বৈপরীত্য
বৈপরীত্য
১।।
“এই এখন চলবে কয়েকদিন ধরে, যত্তসব।“ বিরক্তির সঙ্গে বললেন প্রাঞ্জলা।
এইমাত্র পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা বাড়ি বয়ে এসে জানিয়ে গেল যে তারা রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সামনের শুক্রবার, সম্ভব হলে তাঁরা যেন অবশ্যই পায়ের ধুলো দেন। বিরক্তির কারণটা সেখানেই। প্রবলভাবে আধুনিকমনস্কা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের হেডমিস্ট্রেস প্রাঞ্জলা কোনদিনও রবীন্দ্রনাথকে নিজের কাছের লোক বলে মেনে নিতে পারেননি, এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সব অনুষ্ঠানে ওনার খুব একটা ন্যাক নেই।
“হ্যাঁ, যা বলেছ।“ নিরীহকন্ঠে উত্তর দিলেন শুভাশিস।
“কি আছে ওই প্যানপ্যানানির মধ্যে, আমি ভেবে পাই না। অথচ আজকাল এসবেরই খুব চর্চা চলছে, যেন নতুন ফ্যাশন। সোশাল মিডিয়া খোল, সর্বত্র বিরাজ করছে বাংলা ভাষা বাঁচাও, বাংলা সংস্কৃতি বাঁচাও রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাও। আরে সেদিন ওই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো তেনার গান নিয়ে একটু মশকরা করে পিঠে কি লিখেছিল, তাই নিয়ে সোশাল মিডিয়া তোলপাড়। যেন মেরেই ফেলবে ওদেরকে। মানছি ওরা ভুল করেছিল, তাই বলে এমন বাড়াবাড়ি করার কোন মানে আছে, তুমিই বল?”
শুভাশিস চুপ করে মাথা নাড়লেন। এসব কথায় সায় দেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা জানা নেই তাঁর।
“তবে আমি এসব ব্যাপারকে একদম প্রশ্রয় দিই না। আমি আমার স্কুলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ফবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি হবে না। ফরমালিটি করতে হবে, তাই রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন ফোটোয় দু একটা ফুল মালা চড়িয়ে সামনে কটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখো, ব্যস। এর বেশি বাড়াবাড়ি একদম নয়। নেহাত অফিশিয়াল ছুটি থাকে, তাই স্কুলে পড়াশোনা হয় না ঠিকই, কিন্তু নো প্রোগ্রাম। পিকলু আবার লাফাচ্ছিল আটই মে ওদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন নাকি বড়সড় প্রোগ্রাম হবে, উনি নাকি সেখানে “আফ্রিকা” আবৃত্তি করবেন। দিয়েছি কড়া করে এক ধমক। ওইসব একদম হবে না। পড়াশোনার ক্ষতি করে ওইসব আদিখ্যেতায় আমি একদম বিশ্বাস করি না।“
শুভাশিস এবারে ক্ষীণভাবে একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন, “আহ, পিকলু যখন চাইছিল, তখন ওকে পারমিশন দিতে পারতে। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। ছেলেটা এত উৎসাহ নিয়ে...”
“তুমি থামো, তোমায় আর জ্ঞান দিতে হবে না। তোমার প্রশ্রয়েই ছেলেটা তলে তলে বিগড়োচ্ছে, তা কি আমি বুঝি না?” রীতিমত হুমকির স্বরে প্রাঞ্জলা বললেন,” আমি বলে দিয়েছি ও যাবে না, মিনস যাবে না। কি আছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে? কি আছে বাংলা ভাষার মধ্যে? বাংলার কোন ভ্যালু আছে? হায়ার স্টাডিজ সবক্ষেত্রেই তো এখন ইংরেজির ই যুগ। আর ইংরেজির মধ্যে যে স্মার্টনেস আছে বাংলায় তাঁর ছিটে ফোঁটাও আছে? আর ওই রবীন্দ্রনাথ?” মুখ দিয়ে একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করে প্রাঞ্জলা বললেন,” এই যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তার গানকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়, কি আছে ওতে? সবকটা গান একরকম, ঘুমপাড়ানি সুরের। ওই দিয়ে আজকের যুগ চলে? এখন হল এগিয়ে যাওয়ার যুগ, দৌড়নোর যুগ। রবীন্দ্রনাথের গানে লেখায় কোথাও ডায়নামিক্স আছে? এখনকার ছেলেমেয়েদের উচিত বেশি করে ইংলিশ মুভি দেখা, ইংলিশ গান শোনা, তবে তো ওদের জীবনে সেই ডায়নামিক্সটা আসবে। গতির সঙ্গে তাল রাখাই যুগের ধর্ম। ফালতু কালচারকে আগলে ধরে কাঁদুনি গেয়ে লাভ আছে?”
