The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Sanghamitra Roychowdhury

Comedy Romance Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Comedy Romance Classics

অসমাপ্তের সমাপ্তি

অসমাপ্তের সমাপ্তি

12 mins
254



দে'জ মেডিকেল মিনি থেকে হুড়মুড়িয়ে নামলো শীর্ষ। হাওড়া থেকে এই বাসটাতেই আসে শীর্ষ, এই একটা বাসেই হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে আসা যায়। ওর কলেজ মানে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বালিগঞ্জ ক্যাম্পাস। শীর্ষ ল'তে পড়ে। ওদের ল সেকশনের বিল্ডিংটা একেবারে হাজরা রোডের সঙ্গে লাগোয়া। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকটায় সায়েন্সের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টগুলো আর শীর্ষদের ল বিল্ডিং-এর ঠিক পাশেই অ্যাটমোস্ফেরিক সায়েন্স বিল্ডিং।

বাস থেকে নেমে কলেজে ঢোকার সময় তার মনে হলো, এই হয়তো তার শেষবারের মতো কলেজে আসা। ফাইভ ইয়ার্স এলএলবি কোর্স তার শেষ। পরীক্ষা শেষ, প্রোজেক্ট জমাও হয়ে গেছে। আজ এসেছে, ভাইভা পরীক্ষা দিতে। শীর্ষর বাড়ীতে সবাই চাইছে, এবার শীর্ষ কোর্টে যাতায়াত করুক। টানা পাঁচ বছর ধরে ল গ্র্যাজুয়েশন করার পর বাড়ীর লোক আরও দু'বছর মাস্টার্সের জন্য ব্যয় করতে মত দিতে পারছে না। তাও যদি দু'বছরের কোর্স দু'বছরেই শেষ হয়! সবই তো লেটে চলে এই ইউনিভার্সিটিতে, সে নোটিশ বেরোনো, ফর্ম ফিলাপ, অ্যাডমিশন, পরীক্ষা বা রেজাল্ট আউট যাই হোক না কেন? বাড়ীর লোকের আপত্তির কারণটাও শীর্ষ বোঝে। এই পাঁচ বছরের কোর্স গড়িয়ে কয়েক মাস বেড়ে যাওয়াতেই শীর্ষর বাড়ীর লোক মহাবিরক্ত, তাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে। যদিও আরো পড়ার ইচ্ছে শীর্ষর নিজের মনে ষোলোআনাই।

তাই আজ নস্টালজিক শীর্ষ, এইই হয়তো বাস থেকে নেমে শেষবার কলেজের পথে হাঁটছে শীর্ষ। গত সাড়ে পাঁচটা বছর যে কিভাবে কেটে গেলো তা ভাবলেই অবাক লাগে। বোধহয় ভালো সময় তাড়াতাড়িই কেটে যায়। আনমনে শীর্ষ সোজা ঢুকলো স্টুডেন্ট'স লিফটে। সিঁড়ি ভাঙতে ইচ্ছে করছে না, তাছাড়া বোধহয় একটু দেরীও হয়ে গেছে ওর। উঠেই তিনতলার সেই প্রথম ঘরটায়। সেই চেনা ঘর, আর সেই বড়ো চেনা সেকেণ্ড রো, সেকেণ্ড বেঞ্চ।

******

এইটথ সেমেস্টার... মানে ফোর্থইয়ারের সেদিনও তো সেই এই ঘরে বসেই অনিন্দ‍্যর সাথে ফুটবল নিয়ে তুমুল তর্ক করছিলো শীর্ষ। আর ঠিক তখনই একটা মিষ্টি রিনরিনে গলা স্বরে শীর্ষ চমকে উঠেছিলো। ঘুরে তাকিয়েছিলো শীর্ষ।


