ।

দক্ষিণ ভারতের পাহাড় ঘেরা নগরী উটিতে! তামিলনাড়ুর নীলগি়রি পাহাড়ের কোলে এই এলাকায় পৌঁছতে পার হতে হয় পাকদণ্ডি পাহাড়ি রাস্তা। 

আজ সারাদিনে যা ধকল গেছে তাই আজ ওরা রেস্ট নিতে রিসোর্টে থেকে যায় সারা সন্ধ্যা । রাত অনেক হয়েছে , রিসোর্টের সামনের কাঠের গেইট টা পেরিয়ে সারি সারি ঝাউ গাছ। চারদিকে বড় বড় গাছের সমাহারে সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে কেউ যেন। মাহি বলে উর্যা দি আর কয়েক দিনের অতিথি । হয়ত খুব বেশি হলে একটা বছর । আমরা গুনগুনকে এডপ্ট করতে পারিনা মার্কণ্ডেয় ? ওকে নিয়ে নতুন করে একটা সম্পর্ক গড়তে পারিনা ? মার্কণ্ডেয় মাহিকে জড়িয়ে ধরে , কেমন যেন একটা স্নেহময় গন্ধ মাখা কোল মেয়েটার । নিশ্চন্তে ঘুম নেমে আসে মার্কণ্ডেয়র দুই চোখে ।

সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে ওরা সবাই মিলে বেরিয়ে যায় উটি ভ্রমণ করতে । উটি সফরের সব দৃশ্যই যেন অপলক দৃষ্টিতে শুষে নেওয়া যায়। তবে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে থেকে সফর উপভোগ শুরু করার । তারপর একে একে পাইকারা ফলস আর লেক, উটি লেক,বটানিক্যাল গার্ডেন, টি মিউজিয়াম,ল্যাম্বস রক, রোজ গার্ডেন, এমারেল্ড লেক,দোদাবেত্তা, অ্যাভালঞ্চে লেক , ওয়েনলক হিল সব দেখতে লাগে । কোন জায়গা ওরা মিস করে না। আর এই নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে ঊর্যাও বেশ শান্তি অনুভব করে । কেমন যেন একটা সুখে মোড়া স্থান ! সমুদ্রতল থেকে ২ হাজার মিটার উঁচুতে নিজেকে কেমন হালকা লাগে উর্যার । চারিদিকে যেদিকেই সে তাকায় চোখ জুড়নো সবুজ আর ঢেউ খেলানো পাহাড়ের হাতছানি। বেড়াতে বেড়াতে কিশোরী মেয়ের মত আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় মাহি , মার্কণ্ডেয়কে বলে দেখো আমরা যেন মিশমিশে সবুজের দেশে এসে পড়েছি।

রাস্তার দু’ধারে প্রথম প্রথম শুধুই নারকেল আর কলাবনের সারি । মন ভালো হয়ে যায় ওদের কিন্তু এখানেও ওদের পিছু নিয়েছে বিপদ সেটা ওরা কেউ বুঝতে পারে না । সাইফুল ওদের কাছে বদলা নিতে ওদের পিছু পিছু উটি পর্যন্ত পৌঁছে যায় সন্তর্পণে । একটা সুযোগ সে খুঁজছিল আঘাত হানার জন্য । আর সুযোগ পেয়েও যায় সাইফুল । রিসোর্টের গার্ডেনে খেলছিলো গুনগুন । উর্যা ওষুধ খেতে একবার ভিতরে এসে ছিলো আর মাহি মার্কণ্ডেয় গেছিলো লোকাল শপে কিছু কেনাকাটার জন্য । সাইফুল তুলে নেয় গুনগুনকে । উর্যা গার্ডেনে এসে মেয়েকে খুঁজে পায়না । মাহি আর মার্কণ্ডেয় এলে ওদের কাছে কেঁদে ফেলে উর্যা । গুনগুনকে অনেক খুঁজেও ওরা পায়না । এর মধ্যে সাইফুলের ফোন আসে । সে জানায় তার হাতে উর্যাকে তুলে দিয়ে হবে না হলে গুনগুনকে শেষ করে দেবে । উর্যা পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে গুনগুনকে সাইফুল তুলে নিয়ে গেছে শুনে । উর্যা মাহিকে বলে "আচ্ছা আমার ভালোবাসাতে কি কোনো খাদ ছিল, নাকি আমি নিজেই যোগ্য যোগ্য ছিলাম না কোনদিন ঋষির ? আমি কি চির অপয়া ? জন্মের পর মা চলে গেছে আমাকে ছেড়ে । বাবা ও ঠাকুমা ও চলে গেছে একসিডেন্ট এ । স্বামী ঋষিকে ও মেরে ফেলেছি এই দুটো হাত দিয়ে । এখন যখন একটু নিশ্চিত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি আবার ঝড় উঠেছে আমার জীবনে । সাইফুল আমার মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে গেছে ? মাহি দেখে উর্যার শুকিয়ে যাওয়া গাঢ় নোনতা ধারাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রতিবিম্বেও,ডাগর চোখদুটো এখনও লাল হয়ে আছে । পুলিশের কাছে কিডন্যাপের অভিযোগ দায়ের করে ওরা । সাইফুলকে খুঁজতে শুরু করে পুলিশ । কিন্তু দিন পেরিয়ে ও ওকে পুলিশ ধরতে পারেনা । যখন মার্কণ্ডেয় আর মাহি পুলিশের সাথে গুনগুনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল .. উর্যা একাই বেরিয়ে পড়ে মেয়েকে খুঁজতে । সাইফুল তাকে ফরেস্ট অফিসের সামনে আসতে বলে । উর্যা কাউকে কিছু না বলে পৌঁছে যায় নির্দেশ করা স্থানে । সাইফুল অপেক্ষায় ছিলো উর্যার । গুনগুনকে একটা থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে শয়তানটা । মেয়েটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে একেবারে । উর্যাকে সাইফুল বলে , এসো মামনি এসো ... রোগে তো ভুগে মরবে খুব তাড়াতাড়ি তার আগে আমি ভালো কাজটা সেরে ফেললে হয়ত বাঁচার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না মা মেয়েকে ? উর্যা বলে , আমাকে দেখছিস আমি এসেছি । গুনগুনকে তুই ছেড়ে দে শয়তান । সাইফুল বলে , তা তো হয়না মামনি । মা মেয়ে দুটোকেই মরতে হবে যে ? না হলে আমার বদলার কি হবে ? সারাজীবন কত কষ্ট করে আমি নিজের পার্টিতে ইমেজ তৈরি করেছি । গাঁজা , মেয়ে পাচার করার জন্য কত খেটেছি আর তোদের জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেছে আজ । আইন দয়া করে বেল দিয়েছে কাল আবার জেলে পুরতে কতক্ষণ ? এই তো সুযোগ নিজের প্রতিশোধ মিটিয়ে নেবার । এই বলে একটা কেরোসিনের ডিব্বা এনে গুনগুন আর উর্যার গায়ে ঢেলে দেয় সাইফুল । মেয়ের জীবন বিপন্ন দেখে উর্যা আবার সেই আগের ভয়াল রূপে ফিরে আসে । সাইফুল দেশলাই জ্বালিয়ে মা মেয়ের গায়ে দিত তার আগেই সাইফুলকে ছুটে গিয়ে খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মারে উর্যা । পাহাড়ের গায়ে বানানো পরিত্যক্ত ফরেস্ট অফিসের পাশেই গহীন খাদ । নীচে ঘন অরণ্য । আচমকা ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনা সাইফুল । মুখ গুঁজে সে খাদে পড়ে যায় । ঊর্যাও ওকে ধাক্কা দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে পাথরের উপরে । কোনমতে সে আবার উঠে দাঁড়ায় । সাইফুল হারিয়ে গেছে ততক্ষনে খাদের গহনে । আর কোন ভাবেই ও বাঁচতে পারবে না । নিশ্চিত হয়ে উর্যা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সময় । তারপর মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে যায় মেন রোডের দিকে । কোন মতে গুনগুনকে নিয়ে উর্যা পৌঁছে যায় রিসর্ট । ওখানে মাহি আর মার্কণ্ডেয় পাগলের মতো উর্যাকে খুঁজে