নিঃশব্দে পুরোটা শুনলেন শুভাশিস। কিছু বললেন না। তাই দেখে প্রাঞ্জলাই আবার বললেন,” নাঃ এই নিয়ে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। পাড়ার ছেলেগুলো এসে মাথা খেয়ে গেল, তাই এতগুলো কথা বললাম। অনেক হয়েছে, এবার আমি যাই, স্কুলের জন্য রেডি হতে হবে, অনেক দেরি হয়ে গেছে।“ এই বলে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রাঞ্জলা।
রবীন্দ্রনাথ অলক্ষ্যে হাসলেন।
২।।
ইংল্যান্ডের অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম কিংহ্যাম। সেখানেই সেন্ট জোসেফ চার্চ আর সেই চার্চের ভিতরেই ছোট্ট স্কুল লিটল ড্যাফোডিলস।
ফাদার জেমস আজ নিজে ক্লাসে এসেছিলেন। এক এক করে তিনি সবার নাম ধরে রোলকল করছিলেন।
“পিটার...”
“ইয়েস স্যার...”
“না পিটার।“ জেমস পিটারকে উদ্দেশ্য করে পরিস্কার বাংলায় বললেন,”আজ অন্তত আমরা কেউ স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলব না, তোমাদেরকে শিখিয়েছিলাম না? আজ যে বাংলার দিন। আজ ভারতের তথা সমগ্র বিশ্বের স্বনামধন্য কবি তথা সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। তাকে সম্মান জানানোই আমাদের কর্তব্য। তোমার কি বলা উচিত ছিল, পিটার?”
“উপস্থিত, স্যার।“
“খুব ভালো।“ ফাদার জেমস রোলকল শেষ করে বললেন,” আমার প্রিয় ছাত্রগণ, আজ আমি তোমাদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু জিনিস আলোকপাত করিতে চাই। তোমরা সকলে প্রস্তুত তো?”
সকলে ঘাড় দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
“তোমরা সকলে ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনী পড়েছ। তিনি কোথায় জন্ম নিয়েছিলেন, তার পরিবারে কে কে ছিল, তিনি কি কি সাহিত্য রচনা করেছিলেন, তিনি কবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এসবই তোমরা জেনেছ। কিন্তু এই জানার বাইরেও অজানার ভাগ রয়ে গেছে অনেকটাই। শুধুমাত্র তার সাহিত্যের সংখ্যা দিয়ে তার মাহাত্ম্য বিচার করতে গেলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন যেমন একাধারে সাহিত্যিক, তেমনি একাধারে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, তেমনি তিনি ছিলেন এমন একজন সাধক যিনি মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উঠে জীবনকে জয়ী ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর জীবনদর্শন মানুষের মধ্যে অপার কৌতূহল সঞ্চার করে। তাকে উপলব্ধি করতে হলে সারা জীবন লেগে যায়, কখনো তাতেও তাকে পুরোপুরি জেনে ওঠা যায় না। তিনি তাঁর জীবনদর্শন বলে গেছেন গানে গানে, কবিতায় কবিতায়। কখনো তিনি মুক্তকন্ঠে গেয়ে উঠেছেন, “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়” আবার গেয়েছেন, “আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান” সেই গানেই তিনি লিখেছেন,”জানার মাঝে অজানারে করেছি যে সন্ধান।“ এইভাবেই হয়ত তিনি মানবসত্তাকে মহাবৈশ্বিক সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন, আমাদের জীবনের প্রকৃত গন্তব্যকে অনুসন্ধান করতে চেয়ে। আমি ভারতবর্ষে যখন গিয়েছিলাম, তখন থেকেই আমি রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ি এবং একই সাথে বাংলার। তাই এখানে এসে আমি ঠিক করেছিলাম, আমার জীবনটাও রবিময় হোক। তিনি বেঁচে থাকুন তোমাদের মাঝে, বাংলায় বাংলায়। সে কারণেই আমি এই স্কুলে ছোটবেলা থেকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা শিক্ষারও ব্যাবস্থা করেছিলাম। বাংলা ভাষায় যে মাধুর্য আছে, যে সাহিত্যগুণ আছে, হয়ত পৃথিবীর কোন ভাষায় তা নেই। রবীন্দ্রনাথ অন্য কোন ভাষায় হয়ত তার জীবনদর্শনকে এতটা সুন্দর ভাবে পরিস্ফুট করতে পারতেন না।“
একটু থামলেন ফাদার। তারপর আবার শুরু করলেন,” রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে অনেক দুঃখী ছিলেন। বহু আপনজনের মৃত্যুর ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। তাই একটা সময় পরে হয়ত দুঃখের চেয়েও বেশি করে কৌতূহল ভিড় করেছিল তার মধ্যে মৃত্যুকে নিয়ে। জীবন মৃত্যু নিয়ে তার অমূল্য গবেষণাই তাকে কবিকূলে অনন্য করে তুলেছে। তিনি হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়। সৃষ্টির সর্বত্র জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিরা। এছাড়াও তার রচনার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সকলের থেকে আলাদা। তোমরা এখনো ছোট, তার অনেক রচনাই পড়ার সৌভাগ্য তোমাদের হয়নি, কিন্তু বড় হয়ে যদি তোমরা সেগুলো পড় এবং তাকে উপলব্ধি কর, তাহলে জানবে, তার প্রতিটা গানের সুরে, প্রতিটা কবিতায় প্রতিটা গল্পে এমন কিছু বিশেষত্ব আছে যা মানুষের মনকে ক্ষণিকের জন্য তার স্থিতাবস্থা থেকে তুলে ধরে ওই নিয়ে যায় সেই ঘটনায়, কিংবা সেই প্রেক্ষাপটে কিংবা হৃদয়কে ভরিয়ে তোলে এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিকতায়, সমাপ্ত হবার দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যার অনুরণন রয়ে যায় হৃদয়ে।“
সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। ফাদার আবার বললেন,” আজ সেই কবিগুরুর জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ। সেই উপলক্ষ্যে আমরা প্রতিবছরের মতন এবারও তাকে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতটুকু করা যায়। কিন্তু সেটুকুই যদি আমরা ভক্তিভরে করতে পারি, তাহলেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন। তিনি আকাশে বাতাসে আমাদের চারপাশে সবসময় আছেন, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের শুনতে পাবেন।“
“এবার তোমরা একে একে চার্চের প্রধান কক্ষে এসো। ধীরে ধীরে আসবে, কেউ কোন আওয়াজ করবে না।“
সবাই ধীরে ধীরে নিঃশব্দে চার্চের মেইন হলে এসে দাঁড়াল। সেখানে বৃদ্ধ ফাদার ছাড়াও চার্চের অন্যান্য কর্মচারী,স্কুলের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। অদ্ভুত প্রশান্তি গোটা হল জুড়ে। যীশু খ্রীস্টের মূর্তির সম্মুখে রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবি,ফুলের গুচ্ছ দিয়ে সাজানো। কোন বাড়তি জাঁকজমকের চিহ্ন নেই।
ফাদার বললেন,”ওনার সম্মাননায় আমি পবিত্রতা বজায় রাখতে চাই। সবাই তোমরা প্রথমে ওনাকে প্রণাম কর। তারপর একটা করে মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়াও। তারপর আমরা সবাই মিলে ওনার উদ্দেশ্যে গাইব তারই সে বিখ্যাত গান, ছাত্ররা তোমাদের শিখিয়েছিলাম, সবার মনে আছে তো?”
সবাই একবাক্যে হ্যাঁ বলল। ফাদার বললেন, “বেশ।“
সবাই হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়াল। তারপরে সমবেত সুরে চার্চের ভিতরটা অদ্ভুত গাম্ভীর্য ও প্রশান্তিতে ভরে উঠল।
“আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য কর
এ জীবন পুণ্য করো, এ জীবন পুণ্য করো।
এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে।
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।“
রবীন্দ্রনাথ আবার অলক্ষ্যে হেসে উঠলেন।