শীর্ষর চোখের সামনে বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠেছিলো লাল রঙের একটা লং কুর্তি, কানে টেরাকোটার ঝুমকো, গলায় চেপে বাঁধা টেরাকোটারই চোকার, আর চুলের খোঁপায় গোঁজা ছোট্ট একটা কাঁটা, তার থেকে ঝুলছে সুতোয় গাঁথা টেরাকোটার ছোট ছোট বিডস্। কপালের সামনে এলোমেলো উড়ছে গুঁড়ো গুঁড়ো চুলগুলো। ঈষৎ মোটা ঠোঁটে হালকা বাদামি লিপস্টিকের ছোঁয়া, রিমলেস চশমার পেছনে দীঘির মতো দুই চোখে কাজল, আর ওর গা থেকে ভেসে আসছে একটা সুন্দর নেশা ধরানো ঝিমঝিমে গন্ধ। শরীরটা কেমন যেন একটা করে উঠলো যেন শীর্ষর। কয়েক মিনিটেই শীর্ষর শরীর ও মনে ঝড় তুলে দিয়ে অনিন্দ্যর সাথে নোটসের কথা বলে ও চলে গেলো। ও চলে যেতেই শীর্ষ জানতে চাইলো, "কে রে এটা?" অনিন্দ্য বলে, "স্মৃতিলেখা, অনার্স নিয়ে এবছরই সুরেন্দ্রনাথ থেকে হাজরায় এসেছে, আমাদের একবছরের জুনিয়র, কিন্তু এক ট্যুইশনে পড়ার সুবাদে আগে থেকেই চেনা। খুব ভালো রেজাল্ট করে!" "ও, আচ্ছা, হুম," বলেই তখনকার মতো চুপ করে গিয়েছিলো ঠিকই শীর্ষ, তবে মনে ওর ভাসছিলো তখনও অবধি কেবলই স্মৃতিলেখার সেই ঝিম ধরানো ঝোড়ো উপস্থিতি।

তারপর কেটে গেলো পুরো দুটো দিন। কী একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করেছে শীর্ষর মধ্যে। কলেজ গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখটা কাকে যেন খুঁজেছে। কিন্তু ব‍্যাড্ লাক! দেখতে পায়নি একবারও তাকে গত দু'দিনের মধ্যে।

সেদিন আবার ছুটির সময়ে হঠাৎ অকালের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছাতা, জলের বোতল, টিফিন ইত্যাদি নিয়ে কলেজে যাওয়াটা বড্ড বোকা বোকা। এদিকে আবার ভিজতেও পছন্দ করে না শীর্ষ। তাছাড়া এতোটা পথ ভিজে বাড়ী যাওয়ার বিস্তর হ্যাপাও আছে। শীর্ষর বাড়ী সেই উত্তরপাড়ায়, বাসে হাওড়া গিয়ে, তারপর আবার লোকাল ট্রেনে উত্তরপাড়ায় পৌঁছনো। ভিজে গেলে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ঘন্টা দুয়েক ভিজে জামা কাপড়েই থাকতে হবে। অগত‍্যা তাই অপেক্ষা করছে করিডোরে... বৃষ্টি থামার।


হঠাৎ একটা শব্দ, পিছনে ফিরলো শীর্ষ। দুটো বই পড়ে আছে করিডোরের মেঝেতে, পাশেই একটা ছোট্ট বাহারি লেডিস পার্স, রঙ-বেরঙী খাপ সমেত মোবাইল আর একটা থ্রিফোল্ডের ফুলছাপ ছাতা, আর স্মৃতিলেখা সেসব নীচু হয়ে কুড়োচ্ছে! বিশেষ কিছু ভাবার আগেই শীর্ষ কেমন একটা ঘোরে যেন, আপনা থেকেই এগিয়ে গেছে ঐদিকে। হাঁটু মুড়ে বসে কড়ির কাজ করা বাহারি লেডিস পার্সটা তুলে শীর্ষ এগিয়ে দিয়েছে স্মৃতিলেখার হাতে।

"থ‍্যাঙ্ক ইউ" বলে পার্সটা নিলো স্মৃতিলেখা। শীর্ষ মুখে চাপা হাসি নিয়ে বললো, "সব কথায় থ‍্যাঙ্কস্ জানানোটা কী আপনার বদ্ অভ‍্যেস?" এবার স্মৃতিলেখা হাজার ঝর্ণার ধ্বনি তুলে হাসতে হাসতেই বললো, "ওওও, আর সমবয়সীদের 'আপনি' সম্মোধনটা বুঝি শীর্ষবাবুর বদ্ অভ‍্যেস? কী ঠিক বললাম?" শীর্ষ এবার তার গমগমে গলায় হোহো হাসিতে একতলার করিডোর কাঁপিয়ে বলে ফেললো, "বেশ বেশ, তাহলে 'তুই' চলবে? 'তুমি'টা না আমার আবার ঠিক আসে না। তা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিস কী আনন্দে, সব খুচরো-খাচরা জিনিস পত্তরই যদি হাতে করে নিয়েই ঘুরবি? ব্যাগটা কী তবে শুধুই শো-পিস?"


শীর্ষর মুখের দিকে হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্মৃতিলেখা মুখে ছড়ানো হাসি নিয়ে বললো, "একটা বিষয় প্রমাণ হলো যে, অন্যকে কথা বলার সামান্যতম সুযোগ না দিয়েই নিজের বক্তব্য পেশ করার চেষ্টাই ল'ইয়ারদের বিশেষ গুণ। তোর হবে!" তারপর একটা রিনরিনে আর একটা ঝমঝমে হাসির উত্তাল রোল... করিডোরের এমাথা ওমাথা জুড়ে ঢেউ খেলিয়ে দিলো। আর সেই হাসাহাসির যুগ্ম কলরোল দু-দুটো বুকেই একটা তোলপাড় করা ঝড় তুলে দিলো।


তারপর থেকে শীর্ষ আর স্মৃতিলেখা, স্মৃতিলেখা আর শীর্ষ। কলেজে হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যাটেনডেন্স, তবে ক্লাসে কিন্তু নয়। পকেটে গরীব, তাই ক্লাস বাঙ্ক করে কখনো লাইব্রেরীতে, কখনোবা আবার সায়েন্স বিল্ডিং-এর দশতলায় স্টুডেন্টদের চিপ ক্যান্টিনে। বড়োজোর কখনো-সখনো কলেজ ক্যাম্পাস থেকে খানিক হেঁটে গিয়ে বিড়লা মন্দিরের চাতালে। বেশ জমজমাট প্রেম। ক্লাসে ফাঁকি মারলেও, পড়াশোনায় ফাঁকি ছিলো না। দু'জনের রেজাল্টই চোখ ধাঁধানো, বন্ধুমহলে ঈর্ষা জাগানো।


কলেজে প্রেম করা ছাড়াও ওদের যাতায়াতটাও একসাথেই ছিলো। স্মৃতিলেখার বাড়ী হাওড়ার রামরাজাতলায় আর শীর্ষর বাড়ী উত্তরপাড়ায় হলেও, দু'জনে ঠিক সময় হিসেব করে হাওড়া থেকে হাজরায় কলেজ পর্যন্ত দু'পিঠেই একসাথে বকবকম বকবকম করতে করতেই যেতো আসতো। তারপর শীর্ষর কলেজ ছাড়ার দিন যখন ঘনিয়ে আসছে, ঠিক তখনই স্মৃতিলেখা লম্বা অ্যাবসেন্ট। নাহ্, ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেনি শীর্ষ। বাড়ীতে গিয়েই খোঁজ নেবার প্ল্যান করছিলো শীর্ষ। তখনই অনিন্দ্যই শোনালো সেই বুকভাঙা খবরটা... ও ট্যুইশন থেকে শুনেছে, স্মৃতিলেখার নাকি বিয়ে, হঠাৎ ঠিক হয়েছে। শীর্ষর এর থেকে বেশী কিছু আর জানতে ইচ্ছে হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস শুধু ওর বুক নিঙড়ে বেরিয়ে এসেছে। আর মনে পড়েছে, ঠিক ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা, বেশ কয়েকমাস পিছিয়ে গেছে পরীক্ষা, যথেষ্ট সময় নষ্টই হয়েছে... আর নয়। এবার অন্য কোনোদিকে মন নয় আর, দাঁড়াতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে, তার নিজের পরিবারকে সাপোর্ট করতে হবে। বাবার বয়স হয়েছে, বাবা মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। পরিবারের প্রয়োজনগুলোও চোখে আঙুল দিয়ে আরেকবার দেখিয়ে দিলো শীর্ষকে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য।

******

শীর্ষ সেদিন বহরমপুর কোর্টের এজলাসে বসে, এই কোর্টের বিচারক (জজ) হিসেবে সে দিনদুয়েক হলো জয়েন করেছে সবে। সবার সাথে এখনো চেনা পরিচয় পর্বই শেষ হয়নি। এলএলবি পাশ করার পরের দু'বছর হাওড়া কোর্টের প্র্যাকটিস আর পাশাপাশি আপ্রাণ খেটে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিসিয়াল

সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে জজ মানে বিচারকের চাকরিটা পায় শীর্ষ। তারপর ট্রেনিং শেষে একোর্ট ওকোর্ট ঘুরে ঘুরে বদলি হয়ে হয়ে প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে চল্লিশ প্রায় ছুঁইছুঁই বয়সে এই কোর্টে... মানে বহরমপুরে এসেছে। একলা মানুষ শীর্ষ, কাজের লোকজনের সহায়তায় বহরমপুরে সরকারি কোয়ার্টারেই থাকে।

বসে বসে একমনে মামলা শুনছে বিচারক শীর্ষ বসুমল্লিক। চোখ একবার টেবিলে রাখা কাগজে আর একবার সামনে সওয়াল করতে থাকা উভয় পক্ষের উকিলদের দিকে। একটি মামলা চলাকালীন কোর্টরুমের শেষপ্রান্তে দাঁড়ানো এক মহিলা উকিলের দিকে চোখ আটকালো শীর্ষর। এখানে স্মৃতিলেখা? ধন্ধে পড়লো শীর্ষ, এই ভদ্রমহিলার তো সিঁথি ফাঁকা, কপালও ফাঁকা! রিমলেস চশমার পেছনে দীঘির মতো ঐ গভীর দুই চোখ, শীর্ষ অপলক তাকিয়ে থাকতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না তো? চোখ সরিয়ে নিয়েছে শীর্ষ, বিচারক সে, সবকিছু তাকে মানায় না। নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিলো, মানুষে মানুষে এমনি অবিকল মিল তো অনেক সময় হয়, বিজ্ঞানসিদ্ধ বিষয়। কোনো একটা মামলার নিষ্পত্তি করে রায় দেবার সময় এ বিষয়ে খুব বিশদে পড়াশোনা করেছিলো শীর্ষ... দেশ বিদেশের সব বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী। চোখ সরিয়ে শীর্ষ ভাবলো, "আপাতত কাজে মন দেওয়া যাক।"

একের পর এক মামলা উঠছে, সেদিনের শেষ মামলা, বিবাদী পক্ষের উকিল স্মৃতিলেখা মিত্র। হ্যাঁ, একদম ঠিকই শুনেছে, দেখেও নিয়েছে। স্মৃতিলেখা মিত্র, বয়সও ত্রিশের কোঠার শেষ ধাপের দিকেই হবে... কপালের সামনের চুলে সামান্য রূপোলি রেখা। অতীত আর অনুমান এক সরলরেখায়। বিয়ের পরেও পদবী পাল্টায়নি, সিঁদুরও নেই সিঁথিতে, হাত খালি, বাঁ কব্জিতে বাঁধা শুধু রিস্টওয়াচ। অত্যাধুনিকা! নাকের ওপরে ঝুলে থাকা চশমাটা বাঁহাতে সামান্য ঠেলে ওপরে তুলে তখন, "অ্যান্ড দ্যাটস্ অল, মাই লর্ড", বলে সওয়াল শেষ করেছে উকিল স্মৃতিলেখা মিত্র। তখনও বিচারক শীর্ষ বসুমল্লিকের কানে সেই কবেকার হারিয়ে যাওয়া একটা ঝর্ণা টুঙটাঙ টুঙটাঙ করে জলতরঙ্গ বাজিয়েই চলেছে, বাজিয়েই চলেছে, বাজিয়েই চলেছে। হতচ্ছাড়ির থামারই নাম নেই!

সেদিন এজলাসের শেষে কোর্টের অন্যান্য সব বিচারকদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক পরিচয় এবং আলাপচারিতা পর্ব। তখন চা-পানের মাঝেই উঠে এলো বহরমপুর কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন ও প্র্যাকটিসিং ল'ইয়ারদের প্রসঙ্গ। দুঁদে উকিলদের একটা তালিকা মুখে মুখেই জানা হয়ে গেলো শীর্ষর। বেশ লম্বা তালিকা, এবং সে তালিকায় যথেষ্ট উপরের দিকে স্মৃতিলেখা মিত্রের নাম। ভব্যতাবশে শীর্ষ আর আলাদা করে কারুর কাছে কিছু জানতে চায়নি। পরের দিনও বিচারক শীর্ষ বসুমল্লিকের কোর্টরুমে আবার অন্য এক মামলা নিয়ে হাজির ছিলো ল'ইয়ার স্মৃতিলেখা মিত্র।

মাঝে দু-চারদিন বাদে প্রায় রোজই শীর্ষর কোর্টরুমেই স্মৃতিলেখার কোনো না কোনো মামলা থাকছে। শীর্ষ দেখে আড়চোখে স্মৃতিলেখাকে, আপাদমস্তক। তারপর ঠিক মাথার মাঝ বরাবর স্মৃতিলেখার শূন্য সাদা সিঁথিতে এসে শীর্ষর দৃষ্টিটা থমকে দাঁড়ায়। তবে ব্যাস্, ঐ পর্যন্তই! কেন জানি না শীর্ষ বিন্দুমাত্রও কৌতূহল কোনোস্তরে কারুর কাছে দেখাতে চায় না। তা বিচারকসুলভ নিস্পৃহতা, সৌজন্যমূলক শোভনীয় শালীনতা, অথবা প্রেমিকসুলভ দুস্তর মরুভূমির মতো মরুদ্যানবিহীন অভিমানও হতে পারে।

কোর্ট থেকে ফিরে রোজকার মতোই হাতমুখ ধুয়ে, বিশ্রাম নিয়ে সোফায় পা তুলে বসে গরম চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়েই, সেদিনও উত্তরপাড়ার বাড়ীতে মা'কে ফোন করেছে শীর্ষ। মামুলি কথাবার্তা খানিকক্ষণ চললো প্রতিদিনের মতোই। রোজই ভাবে মা'কে বলবে কথাটা শীর্ষ... যে এখানকার কোর্টে স্মৃতিলেখার সাথে দেখা হয়েছে। তবে দেখা হয়েছে বলাটা ভুল। চোখের দেখাইতো কেবলমাত্র হয়েছে, কোনো বাক্যবিনিময় হয়নি আজ অবধি, ঐ কোর্টের বাঁধাবুলির বাইরে। তবুও কিছুতেই শীর্ষ এই কথাটুকুও বলে উঠতে পারছে না। মায়ের সাথে কথার মাঝখানেই কলিংবেল বেজেছে। মা'কে বলে ফোনটা রাখলো শীর্ষ। এই অসময়ে, কোয়ার্টারে কে আসতে পারে দেখা করতে? শীর্ষ ভাবলো প্রতিবেশী কেউ হয়তো নতুন বলে দেখা করতে এসেছেন অথবা অন্য কোনো কোয়ার্টার থেকে কেউ কোনো বিশেষ প্রয়োজনেই হয়তো এসেছেন। সাহেবলাল... শীর্ষর আর্দালি... খুলতে গেছে দরজা।

শীর্ষ সোফা থেকে পা নামিয়ে বসেছে। বাইরের লোকের সামনে ওভাবে বসাটা ঠিক মানায় না। ব্যাচেলর মানুষ, লোকলৌকিকতা তেমন বোঝে না। সাহেবলালই থাকে সর্বক্ষণ। ওইই দেখে সব, শীর্ষর ঘর-গেরস্থালি, সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। সকালে এসে গোবিন্দর মা ওদের দু'বেলার রান্নাবান্না সব গুছিয়ে করে রেখে যায়। বাদবাকী যথাসর্বস্ব সামলানোর দায়িত্বই সাহেবলালের কাঁধে।

সাহেবলালকে অনুসরণ করে যে এসে বসার ঘরে ঢুকলো, তাকে এই অসময়ে ব্যক্তিগত পরিসরে এই কোয়ার্টারে দেখতে পাওয়ার কোনো প্রত্যাশাও কস্মিনকালেও কখনোই শীর্ষর... মানে বিচারক শীর্ষ বসুমল্লিকের মনের কোনো কোণেই ছিলো না। তবুও এই অনভিপ্রেত ঘটনাটি আজ ঘটেই গেলো। জেলা কোর্টের ডাকসাইটে উকিল স্মৃতিলেখা মিত্র হাজির, ইউনিফর্ম ছাড়া। এখনো পরনে সেই আগের মতোই আধুনিক কেতাদুরস্ত পোশাক আশাক। শীর্ষ কেমন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সাহেবলাল দু'জনকে জরিপ করে কী বুঝলো কে জানে... বেশ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। বোধহয় মিষ্টি-টিষ্টি কিছু আনতে গেলো। বুঝেছে হয়তো স্যারের সম্মানীয় অতিথি।

নীরবতা ভাঙলো স্মৃতিলেখাই, "বসতেও বলবি না? ওহো, সরি সরি, বসতেও বলবেন না?" গুরুগম্ভীর বলে কুখ্যাতি সুখ্যাতি দুইই অর্জন করেছে বিচারক শীর্ষ বসুমল্লিক... সেই কিনা সেই গমগমে গলায় হোহো করে হেসে ফেললো, স্মৃতিলেখার বলার ঢঙে, সেই আগের মতো একইরকম আছে এখনো।

এবার শীর্ষ বললো, "একা এলি? বর আর ফ্যামিলি

নিয়েই আসতে পারতি, পরিচয় হতো বেশ সবার সাথে।" "কার বরকে কোত্থেকে ধরে আনবো বল দেখি? শেষে বরধরা উকিল বলে মারধোর খেয়ে লকআপে ঢুকি আরকি? তাই চাস নাকি বলতো?" সেই খিলখিল করে হাসতে হাসতেই বললো স্মৃতিলেখা। ঠিক আগের মতোই আছে, অমনি চঞ্চল উচ্ছলতা আর অকপট গাম্ভীর্যের পরিশীলিত সংমিশ্রণ। শীর্ষর মনে হলো হঠাৎ, বয়স বাড়া ছাড়া ওদের আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি বোধহয়।

সাহেবলাল অনেক আয়োজন করে ফেলেছে। ধোঁয়া ওড়া সুগন্ধি চা তো আছেই, সাথে মিষ্টি, ফিসফ্রাই, চিকেন পকোড়া। স্যারের অতিথি বলে কথা... এই প্রথমবার কেউ এলো এখানে স্যারের বাড়ীতে অতিথি হয়ে, এটুকু না করলে কি স্যারের মান থাকে? গল্পগুজবে সময় পেরোচ্ছে। খুব ভালো লাগছে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই শীর্ষর। বেশ কেমন একটা শিহরণ সর্বাঙ্গে... সেই কলেজবেলার মতো। সত্যিই, স্মৃতিলেখার বিয়ে একথা শুনেই এতো মুষড়ে পড়েছিলো শীর্ষ, যে আর স্মৃতিলেখার সঙ্গে কোনো যোগাযোগের চেষ্টাই করেনি। এমনকি অন্যান্য বন্ধু বা ক্লাসমেটদেরও সযত্নে এড়িয়েই চলেছে। তারপর স্মৃতিলেখার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার জগদ্দল পাহাড়প্রমাণ তাগিদে নিজের আগের ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত পাল্টে ফেলে নতুন নাম্বার নিয়েছিলো। স্মৃতিলেখা তখন শীর্ষর কাছে পরস্ত্রী, তার কথা ভাবতেও নেই। আর বরং নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিজের মধ্যেই বয়ে বেড়িয়েছে এতোদিন ধরে বুকচাপা দুঃখটা। দুঃখটা ভুলতেই হয়তো কেবল কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে চেয়েছে শীর্ষ। তবে কিছুতেই স্মৃতিলেখার স্মৃতি ভুলতেই পারেনি। তাই এতোবছর ধরে শীর্ষর আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। মা অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু শীর্ষ কিছুতেই রাজী হয়নি বিয়ে করতে। তবে এও কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি, যে অলক্ষ্য থেকে কেউ একজন সময়চক্র ঘুরিয়ে, ঠিক আবার শীর্ষকে স্মৃতিলেখার সামনাসামনি করিয়ে দেবে। ফোন নাম্বার পাল্টালেই তো আর মনটা পাল্টানো যায় না!

স্মৃতিলেখার বিয়ের ঠিক হয়েছিলো ঠিকই, তবে সেই পাত্রের সাথে স্মৃতিলেখা একদিন একলা গিয়ে দেখা করেছিলো, আর বলেছিলো, মানে রীতিমতো শাসিয়েছিলো, "বেকার ঝামেলায় পড়ে যাবেন। কেন খামোখা দুই উকিলের প্রেমের কাবাবের মাঝে হাড্ডি হয়ে ঢুকতে চাইছেন? শেষে নিজের পৈতৃক দুশো ছয়টি হাড্ডি ভেঙে ছয়শো আঠেরোটি টুকরো হয়ে যেতে দেবেন? ভালো হবে কী সেটা? জানেন তো, আমি আবার ইউনিভার্সিটির হকি টিমের ক্যাপ্টেন। বেশ ভালোই হকিস্টিক চালাতে জানি কিন্তু! কাজেই একটু বুঝেশুনে এগোবেন ভাই।" আর শাসিয়ে এসে ফেরার পথে নিজেই ঠ্যাং ভেঙে মাল্টিপল ফ্র্যাকচার নিয়ে স্মৃতিলেখা পড়ে রইলো তিনটি মাস টানা হাসপাতালের বিছানায়। তখন শীর্ষও তো কোনো খোঁজখবর নেয়নি স্মৃতিলেখার! শীর্ষ বুঝলো, ওও... তারমানে আসলে স্মৃতিলেখাও অপেক্ষা করেই ছিলো, হয়তো আশা করেছিলো, শীর্ষই আবার এগিয়ে আসবে, তার অভিমান ভাঙাবে, সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে সেই কলেজবেলার মতো। চারটি চোখের অনাবিল হাসি ভেঙে পড়েছে তীরভাঙা ঢেউ হয়ে শীর্ষর কোয়ার্টারে। শীর্ষ আর স্মৃতিলেখার হাসিতে যোগ দিয়েছে সাহেবলালও, অবশ্য বিন্দুমাত্রও কিছু না বুঝেই।

"রাত হয়েছে, বিদায় নিতে হবে এবার," স্মৃতিলেখা বললো। শীর্ষ বলতে যাচ্ছিলো, "এভাবে বাড়ীতে দেখা করাটা বোধহয়...." স্মৃতিলেখা কেড়ে নিলো শীর্ষর মুখের কথা। "এভাবে একজন বিচারকের বাড়ীতে দেখা করতে আসাটা প্রোটোকলের বাইরে, তবু আজ আমি এলাম এইজন্য", বলে ব্যাগের ভেতর থেকে টেনে বার করলো একটা বেশ বড়ো মাপের লম্বা ব্রাউন পেপারের খাম। আর খামটা এগিয়ে দিলো শীর্ষর দিকে। শীর্ষ চোখে একরাশ কৌতূহল মেখে খামের ভেতরের কাগজটা বার করে পড়তে শুরু করেছে, শীর্ষর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে স্মৃতিলেখা। শীর্ষর মুখের প্রতিটি রেখার পরিবর্তন, মুখের ওপর খেলে যাওয়া আলোছায়ার খেলা খুব মন দিয়ে দেখছে স্মৃতিলেখা।

খামের ভেতরকার কাগজটা পড়া শেষ করে শীর্ষ স্মৃতিলেখার মুখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। দু'জনের চোখের ভাষাই তো দু'জনের খুব চেনা, এখন দু'জনেই একটা দীর্ঘ আলিঙ্গন চাইছে, এতোদিনের তৃষিত থাকার অবসান ঘটাতে। কিন্তু সেটি আর হলো কোথায়? সামনে সাহেবলাল আছে যে। ঐ চোখে চোখেই যেটুকু সম্ভব... আরকি! স্মৃতিলেখা পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি হায়ার জুডিসিয়াল সার্ভিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে, বিচারক পদে। দশবছর চাকরি করে শীর্ষ যেখানে পৌঁছেছে, প্রায় তার সমমর্যাদায়। বড়ো আনন্দের দিন আজ। শুধু একটাই সমস্যা, ওর জামাইবাবুর অকালমৃত্যুর পরে আজ প্রায় বছর আট-নয় ধরে স্মৃতিলেখা দিদির কাছে বহরমপুরেই আছে। দিদি এখানটা ছেড়ে যেতেও পারবে না, ওদের বিরাট ব্যবসাপত্র সমস্ত এখানেই। শীর্ষ আশ্বস্ত করলো, "আমি যতদিন থাকবো, ততদিন দিদির খেয়াল রাখবো। তারপর আমি ট্রান্সফার হয়ে গেলে, তখন ভেবেচিন্তে ঠিক একটা রাস্তা বার করা যাবে।"

******

এর মাসকয়েক পরে ফেলো জজেরা (বিচারকেরা), দু'জনের কলেজের বন্ধুবান্ধবেরা সবাই শীর্ষ ও স্মৃতিলেখা... দু'জনের তরফ থেকে একটা অভিনব নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলো। তাতে লেখা ছিলো,

"প্রিয় বন্ধুসকল,

দু'জন বিচারক একই এজলাসে ঢুকতে চলেছে আগামী সতেরোই ফেব্রুয়ারি। দৃশ্যটি দেখতে আসার আমন্ত্রণ সকলকে। তবে তাদের দু'জনের মাঝখানে অনাবশ্যক ঢুকে পড়লে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের। দু'জন বিচারক শুধুমাত্র পেট পুরে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব বহনে অপারগ। পত্রদ্বারা এই বিশেষ সতর্কীকরণের অপরাধ গ্রহণ করবেন না। তবে এই সমারোহে অনুপস্থিত থাকলে অবশ্যই বিচারকদ্বয়কে অবমাননার দায়ে নিমন্ত্রিতদের জোরপূর্বক তুলে আনার ব্যবস্থা করা হবে নিশ্চিতরূপেই।

ধন্যবাদ ও নমস্কারান্তে,

শীর্ষ বসুমল্লিক এবং স্মৃতিলেখা মিত্র।"

পরিশিষ্ট: উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতির হার শতকরা একশো শতাংশ ছিলো। দুই পরিবারের মেলাই আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুরা, কেউই কোনো ঝুঁকি নেয়নি... সেই অসমাপ্ত প্রেমের পূর্ণতাপ্রাপ্তির সাক্ষী হতে। তারা নবদম্পতিকে একেবারে থাইল্যান্ডগামী বিমানে তুলে দিয়ে মধুচন্দ্রিমায় পাঠিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হয়েছে। উপহার হিসেবে ডজনখানেক হকিস্টিক দিয়েছে দু'জনের ব্যাচমেটরা, একটা "স্মৃতিলেখা ওয়েডস্ শীর্ষ" লেখা পেল্লায় সাইজের রঙীন বাক্সে পুরে। যাক বাবা, অবশেষে অসমাপ্তের সমাপ্তি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy