বাঁধন
বাঁধন
রীনা ও রাতুল একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। রীনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী মেয়ে, অন্যদিকে রাতুল এক বড় ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস তাদের বেশ ভালো ভাবেই কেটে যায়। কিন্তু বিয়ের কিছু মাস পরেই, রীনা লক্ষ্য করে রাতুল যেন কেমন বদলে গেছে। রীনা যা কিছুই করতে যায়, রাতুল তার উপর তার মতামত চাপিয়ে দেয়। প্রথমে রীনা চাকরি করত, তার বেতন রাতুলের তুলনায় বেশী ছিল। তা দেখে রাতুল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত, তাই সে রীনা কে রীতিমতো বাধ্য করেছিল চাকরিটি ছেড়ে যেতে। তাও, রীনা এর কোনো বিরোধিতা করেনি। চুপ করে সব মেনে নিয়েছিল তাদের ভালোবাসার খাতিরে। এরপর ও রাতুল শান্ত হয়নি। রোজই কোনো না কোনো ভাবে সে রীনাকে ও তার পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা কে তুচ্ছ করত। তাও রীনা সব মেনে নিত। রাতুলের মতে সে রীনার মত এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে তার উপর দয়া করেছে। নয়তো নাকি, তার মতো কোনো উচ্চমানের ছেলে, রীনার দিকে ফিরেও তাকাত না। এরকম নানা ধরনের কথা রীনাকে রোজ শুনতে হত। এই কথাগুলো শোনার পর সে মনে মনে ভাবত... স্কুল, কলেজে পড়াকালীন কত ছেলেই তাকে পছন্দ করেছিল... কিন্তু তাও সে তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে রাতুলকে পছন্দ করেছিল কারণ, তার ধারণা ছিল যে রাতুল মানুষ হিসেবে ভালো। আর আজ সেই রাতুলকে পছন্দ করার এই পরিণাম পেতে হচ্ছে তাকে। যেন, মনে হচ্ছে, রাতুল তাকে ভালোবেসে তার উপর করুণা করছে। যেই রাতুলের জন্য সে তার দীর্ঘ বছর ধরে পরিশ্রম করে পাওয়া চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিল, সেই রাতুলই তার ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়েছে বলে তাকে কত কথাই না শোনায়! যেন রাতুলের চোখে, রীনার কোনো যোগ্যতাই নেই। অথচ, চাকরি করাকালীন রীনা কিন্তু রাতুলের তুলনায় বেশী বেতন পেত, কিন্তু তা নিয়ে সে কোনোদিন অহঙ্কার করেনি। রাতুলের সাথে থাকতে থাকতে যেন রীনার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে যতই মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল, ততই বুঝতে পারছিল যেন, তাদের এই সংসার যেন নির্ধারিতই ছিল ভাঙার জন্য।
অবশেষে, তাদের বিয়ের দেড় বছর পর, একদিন রীনার মনে হল, সে আর কোনোভাবেই রাতুলের সাথে থাকতে পারবে না। শুধু রাতুলকে ভালোবাসার খাতিরে সে নিজের প্রতি কত অন্যায়, অসম্মান, অবিচার সহ্য করেছে। সে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে, এরপর ও যদি সে তার প্রতি হওয়া অন্যায় চুপ করে সহ্য করতে থাকে তাহলে সে কী নিজে নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে? রাতুলের সাথে থাকতে থাকতে, তার পছন্দ অনুযায়ী নিজে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে... সে যেন তার নিজস্বতাকেই হারিয়ে ফেলছিল। তার অস্তিত্বটাই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। সে নিজেকে আবারও প্রশ্ন করে, যে রীনা, তার চোখের সামনে হওয়া কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ না করে থাকতে পারত না... সে দীর্ঘদিন ধরে তার প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায় কীভাবে মেনে নিতে পারল। যে রীনা নিজের মনের কথা ছাড়া আর কারোর কথা শুনত না, সে রাতুলের এক কথায় কীভাবে তার শখের চাকরিটি ছেড়ে দিল?
রীনার মনে পড়ে একবার ছোটোবেলায় তার এক দূর সম্পর্কের ডিভোর্সি দিদি তাকে বলেছিল, "হয়তো ভালোবাসা সত্যিই আমাদের অন্ধ আর বুদ্ধিহীন করে দেয় এতটাই যে অন্য কাউকে ভালোবাসতে গিয়ে আমরা নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে যায়। কিন্তু, এই নিজের প্রতি নিজের করা অবিচার বেশীদিন সহ্য করতে থাকলে, একটি সময়ের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের সাথে চোখ মেলাতে লজ্জা করে। তাই সময় থাকতে এরকম বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। নয়তো নিজের প্রতি একটা অপরাধবোধ কাজ করে।"
ধীরে ধীরে রীনা সম্পর্কটি থেকে বেরিয়ে আসে, এবং,একদিন তার আর রাতুলের সহ মতে তাদের ডিভোর্স হয়। সেদিন রীনার মনে হতে থাকে সে যেন আবার এক বাঁধন ছাড়া পাখি হয়েছে, যেমনটা সে বিয়ের আগে ছিল। তার পায়ে শেকল পরিয়ে তাকে বেঁধে রাখার কেউ নেই আর। সে আবার যেখানে খুশী উড়তে পারবে নিজের মত।