না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে ছিলো । তারপর গুনগুনকে সঙ্গে নিয়ে রক্তাক্ত উর্যাকে ফিরতে দেখে ওরা অবাক হয়ে যায় । উর্যা ওদের জানায় সাইফুলের পরিণতির কথা । তারপর মেয়েকে মাহির হাতে তুলে দেয় সে । পুলিশের কাছে নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করে উর্যা । তার স্বামীকে চার বছর আগে খুন , সাইফুলকে খুনের কথা স্বীকার করে সে । মার্কণ্ডেয় বার বার মানা করেছিলো উর্যাকে । তার জীবনে যে কটা দিন পড়ে আছে সেকটা দিন যাতে মেয়েকে নিয়ে কাটাতে পারে এই কথাই বুঝিয়ে ছিলো মার্কণ্ডেয় । উর্যা বলে , আর কিছুই নেই বাকি । মেয়ের দায়িত্ব মাহি যখন নেবে কারো খুনের দায় নিয়ে মরতে সে চায় না । খুন দুটো একান্ত বাধ্য হয়ে করলেও করতে হয়েছে তাকে । তাই তার জন্য যা শাস্তি হয় সেটা নিয়েই মরে শান্তি পাবে উর্যা । কেস কোর্টে ওঠে , বিচারপতি সব শুনে উর্যাকে কারাদন্ড দেয় । তবে সময় যে শেষ হয়ে এসেছিল ওর ! তাই জেল ওকে বেশিদিন বন্দি রাখতে পারেনি । সাজা হবার কয়েক মাস পরেই উর্যা এক ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় । সঙ্গে নিয়ে যায় সব কষ্ট ,অবহেলা , অত্যাচারের স্মৃতিকে । এক মা শক্তির আধার । তার সন্তানের রক্ষায় সে সব করতে পারে । সে নিমেষে কালীর রূপ ধারণ করে সব আসুরিক শক্তির নিপাত করতে পারে । উর্যা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে , এক অসামাজিক স্বামীর বিবাহিতা সহধর্মিণী , সময়ের বিপাকে পড়া এক বেশ্যা ... তারপরেও তার সব থেকে শক্ত পরিচয় ... সে মা .. এক লড়াকু মা । তার নিজের অংশকে রক্ষা করতে একে একে বহু পাথুরে কঠিন পথ অতিক্রম করেছে সে । একে একে খারাপের সঙ্গে ভালো মানুষও এসেছে তার জীবনে । মথুরা বাবু , মাহি বা মার্কণ্ডেয় সকলেই উর্যার সঙ্গে থেকেছে । আমাদের জীবনে একটা দরজা বন্ধ হলে আরো অনেক দরজা খুলে যায় আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে । আসলে আমরাই ওই বন্ধ হয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি আর অন্য রাস্তা গুলো আমাদের নজরের আড়ালেই থেকে যায় । সহ্য করা অবশ্যই ভালো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে সহ্য করা মানে নিজের সাথে অন্যায় করা । সেদিন যদি উর্যা নিজের স্বামীকে না মারত । ওর স্বামী সন্তান সহ উর্যাকে মেরে দিত । যে মামাদের কাছে শেষ আশ্রয় খুঁজতে সে এসেছিল তাদের অভিসন্ধি ভালো না দেখে উর্যা আর নিজের পরিচয় মামাদের কাছে না দিয়ে অন্য ভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল । মোটকথা জীবন একটা যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধে জেতাটা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত । উর্যার মৃত্যুর পর গুনগুনকে লিগালি এডপ্ট করে নেয় মার্কণ্ডেয় আর মাহি । গুনগুনকে ওরা নিজের সন্তানের পরিচয়ে বড় করতে থাকে । শুরু হয় সদ্য মা হারা গুনগুনের নতুন জীবন ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy